ফানাহ্ 🖤 #পর্বসংখ্যা_৬২ #দ্বিতীয়_খণ্ড #হুমাইরা_হাসান

0
734

#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৬২
#দ্বিতীয়_খণ্ড
#হুমাইরা_হাসান

বিলাসবহুল, আভিজাত্যের ছোঁয়ায়পূর্ণ ফ্ল্যাট’টা জুড়ে হাসি,কলরবের ধ্বনি-প্রতিধ্বনিতে ঝলমলে পরিবেশ জুড়েছে। কতশত মর্মবেদনাময় প্রহর গুলো পেরিয়ে আজ যেন খুশিয়াল মুহুর্ত গুলো শিউলি ফুলের মতো ফুটেছে। মোহর আর মেহরাজের ঘর জুড়ে আজ আপন মানুষ গুলোর আমেজ। যারা ওদের ভালো মন্দের প্রতিটা মুহূর্তে, ক্ষণে ক্ষণে আগলে রেখেছে। পাশে থেকে ভালোবেসেছে, ওদের সুখে দুঃখে নিজেদেরকে সামিল করেছে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে শুভকামনা,দোয়া প্রার্থনার বুলি আউড়েছে। ইফাজ-মিথিলা, অভিমন্যু-শ্রীতমা, পৃথক-তাথই, সাঞ্জে সক্কলে মিলে আজ মৌজ-মস্তির আসর বসিয়েছে।
সময়টা জানুয়ারীর মাঝামাঝি, গায়ে কাটা ফোটানো হীম এখন শূলের মতো বিঁধে৷ মোহর গায়ে খয়েরী রঙের একটা শাল জড়িয়ে বসে আছে। ওর পাশটা জুড়িয়ে বসেছে সাঞ্জে,শ্রীতমা। মিথিলা আর তাথই মিলে খাবারের গোছগাছ করছে। ছেলেরা বসার ঘরটায় বসে আছে নিজেদের আড্ডা-আলোচনাতে মশগুল হয়ে।

– আচ্ছা ভাবী কুচুপু টা কী পেটের ভেতর নড়াচড়াও করে?

– আরেকবার এসব উদ্ভট নামে ডাকলে তোর কানের কাছে গরম বাতাস পড়বে সাঞ্জে

নিজের জবাবে এহেন ধমকানিতে ভ্রু যুগল না চাইতেও কুচকে এলো। মন ছোট করে ফেললো। ও তো মোহর কে জিগ্যেস করেছিলো তাথই টা এভাবে না বকলেও পারতো!

– থাক না। ওই তো! বলুক

– কোনো দরকার নেই রে শ্রী এসব উল্টো পালটা নামে ডাকার। তোয়াটাকে ও চমচম বলে ডেকে এমন অবস্থা করেছে এখন তোয়া বললে শোনে না ওকে চমচম বললেই রেসপন্স করে।

যেন বড়সড় একটা অভিযোগ করে বসলো তাথই। শ্রীতমা প্রত্যুত্তরের বদলে ফিক করে হেসে দিলো। সাঞ্জে নিজেও হেসে উঠলো গাল টিপে। তাথই মোহরের হাতে পায়েসের বাটিটা ধরিয়ে দিয়ে বলল,

– তোমার না পায়েস খুব পছন্দ, তার জন্যেই তো করে এনেছি,নাও।

বলে একটা বাটি মোহরের হাতে ধরিয়ে বাকি দুটো সাঞ্জে আর শ্রীতমাকে দিয়ে আবারও বেরিয়ে গেলো। রান্নাঘর তখন ফাঁকা। মিথিলা গেছে ছেলেদেরকে দিতে৷ তাথই একা একা বাসন গুলো সাজাচ্ছিল। ব্যস্ত হাতটা থালগুলো সাজাতে সাজাতে হুট করেই থমকে গেলো, অপ্রতিভতা সামলাতে চোখ দু’টো বুজে এলো৷ পরক্ষণেই নিজেকে সামলে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে বলল,

– ছিহ। দিনদিন দামড়া হচ্ছে আর জ্ঞান বিবেক সব লোপ পাচ্ছে

পৃথকের হাসিহাসি মুখটা নিমিষেই আধার হয়ে গেলো। তাথইকে অপ্রস্তুত করে দিয়ে যতটা মজা পাচ্ছিলো এখণ ঠিক ততটাই হতবিহ্বল হয়ে গেলো। বেশ ভার গলায় বলল,

– দামড়া? এটা আবার কেমন ভাষা! তুমি এসব আমাকে বলছ? আমি দাম..

