ফানাহ্ 🖤 #পর্বসংখ্যা_৬২ #প্রথম_খণ্ড #হুমাইরা_হাসান

0
723

#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৬২
#প্রথম_খণ্ড
#হুমাইরা_হাসান
_______________

ক্লান্ত-মলিন চোখটার নির্মল ধূসর চাহনিটা একদম কাটকাট আঁটকে আছে সামনের দিকে। নতশিরে বসে থাকা মেয়েলী চেহারা টায় চোখদুটো এভাবে বিদ্ধ করে রেখেছে যেন একবার চোখের পলক ফেললেই হারিয়ে যাবে৷ যেন খুব কিছু একটা মিস হয়ে যাবে৷ মোহর রিপোর্ট টা খুঁতে খুঁতে দেখলো। আগের তুলনায় হেলথ্ স্ট্যাবিলিটি অনেকটা গ্রো করেছে। শরীরে এখন আর রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন নেই। অ্যাক্সিডেন্টে কার্ডিয়াক যেই ইস্যু টা ক্রিয়েট হয়েছিল ম্যাজিকের মতো সেটাও ধামাচাপা পড়েছে ধীরে ধীরে সুস্থতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার অদম্যে৷ বডি ইমিউনিটি সিস্টেম,পালস রেট, অন্যান্য অর্গানের অবস্থা সবকিছু সঙ্কটাপন্নতার বাহিরে। কয়েকদিনের অবজারভেশনে যা সিম্পটম এসেছে তাতে অবস্থাটা এখন যথেষ্ট উন্নতির দিকে। মোহর ফাইলটা বন্ধ করে চোখ দু’টো চেপে বুজে নিলো। মনে মনে উপরওয়ালার কাছে খোশ দিলে বহুবার শুকরিয়া আদায় করলো। তার অশেষ মেহেরবানী ছাড়া কখনোই সম্ভব ছিলো না এই মিরাকল। যেন সবটা নাটকীয় ভাবে ঘটে গেলো। এই মাসটা যেন ফারার উপর ফারা সহ্য করে যেতে হচ্ছে। ফোঁস করে দম ছেড়ে যেন বহু টন ভারী বোঝামুক্ত করলো নিজেকে। মোহর হাত থেকে ফাইলটা সাইডে রেখে সামনে তাকাতেই চোখাচোখি হলো ভীষণ বেহায়া চোখ দু’টোর সাথে। এক্কেবারে নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে লোকটা। ভ্রুদ্বয় আনমনেই কুঁচকে নিলো মোহর৷ মেহরাজ বেডে চিত হয়ে শুয়ে রইলেও বেশ অনেকক্ষণ ধরে ঘাড় বাঁ দিকে কাত্ করে তাকিয়ে আছে মোহরের দিকে। হাতের উল্টোপিঠে একটা ওয়ান টাইম টেপ লাগানো। কয়েক প্রহর আগেই– জ্ঞান-চেতনাশূণ্য মস্তিষ্কে লোকটার কথায় সাঁই দিয়ে স্যালাইনের নলটা খুলে ভুল করেছিল সেটা বুঝতে পেরেই এই ব্যবস্থা। মেহরাজের হাতে লাগানো স্যালাইন টা প্রায় শেষের পথেই ছিলো তবে মোহর যতই সাবধানে তা খুলে দিক মেহরাজের অস্থির-উচাটনতায় অতিষ্ট মন নিজের সমস্ত শক্তিটা যেন নিরীহ হাতটার উপরেই খাটিয়েছে৷ সেটাতেই স্যাভলনে ভেজা তুলার আঁচর দিয়ে টেপটা লাগিয়েছে মোহর। এতবড় একটা অঘটন করেও ক্ষান্ত হয়নি লোকটা এখন ঘন্টা ধরে এভাবে তাকিয়ে আছে। রাতে জ্ঞান ফেরার পর থেকে একটা বারের জন্যেই দুচোখের পাতা এক করেনি লোকটা।

– ঘাড়টা সোজা করুন। কখন থেকে এভাবে তাকিয়ে আছেন! এ পাশটায় যে সেলাই পড়েছে সেটা কী মনে নেই? চাপ পড়লে অসুবিধা টা তো নিজেরই হবে

মেহরাজের কপালে ভাঁজ পড়লো কিঞ্চিৎ। মোহরের শাসানির পরিবর্তে অদ্ভুত একটা প্রশ্ন করে বসলো।

– আপনি আমাকে আর ভালোবাসবেন না মোহ?

মোহর বিস্মিত হলো। ওষ্ঠদ্বয় কিঞ্চিৎ ফাঁক করে বিব্রত হয়ে বলল,

– মানে! এটা আবার কেমন প্রশ্ন?

– তাহলে অন্যদিকে তাকাতে কেনো বলছেন? আমার জন্য যদি এতই চিন্তা থাকতো তাহলে পাশে এসে বসতেন। আপনি কী জানেন না আপনাকে না দেখলে আমি শান্তি পাইনা?

