#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৫২
#হুমাইরা_হাসান
| অংশ ০২ |
– আশু?
বহুচেনা একটা পুরুষালী কণ্ঠ কানে এলে ডান হাতের উল্টো পিঠে চোখের পানি মুছে নিলো তাথই। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। বিস্ময়কর ভাবে সামনের দৃশ্যটুকু দেখে বুকের পিঞ্জিরাবদ্ধ যন্ত্রণা টা ভোতা আঘাত করে বসলো। স্তব্ধ নজরের ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো পৃথকের বুকে মিশে থাকা ওর ছোট্ট মেয়েটার মুখে। এতসব ঝামেলার মাঝে কাল থেকে নিজের মেয়েটাকে একবারের জন্য কোলেও নেয়নি। এমনকি কাল রাতটাতেও তোয়া নাজমার কাছেই ছিলো।
– নাজমা খালার কাছে ছিলো, খুব কান্নাকাটি করছে, মনে হয় ওর ক্ষুধা লেগেছে। তুমি একটু ওকে খাওয়াও আশু
বলে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো তাথইয়ের পাশে। তাথই নিষ্পলক চেয়ে রইলো পৃথকের বুকে লেপ্টে থাকা ওর মেয়ের দিকে। যার রক্ত নিজের শরীরে বইছে সেই বাবার বুকটাও তো কখনও এতো আদরে কাছ থেকে পাইনি, তাই বোধহয় আর হাতছাড়া করছে না? ছোট্ট মেয়েটা এটাও বুঝে নিলো! কি সহজে,নির্দ্বিধায় ছোট ছোট থাবা বুকটায় মেলে দিয়ে লেপ্টে আছে। তাথই নিজেকে কোনো ভাবেই ধরে রাখতে পারছে না, এইরকম মুহুর্তেও অবাঞ্ছিত একটা অনুভূতিময়ে কোন্দল তুললো মনের ভেতরে। নিজ সন্তানের বাবার শূন্যতাটা যেন আজ ওর বুকে বেশ গাঢ় আঁচড় দিলো।
নিজের যৌক্তিক ভাবনা গুলোকেও নিছক অযৌক্তিকের তকমা লাগিয়ে ধাতস্থ হয়ে হাত বাড়িয়ে তোয়াকে নিতে গেলো। সাত মাসের বাচ্চাটা কি বুঝলো কে যানে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে ওভাবেই পৃথকের বুকটাতে লেপ্টে রইলো। তাথইয়ের বিস্মিত চেহারা দেখে পৃথক খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
– আ…ব্ ও নাহয় আরেকটু থাকুক আমার কাছে। মানে তোমার যদি কোনো অসুবিধা না হয়?
তাথই মুখটা ফিরিয়ে নিয়ে শক্ত গলায় বলল,
– অসুবিধা নেই
তাথইয়ের এমন গম্ভীর মুখটা দেখে বিচলিত হলেও বেশ জড়তা নিয়ে পৃথক বলল,
– না মানে, ও তো ছোট। কার কোলে উঠেছে বুঝছে না। তুমি কি ওর উপরেও রাগ করবে?
তাথই পৃথকের দিকে গরম চোখে তাকালে ওর উৎসুক মুখটা নিমিষেই শুকিয়ে গেলো। তাথইয়ের রাগ হলেও নিজের উপরেই রাগ হলো। অতিষ্ঠময় গলাতে চ্যাঁচিয়ে বলল,
– আমি কি সবসময় রাগই করি? আমার মনে দয়া মায়া নেই? নাকি পাষাণী মনে হয় আমাকে? আপনারা সবসময় আমাকে কি বোঝাতে চান আমি নিষ্ঠুর?
