ফানাহ্ 🖤 #পর্বসংখ্যা_৪৬ (অন্তিমাংশ) #হুমাইরা_হাসান

0
799

#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৪৬ (অন্তিমাংশ)
#হুমাইরা_হাসান

একবার, দুবার, তিনবার শব্দটা হতেই বাজতেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলেন , আকস্মিক ভাবে ঘুম ভাঙায় চমকে উঠলো। শব্দের উৎপত্তি টা লক্ষ্য করে অন্ধকার হাতরেই ফোনটা হাতে নিলো। কলারের নম্বর টা দেখে ভ্রু কুঁচকে নিলো, ফোনের স্ক্রীনে বাঁ পাশটায় উপরে ছোট ছোট শব্দে কাট-কাট জানান দিচ্ছে সময়টা ঠিক বারোটা বেজে ছাপ্পান্ন মিনিট। এই অসময়ে নামহীন নম্বর থেকে ফোন আসার অর্ধ টা বোধগম্য না হলেও কিছু একটা আঁচ করতে পারলো যেনো, ধীরেসুস্থে সবুজ আলো জ্বলা জায়গাটাতে আঙুল ঘুরিয়ে কানের কাছে নিলেন। ছোট্ট করে ‘হু’ বলতেই ওপাশ থেকে গড়গড়িয়ে কতগুলো লাইন উগড়ে দিলো যেনো। মিনিট খানেক নিঃশব্দে কথাগুলো গলাধঃকরণ করলেও পরমুহূর্তেই গর্জে উঠলো, ভয়ংকর গম্ভীর গলায় শাসিয়ে বলল

– শু’য়োরের বাচ্চা! তোকে সামনে পেলে সপাটে চ’ড়াবো আগে শা’লা জোচ্চর। কোথায় পালিয়ে আছিস ইত’র, তোর জন্য কত ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে কোনো আন্দাজ আছে, কোটি টাকার মা’ল সাপ্লাই দিতে পারছি না। আর এখন নিশিতে ফোন দিয়ে তুই আমার কাছে টাকা চাচ্ছিস

বন্ধ ঘরের দেওয়ালে মিটমিটিয়ে বলা কথা গুলো ঝংকার তুললো। মুহুর্তেই ঘুম ছুটে গেলো কাকলির। অন্ধকারে হাত বাড়িয়ে পাশের স্থান টা ফাঁকা দেখে উঠে বসলেন, তন্মধ্যে আবারও খেঁকিয়ে উঠলো আরহাম মুর্তজা

– এসবের মানে কি, তোকে নিজের রাইট সাইড বানিয়ে খুব বড়ো ভুল করেছি মনে হচ্ছে। নিজে গা ঢাকা দেওয়ার নামে ডুবাতে চাচ্ছিস আমাদের? পালিয়ে বাঁচতে পারবি বলে মনে হয় তোর! মেহরাজ তোকে ইঁদুরের গর্ত থেকে হলেও এক থাবায় বের করে আনবে। তোর মতো চুনোপুঁটি লুকিয়ে বাঁচতে পারবি বলে মনে করিস? গতবার যে হাত দুটো মুঁচড়ে দিয়েছিলো ভুলে গেছিস! লজ্জা করেনি আবারও সেই হাত ওর জিনিসের দিকে বাড়াতে! এতো লোভ যখন পাড়ায় গেলি না ক্যান জা’নোয়ার!!

