#প্রনয়ের_দহন
#Nusrat_Jahan_Bristy
#পর্ব_৪২
তীর লাগাতার কল দিয়ে যাচ্ছে ইশানকে। কিন্তু ইশান বার বার কল কেটে দিচ্ছে তাতে যেন তীরের মেজাজটা আরো বিগড়ে যাচ্ছে। লোকটা কি এমন রাজকার্য করছে যে একটু কলটা ধরতে পারছে না। কিন্তু শেষমেষ ইশান নিজের ফোনটা বন্ধ করে দিলো। ইশানের ফোন বন্ধ পেয়ে তীর ধপ করে বেডে বসে বলে।
–বন্ধ করে দিলো ফোনটা আমার কলটা ধরার প্রয়োজনবোধ করলো না। এতো ব্যস্ত এতো ব্যস্ত যে একটা বারও কলটা ধরে আমার কথা শুনার সময়টুকু নেই ওনার।
তীরের মনটা বিষন্নতায় ভরে গেলো। কিচ্ছু ভালো লাগছে না কি করবে না করবে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। ইশাকেও ফোন দিয়েছে কিন্তু ইশার ফোন বন্ধ। তীর রে’গে বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে।
–বিয়ে করে নিবো আমি লাগবে ওনাকে আমার। ওনি ওনার কাজ নিয়ে পড়ে থাকুক। যখন আমার বিয়ে হয়ে যাবে তখন ওনি বুঝবে।
এমন সময় আয়েশা সুলতানা মেয়ের রুমে এসে মেয়েকে এখনো তৈরি হতে না দেখে বলে।
–তীর তুই এখনো রেডি হোস নি।
তীর নিচের ঠোঁট কিছুক্ষণ কাঁমড়ে ধরে বলে।
–তুমি কি আমার বিয়ে দিয়ে দিবে মা।
মেয়ের কথা শুনে আয়েশা সুলতানা মেয়ের পাশে বসে মেয়ের মাথা হাত বুলাতে বুলাতে বলে।
–মেয়ে কূলে জন্ম নিয়েছিস মা এক দিন না এক দিন তো বিয়ে দিতেই হবে। তোকে সারা জীবন তো আর নিজের কাছে রাখতে পারবো না। তাই তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিচে আয় তোকে এক নজর দেখার জন্য তোর মালিহা আন্টি অপেক্ষা করছে।
–কিন্তু মা আমি এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চাই না।
আয়েশা সুলতানা দু ভ্রু-কুচকে বলেন।
–কেন?
–আমার পড়া এখনো শেষ হয় নি মা। সবে ইন্টার দিয়েছি।
–বিয়ের পরেও পড়াশোনা করা যায়। তাই চুপচাপ যেটা বলছি সেটা করো। কোনো রকম সমস্যা সৃষ্টি করবে না।
আয়েশা সুলতানা কথাটা বলেই চলে যান। তীর তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে রেডি হতে চলে যায়। মা যখন চাইছে তাহলে তাকে এটা করতেই হবে। তার কিচ্ছু করার নেই।
_______
একটু আগেই তীরকে ছেলের বাড়ির লোকেরা পছন্দ করে রেখে গেছে আর এটাও বলে গেছেন খুব তাড়াতাড়ি তীরকে নিজেদের ঘরের বউ করে নিয়ে যেতে চায়। ছেলে লন্ডনে থাকে আর বিয়ের পরে তীরকে নিয়েও লন্ডনে চলে যাবে। ওখানে সেটেল হয়ে যাবে তীরকে নিয়ে আর তীর পড়াশোনা ওখানে থেকেই করবে। তীর যখন এই কথাটা শুনতে পায় তখন তীরের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। তার আগোচরে এতো কিছু ঘটে গেছে আর সে টেরও পায় নি। এই বিয়েতে বাড়ির সবাই রাজি শুধু