প্রচণ্ড খারাপ ভাবে পৃথকের মুখের উপর এতগুলো কথা বলে খিটখিটে মুখটাই অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলো। পৃথক চুপ করে রইলো। আস্তেধীরে এগিয়ে এসে তাথইয়ের পাশে বসে একহাতে তোয়াকে ধরে অন্য হাতটা এগিয়ে তাথইয়ের মাথায় রাখতে বাড়িয়ে দিলেও অদ্ভুত একটা জড়তা, আড়ষ্টতার ভয়ে পিছিয়ে নিলো। তাথই আড়চোখে ঠিকই লক্ষ্য করলো পৃথকের বাড়িয়ে দেওয়া হাতটার পিছিয়ে নেওয়া। ভীষণ রাগ হলো ওর ভীষণ, আবারও আগের মতো রুক্ষ স্বরে বলল,
– হাতটা সরিয়ে নিলেন কেনো? আমাকে ধরলে হাতটা পচে যাবে তাই তো? আমি এতোই খারাপ যে আমাকে স্পর্শও করা যাবে না? তাহলে কেনো এসেছেন, আলগা দরদ দেখাতে এসেছেন?
পৃথক বেশ অবাক হলো তাথইয়ের এরূপ কথাবার্তার ধরনে। ওকে স্পর্শ করলে যদি আবারও রেগে যায় সেই ভয়েই তো পিছিয়ে নিলো! তাথই জোরে জোরে দুবার নিঃশ্বাস টেনে ঘাড় কাত্ করে তাকালো পৃথকের দিকে৷ এতক্ষণ তো ঠিকই ছিল! হুট করে এতো রাগ হচ্ছে কেন? এই মানুষটাকে দেখে এতক্ষণের চাপা উদ্বেগ, ক্ষোভ গুলো উগড়ে আসছে কেনো?
পৃথক তাথইয়ের অস্থিতিশীল দশা দেখে সরে আসতে চাইলো, বসা থেকে উঠতে নিলেও ওর সমস্ত চিত্তকে অভিভূত করে দিয়ে তাথই ঝাপিয়ে পড়লো পৃথকের বুকে, অকস্মাৎ তাল সামলাতে না পেরে নড়েচড়ে গেলো পৃথক। তোয়াকে বুকের একপাশে ধরে আরেকটা হাতের অপ্রকৃতস্থ স্পর্শ টা তাথইয়ের মাথায় রাখলো। পৃথকের সমস্ত জড়তা, বিহ্বলতাকে এক ঝটকায় সরিয়ে বুকের একপাশটায় নিজ অধিকার দখল করে নিলো দেদারসে। চমৎকৃত ভাবে পৃথকের বুকে মুখ গুঁজে দিয়ে সশব্দে কেঁদে উঠলো। কান্নার হিড়কে কম্পিত গলায় বলল,
– আমাকে এতো খারাপ কেনো ভাবেন আপনারা। আমি কি এতোই খারাপ? এতোই রাগী? আমার কি কষ্ট হয়না? হয় . . আমার অনেক কষ্ট হয়। কিন্তু কেও তো আমারটা বোঝে না! আমি কোথায় যাবো কার কাছে যাবো?
অদ্ভুত অনুভূতির জিরিজিরি কম্পনে বুকটা নাড়া দিয়ে উঠলো। একহাতে তাথইকে আগলে নিলো। আকস্মিক কাণ্ডে তালগোল হারিয়ে অদ্ভুত দুঃসাহসিক কাজটা করে বসলো। এতদিনের সুপ্ত অনুভূতি গুলোই প্রিয়তমাকে আগলে নিতে, সাদরে যত্নে নিতে ঠোঁট দুটোর আলতো পরশ বসিয়ে দিলো তাথইয়ের কপালে। তাথইয়ের চোখের জল বাঁধছাড়া হয়ে ছাপিয়ে পড়লো। ওর যত খারাপ মেজাজ, রাগ, ক্ষুব্ধতার পেছনে যে একবুক ভালোবাসা যত্ন আর কারোর কাছে নিজেকে আগলে রাখার সুপ্তানুভূতির প্রখরতা টুকু লুকিয়ে থাকে সেটা তো কেও বোঝেনি। এতটা খারাপ ব্যবহার করলে তো অন্যেরা দূরে চলে যায়, পৃথকই একমাত্র মানুষটা যে বরং পাশে এসে বসেছে। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনি তাথই, অনুচিত সত্ত্বেও তাই ঝাপটে ধরলো বহুকাঙ্ক্ষিত বুকটাতে।
– আশু?