কাকলি বেগম শুকনো মুখেই আন্দাজ মতো হাত বাড়িয়ে রাখলেন স্বামীর ঘাড়ে, ইশারাবার্তা টুকু সতর্কবাণী হিসেবেই আমলে নিয়ে শান্ত করলো নিজেকে, দাঁতে দাঁত চেপে বলল

– কালকের মধ্যে আমার সামনে আই, না তো নেকড়ে টাকে আমি নিজে লেলিয়ে দেবো তোর পেছনে

প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করেই খট করে কল লাইনচ্যুত করলো, তিক্ত মেজাজে ফোনটা ছু’ড়ে ফেলে হাতের তালুতে কপাল টা ভর করে বসে রইলো, কাকলি বেগম স্বামী দুশ্চিন্তা, অশান্তির কারণটা পুরোপুরি না হলেও কিছুটা আঁচ করতে পারলো, ক্ষীণ স্বরে বলল

– এতটা উত্তেজিত হলে প্রেসার টা বাড়বে রাত করে। শান্ত হও

– কিভাবে শান্ত হবো কাকলি, বায়ার’রা ফোন দিয়ে দিয়ে অতিষ্ট করে ফেলেছে। এক তো ব্যবসা ডাউন হওয়ার কারণে সার্ভিস ভালো করে দিতে পারছি না, তার সাথে এই অজাত টা আরেক ঝামেলা বাঁধিয়ে বসে আছে। ওকে কে বলেছিলো মোহরের পেছনে লাগার, কান টানলে মাথা আসবে এ তো বাচ্চাও জানে। মোহরের দিকে হাত বাড়ালে সে হাত যে মেহরাজের মুঠোয় আঁটকাবে সেটা তো ও জানতো। একসাথে কত গুলো সাইড ব্লক হয়ে আছে ভাবতেও পারছো না। কোনো ভাবে ব্যালান্স হারালে সব ডুববে।

এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে দম ছাড়লো আরহাম মুর্তজা। কাকলি বিছানা থেকে নেমে লাইট জ্বালালো। সাইড টেবিল থেকে পানির গ্লাস টা তুলে আরহামের সামনে ধরলে বিনা বাক্যেই ঢকঢক করে গিলে নিলো পানি টুকু।

– ভাইজান এখনো চুপ করে আছে কেনো? শুনলাম ওয়াকিফ ভাই ও এখন উল্টো পথে ঘুরেছে, তিয়াসার সাথে হওয়া ঘটনার জন্য তোমাকে আর ভাইজানকে দোষারোপ করেছে?

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে গ্লাসটা নামিয়ে রাখলো। অস্থির গলাতেই আবারও বলল

– ভাইজানের ও এখন কিছু করার নেই। এসবের মাঝে একটা চিন্তা এখনো আমার মাথায় শূলের মতো আঁটকে আছে আর তা হলো পেনড্রাইভ টা। কাকলি ওটা কিন্তু আজও আমাদের হাতে আসেনি

– বছর পেরিয়ে গেলো। এখনো ওটা আছে? থাকলে এতদিনে একটা দামামা শুরু তো হতোই!

– নষ্ট হয়ে গেছে এমন খবর ও তো নেই। আসলে কাজটাই ভুল হয়েছে ইন্সপেক্টরের কাছ থেকে আগে পেনড্রাইভ টা হাতিয়ে তারপর ওর ব্যবস্থা করা উচিত ছিলো। ওটা যদি কোনো ভাবে কারো হাতে পরে যায় কোনো রেহাই নেই। এরকম একটা সেনসিটিভ নিউজ পেলে সাংবাদিক থেকে রাস্তার পাগল সবাই হাত ধুয়ে লেগে পড়বে পেছনে।

চিন্তার বিন্দু বিন্দু ঘামে এক এক করে কপালটা ভরে গেলো কাকলির। আসন্ন বিপদের আতঙ্কে জান শুকিয়ে যাচ্ছে। মনটা ও কেমন কু-গাইছে। সত্যিই কী সব শেষ হয়ে যাবে! সবটা খোলাসা হয়ে যাবে! অন্ধকার রাত্রিতে দুটো মানুষের মন দুর্বোধ্য দুশ্চিন্তায় কেঁপে উঠলো, না জানে আর কার কার মনে বাজছে এই আতঙ্কের বীণ।

.