তীরের দাদু ছাড়া। কিন্তু তীরের মা তীরের দাদুকে একটা কথা বলে আটকে দিয়েছেন। তাই তীরের দাদুও বাধ্য হয়ে সবটা মেনে নিয়েছেন। তীর বিয়ে করবে না বলে চিৎকার চেঁচামেচি করেও কোনো লাভ হলো না আয়েশা সুলতানাকে মেয়েকে এদিকে বিয়ে দিয়েই ছাঁড়বে তার একটা কারণ ওনি নাকি আগে থেকেই তার বান্ধবী অভিলাকে কথা দিয়ে রেখেছেন তার ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিবেন।
তীরের পরিবারের সকল সদস্যরা ড্রয়িং রুমে বসে আছে শপলা বেগমেই সবাইকে ডেকে পাঠিয়েছেন কিছু বলার জন্য কিন্তু এসবের মাঝে তীর নেই। তীর মায়ের উপর রাগ করে দরজা বন্ধ করে কান্না করতে ব্যস্ত আছে। শাপলা বেগম আয়েশা সুলতানাকে উদ্দেশ্য করে বলেন।
–এই বিয়েতে আমার মত নেই বউমা। আমার নাতনি এখনো আইএ পাসেই করে নি আর তুমি তার বিয়ে দিতে উঠে পড়ে লেগেছো কেন?
–আম্মা বিয়ের পরেও কিন্তু পড়ালেখা করা যায়।
–কিন্তু ও এখনো ছোট।
–ও ছোট নেই আম্মা ও যথেষ্ট বড় হয়েছে। আর এই বিয়েটা আগেই থেকে ঠিক করা ছিলো সেটা আপনি জানেন আম্মা।
আজিজুল আহমেদ মায়ের পক্ষ নিয়ে বলেন।
–তুমি মেয়েটার দিকটা একটু চিন্তা করো ও এখন বিয়ে করতে চাইছে না।
–কেন বিয়ে করতে চাইছে না তোমার মেয়ে তার একটা কারণ বলুক আমাকে। আর আমার বান্ধবীর ছেলে যথেষ্ট ভদ্র একটা ছেলে এমন ছেলে প্রত্যেকটা মায়েই তার মেয়ের জন্য চায়। তাই আমি কোনো কারণ দেখতে পারছি না বিয়ে না করার তোমার মেয়ের।
–কিন্তু বউ মা।
–আম্মা আমি আর এই বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাই না। আমি আমার মেয়ের কোনটায় ভালোটা হবে সেটা আমি ভালো করেই জানি। তাই এই বিষয়ে আর কোনো কথা না হলে আমি খুব খুশি হবো। আর তীরকে বিয়েতে রাজি করানোর দায়িত্ব আমার আমি জানি আমার মেয়ে আমার কথা ফেলতে পারবে না।
শাপলা বেগম কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। ওনি যে তার নাতনির জন্য অন্য কিছু ভেবে রেখেছিলো কিন্তু ওনার সব ভাবনায় যে তার ছেলের বউ জল টেনে দিলো। শাপলা বেগম তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে বলেন।
–ঠিক আছে বউমা তোমার যা ভালো মনে হয় তাই করো আমি আর কিছু বলবো না। তবে আমার নাতনি যেন সুখী হয়।
বলেই ওনি চলে যান নিজের ঘরে। আজিজুল আহমেদ আর কি বলবেন ওনি এই বিয়ের ব্যাপরে আগে থেকেই জানেন আর স্ত্রীর সিদ্ধান্তে আগে থেকেই রাজি।