শব্দটা যেন খুব নিন্দনীয় ঠেকলো পৃথকের নিকট। পুরোটা বলতে গিয়েও থেমে গেলো। তাথই কপালে মোটা ভাঁজ ফেলে বলল,

– শুধু দামড়া’ই না বুড়ো ও

– কিসব বলছ আশু! আমাকে কোন দিক থেকে বুড়ো মনে হয় তোমার? কত্ত হ্যান্ডসাম আমি। এখনো মেয়েরা আমাকে দেখে ফিদা হয় জানো? এই তো সেদিনও রেস্টুরেন্টে একটা মেয়ে প্রপোজ করে বসলো।

বাঁকা হেসে কথাগুলো বলতেই তাথই চরম অবজ্ঞা করে বলল,

– এ্যাহ! এসেছে হ্যান্ডসাম। ত্রিশের কোঠা তো আজ পেরোয়নি। কদিন বাদে মনে হয় চামড়া গুলোও কোঁচকাবে।

তাথইয়ের কথাগুলো শুনে পৃথক নিজের গালে অবিন্যস্ত হাত বোলালো। ওর বিভ্রান্ত চেহারাটা দেখে তাথই খুব মজা পেলো মনে মনে। অন্যদিকে ফিরে মুখে হাত চেপে হেসে সরে যেতে নিলে পৃথক খপ করে ওর হাতটা চেপে ধরে বলল,

– যাচ্ছো কোথায়? আর কত যাবে হু! তোমার অপেক্ষায় থেকে থেকেই আমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। বুড়ো বলে খোটা দিচ্ছ আর বুড়োকে সামলানোর জন্য আসতে পারছ না?

– কোথায় আসব?

– আমার কাছে

– কেনো যাব?

– ভালোবাসতে

পৃথকের লাগামহীন কথার শেষ জবাবটি আর দিতে পারলো না তাথই। মুখ জুড়ে লজ্জার প্রলেপে ঢালা পড়লো কপট দেখানো রাগ গুলো। পৃথক মাঝামাঝি দূরত্ব ঘুচিয়ে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বলল,

– ওদিকে দ্যাখো! সবাই সবার নিজের মানুষ গুলোকে নিয়ে আছে। সবাই কাছাকাছি, পাশাপাশি, সাথে-সাথে আছে। অথচ আমি তুমি দূরে দূরে। আর কতো অপেক্ষা করাবে! চলো না বিয়ে করি,আমার আর এই দূরত্ব ভাল্লাগে না আশু!

যেমন ছোট্ট বাচ্চা খেলনার জন্য আবদার করে। যেই আবদারে অনুরোধ, অনুনয় নয় বরং থাকে তীব্র অধিকারবোধ আর নিজের পাওনা টা অর্জন করে নেওয়ার উৎকণ্ঠা – ঠিক সেভাবেই যেন নিজের অধিকার টা নিজের বাহুডোরে গুটিয়ে নেওয়ার আবদার রাখলো পৃথক ও। তাথই লজ্জা,জড়তা,ভালোবাসা মিশ্রিত ছলছল চোখে তাকালো পৃথকের দিকে। যে চোখের ভাষা বড্ড স্পষ্ট, সুবোধ্য। পৃথক ওর গালে হাত রেখে বলল,

– কতশত বাঁধা পেরিয়ে আমরা আজ সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে। চলোনা এক হয়ে যাই। আমি তুমি আর আমাদের মেয়েটাকে নিয়ে। আর দেরী কোরোনা আশু!