ঘড়ির কাটা-টা যেনো নড়ছেই নাহ। ইদানীং সময় টাও একটু বেশিই গড়িমসি করেছে। পার-ই হতে চাইনা। দীর্ঘ রাতটা বেশিরভাগই নির্ঘুম কা’টে তাথইয়ের। কোনো অজানা চিন্তায় ডুব দিয়ে আকাশ পাতাল ভাবনায় বুদ হয়ে ভুলে যায় ইহজাগতিক সমস্ত চিন্তা ভাবনা।
এর মাঝেই বার কয়েক ফোন দেওয়ার চেষ্টা করেছিলো অরুণ। শেষবার যখন ফোন করেছিলো তখন ওর মা কথা বলেছিলো। তার বলা কথাটা ঠিক এমন ছিলো
” মানছি আমার ছেলেটা ভুল করেছে, তা তোমরাও তো চুপ করে থাকোনি? কেস করেছো, ডিভোর্স ফাইল ও করেছো এর মাঝে আমার ছেলেটাকে মা’র খাওয়ালে কেনো! ও তো আর তোমাদের জ্বালাতে যায়নি। ছেলেটার আমার হাত,পা কি বিশ্রী ভাবে যখ’ম করেছে। ও তো এখনো তোমার স্বামী-ই আছে। এতগুলো দিন সংসার করে কি এতটুকুও মায়া হয়নি তোমার ”
এটুকু বলেই দমে যায়নি। ভালো মন্দ কত রকম দোষারোপ করেছে মহিলা তাথইয়ের ওপর। অবশ্য ও কোনো রকম অভিব্যক্তি দেখায় নি। অবাক হয় ও মাঝে মধ্যে এই ভেবে যে শুধুমাত্র নিজের আপনজন বলে হয়তো মানুষ খু’নিকে নিয়েও সাফাই গাইবে এখন। অরুণের বাবা বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলো পরিবার সাথে,পারেনি। অগত্যা দমে গেছে।
থমকে গেছে সব৷ তাথইয়ের জীবন, অনুভূতি সব থমকে গেছে। এতসব নিষ্ক্রিয়তার মাঝেও মনের কোনো এক কোণের ছোট্ট জায়গা জুড়ে একটা মানুষের উপস্তিতি’টা কিন্তু এক মুহুর্তের জন্যেও ভুলতে পারেনা ও।

এসব ভাবতে ভাবতেই হাতের মুঠোয় আগলে রাখার অর্ধমৃত ফুলগুলো নাকে চেপে নিলো। পৃথকের চেহারা ওর কণ্ঠস্বর ওর হাসিটা যেনো বিদ্যুতের ন্যায় ছড়িয়ে পড়লো সমস্ত দেহে। পৃথক ওর কথা রেখেছে, সেদিনের পর থেকে আর আসেনি তাথইয়ের সামনে, আর নাইবা যোগাযোগ করার ক্ষীণ চেষ্টা অব্দি করেছে। কিন্তু এখন যেনো তাথইয়ের আর সহ্য হয়না। কারণে অকারণে মানুষটাকে দেখতে ইচ্ছে করে, পুরোনো আবেগ অনুভূতি গুলো সুচের মতো বুকটা ঝাঁঝরা করে ফেলে।
ফোনটা হাতে নিলো, বহুক্ষণ দ্বিধাদ্বন্দে বুদ হয়ে অবশেষে সংযোম চুরমার করে কলটা করেই বসলো, কয়েকবার রিং হয়ে কে’টে গেলেও রিসিভড হলো নাহ। তাথইয়ের সংযমচ্যুত সত্তা ওকে যে ধৈর্য ধরতে দিলো না, অবিলম্বেই আবারও কল করলো, এবার তিনবার বাজতেই রিসিভ হলো। খানিকটা আড়ষ্টতা নিয়ে তাথই হ্যালো বলবে তার আগেই ওপাশ থেকে ভীষণ ক্ষীণ, দুর্বল গলায় জবাব আসলো

