ফানাহ্ 🖤 #পর্বসংখ্যা_৫৯ #হুমাইরা_হাসান

0
703

#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৫৯
#হুমাইরা_হাসান
_____________

ফর্সা ধবধবে একটা চেহারা৷ পরনে একটা সাদা রঙের গাউন। বাদামী আর কালচে মিশেলের চুলগুলো বেণি করে রাখা। সরু নাক, ভাসা ভাসা চোখ, পাতলা ঠোঁট, ধূসর বর্ণের চোখ…সব মিলিয়ে অপরূপা নারীমূর্তি যেন। একবার দেখলে পুরুষের চোখ আরও একবার দেখবার বাসনা রাখতে বাধ্য। মেয়েটির কোলে পাঁচ বছরের একটা ছেলেসন্তান। কী নান্দনিক সে হাস্যজ্বল দুটো চেহারার দৃশ্য। একদম হুবহু প্রতিচ্ছবি যেন একে অপরের।
টুপ করে এক ফোঁটা জলকণা পড়লো মেয়েলী চেহারাটার উপর। সযত্নে, সহস্তে মুছে দিলো মেহরাজ কাঁচের ফ্রেমটা। খুব আদরে, ভালোবাসা পূর্ণ স্পর্শ মেলে অসংখ্যবার মায়ের ছবিটায় হাত বুলায়। ভীষণ অস্পষ্ট কণ্ঠে বলল,

– আম্মা! ও আম্মা! যানো আমারও একটা মানিক আসবে। খুব ছোট্ট, নরম তুলতুলে একটা প্রাণ। আমার এক পৃথিবী ভালোবাসার চিহ্ন বহন করে আসবে দুনিয়াতে। আমি, আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছিনা আম্মা। ডাক্তার যখন বলল যে আমার মোহ প্রেগন্যান্ট আমার,আমার তখন বুকের ভেতর কেমন করলো আমি কী করে বোঝাতাম বলো! কী করে বোঝাতাম, এই অনুভূতি প্রকাশ করার ভাষা তো আমার নেই আম্মা! তুমি বলো না, আমায় যখন কোলে তুলে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে আমার গালে অসংখ্য আদর মেখে দিতে সেইটা কী মুখে বলে ব্যাখ্যা করতে পারতে তুমি? বলো! তাহলে আমি কীভাবে করব! আমার তো…আমার তো…

মাথা টা তুলে সিলিং এ তাকালো। ঘাড়ের পেছনে সাইনাল কর্ডে হাত বুলিয়ে নিজের ভেতরের প্রবল উত্তেজনা গুলো সামলে নেওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু ভীষণ ভাবে ব্যর্থ হলো। আবারও ছবিটা হাতে নিয়ে বলল,

– আম্মা আমি বাবা হবো৷ আমার সন্তান, আমার অংশ আসবে দুনিয়াতে। আমি ভেবেছি ওর নাম তোমার নামে রাখবো। বাহার! যে আমার জীবনের সব দুঃখ গুলোকে ওর ছোট্ট পবিত্র ছোঁয়ায় খুশির বাহারে ভরিয়ে দেবে। দেবে না আম্মা! আমি ওর মাঝে তোমায় দেখবো। জানো আম্মা আমার খুব করে মনে হচ্ছে আমার একটা মেয়ে হবে। একটা জান্নাত আসবে আমার ঘরে। আমার মোহ সব অভিমান ভুলে আমার কাছে চলে আসবে। আমিতো ওকে ছাড়া একটুও থাকতে পারিনা আম্মা, তুমি বাদে আর কাওকে এতটা ভালো তো আমি কখনো বাসিনি যতটা ওকে বেসেছি। কেনো যে এতটা ভালোবাসলাম আমি জানি না, কীভাবে ভালোবাসলাম তাও জানি না। আম্মা আমি তো ওকে ছাড়া থাকতে পারিনা, কিন্তু ওকে বলতেও পারিনা। আমার বিশ্বাস এই বিধ্বংসী যন্ত্রণা, এই বিচ্ছেদ খুব শীঘ্রই সেরে যাবে। সব ঠিক হয়ে যাবে। তোমার রুদ্ধ সব ঠিক করে দেবে আম্মা সব৷ আমার মোহ আর বাহার কে নিয়ে আমি একটু শান্তিতে বাঁচতে চাই আর কিচ্ছু না।

