ফানাহ্ 🖤 #পর্বসংখ্যা_৫০ #হুমাইরা_হাসান

0
701

#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৫০
#হুমাইরা_হাসান

– শ্রীতমা?

পুরুষালী গলাটা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই পা দুটি থামিয়ে নিল শ্রীতমা। ফোনটা ব্যাগের ভেতর ঢুকিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো। অত্যন্ত শ্রদ্ধাময়ী ভঙ্গিমায় বলল,

– জ্বী স্যার?

– মোহর আজ আসলো না যে?

চশমাটা হাতের আঙুলের ভাঁজে বদ্ধ করে, এক হাত পকেটে ঢুকিয়ে এগিয়ে আসতে আসতে বলল ফায়াজ। শ্রীতমা ওর স্বভাব সুলভ একটা মিষ্টি হাসি বিনিময়ে বলল,

– স্যার ওর শরীর টা একটু খারাপ করেছে মনে হয়। কেনো আপনাকে ইনফর্ম করেনি?

– হ্যাঁহ.. মেইল করেছিল। লিভ নিয়েছে।

ব্যস্ত ভঙ্গিমায় ঘাড় নাড়িয়ে বলল ফায়াজ। পরমুহূর্তেই বেশ আড়ষ্টতা নিয়েই জিগ্যেস করলো,

– ও তো কালও তাড়াতাড়ি চলে গেলো,কোনো অসুবিধা হয়েছে কী? মানে সিরিয়াস ইস্যু! মোহর কী খুব বেশিই অসুস্থ?

শ্রীতমা শুরুতে ভ্রু গুটিয়ে নিলেও পরক্ষণে প্রসারিত গালে বলল,

– না তেমন কিছু না স্যার। ওই একটু আকটু শরীর খারাপ। চিন্তার কিছু নেই,ও কাল থেকেই রেগ্যুলারিটি মেইনটেইন করবে।

– আচ্ছা ঠিকাছে। থ্যাংকস

প্রত্যুত্তরে আবারও এক গাল হেসে বেরিয়ে এলো হসপিটাল থেকে। রাস্তার কোণ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইলো বেশ খানিকটা সময় ধরে। অন্যান্য দিন মোহর থাকে বলে হসপিটাল মোড় পর্যন্ত হেঁটেই যায় দুজনে। আজ ও না থাকায় একা একা হাঁটার একদম ইচ্ছে হলো না শ্রীতমার। তবে অটোরিকশার অপেক্ষায় থেকেও কোনো লাভ হলো না। আজ কপাল টা যেনো বড়সড় ষড়যন্ত্র করে বসলো। অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে থাকার দরুন হাঁটুতে ঝিনঝিন করে উঠলো শ্রীতমার। ভীষণ বিরক্তিতে চোখ মুখ কুচতে ক্যাচক্যাচ করে বলল,

– আজ কী সব অটোরিকশা ধর্মঘট করে বসলো? নাকি হরতাল! উফফ! আমার কপাল টাই আসলে বিশ্রী

বলে একা একাই গজগজ করতে করতে সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করলো, কদম কয়েক ফেললেও পেছন থেকে একটা পরিচিত গলার স্বর কানে আসায় আবারও দাঁড়িয়ে পড়লো

– এই যে উড়নচণ্ডী

শ্রীতমা ঘুরে তাকালে একদম ওর মুখের মতোই বিরক্তিতে ভরা আরেকটা মুখ দেখতে পেলো। তবে ওর মনোযোগ টা সেদিকে নয় মানুষটার সম্বোধন করা নামটাতে, দাঁতে দাঁত চেপে জবাব দিতে চাইলো তবে তার আগেই অভিমন্যু ক্লান্ত চেহারায় বলল,

– যেভাবে হাঁটছিলেন অন্যকেও দেখলে ছোটখাটো গরিলা বলে দিতো আমিতো তবুও ভদ্রসূচক মন্তব্য করেছি। যাই হোক, আপনার ফ্যাচফ্যাচে গলাটা না বাজিয়ে চুপ করে গাড়িতে উঠে বসুন