– রাজীব তোমাকে বলেছিই তো শরীর টা খুব খারাপ। আপাতত কোনো কেসেই হাত দেবো নাহ। কথা বলার শক্তি নেই, বিরক্ত করিও না। পারলে কাল সকালে ডাক্তার নিয়ে এসো

বলে সাথে সাথে কল কাট করে দিলো। তাথই বিচলিত চিত্তে আবারও ফোন লাগালো তবে এবার অপরপক্ষ হতে এলো একটা মেয়ের যান্ত্রিক জবাব
‘ The number you are trying to call is currently unreachable ‘

__________________________

এক বুক দুরুদুরু কম্পনের অতিষ্টতা নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মোহর। এ কাকে দেখছে সে! এই চেহারা,এই শরীর, এই মানবী কি আদও ও নিজে! নাহহ, বুকের ভেতরের অবুঝ যন্ত্রটার ধুকপুকানি টা আজ অন্যরকম আস্বাদন দিচ্ছে, একটা মানুষের বাচ্চাদের মতো আবদারের খোরাক মেটাতে এই যে মধ্যরাত্রির ও পরে শাড়ি পড়েছে। সত্যিই হলুদ রঙের শাড়িটা জড়িয়েছে শরীরে, তবে যার আবদার মেটাতে পড়েছিলো তার সামনে যাওয়ার কথা ভাবতেও প্রাণে-প্রাণে, হৃদয়ে-হৃদয়ে চাঞ্চল্যতা ছড়িয়ে দিচ্ছে।

অপরদিকে মেহরাজ দাঁড়িয়ে বারান্দায়, এই নিশিতে আকাশটা অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে। ঋতু বদলের পালায় আকাশটা যেনো অভিমানে গুমোট রূপ ধরেছে৷ ক্ষণে ক্ষণে ধরণী কাঁপিয়ে, আলোর ফুলকি তুলে গর্জে উঠে বিদ্যুতের চমকানি। মেঘের গর্জনের ঝংকার তোলা বিকট শব্দেও একটা খুব ক্ষীণ শব্দটা মেহরাজের কানে আসতে ভুল হলো নাহ। শুষ্ক অধরখানা সামান্য চওড়া হলো। সেই ঠোঁটের তৃপ্তির শ্বাস টুকু হয়তো আগত রমণীর চোখে বিঁধলো নাহ, কিন্তু শীতল পরিবেশটার চেয়েও হীম একটা কণ্ঠ ঠিকই ওর কান হতে মস্তিষ্কে পৌঁছালো

– এসেছেন মোহ?

ছোট্ট শব্দের সম্বোধন টা যেনো আজ অন্যরকম দোলা লাগিয়ে দিলো শরীরে। গুটি গুটি পা ফেলে আরেকটু এগিয়ে এলো, পাশাপাশি রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল

– আমিতো একটু শব্দও করিনি, আর করলেও এমন বজ্রপাতের শব্দেও কি করে বুঝলেন আমি এসেছি?

মেহরাজ তৎক্ষনাৎ জবাব দিলো নাহ। পাশ ফিরে তাকালো স্নিগ্ধ একটা মানবীর দিকে । মায়াময় সে মুখ,মোহভরা সেই রূপ। আবছা আলোতেও যেনো রূপকথার গল্পের মতো রাঙিয়ে উঠলো পরিবেশটা। মধ্যবর্তী দূরত্ব ঘুচিয়ে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো একদম মোহরের কাছাকাছি, পকেটে গুজে রাখা হাতটা বের করলো না,সটান দাঁড়িয়ে রুদ্ধের সেই ভরাট গলাটায় মুগ্ধতা মিশিয়ে বলল

– বজ্রপাতের শব্দ তো বড়জোর শ্রবণযন্ত্র ভেদ করে, আপনার পদধ্বনি তো আমার হৃদয় পর্যন্ত ছুঁয়ে দেয়, এফোড় ওফোড় করে দেয়।

লজ্জাবিষ্ট আবেশে মাথা নুইয়ে নিলো মোহর। আজ যেনো মেহরাজের কথাগুলো একটু বেশিই ভালো লাগছে শুনতে। হীম হাওয়া টা আরও জোরসে বইতে লাগলো, পাতলা ফিনফিনে শাড়িটা বাতাসের দাপটে মিশে যাচ্ছে শরীরের সাথে। মোহর পরিস্থিতি সামাল দিতে অন্যমনস্ক হয়ে বলল

– এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো!