তারপর খানিক দম নিয়ে বলল,

– আম্মা তুমি কী আগেই বুঝতে পেরেছিলে আমার জীবনটা এমন শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি গুলোতে টিকেই বাঁচতে হবে! তাই কী আমার নামটা রুদ্ধ রেখেছিলে? তুমি তো বাংলা বুঝতে না তাহলে কেনো রেখেছিলে? বাবার কথা শুনে? আম্মা তুমি কেনো সেদিন আমাকে ছেড়ে গেলে তুমি থাকলে তো আজ এত কিচ্ছু হতো না। আমি আজ এতবড় পাপের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে বয়ে বেড়াতাম না। যুগ যুগ আগে যে পাপ বাবা করে গেছে সেই পাপ তো আমাকেও ছাড়েনি আম্মা। অতীত কী কখনো পিছু ছাড়ে না! আমি মোহ’র সামনে দাঁড়াতে পারিনা আম্মা! ওর চোখ ভর্তি অভিযোগ, যন্ত্রণা। মেয়েটা বড্ড দূর্বল, মুখে যতই বলুক ঘৃণা করা ওর দ্বারা সম্ভব না তো। রোজ আড়ালে দাঁড়িয়েই আমায় দেখে যানো, কিন্তু সামনে আসেনা। আমিও যাইনা, যাবো ও না আপাতত। একটু থাক দূরে, এই কুমির ভরা খালে ওকে আনতে চাইনা।এখন তো আর একা না, আমাদের আরও একটা অংশ ও তো ওর সাথে মিশে আছে। এইখানে আনলে ওকে কখন কে ক্ষতি করে ফেলবে আমি যেই রিস্ক নেবো না।আমার মোহ’র গায়ে একটা ফুলের টোকা ও আমি সইতে পারবো না। তোমাকে হারিয়েছি ওকে হারাতে পারবো না আম্মা।

হাজারো অব্যক্ত অভিযোগ, আবেগ, অনুভূতি সবটা একে একে বলে মেহরাজ। মায়ের প্রাণহীন ছবিটার দিকে তাকিয়েই বলে। এতেই হয়তো শান্তি পাওয়া যায়! তাই তো বাইশটা বছর ধরে এই স্মৃতিটুকু আগলে রেখেছে।

•••

– এটাই মোক্ষম সময়, আপনারা চাইলেই এটাকে কাজে লাগিয়ে জিনিসটা হাতিয়ে নিয়ে পারেন

ওয়াকিফ চৌধুরী ভীষণ ব্যস্ত স্বরে বললেও আজহারের কোনো হেলদোল লক্ষ্য করা গেলো না। আরহাম একটা ফাইলে কলম ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন ,

– সম্ভব না। চেষ্টা করেছি। মেহরাজ এত নির্বোধ না যে ওর বউকে একা ছেড়ে দেবে আমাদের খপ্পরে ফেলার জন্য। পৃথক টুয়েন্টি ফোর সেভেন ওই বাড়ির আশেপাশে সিকিউরিটি রেখেছে, ওরা সিভিল লুকে পাহার দিচ্ছে একদম জনসাধারণের বেশে। ওই যে মোহর রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল সেটাও ওদের মোতায়েন করা লোকগুলোই খবর দিয়েছে ওদের৷

– আপনি কি করে জানলেন?

– জেনেছি কোনো ভাবে।

বলে হাতের ফাইলটা বন্ধ করে আরহাম সোজা হয়ে বসলো। টেবিল থেকে চায়ের কাপটা তুলে একটা চুমুক দিয়ে গলা কেশে বলল,

– ভাইজান। এবার আপনি একটু নড়েচড়ে বসুন। আর কত অপেক্ষা করবেন। যেটাকে সুচ ভেবে গিলেছিলাম সেটা ফাল হয়ে বের হচ্ছে। মেহরাজের নামে রেজিস্ট্রি করা সম্পদের এক ছিটাফোঁটা ভাগ আমরা পাইনি। বরং ওর বয়স হওয়ার পর থেকে ও নিজের মতো ব্যবসা গুছিয়ে নিয়েছে। ছোট বেলায় কথা বলেনা, কারো সাথে মেশে না কিছু শোনে না দেখে যাকে পাগল হয়ে গেছে ভেবে নিজেদের কার্যসিদ্ধি করার জন্য এনেছিলাম সেই এখন আমাদের ঘাড়ে পা দিয়েই নিজের কার্যসিদ্ধি করছে। ওকে বাপের নামের বাঁধ দিয়ে কতদিন আঁটকাবেন৷ এতদিন ও এসবে মাথা না দিলেও এখন দিবে, অবশ্যই দিবে। কারণ আগে ওর কিছু ছিলো না এখন পরিবার আছে

আজহার প্রসস্থ কপালে অসংখ্য ভাঁজ ফেলে বলল,

– তবে কী করতে চাচ্ছ?