শ্রীতমা খানিক চুপ করে রইলো। অভিমন্যু বিরক্ত হয়ে আবারও তাড়া দিবে তখনি মুখ খুলে বলল,

– আপনার সাথে আমি যাবো কীসের দুঃখে। আমার তো ঠ্যাকা পড়েনি আপনার মতো হনুমান মুখো টার সাথে গাড়িতে বসতে।

– শুনুন আমারও ঠ্যাকা পড়েনি আপনার মতো উড়নচণ্ডী ঝগড়ুটে টাকে নিজের সাথে বসাতে। সে তো গ্যাড়াকলে পড়েছি এখন আর কী করবো। সারাদিন অফিস করে বাড়ি ফিরেছি ঘরে অব্দি ঢুকতে দেয়নি, উলটো রাস্তা ধরিয়ে দিয়েছে। আপনাকে না নিয়ে গেলে আজ মনে হয় না আমাকে ঘরে জায়গা দেবে

– কে আংকেল আন্টি?

– তাছাড়া আর কে! চুপচাপ উঠে বসুন। প্লিজ! আমি অনুরোধ করছি। আজকের দিনটা অন্তত এ্যাডযাস্ট করে নিন, তারপর আমি সবটা বুঝিয়ে বলবো বাবা মা কে। আপাতত আমার কোনো কথা শোনার মুডে তারা নেই।

শ্রীতমা চেয়েও কিছু বলল না। ওর ও মনে হলো মানুষ দুটোর সাথে দেখা করবার দরকার। এভাবে কতদিন মিথ্যের জালে জড়িয়ে রাখবে। তার চেয়ে বরং যত আগে সবটা জানিয়ে দেওয়া যায় ততই ভালো।
গাড়ির দরজাটা খুলে উঠে বসতে বসতে বলল,

– আজকেই শেষ। আপনি যেই মিথ্যে বানিয়েছেন, তার দায়ভার আপনাকেই নিতে হবে। শুধু শুধু মানুষ দুটোকে অন্ধকারে রাখছেন। সত্যটা জানলে কতটা কষ্ট পাবে কোনো ধারণা আছে?

অভিমন্যু স্টিয়ারিংয়ে হাত ঘুরিয়ে মোড় নিতে নিতে বলল,

– এমনিতেই আমি চিন্তায় মরছি, আপনার অন্তত জ্ঞান দেওয়া দরকার নেই

– আপনি আসলেই একটা হনুমান, হনুমান মুখো। এদের সাথে শুদ্ধ ভাষায় কথাই বলা উচিত নাহ

– অন্য কোনো ভাষা জানা আছে? মানে উড়নচণ্ডীদের আবার আলাদা ভাষাও থাকে নাকি?

– আপনি!

এরপরই অভিমন্যুর উচ্চস্বরে হাসির শব্দটা শোনা গেল।যেনো খুব মজার কিছু বলে ফেলেছে। শ্রীতমাকে রাগীয়ে যেন অন্যরকম মজা পায় ও।

•••

– আর কতক্ষণ ও এভাবে পড়ে থাকবে? সারাটা দিনেও কথা বলল না

কাকলি খাতুন অতিষ্ট হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। বেশ বড়সড় সাজানো গোছানো ঘরটা ভর্তি মানুষে। কাকলি, আম্বি, শাহারা বেগম সাথে তাথই আজহার, মেহরাজ। মোহর ত্রস্ত চোখে তাকালো বিছানার সাথে ঝুলিয়ে রাখা মাঝারি আকৃতির প্লাস্টিকের ব্যাগের দিকে। ভেতরকার তরল প্রায় শেষের পথে। মাথা টা এবার নামিয়ে তাকালো বিছানায় পড়ে থাকা রুগ্ন, দূর্বল শরীর টার দিকে৷