মেহরাজ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল

– বৃষ্টি হবে, কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝুম বৃষ্টি নামবে।

মোহর ও একইসাথে তাকালো। ঝড়ো হাওয়া আর মেঘের চমকানিতে বৃষ্টির আগমনবার্তা স্পষ্ট। মোহর আবারও জিগ্যেস করলো

– এতো রাতে শাড়ি কেনো পড়তে বললেন আপনি?

কণ্ঠে কৌতূহলের চেয়েও জড়তা বেশি প্রকাশ পেলো। মেহরাজ মুচকে হেসে বলল

– রাত হোক আর দিন। আমিই তো দেখবো। আমার যে এখন আপনাকে দেখতে ইচ্ছে করেছে তাই

মোহর প্রত্যুত্তর করার জন্য কোনো শব্দ খুঁজে পাচ্ছে নাহ। মিনিট খানেকের মধ্যেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ছুঁয়ে দিতে থাকে চোখ মুখ। নিস্তব্ধতা ভেদ করে বৃষ্টির গাঢ় হওয়ার শব্দ। শীতল আমেজে কা’টা লাগিয়ে দিচ্ছে। মেহরাজ পা দুই পিছিয়ে মোহরের পেছনে এসে দাঁড়ালো। দু’হাতের নিচ দিয়ে কোমর জড়িয়ে ঘাড়ে থুতনি চাপিয়ে দিলো, নরম শরীরটার মিষ্টি ঘ্রাণে নাক ডুবিয়ে নিঃশব্দে অতিবাহিত করলো কতগুলো মুহুর্ত,ক্ষণ। জড়ত্ব ভর করা মোহরের অর্ধভেজা শরীর টা সমস্ত ভার ছেড়ে দিলো, মেহরাজের বুকে পিঠ এলিয়ে দিয়ে হেলান দিলো। মেহরাজ কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল

– মোহ! ভালোবাসেন?

স্তব্ধরূপে ঠাঁই পড়ে রইলো মোহর প্রসস্থ বুকটার মাঝে। চোখে,ঠোঁটে ব্যকুলতা অস্থিরতা ছড়িয়ে গেলো। এর উত্তর কি করে দেবে,কিভাবে দেবে! ‘মোহ ভালোবাসেন’ নামক দুটো শব্দের এই প্রশ্নের উত্তরে কি জবাব দেওয়া যায়! আজ যেনো মন,শরীর আর সামলাতে পারে না।নিজের উষ্ণ,পরিস্ফুটিত মনের উদ্বেলনের সাঁই দিয়ে অস্ফুটস্বরে বলল

– বাসি

দু’হাতের বেরিবাঁধ আরও দৃঢ় হলো, কানের কাছ থেকে মুখের অবস্থান পরিবর্তন করে ঘাড়ের কাছে নিয়ে মেহরাজ ভীষণ রকম শাণিত গলায় আবারও বলল

– ভালোবাসেন মোহ!

– বাসি, ভালোবাসি!