– বাইশ বছর আগে যা করেছিলেন। সাপের বিষদাঁত গজানোর আগেই উপড়ে ফেলা উচিত এখন বিষদাঁত যখন হয়েই গেছে তাই সাপটাকেই সরিয়ে দিন রাস্তা থেকে।

– মানে..

– মানে মেহরাজকে রাস্তা থেকে স’রানোর সময় এসে গেছে৷ ওকে আর বাঁচ’তে দেওয়া যাবে না। একবার ওকে শেষ করে দিলে পেনড্রাইভ, প্রোপার্টি সব আমাদের। ব্যারিস্টার কী করে সে দেখে নেবো।

আজহার মুর্তজা প্রসারিত চোখে তাকিয়ে রইলো কয়েক মুহুর্ত। এমন নয় যে সেও এমনটা ভাবেনি, ভেবেছে এ কথা বহুবার। তবে বাস্তবায়ন করার মতন ও মনে হয়নি। এক মুহুর্তের জন্য আম্বির কথা মনে হলো। ওই মানুষটা বাইশটা বছর ধরেই মেহরাজকে আগলে রেখেছে, মেহরাজের জন্য কতশত আঘাত সহ্য করেছে। ও যদি কোনো ভাবে এই পরিকল্পনার কথা জানতে পারে তাহলে জান প্রাণ দিয়ে হলেও আঁটকানোর চেষ্টা করবে। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে আজহার তাকালো আরহাম আর ওয়াকিফ এর সকৌতুক চোখের দিকে মন্থর গলায় বলল,

– কী করবে তোমরা!

– সে সব আমাদের ঠিক করা হয়ে গেছে। আপনি শুধু নিজের মতামত টা বলুন। মুর্তজা সাহেব প্লিজ! এবার আর পিছপা হবেন না, এমন তো না যে পাপের ভয়ে থেমে যাচ্ছেন। এমন পাপে হাতদুটো নীলরঙা হয়ে গেছে আপনাদের। শেষ কাজটার জন্য আঁটকে যাবেন না!

আজহার কেমন একটা আতঙ্কিত চোখে তাকালো ওয়াকিফের দিকে। তার চোখ ভর্তি মানবতা,ন্যায়, মনুষ্যত্বের ছিটাফোঁটা অবশিষ্ট নেই শুধু আছে লোভ,ঔদ্ধত্য, দাম্ভিক্য। আসলেই লোভ মানুষকে কতদূর নিয়ে যায়! নিজের মনুষ্যত্বের কালো পট্টিবেঁধে নিজের ভেতরের পশু চরিত্র গুলোকে জাগিয়ে তোলে। ওয়াকিফ ওদের সাথে হাত মিলিয়েছে প্রায় বছর দশেক ধরে। যখন বিদেশ থেকে ফিরেছিল তখন মনে হয়েছিলো কা’লো সাম্রাজ্যটাকে বোধহয় ওখানেই ইতি টেনে দিয়ে এসেছে, তবে সে ধারণাকে ভুল করে আবারও শুরু হয় পা’পের লীলাখেলা। এদেশের বহু বড় বড় রাঘব বোয়ালেরা অনেক আগে থেকেই যুক্ত এসব কারবারে৷ যারা খুব গোপনে চালিয়ে যাচ্ছে টাকা হা’তিয়ে নেওয়ার সমস্ত জঘন্য কলাকৌশল। তখন থেকেই আবারও শুরু হয় ওদের কু’কর্মের অগাধ ক্ষমতা। তবে এখনো নামটা সেই আগেরই আছে। এই দেশে যেসব গুটি কয়েক মানুষ এসবে জড়িত তাদের মধ্যে মুর্তজা ব্রাদার্স এর নাম শীর্ষে, আর তাদের নামটা চলেই আব্রাহাম নামে।বহু আগে আব্রাহাম মাজহাব সেই ফাইলটার শিরোনামে নিজের নামটা বসিয়েছিলেন আজও সেই নামটাই চলে। শুধু সেই চলনের পায়া অন্যেরা। মাজহাবের নামটা একটা বৃহৎ মাপের সুবিধা মুর্তজাদের জন্য। নিজেদের সমস্ত কারবার এখনো সেই মানুষটার নামেই চালিয়ে যাচ্ছে যার অস্তিত্ব বহু আগেই মাটিতে মিশে গেছে। এমনিতে তো এসবের টিকিটার ও খোঁজ কারো জানার ক্ষমতার বাহিরে, আর জানতে পারলেও সবার আগে আব্রাহাম নামটাই আসবে। তাই তো আজও সেই নামটা বয়ে বেড়াচ্ছে আজও প্রত্যেক্ষ ভাবে সমস্ত দায়ভারের মালিকানা সেই ঘাড়েই চাপিয়ে রেখেছে।

•••

– আপনি কী আমাকে একটু মোহরের বাড়িতে ছেড়ে আসতে পারবেন?