এইতো ভালো মেয়েটা মাস খানেক আগেই গেলো,অথচ এ কোন চেহারা নিয়ে ফিরলো! চোখ দু’টো অক্ষিকোটরের ভেতরে দেবে গেছে, চোখের নিচে কালচে দাগ। অত্যাধিক দূর্বল শরীর জীর্ণশীর্ণ অবস্থা। এতটা অসুস্থ হয়ে গেলো মেয়েটা! তাথই আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলো সাঞ্জের মাথায়। একটা মাত্র ছোট বোন ওর. . উপরে উপরে রাগ, শাসন দেখালেও সাঞ্জে যে ওর চোখের মণি। এই জন্যেই ওকে হোস্টেলে ফিরিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলো না ও। মেয়েটা তো কারো কথাই শুনলো না। এখন ওর এইরকম অবস্থাটা তো চোখে দেখা যাচ্ছে না।

– মা আপনি সকালে নাস্তার পর আর কিচ্ছুটি খেলেন না। বিকেল হয়ে এসেছে প্রায়, এতটা সময় না খেয়ে থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়বেন। আপনার মাজা ব্যথায় ওষুধ টাও খাননি আজ!

আম্বি খাতুনের কথাগুলো যেনো কান অব্দি পৌঁছালো না শাহারা বেগমের। শুভ্র কাপড়ের মোটা পাড় টা হাতে তুলে চোখ দুটি মুছে নিলেও আবারও এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। কান্নামিশ্রিত পৌঢ়া কণ্ঠে বললেন,

– আমার সাঞ্জেটার কী হলো গো আম্বি? ও এতটা অসুস্থ হয়ে পড়েছে অথচ আমরা কেও একটুও জানতে পারিনি। এতটা দিন মেয়েটা অসুস্থ শরীর নিয়ে দূরে ছিলো। কেও একটু দেখভাল করেনি

বলতে বলতে আবারও কেঁদে ফেললেন। কাকলি বেগম পাশেই বসে। নিজের মেয়ের এমতাবস্থায় মুখটা তার ও ভীষণ মলিন। বকাঝকা করলেও তারই তো সন্তান। কোনো মা’ই তো সন্তানের কষ্ট সইতে পারে নাহ।
মেহরাজ ফোনে কথা সেরে ঘরে এসে সাঞ্জের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,

– ওর আর কতক্ষণে জ্ঞান ফিরবে মোহ?

মোহর খুব আস্তেধীরে চোখা সুচটা হাত থেকে বের করে একটা টেপ লাগিয়ে দিলো। নিচু কণ্ঠে বলল,

– এইতো এখনি জেগে উঠবে। ভীষণ দূর্বল শরীর, খাওয়া দাওয়ার অনিয়ম চলছে হয়তো লম্বা একটা সময় ধরেই। প্রেসার ফল করেছে৷

– কিন্তু হুট করেই এর এতটা অসুস্থ হওয়ার কারণ কী? এইতো পরশুই তো ফোনে কথা বললাম, কই কিছুতো বলল না?

– হুট করে অসুস্থ হয়নি আপা। লং টাইম ধরে চলছে, সময়মতো ট্রিটমেন্ট না পাওয়ায় এতটা..