যন্ত্রমানবীর মতো তৎক্ষনাৎ জবাব দিলো মোহর। কি বলল,কিভাবে বলল তা ওর মস্তিষ্ক ঠাওর করতে পারলো নাহ। এই নিগূঢ় নীরবতায়, বৈরী আবহাওয়ার বর্ষণে শুধু একটা নামই ওর মস্তিষ্কে ঘিরে রইলো আর তা হলো মেহরাজ।
মেহরাজ বিভোর হলো, মাতোয়ারা হলো। স্নিগ্ধ মানবীর মোহনীয়তায় ডুব দিয়ে সিক্ত করলো সমস্ত মন-মস্তিষ্ক। মৃদু হেসে বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিলো। মোহরকে বুক থেকে তুলে নিজের সামনাসামনি ঘুরিয়ে থুতনিতে হাত রাখলো, কোমল দৃষ্টিটা মোহরের সমস্ত আননে ছড়িয়ে মোলায়েম গলায় বলল

– মোহ নামক মায়াতে ডুবে বিভোর হয়েছি। একজনের সুমিষ্ট ঘ্রাণভরা মায়াতে আবিষ্ট হয়ে মাতোয়ারা হয়েছি। নরম ওষ্ঠের ভাঁজ থেকে প্রস্ফুটিত এই শব্দটার জন্য একবুক তৃষ্ণা নিয়ে অপেক্ষা করেছি চাতক পাখির মতো। কতবার আপনাকে স্পর্শ করতে গিয়েও গুটিয়ে নিয়েছি নিজেকে তা শুধু আমিই জানি, কতবার আপনাকে ভালোবাসি বলতে গিয়েও আঁটকে গেছি তাও শুধু আমি আর ওই রব জানে। আমার সবটুকু যত্ন,আদর, মুগ্ধতা উগড়ে দিয়েছি শুধু দেইনি অধিকার মেশানো ভালোবাসা টা ,চাই ও নি। অপেক্ষা করেছি সেই মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য যখন আপনি বুঝবেন আমি শুধু আপনার জন্যেই,আর এই আপনিটা শুধু আমার ।

থামলো মেহরাজ, মোহর নিস্তেজ তাকিয়ে রইলো মেহরাজের স্বচ্ছ আঁখিজোড়ায়। মেহরাজ নিজের মুখটা ঝুঁকিয়ে আনলো, মোহরের নাক বরাবর মুখটা রেখে বলল

– এতগুলো দিন যেই উন্মত্ত ভালোবাসার অভিলাষটা বুকে পুষে রেখেছি, তার প্রণয়াকাঙ্ক্ষা আপনার দেহেও মিশিয়ে দিতে চাই!

মেহরাজের অবাধ্য কথাটার মর্মার্থ বুঝতেই মুষড়ে পড়লো, মুখটা আরও নিচু করে নিলো। মেহরাজ নিজের ঘাড়টা আরও ঝুঁকিয়ে মোহরের কানের কাছে মুখ এনে বলল

– আপনার সমস্ত সত্তাকে নিজের মাঝে শুষে নেওয়ার, ভালোবাসার উষ্ণতায় ছুঁয়ে দেওয়ার অধিকার, অনুমতি টুকু আজ দেবেন না মোহ!