অভিমন্যু গাড়ির চাবিটা হাতে তুলে ঘাড় ঘুরিয়ে এক পলক তাকালো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা শুভ্রতার পানে। হালকা মিষ্টি রঙের একটা সুতি শাড়ি পরনে। চুলগুলো পরিপাটি করে আঁচড়ানো, দেখেই বোঝা যাচ্ছে বের হওয়ার সমস্ত প্রস্তুতি সেরেই এসেছে। মুখটা ফিরিয়ে নিয়ে আবারও নিজ কাজে মনোযোগ দিলো অভিমন্যু। শ্রীতমার ললাটে আপনা আপনিই ভাঁজ পড়ে। অভিমন্যুটা বিয়ের পর থেকে একেবারেই কেমন পালটে গেছে, আগে যেমন পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া করার মতো ছিলো এখন ততটাই শান্ত আর এড়িয়ে যাওয়ার মতন ব্যবহার করে। শ্রীতমার তখন নিজেকেই ছোট মনে হয়, লোকটা কী জোর করে বিয়ে করে এনেছে ওকে দেমাগ দেখানোর জন্য!

– হসপিটালে যেতে হবে না?

নিজের ভাবনার মাঝেই অভিমন্যু হতে আসা প্রশ্নে সচকিত হলো। আগের মতোই সুবোধ্য কণ্ঠে জবাব দিলো,

– আজকে অফ ডে।

এতটুকু বলেই ক্ষান্ত হলো। দরজা থেকে সরে এসে বসার ঘরে সোফার উপরে বসলো। অভিমন্যুর সামনে আর দাঁড়াতে ইচ্ছে করলো না, ও বরং একাই যাবে৷ কোনো দরকার নেই ব’জ্জাত টার সাথে যাওয়ার।

– মুখটা এমন শুকনো করে রেখেছিস কেনো শ্রী?

– কিছুনা মা।

– কিছুনা মানে কী। সকাল করে রেডি হলি যে! কাল যে বললি আজ হসপিটালে যাওয়া নেই?

শ্রীতমার পাশে রুটির প্লেট টা রেখে জিগ্যেস করলেন মাধুর্য ব্যানার্জি। শ্রীতমা শুকনো মুখেই বলল,

– মোহরের কাছে যাবো একটু মা। ওর শরীর টা একদম ভালো নেই।

– যাবি বৈকি। কিন্তু না খেয়ে একদম বের হতে দেবো না।

শ্রীতমা তীব্র অরুচি দেখিয়ে জবাব দিলো,

– থাক না মা, আজ একটুও খেতে ইচ্ছে করছে না।

– করছে না বললে হবে না। এমনিতেই পাতলা শরীর, না খেয়ে শেষে রোগ বাঁধাবি তো। চুপ করে বোস।

বলে একটা প্লেটে ভাজি তুলে রুটিতে পুরে শ্রীতমার মুখের সামনে ধরলো। শ্রীতমা অনিচ্ছা সত্ত্বেও তা খেয়ে নিলো। কারণ সামনে বসে থাকা মা জননীটি তাকে এক বেলায় না খাইয়ে ছাড়বেন না। শ্রীতমা মাঝে মধ্যে বেশ অবাক হয়, বিশ্বাস হতে চাইনা যে এতো অকৃত্রিম ভালোবাসা, স্নেহ ওর জন্য ছিলো। এই দুটো মানুষের প্রাণভরা ভালোবাসা, আদর আর স্নেহ ওকে এক অন্যরকম মায়াডোরে বেঁধে রাখে যা ওকে ক্ষণে ক্ষণে ওর সমস্ত অপ্রাপ্তি গুলোকে ভুলিয়ে দেয়। তাই তো ওর কাছে রাস্তা থাকলেও ও ফিরে যাইনি। যেই বিয়েটা অভিমন্যু ওকে জোর করে করেছিল তার জন্য এখন মনে মনে নিজের অজান্তেই শুকরিয়া জ্ঞাপন করে ভগবানের নিকট। তা না হলে এই ভালোবাসা আদরটুকু কোথায় পেতো ও!