তাথই নড়াচড়া করলো না। পৃথক ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
– তোমাকে কেও খারাপ ভাবে না আশু, নাইবা পাষাণী ভাবে। তুমি যে কতটা মায়াবতী সেটা আমিতো জানি। আমিতো শুধু চেয়েছিলাম তোমাকে স্পেস দিতে, তোমার মন মেজাজ ভালো নেই এই ভেবে।
– লাগবে না আমার স্পেস। কিচ্ছু লাগবে না। বহুত স্পেস পেয়েছি। এতটাই পেয়েছি যে আমার সাথে,আমার পাশে কেও নেই আর।
– কে বলেছে কেও নেই? সবাই আছে আশু
– চুপ করুন। একদম চুপ। লাগবে না আমার কাওকে৷
পৃথক হাসলো। একেবারেই সামান্য, নিঃশব্দে, অল্পবিস্তর। কিন্তু এই এক ফালি হাসিতে যেন ওর একবুক তৃপ্তিটুকু স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেলো। দীর্ঘ বছরগুলো পরে সুখানুভূতি টাকে বুকের মাঝে পেয়ে ওর কতটা আনন্দ লাগছে এটা কি করে বোঝাবে ও!
তাথইয়ের হুট করেই সম্বিত ফিরলো যেন। আবেগের বশে কতবড় কাজটা করে ফেলেছে সেটা বোধগম্যতায় আসলেই ছিটকে সরে এলো। অপ্রস্তুত চেহারায় উঠে দাঁড়ালো। পৃথক আর বাড়ালো না তাথইয়ের অস্বস্তি, বিষয় বদলাতে সাঞ্জের দিকে তাকিয়ে বলল,
– সাঞ্জের অবস্থা কেমন?
তাথই সামনের দিকে এগিয়ে গেলো। ছোট্ট বোতলটা হাতে নিয়ে ধীমি গলায় বলল,
– আগের মতোই। সারারাত জ্বরে ছিলো। সকালে ছেড়েছে। কিন্তু চোখ খোলেনি।
– স্বাভাবিক। প্রি-ম্যাচিউর প্রেগন্যান্সিতে অনেক বেশিই ক্রিটিকাল হবে ফিজিক্যাল কন্ডিশন।
তাথই উত্তর করলো না। ঘর থেকে বেরিয়ে মিনিট পাঁচেক বাদেই এসে পৃথকের সামনে হাত বাড়িয়ে বলল,
– ওকে খাওয়াতে হবে।
পৃথক বুক থেকে ছোট্ট তোয়াকে তুলে তাথইয়ের হাতে দিলে। তাথই ওকে নিয়ে বসে দুধভর্তি ফিডারটা ওর মুখে ধরলো। পৃথক তাকিয়ে আছে নিষ্পলক সেদিকে, তাথইয়ের অবশ্য বেশ অস্বস্তি হলো এহেন চাহনিতে।
•••
– তুই কি এখনি বেরিয়ে পরবি মহু?
– হ্যাঁ।
শ্রীতমা হাতের ফাইলটা একপাশে রেখে এগিয়ে এলো। মোহরের হাতের বাহুটা জড়িয়ে ধরে মাথা ঠেকিয়ে বলল,
– এতো সমস্যা কি সব তোর জীবনেই আসে। কেনো আসে মহু, আমার আর ভাল্লাগে না এসব।
মোহর স্মিত হাসলো। স্টেথোস্কোপ টা গলা থেকে খুলে শ্রীতমার গালটা টেনে দিয়ে বলল,
– এসব নিয়ে একদম ভাবিস না তো। সব ঠিক হয়ে যাবে। পরিস্থিতি যেমনই হোক, আমাদের উচিত প্রতিটা মুহুর্তে ধৈর্য ধরে সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাসী হওয়া। তিনিই পারেন সব সমস্যার সমাধান দিতে। এসব ছাড়,তোর খবর বল তো! হাতের বালাটার কাহিনি কিন্তু এখনো বলিস নি আমাকে?