চোখ ভরে আসে নোনাপানিতে,প্রাণপণে আড়াল করতে চাই তাথই। পৃথকের মুখটার দিকে তাকিয়ে যতটা অবাক হয় ততটাই ভালোবাসা, মুগ্ধতায় অভিভূত হয়। মানুষটা নিজের যোগ্যতায়, কত প্রতিদ্বন্দ্বিতা সামলে আজ নিজের স্থানটা উচ্চে নিয়েছে, পাকাপোক্ত করেছে অথচ মানুষটার মধ্যে কোনো অহমিকা নেই নাইবা আছে কোনো দাম্ভিকতা। শত ব্যস্ততা সামলেও নিজেকে জানপ্রাণ দিয়ে উজাড় করে দিচ্ছে, প্রতিটা প্রতিকূলতাকে নিজের আপন মনে করে ঢাল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। লোকটা যেই স্থানে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে চাইলেই ওর চেয়ে হাজারো গুণ ভালো, প্রতিষ্ঠিত, সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করে নিতে পারে। সেখানে ও কী না পড়ে আছে একটা ডিভোর্সি মেয়ের জন্য যার কিনা বছর খানেকের একটা মেয়েও আছে! তাথই নিজের অজান্তেই ভালোবেসে ফেলে৷ প্রতিবার আরও বেশি করে ভালোবেসে ফেলে মানুষ টাকে। আবেগান্বিত হয়ে পৃথককে জড়িয়ে ধরলো তাথই খুব আকস্মিক ভাবেই। স্তম্ভিত পৃথক স্মিত হেসে আলতো ভাবে হাতখানা রাখলো তাথই এর পিঠে।

– আশ্চর্য! কী শুরু করেছ ইফাজ? এভাবে পিছু পিছু ঘুরছ কেন?

– আজকে না তোমাকে একটু বেশিই সুন্দর লাগছে মিথি, ইচ্ছে হচ্ছে আরও একবার বিয়ে করে বাসর…

বাকিটুকু বলার আগেই সামনের দৃশ্যে চোখ পড়লে অকস্মাৎ পা থামিয়ে খপ করে মিথিলার হাতটা চেপে ধরলো। মিথিলা রাগান্বিত চোখে তাকালেও ইফাজের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকিয়ে চোখ খিঁচিয়ে নিলো। খুব একটা অপ্রীতিকর অবস্থায় দুজন উপস্থিত হয়েছে ব্যাপার টা বুঝতে পেরেই ইফাজ মিথিলার কোমরের ফাঁকে হাত দিয়ে পেঁচিয়ে ওকে সরিয়ে আনলো। মিথিলার দুহাত জুড়ে কাপের ট্রে। তাই চাইলেও ছাড়িয়ে নিতে পারলো না। পৃথক-তাথই ওদের এহেন মুহূর্তে অন্যদুটো মানুষের আগমনের কিঞ্চিৎ আভাস পাওয়ার আগেই সরে এলো ।

– ছাড়ো, ইফাজ ছাড়ো বলছি!

– চুপ! কথা বোলো না।

ইফাজ রান্নাঘর থেকে দূরে পাশেই একটা বারান্দার দিকে নিয়ে ওকে দাঁড় করিয়ে বলল,

– নিজে তো বর কে সময় দিচ্ছ না। অন্যরা প্রেম করছে সেসবেও বাগড়া দিতে হবে।

মিথিলা কপট রাগ দেখালেও কিছু বলল না। ইফাজ মিথিলার অপ্রস্তুত চেহারাটা দেখে মুচকি হেসে গালটা এগিয়ে ছোট্ট একটা চুমু দিয়েই সরে এলো। মিথিলা ঘরে এসে মোহরের পাশটায় বসলে মোহর বলল,

– বুবু উনি কোথায়?

– কে?

মিথিলা যেন বুঝেও বুঝলো না মোহরের ইঙ্গিত। অবুঝের ন্যায় প্রশ্নটা করে বসলো। মোহর আবারও বলবে তন্মধ্যে সাঞ্জে বলে বসলো,

– আরে কুচুপুর বাবার কথা বলছে ভাবী। বুঝছ না সেই উনি!

সাঞ্জের কথার ধরণ আর বলার সুরে উপস্থিত মানুষ গুলো হেসে ফেললো সশব্দে। মোহর মুচকি হেসে আস্তেধীরে নড়েচড়ে খাট থেকে নামতে লাগলে শ্রীতমা জিগ্যেস করলো,

– কোথায় যাস?