মোহর আর পারলো নাহ, ঝড়ো অনুভূতির ওঠাপড়োনে অতিষ্ট হয়ে উঠলো। মেহরাজের বুকে মুখ লুকিয়ে ঝাপটে ধরলো, তীব্রভাবে খামচে ধরলো শুভ্র রঙের শার্টটা হাতের মুঠোয় মুচড়ে ধরলো। পুরুষালী শরীরটার কারাগারে নিজেকে স্বেচ্ছায় সমর্পিত করে, নিঃশব্দে জানান দিলো নীরব সম্মতি। শব্দ,যুক্তিহীনায় নিজের পবিত্র মন,শরীর আর সত্তাটুকু কে ভালোবাসার জোয়ারে প্লাবিত, উচ্ছ্বসিত করতে অর্পণ করলো
মেহরাজের বাহুর ডেরায়।
ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে জবজবে দুটো শরীর, মধ্যবর্তী দূরত্বের মাপটা অতিমাত্রায় শূন্য। ভয়াবহ রকম শীতলতায় জরাজীর্ণ অবস্থায় নিজেকে একটু উষ্ণতা দিতে,ওমের মাঝে লুকিয়ে নিতে আরও গভীরে জড়িয়ে যেতে অস্থির মনটা আনচান করে উঠছে। ঠিক এই মুহুর্তেই মেহরাজ বুক থেকে তুলে সোজা করলো মোহরকে।
আপাদমস্তক নেশাতুর দৃষ্টি বুলালো, লাইটের হালকা আলো আর ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুতের ঝলকানিতে সদ্য স্নাতা রমণীর অগাধ রূপটা প্রবল তৃষ্ণা ধরিয়ে দিচ্ছে। সিক্ত চেহারা, গায়ে চুইয়ে চুইয়ে অঝোরে পানি ঝরে পড়ছে, হালকা পাতলা হলুদ রঙের শাড়িটা ভিজে চুপসে মিশে আছে শরীরের প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে। প্রাণভরা আকুলিবিকুলি নিয়েই হাসলো মেহরাজ, দুর্বোধ্য সেই হাসি। প্রসারিত ঠোঁটজোড়া এগিয়ে এনে পরম আদরে চেপে ধরলো মোহরের কপালে।
এক লহমা অপেক্ষা না করে কোলে তুলে নিলো মোহরকে। ভেজা শরীরটাকে নিজের যতটা নিকটে সম্ভব চেপে ধরলো। এক পা দুই পা করে এগিয়ে গেলো ঘরের দিকে।
প্রবল কম্পনে ক্ষণে ক্ষণে নড়েচড়ে উঠলো মোহরের পাতলা শরীর টা।
খাটের উপরে আধশোয়া করে বসিয়ে দিলো মোহরকে ভেজা বস্ত্রেই। মোহরের নিস্তেজ চোখজোড়ার অস্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো দরজার দিকে এগিয়ে যাওয়া মেহরাজের দিকে। খট করে ছিটকিনি তুলে দিয়েই ঘুরে দাঁড়ালো। মোহরের চোখে নিষ্পলক চেয়েই আস্তে আস্তে এগিয়ে আসতে থাকলো মেহরাজ। ঠান্ডায় কাঁপতে থাকা শরীর টা হুট করেই থমকে গেলো। বিচলিত চোখে তাকিয়ে রইলো মোহর তার একান্তই নিজের মানুষটার দিকে। বৃষ্টিতে ভিজে সাদা শার্টটা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে সৌষ্ঠব শরীরটায়। কপালের চুল,কানের লতি, ঘাড় বয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানির ছোট ছোট মুক্তকণা। ব্যকুল তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এলো মোহরের, নিজেকে প্রাণপণে গুটিয়ে নিলো, দুই হাতের তালুতে ভর করে একটু একটু করে পিছিয়ে যেতে থাকলো। মোহরের সমস্ত আড়ষ্টতা, জড়তা,কুণ্ঠাকে হরদমে অগ্রাহ্য করে কোমরের কাছে শার্টটা উঁচিয়ে বেল্ট ধরে এক টান মারলো। ভারি জিনিসটা ফ্লোরে ছু’ড়ে ফেলার বিকট শব্দ তুললে মোহর ভয়াতুর চাহনি মেলে তাকালো সেদিকে। ঘাড় ঘুরিয়ে সামনে তাকানোর সাহস টুকু আর জুটলো না শরীরে যেনো, কম্পিত শরীরেই আড়চোখের আরক্তিম নজরে তাকালো মেহরাজের দিকে। মোহরের পায়ের দু’দিকে হাঁটু গেড়ে একটু একটু করে হামাগুড়ি দেওয়ার মতো করে এগিয়ে এলো মেহরাজ। আস্তে আস্তে মুখটা একদম মোহরের কাছাকাছি এনে অস্থির স্বরে আদরের সুর ঢেলে বলল

– মোহ. . আমার মোহ!