শেষের কথাগুলো কেমন মিনমিন করে বলল মোহর। উদ্বিগ্ন চোখ দু’টো তুলে তাকালো মেহরাজের দিকে। মেহরাজ মোহরের চোখে স্পষ্ট দুঃশ্চিন্তা, উদ্বেগ, তটস্থতা দেখতে পেলো। সাঞ্জেকে দেখার পর থেকেই মোহরের মুখ জুড়ে কেমন দুঃশ্চিন্তা আর আতঙ্কের অমাবস্যা নেমে আছে সেটা আর কেও না হলেও মেহরাজ স্পষ্ট আঁচ করতে পারছে।
— রাতে সাঞ্জের হোস্টেল থেকে ফোন পেয়েই বেরিয়ে পড়েছিল মেহরাজ। ইমারজেন্সী কল করেছিলো কলেজ অথোরিটি থেকে। ক্যাল ব্যয় না করেই ছুটেও সুদূর পথটা পারি দিয়ে মেহরাজের পৌঁছাতে অনেক বেশি রাত করে ফেলেছিল। ওখানে গিয়ে সাঞ্জের অবস্থা দেখে আর ধরে রাখতে পারেনি নিজেকে। গার্লস হোস্টেলের তিনতলার একশত ছয় নম্বর রুমটাতে যখন ওকে নিয়ে গেলো তিনচারজন মেয়ের দলটা কে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো সাঞ্জেকে কেন্দ্র করে। চেতনাহীন শরীর টা বিছানাতে পরে ছিলো, ঘরটাতে বমি করে ভাসিয়েছে। মেহরাজ এইরকম অবস্থা দেখে একচুল অপেক্ষা করতে চাইনি, ওখানকার লোকাল ডক্টর কে দেখিয়ে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা নিয়ে শেষ রাতেই সাঞ্জে কে নিয়ে রওয়ানা করেছিলো। আব্রাহাম ম্যানসনে এসে পৌঁছাতে প্রায় বেলা গড়িয়ে গেছে। রাজধানী থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব একটু বেশিই কী না। এ বাড়িতে আনার পর থেকে সাঞ্জের মুখ থেকে একটা টু শব্দ শুনতে পাইনি কেও। শীর্ণকায় শরীরে পড়ে আছে বিছানাতে। মোহর প্রয়োজনীয় ওষুধ সহ, স্যালাইন ও দিয়েছে। তার কারণ অত্যন্ত দৌর্বল্য আর শরীরে পানিশূন্যতা।

সারাটা দিন পেরলেও মেয়ের শরীরের তেমন কোনো উন্নতি না দেখতে পেয়ে চিন্তা, অস্থিরতায় ক্ষ্যাপাটে হয়ে উঠলো কাকলি খাতুন। মুখ দিয়ে চ-জাতীয় শব্দ করে খিটখিটে স্বরে বললেন,

– সারাটা দিন পেরিয়ে গেল, আমার মেয়ের শরীরের উন্নতি নেই। ভাতটাও মুখে দিতে পারছে না। ওর শরীরের অবস্থা দেখেই বোঝা যাচ্ছে বড়ো কোনো সমস্যা হয়েছে, অথচ তোমরা ওকে এখনো হসপিটালে নিতে দিচ্ছো না!

কাকলির কথার সাথে একরাশ ক্ষোভ আর অস্থিরতা প্রকাশ পাচ্ছে। তাথই মাকে শান্ত করতে বলল,

– মোহর তো ওকে ওষুধ স্যালাইন দিয়েছে মা। সুস্থ হতে তো একটু সময় লাগবে?

– আসল সমস্যাটার নাম তো ও বলছে না। নাকি বলতে জানেই নাহ? দেখ আমি আমার মেয়েকে এভাবে আর রাখতে পারবো না। ওর হোস্টেল সুপার তো মেহরাজকে বলেছে সাঞ্জে প্রায় বিশ দিনের চেয়েও বেশিদিন ধরেই অসুস্থ। ও নিজে স্বাভাবিক অসুস্থতার দায় দেখিয়ে বাড়িতে ব্যাপার টা জানাতে নিষেধ করেছে, এতগুলো দিন ধরে তো শুধু প্রেসার ফল বা ঘুম,খাওয়ার অনিয়মের কারণে অসুস্থ থাকতে পারেনা একটা মানুষ! আর তা হলেও এতটা গুরুতর ভাবে না। ওর চেহারাটার দিকে তাকিয়েছিস? কতো বড়ো অসুখ বাঁধিয়েছে আল্লাহ মাবুদ ভালো জানেন