বালাটার কথা শুনতেই মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেলো শ্রীতমার। মোহরের হাতটা ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। শুকনো গলায় বলল,
– এখন তুই বাড়িতে যা। এমনিতেই অনেক সমস্যা চলছে। এসব নাহয় সময় করে একদিন বলবো।
প্রিয় বান্ধবীর চোখ মুখের ভাষা, আর অভিব্যক্তি বুঝতে একটুও দেরী হলো না মোহরের। ও শ্রীতমাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
– ঠিকাছে। আমি জানি আমার শ্রী অনেক বুদ্ধিমতী। যা করবে ভেবেচিন্তেই করবে। তবে মন্দের চেহারা দেখে ভালো টাকেও ঠেলে দেওয়া কিন্তু বুদ্ধিমত্তার পরিচয় না।
ছোট্ট ইঙ্গিত টা হয়তো শ্রীতমাও বুঝতে পারলো। তবে সে বিষয়ে আর না বলে মোহর ওকে ছেড়ে বলল,
– সাবধানে ফিরিস। কেমন?
শ্রী ঘাড় নাড়ালো মৃদু হেসে। মোহর চলে গেলে ওর যাওয়ার পথে তাকিয়েই নিজের হাতটার দিকে তাকালো। সোনার বালা টা চকচক করছে। ওর ফর্সা হাতটার শোভাটা যেন দ্বিগুণ করে দিয়েছে। বালাটা খুলতে চেয়েও কি ভেবে ওভাবেই পড়ে রেখেছে, যতবার এর দিকে তাকাচ্ছে মাধুর্য নামের মানুষটার মমতা, মাতৃস্নেহটা যেনো কড়া ভাবে অনুভূত হচ্ছে ওর।
.
যেহেতু আজ অন্যদিনের তুলনায় হসপিটাল থেকে আগে আগে বেরিয়েছে তাই গাড়িটা আজ আসেনি, নাইবা মোহর জানিয়েছে আসার জন্য। রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে রিকশার জন্য অপেক্ষারত অবস্থায় চোখ গেলো অল্প দূরেই দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটর দিকে। মুচকি হাসলো মোহর। এগিয়ে গিয়ে পেছন থেকে ডেকে বলল,
– আজকে আমাকে এড়িয়ে গেলেন যে?
ফোনে মুখ গুঁজে থেকেও কণ্ঠস্বরটা কানে এলে না চাইতেও তাকালো তিয়াসা। মোহরকে দেখে ইচ্ছে করেই সরে দাঁড়িয়েছিলো। গাড়িটা এলেই এখান থেকে সরে বাঁচে, তবুও মেয়েটা দেখেই ফেললো ওকে। বিরক্তি ভরা মুখাবয়বে বলল,
– তুমি কে যে তোমাকে দেখে সালাম ঠুকে চলতে হবে
– সালাম তো অন্যদিনেও ঠুকেন না। তবুও আমাকে দেখলে দুটো তেতো কথা শোনার জন্য তো মুখিয়ে থাকেন। তবে আজ কেনো সালামের প্রশ্ন আসছে!