– চলো

খাওয়া শেষ করে বসেই ছিলো। অভিমন্যু ঘর থেকে বেরিয়ে শ্রীতমাকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলতেই ও উঠে দাঁড়ালো। এতক্ষণ একা যাওয়ার চিন্তা ভাবনা করলেই এখন আর ইচ্ছে হলো না। এগোনোর জন্য পা বাড়ালেই রান্নাঘরের দিক থেকে ডাক এলো,

– যাবি ক্ষণ। একটু দাঁড়া।

মাধুর্য ব্যানার্জির ডাকে শ্রীতমার সাথে অভি ও দাঁড়ালো। মিনিটের মাথায়ই ভদ্রমহিলা সহাস্য মুখে বেরিয়ে এসে শ্রীতমার হাতে একটা কাঁচের বয়াম ধরিয়ে দিয়ে বললেন,

– এইটা নিয়ে যা। মেয়েটার শরীর টাও তো ভালো না। এই সময় আচার খাওয়ার ভীষণ ঝোঁক হয়৷ পরশুই বানিয়েছিলাম চালতার আচার ওকে দিস।

শ্রীতমা এমন নিঃস্বার্থ মাতৃস্নেহ দেখে আপ্লূত হয়ে পড়লো। এক হাতে বয়ামটা ধরে আরেক হাতে জড়িয়ে ধরে বলল,

– আমার মাঝে মধ্যে স্বপ্ন মনে হয় জানো। আমার বিশ্বাস ই হয়না তোমার মতো একটা মা পেয়েছি আমি। ভগবান আমার এক জীবনের সমস্ত প্রাপ্তিকে তোমাদের চেহারায় পাঠিয়েছেন।

মাধুর্য ব্যানার্জি শ্রীতমাকে জড়িয়ে ধরে ওর কপালে চুমু দিয়ে অতঃপর বিদায় দিলেন৷ নিচে এসে দুজন গাড়িতে বসলে চলতে আরম্ভ করলো। বেশ কয়েক মিনিট নীরবতা কাটিয়ে শ্রীতমা নিজেই প্রশ্ন করলো,

– আপনাকে একটা প্রশ্ন করব। সত্যি সত্যি উত্তর করবেন?

– বলো।

শ্রীতমা অবিলম্বেই কোনো প্রকার ভনিতা ছাড়াই বলল,

– মেহরাজ দাদার সাথে জড়িত এইসব ঘটনা আপনি জানতেন? আপনি জানতেন যে মোহরের বাবার মৃত্যু আর..

– সাট আপ! না জেনে বুঝে কার বিষয়ে কথা বলছো! কত বছর ধরে চিনি আমি স্যারকে। কখনো ওনার দ্বারা কোনো খারাপ কাজ হবে এমনটা ভাবতেও পারিনা আমি। ওনাকে যে কাছ থেকে দেখেছে শুধুমাত্র সেই জানে মেহরাজ স্যার কেমন মানুষ।

এই অবস্থানে দাঁড়িয়ে শ্রীতমার এই প্রশ্নটা করা খুব অস্বাভাবিক না হলেও অভিমন্যুর এমন রেগে যাওয়া ওর বোধগম্য হলো না। মুখটা কালো করে বলল,

– তাহলে কেনো তার নামে এসব প্রমাণ সামনে এলো। কেনো তার জন্য আমার মোহরকে এতো কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে বলুন?

– অনেক সময় আমরা এমন সব সিচুয়েশনের মধ্যে পড়ে যায় যেখানে দাঁড়িয়ে কোনটা ভুল কোনটা সঠিক সেটা নির্বাচন করা খুব কঠিন হয়ে যায়, সত্য গুলোকেও মরিচীকা আর মিথ্যেকে অকাট্য সত্য মনে হয়। কিন্তু আসলেও সেই সত্য বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে, আপেক্ষিক দৃষ্টির আড়ালেও অনেক কিছু থেকে যায়।

আর কোনো প্রশ্ন বা উত্তর হলো না। শ্রীতমা চুপ করে রইলো।এতসব প্যাঁচগোজ ওর সহজ সরল মাথায় ঢোকে না। ওর শুধু একটাই চাওয়া মোহরটা যেনো আগের মতো খুশি থাকে, সব ভুল গুলো সর যাক পাপ গুলো ধুয়ে যাক। শুধু মোহর আর তার ভালোবাসা ধ্রুব হয়েই থাক।

•••

– আমি বুঝছি যে আমার ওপর অনেক ক্ষোভ, অভিমান জড়ো হয়েছে তোমার মনে, তবুও একবার আমাকে আগের মতো ভরসা করো মোহর,প্লিজ!