– তার ওষুধ খাওয়ার সময় হয়েছে। হাতে করে না দিলে তো কখনোই খাবেন না৷

বলে ধীরে সুস্থে সন্তপর্ণে এগোলো টেবিলের ওপরে রাখা বক্স টা হাতে নিয়ে। বসার ঘরের দিকে পা রাখলে মোহরের কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটার চোখ খুব দ্রুতই খুঁজে নিলো তাকে তলব করা মানুষটিকে। কোনো শব্দহীনায় উঠে এলে মোহর বক্স টা রেখে ওষুধ গুলো বের করতে করতে বলল,

– আমি এসে না দিলে তো কখনোই নিজে নিয়ে খাবেন না। আশ্চর্য শরীর টা কী আমার!

– গোটা মানুষটাই তো আপনার।

মোহর জানে ঠোঁট কাটা মানুষটার সাথে কথা এগিয়ে লাভ নেই। তাই নিজের কাজটা সেরে সরে এলো৷ ঘরে এলে তাথই কেও বসে দেখে বলল,

– মায়ের শরীরটা কেমন আছে আপা?

যেন খুব অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ব্যাপারে বলে ফেলেছে৷ তাথইয়ের মুখটা কালো হয়ে এলো নিমিষেই। কেমন মলিন মুখে বলল,

– যতবার তোমার এখানে আসি বাড়ি গেলে কত কথা জিগ্যেস করে অস্থির হয়ে যায়। তুমি কেমন আছ, ভাই কেমন আছে, তোমার শরীর কেমন, এটা যেন খেতে বলি ওটা যেন করতে বলি– আরও কত কী৷ এখানে আসছি শুনে কত উচ্ছলতা তার চেহারায়।

বলে একটা দম ছেড়ে পূনরায় বলল,

– বড়মা তোমাদের দেখার জন্য মরিয়া হয়ে আছে গো। শুধু আসার সাহস পায়না বেচারি। নিজেকে অপরাধী ভেবে গুটিয়ে থাকে।

– মাকে বলবে তার ছেলে আর নাতনী তাকে দেখতে চাই। পরের বার যেন তাকেও পাই।

•••

ছিমছাম পরিষ্কার গোছানো ঘরটায় আশপাশে অসংখ্য কাঁচের শোপিস৷ বিশাল বাড়িটায় সার্ভেন্ট বাদে মানুষের উপস্থিতি একেবারেই কম। ফায়াজ প্রায় মাস খানেক পর পা রাখলো বাড়িটায়। তাও নিজ ইচ্ছেতে নয়, এক প্রকার বাধ্য হয়েছে।

– স্যরি! অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখলাম না?

– না না। খুব বেশি সময় না।

ভদ্রমহিলা এসে বসলেন ফায়াজের একদম সামনাসামনি। ফায়াজ হাঁটুর উপর দুহাতের কনুই ভর দিয়ে বসে আছে সোফাতে। এরই মাঝে একজন সার্ভেন্ট দু’কাপ কফি রেখে গেলো সামনে৷ তানজিলা চৌধুরী তথা ফায়াজের মামী কফির একটা কাপ ফায়াজের হাতে ধরিয়ে আরেকটা নিজের নিয়ে খুব নরম গলায় বলতে শুরু করলেন,

– আমি জানি তোমাকে খুব বেশিই বিরক্ত করে ফেলছি। কিন্তু আমি কোনো রাস্তা পাচ্ছি না বাবা। মেয়েটা আমার দিনদিন মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে ওকে বাঁচাবো কী করে আমি!

কথাগুলোর ভাঁজে ভাঁজে বিষন্নতা, দীর্ঘশ্বাসের প্রবল ভারটা দু’হাত দূরে বসে থাকা ফায়াজের বোধগম্যতার বাহিরে রইলো না। হাতের কাপটায় আঙুলের চাপ বসিয়ে নতমস্তকে শুনতে থাকলো তানজিলা চৌধুরীর কথাগুলো।

– প্রায় চার মাস হয়ে গেলো মেয়েটা আমার বাড়ির বাইরে বের হচ্ছে না। রাগ,জেদ,অহংকার, একটা মানুষকে পাওয়ার আকাঙ্খা ওকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। তুমি ওকে বাঁচাও বাবা। আমি তোমার কাছে অনুরোধ করছি

চোখ দু’টো ইতোমধ্যেই পানিতে ভিজে এসেছে ভদ্রমহিলার৷ ফায়াজ কাপটা হাত থেকে নামিয়ে রেখে ব্যস্ত স্বরে বলল,

– অনুরোধ কেনো করবেন মামী। ভাই হিসেবে আমারও তো দ্বায়িত্ব ওকে সুস্থ করার। কিন্তু এখানে ওর নিজের চেষ্টা টা সবচেয়ে বেশি ইম্পর্ট্যান্ট। যেখানে ও মুভ অন করতে চাই না সেখানে..