তিয়াসা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে তাকালো মোহরের মুখের দিকে। খিটমিট করে বলল,
– এই তোমার সমস্যা কি। আমি কি করবো না করবো সেটা তুমি বলার কে? শুনেছি বাড়িতে বিরাট ঝামেলা হয়েছে, সেসবই সামলাও আমি কি করছি সেটা না দেখলেও হবে।
শেষোক্ত কথাটুকু বলতে ক্রুর হাসলো তিয়াসা। মোহরও হাসলো। হাসি হাসি মুখেই বলল,
– হ্যাঁ সেটাই তো, যার জন্য ঝামেলা হয়েছে আপাতত সে গারদের ওপারে। তাই আপনাকে আগাম বার্তা দিতে এলুম। কান টানলে মাথা আসে জানেন তোহ। চা’বুকের ঘা পিঠে পড়লে কেও ই মুখ বুজে থাকবে না, সে যতটা অনুগতই হোক। আর আমি যতদূর জানি পার্টনারশিপে সবাই স্বার্থপর হয় অনুগত নয়।
তিয়াসার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে এলো। মোহর কিসের ইঙ্গিত দিলো। এসব ওকে বলতে আসা মানে ইন্ডাইরেক্টলি ওর দিকেই আঙুল তুলেছে মোহর। শুদ্ধ বাংলায় যাকে হুমকিই বলা যায়।
– এসব আমাকে কেনো বলতে এসেছ? নোমান তোমাদের ফ্যামিলি মেম্বার। ঝামেলা ও করেছে এখানে কান টানলে মাথা আসবে না চুল এসব আমাকে শুনিয়ে লাভ কি? শোনো আমি কোনো দু’টাকার মানুষ নোই যে, যে যা খুশি বলে দেবে। আমি ওয়াকিফ চৌধুরীর মেয়ে। আমার বাবার হাত কত লম্বা তোমার ধারণাও নেই।
মোহর এবার দুগাল এলিয়ে হাসলো। বেশ চমৎকার ভঙ্গিমায় বলল,
– আমি কিন্তু নোমানের নাম বলিনি অথচ আপনি নিজেই ওর দোষটা খুঁজে দিলেন। আর আমি আপনাকেও কিছু বলিনি,তবুও নিজের বাবার ক্ষমতার হাত শুনিয়ে দিলেন। তা শোনালেনই যখন একটা কথা বলে রাখা ভালো, আপনার বাবার হাত যে অনেক লম্বা সে আমি কেন শহরের অধিকাংশ মানুষই জানে, তবুও আপনার হাতটাতে ব্যান্ডেজের কাপড় টা এখনো আছে। গভীর ক্ষত তোহ ব্যান্ডেজ তো থাকবেই!
শেষের কথাটা বেশ আফসোসের ভাব দেখিয়ে বলল মোহর। এরপর তিয়াসা কিছু বলার আগে নিজেই বলল,
– ওইতো একটা রিকশা এসেছে। যাই, ভালো থাকবেন।
বলে রিকশা ডেকে চড়ে বসলো। কিছুক্ষণের মধ্যে চলেও গেলো অথচ তিয়াসা হা করে চেয়ে রইলো ওর যাওয়ার দিকে। কি বলে গেলো মেয়েটা! কিসের ইঙ্গিত দিলো? বেশ খানিকটা সময় ভাবনায় বুদ হয়ে রইলো তিয়াসা, এর মাঝেই ওর গাড়ি এসে পড়লে উঠে বসলো। একটা কথা ওর কানে এখনো বাজছে, মোহর তো ভুল কিছু বলেনি! ওর বাবার এতো ক্ষমতা থেকে কি হবে ওর হাতটা এসিডে ঝ’লসে মেহরাজ দিব্যি নিজের মতো বহাল আছে। অথচ ওর বাবাতো একবারও তাকে কিচ্ছুটি বলেনি। হাত পা ঠান্ডা হয়ে এলো তিয়াসার কোনো এক দুঃশ্চিন্তায়, হ্যান্ডব্যাগ থেকে ফোনটা বের করেই কানে ধরলো
•••
– কাকলি! এই কাকলি? কোথায় ঢুকে বসে আছিস? বেরিয়ে আই।
ভারী কণ্ঠের চিৎকারে কাকলি খাতুন ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এলেন। সাথে ছিল আম্বি আর মালা। বেরিয়ে এসেই কণ্ঠের মালিককে দেখে মুখটা কালচে হয়ে এলো। তবে উত্তর দেওয়ার আগে রুকাইয়া আবারও চ্যাঁচিয়ে বলল,
– আমার ছেলেকে বেধড়ক পি’টিয়ে গারদের ওপারে দিয়ে খুব আরামে এসির হাওয়া খাচ্ছিস তাই না? মুখ কালা কি আমার ছেলে একা করেছিল নাকি তোর মেয়েকে ধ’র্ষণ করেছে? তোর মেয়ের ইচ্ছে ছিলো না? তোর মেয়ের ছোক’ছোকানির জন্যেই তো হয়েছে এসব। কে বলেছিল ওকে আমার ছেলের কাছে যেতে?