নির্লিপ্ত চোখ মেলে তাকিয়ে আছে মোহর। মুখাবয়বে অভিব্যক্তি স্পষ্ট নয়। এইখানটাতে আসার একদম ইচ্ছে ছিলো না ওর৷ বাড়িতে বসে থাকলে ভালো লাগবে না বলেই হসপিটালে এসেছিল কাজের মাঝে নিজেকে ব্যস্ত রাখার তাগিদে। কিন্তু সেখানেও মন টেকে না, ভেতরটা কোনো ভাবেই শান্ত করা যায় না। ডিউটি শেষ করে ফিরছিলো, রাস্তায়ই দেখা পৃথকের সাথে। সেই ওকে অনুরোধ করে এনেছে এখানটায়।

– আমি জানি তোমার মনে অনেক রাগ,অভিমান, প্রশ্ন দুঃখ সবটাই জমে আছে। কিন্তু বিশ্বাস করো আমরা পরিস্থিতির সামনে বাধ্য। আমি চাইলেও এখন..

– আপনি সবটাই শুরু থেকে জানতেন?

নিজের কথাটাকে সম্পূর্ণ করতে পারলো না পৃথক মোহরের কথার তুবড়িতে৷ খানিক থতমত খেয়ে তাকিয়ে পরক্ষণেই স্বাভাবিক চিত্তে বলল,

– হ্যাঁ।

– আপনি জানতেন রুদ্ধর আসল পরিচয়, আমার সাথে জড়িত সকল ঘটনা?

– হ্যাঁ

আবারও সম্মতি সূচক ঘাড় নাড়িয়ে জবাব এলো পৃথকের নিকট হতে। মোহরের ভেতরটা আড়ষ্টতায় ভরে গেলো। এতগুলো মানুষ ওকে এগুলো লুকিয়েছে! কেও একটা বার ওকে সত্যটা জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি?

– আপনাকে তো আমি সত্যিই নিজের ভাইয়ের জায়গাটা দিয়েছিলাম।আপনিও আমাকে ঠকালেন! যাকে বোন বললেন তাকে এতোদিন অন্ধকারে কেনো রাখলেন?

পৃথকের মুখটায় বেদনাময় ছাপ ভেসে উঠলো। এর জবাবে কিই বা বলবে ও!

– মোহর আমি তোমায় সত্যিই নিজের বোনের স্থান দিয়েছি, ভাইয়ের মতই ভালোবাসি। তাই আমি আজ সব বাঁধা সত্ত্বেও এসেছি তোমার সাথে কথা বলতে৷ প্রথমত তুমি যেই পরিস্থিতি দিয়ে পার হচ্ছিলে সেখানে দাঁড়িয়ে তোমাকে সবটা বলা সম্ভব ছিলো না। তোমার বাবাকে সরিয়ে ওদের মূল লক্ষ্য ছিলে তুমি। তাই তোমার ওপর একাধিক বার আ’ক্রমণ হয়েছে। আমি তখন দেশের বাহিরে। এতসব তথ্য বা ক্ষমতা কোনোটাই আমার হাতে ছিলো না। যতদিনে আমি জায়গা মতো দাঁড়িয়েছি ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গেছে। তুমি একটা সুস্থ জীবন শুরু করেছ, আবারও তোমাকে সেই সব জঘন্য অতীতে পেঁচাতে চাইনি আমরা!

– কোন অতীত থেকে দূরে রাখার কথা বলছিলেন ভাইয়া! যেটা সবসময় আমার সাথেই ছিলো! আমি কী এতটুকু বিশ্বাসযোগ্য না! যাকে ভালোবেসে নিজের সমস্ত দুঃখ গুলোকে আমি ভুলে গিয়েছি তার দেওয়া কষ্ট আমি কী করে সহ্য করবো? আমি তো ভয়ংকর গোলকধাঁধায় আঁটকে গেছি কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যে কোনোটাই বুঝছি না আর নাইবা আপনারা আমাকে বুঝতে দিচ্ছেন! কেনো সবটা আড়াল করছেন এখনো? আমি জানতে চাই আসল সত্যটা কী? রুদ্ধর বাবা যেটা শুরু করে গিয়েছিলেন সেটা এখনো চলমান, তাতে কী তার ছেলেও জড়িত?