– লাগবে না ওর চাওয়া। ওর চাওয়ারকে প্রাধান্য দিয়ে দিয়েই আজ এই অবস্থা। এখন যা হবার আমার ইচ্ছেতেই হবে। না ও, না ওর বাবা। কারো মতামত চাইনা আমি।

তানজিলা চৌধুরীর গলায় তেজ, আক্রোশ, রাগ স্পষ্ট। বাবা আর মেয়ের জন্য অতিষ্ট মনে আর কোনো আপোষ করবার ইচ্ছে রাখেনা। ফায়াজ স্থবির হয়ে চেয়ে বলল,

– কী করতে চাচ্ছেন মামী?

– বিয়ে। ওকে যত দ্রুত সম্ভব বিয়ে দিতে চাই আমি।

অনতিবিলম্বেই জবাব দিলেন৷ জড়তাহীনায় নিজের মতামত প্রকাশ করে ক্ষান্ত হলেন না। আবারও বলতে লাগলেন,

– অনেক হয়েছে ওর মনমর্জি। এখন আমি যা বলব তাই হবে। শুধু শুধু পরের ছেলের দোষ ধরে থেকে তো বসে থাকলে হবে না। মেহরাজ কখনোই ওকে নিয়ে আগ্রহী ছিলো না। তিয়াসাকে আংটিও পড়িয়েছেন মিসেস আম্বি। সম্পর্ক এগোনোর কোনো ধাপেই মেহরাজের কোনো ভূমিকা ছিলো না।সেখানে ও নিজ ইচ্ছেতে একটা মেয়েকে বিয়ে করে সংসার করলে ওকে দোষারোপ করবার কোনো অধিকার তো আমাদের নেই। যাদের কাছে উত্তর চাইবো তারাই নিরুত্তর। শুধু নিরুত্তর নয় দায়সারা ও। আর তারা নাহয় পর, তিয়াসার নিজের বাবা! ওনার আচরণে আমি অবাকের সীমা ছাড়াচ্ছি।

বলেই ঘনঘন দম ছাড়লেন৷ রাগের চোটে ফর্সা মুখটা লাল হয়ে এসেছে। ফায়াজ নিশ্চুপতা কাটিয়ে ক্ষীণ স্বরে বলল,

– তিয়াসা কোথায়?