তাথই দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নেমে এলো রুকাইয়া বেগমের বাজখাঁই গলার উচ্চস্বরে শুনে । পরিস্থিতি খুব একটা সুবিধার না দেখে যেভাবে এসেছিল ঠিক সেভাবেই ছুটে গেলো, নিচতলার কোণার ঘরটার দিকে।
– কি হলো উত্তর দে? আমার ছেলেকে কি পেয়েছিস তোরা। আজ ওর বাপ নেই বলে যা তা করবি? নিজেদের কাজে গাধার মতো খাটিয়ে আবার মেয়ের দোষ ঢাকতে ওকেই অ’ত্যাচার করেছিস?
– আপা আপনি একটু শান্ত হোন। এভাবে চ্যাঁচামেচি করবেন না।
– আমি চ্যাঁচামেচি করছি? আর তোরা যেটা করেছিস? আমার ছেলেকে আমার ফেরত চাই। তোদের সাহস কি করে হলো আমার ছেলেকে পুলিশে দেওয়ার। দিবিই যখন নিজের মেয়েকেও দে। আজহার ভাই কোথায়? আরহাম কোই? ডাক ওদের আমার ছেলেকে এই মুহুর্তে বাইরে দেখতে চাই আমি
রুকাইয়ার এহেন আচরণে দমে গেলেন আম্বি। কাকলি এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার সেও তেতে উঠে বললেন,
– আপনার ছেলে দোষ করেছে তাই জেলে গেছে। সাঞ্জে ওর বোনের মতো। এটা কি করে করলো ও?
– বোন হয় সেটা তোর মেয়ের মনে ছিলো না যখন ছ্যাচড়ার মতো আমার ছেলের পেছনে পড়েছিল!
– আমার মেয়ের নামে কুৎসা রটার আগে নিজের ছেলেকে দেখুন। ওর চরিত্র কেমন তা কমবেশি সবাই জানে। আর যদি চ্যাঁচ্যাঁতেই হয় তবে মেহরাজের সামনে গিয়ে চ্যাঁচামেচি করুন। কারণ ওকে মা’রধর ও মেহরাজ করেছে আর হাজতেও ওই পাঠিয়েছে
রুকাইয়া বেগম যেনো দিশেহারা হয়ে পড়েছে। ছেলের অবস্থা দেখে মাথায় খু’ন চড়েছে উনার। কি পেয়েছে টা কি! তার ছেলের একবিন্দু কষ্ট চোখে দেখতে পারেন না। আর সেখানে কি না সারা শরীরে ক্ষত নিয়ে ওই গারদে পড়ে আছে!