শেষোক্ত কথাটুকু বলতে কণ্ঠনালী কেঁপে উঠলো প্রচণ্ড রকম ভাবে। চোখের পানি গুলো উপচে পড়তে চাইলেও আঁটকে নিলো মোহর। ভীষণ কাবু গলায় বলল,

– কোনো না কোনো ভাবে মনের ভেতর এখনো আশা পুষে রাখি হয়তো সবটা ভুল প্রমাণিত হবে। আমার বাবা যেসব রেখে গেছে তা হয়তো ভুল! আমি যেই মানুষটাকে ভরসা করেছি সে হয়তো মিথ্যে নয়! এখনো এই আশায় আমি পথ চেয়ে আছি যে লোকটা এসে আমায় সমস্তটা বলবে, কিন্তু কোথায় সে? কেনো আসছে না, তাহলে কী আমি যেটা দেখছি সেটায় মেনে নেবো?

পৃথক জবাব করবার আগে অপরাধীর মত করে মোহরের মুখে তাকালো। সত্যিই কষ্ট হচ্ছে, খুব! অকৃত্রিম ভালোবাসার গুলোর সত্যতা যেমন গভীর তার বিরহ বেদনাও তেমন প্রবল। দুপাশে দুজনকে দেখে পৃথক নিজেও কষ্ট পাচ্ছে। কিন্তু…

– মেহরাজ আসবে মোহর, ওর সবটা ও ফিরিয়ে নেবে। একটু সময় দাও ওকে। এ ছাড়া আর কিচ্ছু বলার ক্ষমতা আমার আপাতত নেই।

ফ্যাকাসে, পাণ্ডুর মুখটায় চোখ দু’টো বুজে ঘাড় এলিয়ে দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে আছে মোহর। রাত প্রায় এগারোটা, মিথিলা ইফাজ মাত্রই নিজ ঘরে ফিরেছে। শ্রীতমা সকালে এসেছিল ওকে না পেয়ে অপেক্ষাতেই ছিলো। দুপুরের পর মোহর বাড়িতে ফিরলে সারাটা বিকেল থেকে সন্ধ্যা অব্দি ওর সাথেই ছিলো। কিন্তু অস্থির মনটায় কোনো কিছুই ওর ভালো ঠেকছে না। ভেতরের প্রবল উৎকণ্ঠা, উন্মাদনা ওকে স্থির হতে দিচ্ছে না কোনো ভাবেই৷ মুখের উপর থেকে হাতটা নামিয়ে পাশে তাকালো। মিথিলা ওর সেলফোন টা রেখে গেছে ওর কাছে, নিজের ফোনটা তো ও বাড়িতেই ফেলে এসেছে।
বহুক্ষণ নিজের ভেতরের বাড়তে থাকা অস্থিরতা, মনস্তাপে দগ্ধ হৃদয়ের ব্যাকুলতায় হার মেনে ফোনটা হাতে তুলে নিলো মোহর। এগারো ডিজিটের নাম্বার টা তুলতে প্রায় আধ ঘন্টা সময় লাগিয়ে ফেললো। অবশেষে তীব্র বিতৃষ্ণায় অস্থির মনটা দুর্বোধ্য কাজটা করেই বসলো। সেলফোনের যান্ত্রিক শব্দটা এক দুই করে বেজে কেটে গেলো। মোহর আবারও চেষ্টা করলো, এবার অপেক্ষার পাল্লা টা দীর্ঘ না করে ফোনটা রিসিভড হলো ওপাশ থেকে। বুকের ভেতর চলমান অতিষ্ট দাবানলে জ্বলন্ত কণ্ঠনালীটা যেনো এই মুহূর্তে চরম বেইমানি করে স্তব্ধ হয়ে গেলো। চাইতেও কোনো শব্দের উৎপত্তি ঘটাতে পারলো না মোহর, নাইবা ওপাশ থেকে উত্তর এলো। সহস্রাধিক বি’ক্ষোভকারী অস্থিরতাকে গলাধঃকরণ করে সর্বোচ্চ চেষ্টায় পোড়োবাড়ির ন্যায় নিস্তব্ধতা ভেঙে কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে পুরুষোচিত ভরাট গলার ক্ষীণ স্বর শুনতে পেলো,

– মোহ!

দু চোখ খিঁচিয়ে নিয়ে পরনের জামা টা সর্বশক্তি দিয়ে খামচে ধরলো মোহর। একটা কণ্ঠের ছোট্ট শব্দটা যেনো ওর জলন্ত অগ্নিশিখাময় বুকটাতে শৈথিল্যের বাঁধ ভেঙে দিলো। এ যেনো দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের হীম শিথিলতা। নিঃশ্বাস রূপে চলমান টর্নেডোয় ক্লান্ত মোহর আবারও শুনতে পেলো প্রিয় কণ্ঠের শব্দ,

– আর কতো চুপ করে থাকবেন মোহ!