______
ইশান রাত সাড়ে সাতটার দিকে বাড়ি ফিরে অফিস থেকে। আজকে সারাটা দিন ইশান দৌঁড়ের উপরে ছিলো ইম্পরট্যান্ট একটা ডিল নিয়ে। যেই ডিলটা কোম্পানির জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিলো আর সেটাতে সাকসেসফুলও হয়েছে ইশান। এখন চিন্তা মুক্ত হয়ে বাড়িতে এসে ফ্রেস হয়ে নিচে নামতেই কিছু একটা শুনে থমকে যায় পা জোড়া আপনাআপনি। ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে ইশান নিজের কানকে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না। সারা রাজ্যে বিস্ময়, অবিশ্বাস তার সারা মুখশ্রীতে ফুটে উঠছে। কানে বেজে চলছে এখনো আয়েশা সুলতানার বলা কথাটা “তীরের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে”। তার তীরের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে তাও আবার অন্য একজনের সাথে। তীরের বিয়ে ঠিক হওয়ার কথাটা শুনে কিছু সময়ের জন্য যেন ইশানের দেহ থেকে রুহটাই উঁড়ে গেছে। বাড়িতে এসে যে এমন একটা খবর তাকে শুনতে হবে কল্পনাও করতে পারে নি। আশেপাশে কি হচ্ছে সেটার কোনো ধ্যান নেই ইশানের। কিন্ত পরক্ষণে নেহা বেগমের কথায় ধ্যান ভাঙ্গে ইশানের।
–কি বলছেন আপা তীরের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে মানে।
–আসলে আপা তীরের তো আগে থেকেই বিয়ে ঠিক করা ছিলো আমার বান্ধবীর ছেলের সাথে। ছেলে লন্ডনে থাকে আর কয়েকদিন পরেই দেশে আসবে। আর আজকে এসে তীরকে অভিলার পরিবারের সকলে দেখে গেছে তাদের পছন্দও হয়েছে তীরকে। আর ছেলে তো তীরের ছবি দেখে তীরকে ভীষণ পছন্দ করেছে।
এসব কথা ইশান যেন আর সহ্য করতে পারছে না। মাথায় মনে হচ্ছে আগুন ধরে যাচ্ছে। ইশান কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে আয়েশা সুলতানার উদ্দেশ্যে রা’গে বলে।
–আন্টি এসব কি বলছেন আপনি তীর এখনো একটা বাচ্চা মেয়ে আর আপনি এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন ওর।
হঠাৎ ইশানের মুখে এমন রা’গমিশ্রিত কথা শুনে আয়েশা সুলতানা অবাক হয়ে যান। তিনি ঠিক বুঝতে পারছে না ইশানের রে’গে যাওয়ার কারণটা কি? আয়েশা সুলতানা অবাক হয়ে বলেন।
–ইশান তুমি ঠিক আছো।
–এতক্ষণ ঠিকেই ছিলাম কিন্তু আপনার কথা শুনে নিজেকে ঠিক রাখতে পারছি না।
নেহা বেগমের বুঝতে আর বাকি নেই ছেলের রেগে যাওয়ার কারণ। কিন্তু এখন পরিস্থিতিকে সামাল দিতে হবে না হলে বড় কোনো অঘটন ঘটে যেতে পারে। নেহা বেগম সুযোগ বুঝে ইহানকে ইশারা করে বলেন ইশানকে এই মুহূর্তে এখান থেকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য। ভাগ্যিস ইহান আজকে বাড়িতে আছে এমন সময় না হলে একা নেহা বেগম সবটা একা সামলাতে পারতেন না। ইশান আরো কিছু বলতে নিবে তার আগে ইহান বলে উঠে।
–ইশান ভাই আমার! তোর সাথে আমার ইম্পর্টেন্ট কথা আছে তাড়াতাড়ি উপরে চল।
–ভাইয়া তোমার সাথে পরে কথা বলি আগে আমি…
–আগে তুই আমার কথাটা শুন।