শেষের কথাটুকু বলতে কণ্ঠনালীটা যেনো কেঁপে উঠলো রূঢ়ভাষী মহিলার। মেয়ের জন্য দুঃশ্চিন্তা এক মুহুর্ত স্থির থাকতে দিচ্ছে না তাকে। আজহার মুর্তজা মোহরকে উদ্দেশ্য করে বলল,

– মোহর তুমি ঠিকঠাক ভাবে বলো তো সাঞ্জের আসল সমস্যা টা কোথায়? ওকে হসপিটালে নিতে হবে? কোনো টেস্ট করানোর প্রয়োজন? আরহাম শহরের বাইরে ছিলো, সাঞ্জের কথা শুনে সকালেই রওয়ানা দিয়েছে। চলেই আসবে, আমি কী অ্যাম্বুলেন্সে কল করবো?

– না না! অ্যাম্বুলেন্সে কল করার দরকার নেই।

– দরকার নেই মানে কী? ওকে এভাবে কতক্ষণ রাখবে

আম্বি খাতুনের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলো না মোহর। মেহরাজ এগিয়ে এসে মোহরের পাশে দাঁড়ালো। ওর কাঁধে হাত রাখলে মোহর অস্থির চোখে তাকালো মেহরাজের দিকে, যে চোখে স্পষ্ট আতঙ্ক, অস্থিরতা। মেহরাজের বুকটা কেমন ধক্ করে উঠলো, আলতো স্বরে বলল,

– মোহ! সাঞ্জের কী হয়েছে মোহ?

মোহরের চোখ দু’টো টলমল করে উঠলো। ব্যস্ত চেহারায় ঠোঁট দুটো জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে নিলো। কাকলি খাতুন মোহরের সংবিগ্ন চেহারা দেখে ছুটে এসে ওর হাতের বাহু চেপে ধরলো, কেমন তটস্থ হয়ে বলল,

– এই মেয়ে তুমি এমন করছো কেনো বলোতো? কী হয়েছে ওর। তুমি কী আদও কিছু জানো?

বলে মোহরের হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলল,

– শোনো তোমাকে আমি একটুও ভরসা করিনা।আমার মেয়েকে আমি হসপিটালে নিয়ে যাবো৷

মোহর উঠে কাকলির সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

– হসপিটালে নেওয়ার কোনো দরকার নেই চাচী
ও ঠিক হয়ে যাবে

– তোমার কথায় আমি কোনো নিশ্চয়তা পাচ্ছি নাহ

বলে ফোনটা হাতে তুলে বলল

– আমি ওর বাবাকে এক্ষুনি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে আসতে বলছি

মোহর দ্রুতপায়ে এগিয়ে এসে কাকলির হাত থেকে ফোনটা ছিনিয়ে নিলো। মোহরের এহেন কাজে সকলে অনেক বেশিই বিস্মিত হলো, কাকলি ক্ষুব্ধ চেহারায় কিছু বলবে তার আগেই মোহর বলল,

– সাঞ্জে প্রেগন্যান্ট! ওকে হসপিটালে নেবেন নাহ, আনম্যারিড মেয়েদের প্রেগন্যান্সি নিয়ে ইস্যু পাবলিক হবে

কথাটা মোহর এক নাগাড়ে বলে ফেললেও সকলের মাঝে বড়সড় একটা ঝড় বয়ে গেলো। উপস্থিত মানুষ গুলোর মুখ জুড়ে এখনো স্থবিরতা, মোহরের কথাটা কর্ণকুহরে পৌঁছে ঠিকঠাক ভাবে বোধগম্য হতে প্রায় মুহুর্ত খানেক লেগে গেলো। হুট করেই চেনাজানা মুখগুলোর অবয়ব কেমন বদলে গেলো। মোহরের কথাটার মর্মার্থ উপলব্ধি করতে পেরে কাকলি খাতুন শান্ত কণ্ঠে বলল,

– তুমি আমার সাথে মসকারা করছো? এই মুহুর্তে তোমার ফাজলামি করতে ইচ্ছে করছে? কীসব যাতা কথা বলছো তুমি?