তানজিলা চৌধুরী চোখের ইশারায় ফায়াজকে স্থানটা দেখিয়ে দিলে ও শব্দহীনা উঠে এলো। ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে নব মুচড়ে ঢুকলো অধো অন্ধকারময় ঘরটায়। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে বসলো তিয়াসার পাশে। ঘরে ছোট্ট একটা বাল্ব জ্বলছে৷ তার আলোয় তিয়াসার ফ্যাকাসে মুখটা স্পষ্ট দৃশ্যমান। খুব সন্তপর্ণে কপালে হাতের উল্টোপাশটা ঠেকিয়ে দেখলো। ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসলো ফায়াজের৷ আফসোস করবে না দুঃখ পাবে তা বুঝতে পারেনা। মেয়েটাকে ও কতশত বার বুঝিয়েছে জীবনে সবকিছু চাইলেই পাওয়া যায় না। হাজারো প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি মিশ্রিত একটা ঠিকানাহীন লড়াইয়ের নামই হলো জীবন। সেখানে কোন মোড়ে কোন অনুভূমিক অপেক্ষা করছে তা কারোই জানবার সাধ্যি নেই। শুধু জীবনের স্রোতে গা ভাসিয়ে মানিয়ে নিতে হয়, মেনে নিতে হয় হাজারো হারানোর বেদনা,সুর। ঠিক যেমনটা ফায়াজ মেনে নিয়েছে। মোহরটাকে আজ বছর পাঁচেক ধরে ভালোবাসে, অথচ হুট করেই জীবন অনাকাঙ্খিত একটা মোড় ঘুরিয়ে আজ ওকে কতটা দূরে সরিয়ে দিয়েছে। জীবনের এই প্রান্তে দাঁড়িয়ে ফায়াজ শুধুমাত্র একজন পরপুরুষ মোহরের নিকট। মোহরের চোখের দিকে তাকালে শুধু একটা মানুষেরই প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়। ওর মন-প্রাণ জুড়ে শুধু একটাই নাম একটাই চেহারা। যাকে ও প্রতিটি ক্ষণ মুহুর্ত নিজের সমস্তটা উজাড় করে ভালোবেসে যাচ্ছে। তাই তো ফায়াজ সরে এসেছে,নিজের নীরবতাকে নিস্তব্ধতা করে ফেলেছে। বুকের পাজরের হাড়গুলো বিদীর্ণ হলেও ওষ্ঠদ্বয়ের ভাজ থেকে নিঃসৃত হয়নি এক একক শব্দও। ও যাকে ভালোবাসে তাকে ভালো থাকতে দিয়েছে। ভালোবাসা তো কোনো প্রতিযোগিতার মেডেল নয় যে লড়াই করে অর্জন করে নিতে হবে।বরং ভালোবাসা একটা নৈসর্গিক সৌন্দর্যমণ্ডিত ফুলের বাগান। যার এক একটা ফুল খুব যতনে,আদরে ফোটাতে হয়। সেখানে গায়ের জোর বা জেদের ছোঁয়া থাকে না। তাই তো নীরবেই সরে এসেছে ফায়াজ। যাকে ভালোবেসেছে তাকে নিজের করে নেওয়ার লড়াইয়ে কোনো খেলার বস্তু বানিয়ে অপ্রীতিকর অবস্থায় রাখতে চাইনি। নিজের নিখাঁদ ভালোবাসাটাকে সবচেয়ে নিখাঁদ জায়গাটাতেই আগলে রেখেছে, বুকের ভাঁজেই লুকিয়ে রেখেছে। শুধু রয়ে গেছে একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে। যে সমস্ত প্রয়োজনে রয়ে যাবে মোহরের জন্য। পাশে দাঁড়ানোর অধিকারটুকু নাহয় নাই পেলো পেছনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা তো করতে পারবে মোহরের একটা ডাকের। মোহর যতবার ডাকবে ততবারই ছুটে যাবে, এগিয়ে যাবে নিজের সর্বস্ব দিয়ে সাহায্য করতে —

অথচ তিয়াসা! শত বোঝানোর পরেও মেহরাজকে অর্জন করার জেদ,হিংসাত্মক অনুভূতি গুলোকে মন থেকে সরাতে পারেনি। মেহরাজের অ্যাক্সিডেন্টের খবর শোনার পর থেকে মরিয়া হয়ে গেছিলো ওকে দেখার জন্য। কোনো এক অজানা কারণ যার হেতু ফায়াজের জানা নেই তিয়াসার বাবা ওয়াকিফ চৌধুরী কোনো ভাবেই মেহরাজের কাছে যেতে দেয়নি ওকে। বাবা মেয়ের মাঝে খুব গোপন একটা কারণেই বহু কথা কাটাকাটি থেকে ঝগড়ার সৃষ্টি হয়েছে। একটা পর্যায়ে এসে তিয়াসাকে ওর বাবা ঘরবন্দী করে রাখতে বাধ্য হয়েছেন। আস্তেধীরে মেহরাজ যখন সুস্থ হলো তখন তিয়াসা ছুটে গেছিলো আব্রাহাম ম্যানসনে। তবে সেখানে ওদের না পেয়ে একা একাই খুঁজেছে। পায়নি,কেও দেয়নি ঠিকানা। আত্নহত্যার চেষ্টাও করেছিলো মাস দুয়েক আগে৷ তারপর থেকেই নিজের শরীরের সমস্ত চঞ্চলতা, শক্তি হারিয়ে এভাবেই ঘরবন্দী হয়ে আছে। ফায়াজ অনেক বুঝিয়েছে অথচ মেয়েটা বোঝে না। একটাই ধারণা ওর মস্তিষ্কে কাঁটার মতো বিঁধে আছে, আর তা হলো সবাই ওকে ঠকিয়েছে। ধোকা দিয়েছে, প্রতারণা করেছে।

দীর্ঘ একটা প্রশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো ফায়াজ। ঘর থেকে বেরিয়ে আসলেই তানজিলা চৌধুরী এসে ওর হাত ধরে বলল,

– তুমি তো অ্যাব্রোডে ফিরে যাচ্ছ নিজের বাবা মায়ের কাছে?