বলেই ইশানের হাত ধরে টানতে টানতে উপরে নিয়ে যায়। আয়েশা সুলতানা হতভম্ব হয়ে দুই ভাইয়ের কান্ডকারখানা গুলো দেখে নেহা বেগমকে বলেন।
–ব্যাপারটা কি হলো ভাবি আমি তো কিছুও বুঝতে পারলাম না।
নেহা বেগম মেকি হাসি দিয়ে বলেন।
–বাদ দেন তো ভাবি ওরা দুই ভাই এমনেই।
–কিন্তু ইশান যে তীরের বিয়ের কথাটা শুনে হঠাৎ রে’গে গেলো বিষয়টা ঠিক বুঝতে পারলাম না।
— আসলে ও হঠাৎ করে তীরের বিয়ের কথাটা শুনছে তো তাই রে’গে গেছে। আপনি চা খাবেন তো দাঁড়ান আমি চা করে নিয়ে আসি।
কথাটা বলেই নেহা বেগম রান্না করে চলে যান। আর রেখে যান ভাবুক আয়েশা সুলতানাকে। আয়েশা সুলতানার কেমন জানি সন্দেহ হচ্ছে ইশানের এমন অদ্ভুত আচরণ দেখে তবে কি।
_____
ইহান ইশানকে ঘরে নিয়ে আসতেই ইশান বাজখাঁই স্বরে বলে।
–কি হচ্ছেটা কি ভাইয়া এসব? তুমি আমাকে ওখান থেকে এভাবে নিয়ে আসলে কেন?
–দেখ ইশান তোকে ওখান থেকে এখানে নিয়ে এসেছি তোর ভালোর জন্যই। আমরা জানি তুই তীরকে পছন্দ করিস কিন্তু।
ইশান অবাক চোখে ইহানের দিকে তাকাতেই ইহান বলে।
–এতো অবাক হওয়ার কিচ্ছু হয় নি তুই যে তীরকে পছন্দ করিস সেটা আমরা ভালো করেই জানি। কিন্তু আয়েশা আন্টি তো আর সেটা জানেন না আর তুই যদি এখন ওনার সামনে রা’গে কোনো রকম সিনক্রিয়েট করে ফেলিস তাহলে হিতে বিপরীত হতে পারে। কারণ তীরের বিয়ে আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছেন আয়েশা আন্টি। তাই যা করতে হবে ভেবে চিন্তে করতে হবে। যাতে সাপও মরে আর লাঠিও না ভাঙ্গে।
–কিন্তু ভাইয়া।
–দেখ ইশান বিয়ে ঠিক হলেই যে তীরের বিয়ে হয়ে যাবে এমন কোনো কথা নয়। আমরা সকলে মিলে আয়েশা আন্টিকে বুঝাবো। ওনাকে বুঝালে হয়তো ওনি বুঝবে তুই বরং তীরের সাথে কথা বল।
তীরের কথাটা ইশানের মাথা থেকে একদম বেরিয়ে গিয়েছিলো এত সবের মাঝ থেকে। মেয়েটা আজকে এতো গুলা কল করেছে তার মানে এটার জন্যই নিশ্চয়ই। কিন্তু ইশান মিটিংয়ে থাকার জন্য কল ধরতে পারে নি। ইহান ইশানকে চিন্তিত দেখে ইশানের কাঁধে হালকা চাপড় মেরে ঘর থেকে চলে যায়। ইহান চলে যেতেই ইশান তড়িঘড়ি করে তীরের নাম্বারে কল দেয়। কিন্তু রিং হয়ে কেটে যায়। ইশান ক্রমাগত কল দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু তীর কল ধরছে না। বরং এক পর্যায়ে তীরের ফোন বন্ধ আসে। ইশানের আর বুঝতে বাকি রইলো না তীর যে তার উপর ভীষণ ক্ষেপে আছে। কিন্তু মেয়েটা কল না ধরলে ইশান তীরের সাথে কথা বলবে কি করে? ইশানের এবার তীরের উপর ভীষণ রা’গ উঠছে সে না হয় ব্যস্ত ছিলো তার জন্য তীরের কল ধরতে পারে নি তা বলে এখন তার ফোনটা ধরবে না এতো জেদ এই পুচকে মেয়েটার।
#চলবে______