কাকলি খাতুন যেভাবে বলল ঠিক তার চেয়েও উচ্চস্বরে মোহর জবাব দিলো,

– আমি কোনো মসকারা করছি না। সাঞ্জে সত্যিই প্রেগন্যান্ট। আর এই কথাটা যদি সত্যিই মসকারা হয় তাহলে আমার চেয়ে বেশি খুশি আর কেও হবে নাহ!

– তুমি কী বলছো ধারণা আছে? ডাক্তার হয়েছো বলে তো এই না যে, যা খুশি বলে দেবে আর আমরা মেনে নেবো!

– আপনাদের কেনো মনে হচ্ছে আমি মিথ্যে বলছি? এতে আমার লাভ টা কোথায়! আমি কেনো শুধু শুধু সাঞ্জেকে মিথ্যে অপবাদ দেবো? তাও এমন একটা ব্যাপার নিয়ে!

বলে থপ করে খাটের এক কোণায় বসে পড়লো মোহর। দু’হাত মাথায় চেপে ঝুঁকিয়ে নিলো ঘাড়। ফোসফাস করে বড়ো বড়ো শ্বাস ছেড়ে তাকালো। মেহরাজ এগিয়ে এসে মোহরের সামনে বসে বলল,

– মোহ আপনি যা বলছেন তা ভেবেচিন্তে বলছেন তো!

মোহর ছলছল চোখে তাকালো মেহরাজের দিকে। মানুষটার স্তম্ভিত চেহারা দেখে ওর কান্না পাচ্ছে। বোন দুটো ওর চোখের মণি, সাঞ্জের অসুস্থতায় সদা সর্বদা শান্তশিষ্ট মানুষটা ঠিক কতটা অস্থির, চিন্তিত হয়েছিলো তা ও নিজ চোখে দেখেছে। এখন এই ধাক্কা টা কি করে মানবে!

– বলুন মোহ?

প্রশ্নটা বেশ জোর দিয়ে করলেও মোহরের জবাবের আগেই তাথই বলল,

– সাঞ্জের জ্ঞান ফিরছে

উপস্থিত কৌতূহলী চোখ জোড়ার দৃষ্টি গিয়ে ঠেকলো তখন সাঞ্জের দিকে। কয়েকবার চোখ মুখ কুচকে ধীরে ধীরে খুলে তাকালো সাঞ্জে, মেয়ের জ্ঞান ফিরতে দেখেই কাকলি দৌড়ে গেলো ওর কাছে, ওকে দু’হাতে ধরে সোজা করে বসিয়ে দিয়ে বলল,

– কী হয়েছিলো তোর? কীভাবে এতো অসুস্থ হয়েছিস?

বলে দুবাহু ধরে ঝাকালো সাঞ্জেকে । আজহার মুর্তজা খানিক গম্ভীর স্বরে বলল,

– আহ, সবেমাত্র চোখ খুলেছে মেয়েটা। ওকে ধাতস্থ হতে দাও অন্তত। এমন করলে তো মেয়েটার আরও শরীর খারাপ করবে।

– না করবে না। আগে ও উত্তর দেবে। বল তুই, কী হয়েছে তোর?

বলে আবারও সাঞ্জেকে বাহু চেপে ধরতে নিলে তাথই দুহাতে সাঞ্জেকে ধরে নিজের কাছে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরলো। মায়ের দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বলল,

– একদম ওর সাথে এমন ব্যবহার করবে না মা! তোমার এই রুক্ষ স্বভাবের জন্য আমরা কখনো নিজের ভালো মন্দের খবর তোমাকে জানাই না। ওর জ্ঞান ফিরেছে একটু অপেক্ষা করো। আস্তে ধীরে জানতে পারবে।

– তোমরা কী আমাকে পাগল পেয়েছো বলোতো? হুট করেই খবর এলো, আমার মেয়েকে রোগীর চেহারায় বাড়িতে আনলো। সারাটা দিন পেরিয়ে যাওয়ার পর এখন এই মেয়েটা বলছে সাঞ্জে নাকি প্রেগন্যান্ট! এটা কী সার্কাস হচ্ছে? ও কী করে প্রেগন্যান্ট হবে? কার সাথে সম্পর্ক ছিলো ওর?