ফায়াজ নিঃশব্দে ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। এই সিদ্ধান্ত টা একান্তই ওর নিজের। এদেশে থাকার আর কোনো উদ্দেশ্য বা কারণ অবশিষ্ট নেই। তাই আবারও ফিরে যাচ্ছে নিজের বাবা মায়ের কাছে। এতে তারাও ভীষণ খুশি। যেই ছেলেকে এতদিন বলেও ফেরাতে পারেনি সে স্বেচ্ছায় ফিরছে এর চেয়ে আনন্দের ব্যাপার যেন আর দুটি নেই।

– একটা অনুরোধ রাখবে বাবা! তুমি তিয়াসাকে নিয়ে যাও নিজের সাথে।

তানজিলা চৌধুরীর কথায় বেশ হতবাক হলো ফায়াজ। বিব্রতকর মুখে বলল,

– আপনি তিয়াসার বিয়ের ব্যাপারে বলছিলেন!

– হ্যাঁ বলছিলাম। দেখো ওর ব্যাপারে আমি তোমাকে ছাড়া আর কাওকে ভরসা করতে পারছিনা। তুমি ওকে তোমাকে সাথে নিয়ে যাও বাবা। বিয়ে না হোক, অন্তত স্থান পরিবর্তন হলেও ও একটু ভালো থাকবে। নতুন দেশ,নতুন মানুষ পরিবেশের ছোঁয়া পেলে এমনিতেই ওর মন ভালো হয়ে যাবে। তুমি আর নাকচ কোরো না বাবা। আমি মা হয়ে অনুরোধ করছি তোমায়!

•••

বিকেল গড়ালো প্রায়, সন্ধ্যার কালচে আভা আকাশের বুকে খুব দাম্ভিকতার সহিত আঁচড় কেটে নিজের বিস্তার ঘটাচ্ছে। ইফাজ আর মিথিলা বিদায় নিয়ে বেড়িয়েছে খানিক আগেই। রইলো অভিমন্যু আর শ্রীতমা…অভি অফিসের কিছু কাজের জন্য মেহরাজের সাথে ফাইল খুলে বসেছে৷ সমস্ত কাজ গুলো ও নিজেই দেখাশোনা করে, প্রয়োজন পড়লে নিজেই আসে মেহরাজের কাছে৷ সাঞ্জে আর তাথইকে পৃথক ছাড়তে যাবে। তাথই আর সাঞ্জে গিয়ে গাড়িতে বসলে পৃথক মেহরাজের সাথে কয়েকটা কথা সেরে ফিরবে সেই মুহূর্তে ফোন বেজে উঠলো। পৃথক দরজার নবে হাত রেখে আরেকটা হাতে ফোন ধরে কানে ধরে বলল,

– হ্যালো! পৃথক ইয়াসির স্পিকিং।

– স্যার আমি ঢাকা আন্তজার্তিক বিমান বন্দর পুলিশ অথোরিটি থেকে বলেছি। চার মাস আগে আপনি ইশতিয়াক নোমান নামের একজনের ডেটা-ইনফরমেশন দিয়েছিলেন। আজ একজন বিকেল পাঁচটার ফ্লাইটে দুবাই থেকে আসা প্লেন থেকে ল্যান্ড করেছে যাকে আপনার ইনফরমেশন অনুযায়ী সেই ছেলেটা বলেই সন্দেহ হচ্ছে আমাদের…

বাকিটুকু আর শোনা গেলো না। পৃথকের হাতটা দরজার নবেই আঁটকে গেছে। অফিসারের সাথে বেশ কয়েক মিনিট কথা সেরে তৎক্ষনাৎ ওখানকার লোকাল থানায় কল করলো। রাজীবকে টেক্সট করতে করতে এগিয়ে এসে বলল,

– মেহরাজ! নোমান দেশে ফিরেছে …

.
.
.
চলমান

#Humu_❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here