– কোই তোর মেয়ে কোই? ওকে ডাক! আমি ওকে এক্ষুনি পুলিশ স্টেশনে নিয়ে যাবো। ও নিজে মুখে বয়ান দেবে যে আমার ছেলে নির্দোষ।
বলে কারো কথার অপেক্ষা না করে ভারী শরীর টা নিয়েই দ্রুতপায়ে ছুটলো উপরে সাঞ্জের ঘরের দিকে। তাথই মাত্রই শাহারা বেগমকে নিয়ে বেরিয়েছিলো। রুকাইয়াকে ওভাবে ছুটতে দেখে ওউ পিছু পিছু ছুটলো।
– আপা আমাদের কথাটা শুনুন, সাঞ্জে কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। ওর শরীর খুব খারাপ
পেছন থেকে আম্বির হাঁকডাক কানে না নিয়ে ক্ষিপ্ত পায়ে ছুটলো ঘরের দিকে। সাঞ্জের একটু আগেই চোখ খুলেছে। উঠে আধশোয়া হয়ে হেলান দিয়ে বসেছে আর তক্ষুণি ধড়াম করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো রুকাইয়া। ওকে ধাতস্থ হবার সুযোগ টুকু না দিয়েই হড়বড়িয়ে বললেন,
– এই সাঞ্জে! এই তোর জন্য আমার ছেলেটা হাজতে গেছে। বল কি ক্ষতি করেছিল ও তোর? তুই তো নিজেই ওর পেছন পেছন ঘুরেছিস। কবে করেছিস এসব হ্যাঁ? আর যা করেছিস অবশ্যই তোর সম্মতিতেই তাহলে দোষ একা আমার ছেলের কেন হয়েছে? তুই তো আসল দোষী
বলে সাঞ্জের বাহু ধরে ঝাকাতে লাগলো। তাথই ছুটে এসে রুকাইয়াকে পেছন থেকে ধরে বলল,
– ওকে ছাড়ুর ফুফু। ওর সাথে এমন আচরণ করবেন না!
– ছাড় আমাকে। ওর সাথে এর চেয়েও খারাপ করা উচিত। নির্লজ্জ বেহায়া মা** তোর এতো ছোকছো’কানি বাপ মাকে বিয়ের কথা বলিস নি কেনো? আমার ছেলেটাকে ফাঁ’সিয়ে মা’রতে চাস?
বলে এক হাত তুললেও হুট করে পেছন থেকে শক্তপোক্ত একটা হাতের মুঠোয় আঁটকা পড়লো। তাথই ভেবে আবারও ঝটকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিতে গেলেও পেছন ঘুরে আসল ব্যক্তির চেহারা দেখে চোখ দু’টো যেনো আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। রাগে, রোষে নিজের হাতটা সজোরে ছিনিয়ে নিতে চাইলেও পারলো না। সজোরে চেপে রাখা মোটাসোটা হাতের কব্জিটা মোহরের হাতের শেকলে দৃঢ়ভাবে আঁটকা পড়েছে।
– ওর গায়ে হাত দেওয়ার কথা ভুলেও ভাববেন না
মোহরের শান্ত চেহারায় বলা শান্ত শব্দগুলো শুনে রুকাইয়া রোষানলে উদ্ভুদ্ধ হয়ে ক্ষ্যাপাটে সুরে বলল,
– তোমার সাহস কি করে হলো আমার হাত চেপে ধরার। ছাড়ো বলছি অসভ্য মেয়ে
বলে একটানে হাতটা সরিয়ে আনতে চাইলে এবার আরও ক্ষিপ্তভাবে চেপে ধরলো মোহর। তপ্ত গলায় বলল,
– আপনার আচরণই আঙুল তুলে দেখিয়ে দিচ্ছে অসভ্য কে। যার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আছেন তাদের সাথে এরকম দুঃসাহস দেখানোর সাহস কি করে হচ্ছে। নিজের চরিত্রহীন ছেলের হয়ে গলাবাজি করতে লজ্জা করছে না যার সে কি করে অন্যকে নির্লজ্জ বলে!
বলেই এক ঝটকায় হাতটা ছেড়ে দিলো। রুকাইয়া নিজের লাল হয়ে যাওয়া কব্জিখানায় হাত বুলিয়ে তীব্র ক্রোধে গর্জন করে বলল,
– খুব সাহস তাই না? বড়োলোক বাড়ির বউ হয়ে এসে বেশি বাড় বেড়েছে তোমার? সাঞ্জে কে তো দূর তোমাকে আমি আগে দেখে নেবো। তোমার জন্য এই মাস কয়েক আগেই আমার ছেলের হাত ভে’ঙে দিয়েছিল মেহরাজ। সেটা আমি ভুলিনি। শোধ আমি নেবোই। কড়ায় গন্ডায় উসুল করে নেবো
বলে আড়চোখে একবার কাকলির দিকে তাকিয়ে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে গেলো রুকাইয়া বেগম।
.
.
.
চলমান
©Humu_❤️