কাকলি খাতুনের উচ্চস্বরের চ্যাঁচানোতে ঘর জুড়ে একটা উত্তাপ বয়ে গেলো। সাঞ্জে ফুঁপিয়ে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো তাথইকে। না শাহারা বেগম নাইবা আম্বি, কেও ই বলার মতো কোনো ভাষা পাচ্ছে নাহ।

(…..)

অস্থির ভাবে পায়তারা করছেন কাকলি। একটু পরপর ওয়াশরুমের দরজার দিকে তাকাচ্ছে । ঘরের ভেতর এখন শুধু মেয়েগুলোই আছে, আজহার মুর্তজা বেরিয়ে গিয়েছেন অনেক আগেই। মেহরাজ ও থাকেনি এখানে। থাকতে পারেনি, কেমন যেনো একটা ব্যথা, বেদনাভূত হচ্ছে বুকের ভেতর। কোনো কিছুতেই নিজেকে শান্ত করাতে পারছেনা।
সাঞ্জে জ্ঞান ফিরে থেকে কেঁদেই যাচ্ছিল শুধু, ঘন্টা ধরে ওভাবেই বসে ছিলো তাথই কে জড়িয়ে। ওকে স্বাভাবিক করে সান্ত্বনা দিয়ে থামালেও কাকলিকে থামাতে পারেনি। দশ মিনিটের ব্যবধানে কোত্থেকে একটা কিট এনে সাঞ্জের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন

– যা এটাতে ইউরিন দিয়ে টেস্ট করিয়ে আন। আমিও দেখবো এই মেয়েটা এতো জোর দিয়ে কীভাবে বলছে এসব

সকলের হাজার বাঁধা নিষেধ সত্ত্বেও অপেক্ষা করতে রাজী নন মহিলা। এক প্রকার জোর করেই পাঠিয়েছে সাঞ্জে কে ওয়াশরুমে। কেও আঁটকানোর ভাষা’টাও আর পাইনি।

– তুই আর কতক্ষণ লাগাবি? ঘন্টা পার করার উদ্দেশ্য আছে? এক মিনিটের মধ্যে না বেরোলে তোর খবর আছে

তাড়া দিয়ে আবারও পায়চারি শুরু করলেন কাকলি। পা দুটোকে যেনো এক মিনিটের জন্যেও স্থির বসাতে পারছে না। অবশেষে দীর্ঘক্ষণ অতিবাহিত করে সবগুলো উৎসুক মনের উৎকণ্ঠাকে কণ্ঠনালি পর্যন্ত ঠেলে দিয়ে খট করে শব্দ হলো, ওয়াশরুমের দরজা টা খুলতেই সাঞ্জের বিধ্বস্ত চেহারাটা স্পষ্ট হলো। গুটি গুটি পা ফেলেও যেনো বেরিয়ে আসতে পারলো না। এক পা সমান পথটাও এক ক্রোশ লাগছে। তবে সাঞ্জের মায়ের আর তর সইলো না, ছুটে গিয়ে সাঞ্জের হাত থেকে স্টিক’টা।
সাদা সাদা রঙের স্টিকটাতে ছোট ছোট লাল রঙের দুটো দাগ দেখে চোখ দু’টো জ্বলজ্বল করে উঠলো মহিলার। অদ্ভুত ভাবে আহাজারির মতো করে বলল,

– এ তুই কী করেছিস সাঞ্জে? কার বাচ্চা পেটে ধরেছিস তুই!

.
.
.
চলমান।

#হীডিংঃ আগামী পর্বে বড়সড় ব্যাপার ঘটতে চলেছে, আপনারা প্রস্তুত তো!!

©Humu_❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here