কপালে উষ্ণ স্পর্শটা গাঢ়ভাবে চেপে ফিসফিসিয়ে বলল ‘ভালোবাসি বিবিজান,এই অধমটা তার সমস্ত জান দিয়ে আপনাকে ভালোবাসে’
কথাটা বলার সাথে সাথেই প্রচণ্ড ভাবে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিলো মোহর,নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের ঝড় উঠলো মেহরাজের পাগল করা অস্থির স্পর্শে। কপাল থেকে গাল, নাক, চোখ, থুতনি,কান সব খানেই চেপে ধরলো উষ্ণতায় ভরা ওষ্ঠদ্বয়। মেহরাজের শরীর থেকে টুপটাপ করে পানির বিন্দুগুলো পড়ছে মোহরের গলায়, মুখে। ঝিমঝিম করা অনুভূতিতে বজ্রাহতের মতো মুষড়ে পড়লো মোহর। বাজ পরার বিকট শব্দে কেঁপে উঠলো ধরণী। বৃষ্টিত ফোঁটাগুলো যেমন মিশে যায় শরীরের প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে তার চেয়েও গহীনে মিশে গেলো মেহরাজ। অস্থিরতম অনুভূতিতে ভাসিয়ে নিলো মোহরের সমস্ত সত্তা। সংযম,ধৈর্য, বাঁধ চুরচুর হলো। বেসামাল আদরের আশ্লেষীপূর্ণ চুম্বনে আবদ্ধ করলো দুইজোড়া ঠোঁট। হাতের উপরে চেপে রাখা পুরুষালী হাতের করপুট দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হলো। হাতের চাপে নরম বিছানার বুকে দেবে গেলো হাতদুটো। বুকের মধ্যিখানে অধরের চাপে নৈসর্গিক আদলে তলিয়ে গেলো মেয়েলী সত্তা আর পুরুষালী অনুভূতি। বৃষ্টি আর বজ্রপাতের গর্জনের মাঝে অসহনীয় হয়ে উঠলো দুটো আত্মার মিলনের আর্তনাদ। রুদ্ধশ্বাস আঁটকে গেলো শিরশিরানির অনুভবে। বাতাবরণটা যেনো হুট করেই অন্য জগতে পদার্পণ করলো, সারা শরীরে মেহরাজময় অস্তিত্বে অবগাহন করে উন্মাদনায় আরক্ত স্বরে মোহর দূর্বল গলায় বলল

– আরেকবার বলুন নাহ

অনতিবিলম্বেই ভূবণ ভোলানো নিবিড়, আকুল স্বরটা উত্তপ্ততা ছড়িয়ে বলল

– ভালোবাসি

শোঁ শোঁ বাতাসে পর্দাগুলো বেয়ারা উড়তে লাগলো। লাইট গুলো যেনো নাটকীয় ভাবেই ধপ করে বুজে গেলো, বৃষ্টি আর মেঘের গর্জন বেড়েই চলল। তার সাথে তাল মিলিয়ে বাড়লো দুটো মানবের অবাধ্য মায়া, কিছু দূর্লভ ইচ্ছে, নিষিদ্ধ আবেগ। স্পৰ্শ গুলো যতটা সম্ভব প্ৰগাঢ় হলো। নিয়ন্ত্রণ হারা হলো সকল সুপ্ত কামনা। অগাধ প্রণয়লীলা মত্ত বেহুশ হৃদয়জোড়ার খায়েশ ।
তপ্ত নিঃশ্বাসের ঝড়ো হাওয়া, একসমুদ্র সুখেপ্রণয় প্রহেলিকা ভূবন্ত শীতল কক্ষ আবেষ্টিত হলো অদ্ভুত বাতাবরণে, মোহরুদ্ধকর আবেশে।
.
.
.
চলমান

#হীডিংঃ আজ সবটা কেমন #মোহরুদ্ধকর 🖤. . . তাই নাহ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here