মোহরের ঠোঁট, জিহ্বা যেনো তীব্র রকম জেরোস্টোমিয়ার প্রকপে শুকিয়ে কাঠকাঠ হয়ে গেলো। অবশেষে দূর্বল স্বরে বলল,

– একবার আসবেন রুদ্ধ? আমার কাছে একটা বার আসবেন প্লিজ!

ওই কণ্ঠে কী ছিলো জানা নেই। মেহরাজের ভেতরের তোলপাড় যেনো সর্বাঙ্গে দংশ’ন করলো। তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়িয়ে ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে অস্থির গলায় বলল,

– আসছি মোহ, আমি এক্ষুনি আসছি।

ফোনটা পকেটে ঢুকিয়েই প্রচণ্ড বেগে ছুটে বাহিরে এলো মেহরাজ৷ যেনো বৈদ্যুতিক গতি ভর করেছে শরীরে। প্রাণপ্রিয়ার একটা ডাক ওর প্রাণ সমতূল্য। অন্তরে পুষে রাখা দাবদাহ গুলো ওকে একটু স্থির হতে দিলো না। প্রচণ্ড উৎকণ্ঠায় আবিষ্ট মেহরাজ গাড়ি বের করেই ছুটিয়ে নিলো দাপটের সহিত, যেনো গাড়িটা শান্তস্থির হিংস্র রক্ষীর মতন ওর হুকুমের অপেক্ষাতেই ছিলো, আদেশ পেয়েই ছুটলো বাতাস ধুলো উড়িয়ে।
বাড়ি থেকে কয়েক মিটার পেরিয়ে মেইন রোড ছেড়ে একটা অন্যরাস্তা ধরলো মেহরাজ। সামনেই তিনি রাস্তার মোড়, সেটা পার করলেই দূরত্ব আর কয়েক মিনিটের, এইটুকু ধৈর্য যেনো সহ্য হচ্ছিলো না। প্রচণ্ড স্পীডে ছুটন্ত গাড়িটা হয়তো ঘুনাক্ষরেও টেও পাইনি ওর মোড় নেওয়া দেখে দিক পালটে অনেক আগেই একটা দানবীয় শক্তি অপেক্ষা করছে মোড়ের ধারেই। মোড়ের উপরে ওঠবে ঠিক সেই মুহুর্তেই বাঁয়ের রাস্তা থেকে একদম ওর মার্সিডিজের গতির মতোই ছুটে এলো একটা বিশালাকৃতির ট্রাক। মেহরাজ আলোর উৎস দেখে পাশ ফিরে তাকানোর আগেই প্রচণ্ড বেগে ছুটে এসে ট্রাকটা এক ধাক্কায় উড়িয়ে দিলো কালো রঙের কার গাড়িটা। গাড়ির ভেতরেই প্রবল ধাক্কায় বিরতিহীন বা’রি খেয়ে জানালার কাঁচটা ভেঙে ঘাড়ের পেছনটায় বিঁধে গেলো মেহরাজের, একদম রাস্তার মাঝ বরাবর ছিটকে পড়লো ব্যাপক শব্দের সৃষ্টি করে, সীটবেল্টে আঁটকানো শরীর টা উলটে চাপা পড়ে রইলো গাড়ির ভারে। কয়েক মুহুর্ত একদম সুনশান নিস্তব্ধতা, এর মাঝেই রাস্তার সোডিয়াম আলোয় চিকচিক করে উঠলো গাড়ির ভেতর থেকে ক্রমশ বহমান টাটকা রক্তের স্রোত। খোলা চোখটার ঝাপসা দৃষ্টি ক্রমেই গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে থাকলো, অকল্পনীয় ভাবে চোখের সামনে ভেসে উঠলো মোহরের হাসিমুখ, ওর কান্নারত চোখ আর খুব অদ্ভুত রকম একটা দৃশ্য। ছোট্ট একটা মেয়েসন্তানের অস্পষ্ট চেহারা। মেহরাজ নিস্তেজ, নিশ্চল শরীর টা একচুল নাড়াতে পারলো না, বাঁচার জন্য প্রাণপণে লড়াই করার সামর্থ্য টুকু খুইয়ে অস্পষ্ট ভাবে রক্তে জবজবে ঠোঁট নাড়ালো,

– আমার মো…হ্

.
.
.
চলমান

#Humu_❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here