মোহর বসা থেকে উঠে এসে পাশে দাঁড়ালো। মেহরাজের ঘাড়টা নিজ হাতে খুব সাবধানে সোজা করে দিয়ে বলল,

– শান্তির চেয়ে সুস্থতা টা অনেক বেশিই দরকার আব্রাহাম রুদ্ধ। ঘুমানোর চেষ্টা করুন, না তো আমিই ঘুমানোর ব্যবস্থা করে দেবো।

– কী করবেন?

মেহরাজের কৌতূহলী দৃষ্টিকে অগ্রাহ্য করে মোহর রিপোর্ট সহ আরও কয়েকটা জিনিস হাতে নিয়ে বলল,

– ডাক্তারেরা মাথায় হাত বুলিয়ে নয় ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়ায়। আপনি কী চাচ্ছেন আমিও তাই করি?

মেহরাজ মুখখানা খুব করুণ করে বলল,

– আমার কাছে একটু থাকুন মোহ। আমার পাশটায় বসুন। এই বালিশটা অসহ্য ঠেকছে আমার এখানে শুয়ে থাকতে খুব জঘন্য লাগছে। এখান থেকে বেরোতে চাই আমি।

মোহর নিজেকে শক্ত রাখতে চাইলেও মেহরাজের কথা,ওর মুখটা বারবার কেমন গুড়িয়ে দিচ্ছে সবটা। কেমন চুপচাপ গুটি গুটি পা ফেলে এগিয়ে মেহরাজের পাশে বসে ওর মাথায় হাতটা ছুঁয়ে বলল,

– আপনাকে সুস্থ হতে হবে রুদ্ধ! এখনো অনেক কিছু বাকি। আসল লড়াই টা সামনেই। নিজের আর নিজেদের উপর হওয়া সকল অন্যায়ের হিসেব নিবেন না? আমার সব প্রশ্ন গুলোর উত্তর দেবেন না? যে আসছে তাকে একটা সুস্থ পৃথিবী উপহার দিবেন না?

মেহরাজের চোখ জোড়া কেমন টলমল করে উঠলো। মোহর যেন খুব অভাবনীয় এক দৃশ্য দেখতে পেলো।সবা সর্বদা স্থির, প্রশান্ত চোখ দু’টো তার স্বভাবের হেরফের করেই দিলো! মোহর খুব যত্নে মেহরাজের মাথাটা তুলে নিজের নরম কোলটায় রাখলো। যেন একটা নবজাতকের দেহ একটু ছুলেই আঁচড় পড়ে যাবে৷ সযত্নে, অতি সাবধানে মেহরাজকে নিজের কোলে রেখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়িবৃত গালটায় আদুরে হাতের নরম স্পর্শ মেখে বলল,

– আমি আর কিচ্ছু ভাবতে পারছিনা রুদ্ধ। আপনাকে ছাড়া এক একটা দিন আমার কাছে যন্ত্রণাময় বিষ লাগে। আমি এখনো জানি না আসল সত্য টা কী। আপনি আমায় সবটা কেনো বলেননি বা বলছেন না তাও জানিনা। কিন্তু আপনার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি আপনাকে অবিশ্বাস করতে পারিনা।যতটা দৃঢ়তা, নিষ্ঠুরতা দেখিয়ে আপনাকে ছেড়ে এসেছিলাম ততটাই ভেঙেচুরে মুষড়ে আপনারই বুকের মধ্যে এসে পড়েছি। এটাকে আমি নিজের ব্যক্তিত্বহীনতা বলবো নাকি ভুল শুধরে নেওয়া বলবো আমি জানি না। আপনাকে সুস্থ হতে হবে খুব শীঘ্রই আমার জবাব গুলো দিতে হলেও আপনাকে সুস্থ হতে হবে।

মেহরাজ চুপটি করে পড়ে রইলো আদুরে স্পর্শের নীবিড়ে। বুকের ভেতর যাতনার অমাবস্যা গুলো আস্তে আস্তে যেন উবে গেলো এতটুকু স্পর্শেই। বহুদিন পর যেনো একটু শান্তি একিটু আমিত্ব ফিরে পেলো৷ আগামী কাল এমনকি আগামী ঘন্টায়ও কী হবে জানা নেই। ও শুধু এই এখনটাকে উপভোগ করতে চাই। শরীরের সমস্ত বিষব্যথা, ক্ষত গুলোকে ভুলে একটু ভালোবাসা পেতে চাই। মোহরের পেটের দিকে মুখ গুঁজে দিয়ে বলল,

– আমায় আরেকটু ভালোবেসে দিন মোহ

•••

ঘরে ঢুকেই বিছানাতে থপ করে বসে পড়লো। শরীর টা ভীষণ ক্লান্ত। বিগত কয়েকটা দিনে না খাওয়া না ঘুম কোনো টাই হয়নি ঠিকভাবে। হসপিটাল থেকে অফিস, অফিস থেকে পৃথকের অফিস এই ছোটাছুটিতেই দিনগুলো কেটেছে। অভিমন্যু জানে ও না গেলেও পৃথকের কাজে কোনো অসুবিধে হবে না তবুও মনের কাছে বাধ্য হয়ে যায়। হসপিটালের বেডে মেহরাজের ক্ষতবিক্ষত শরীর টা দেখতে কষ্টে, রাগে ওর ভেতরটা জ্বলে ওঠে। পারেনা নোমান কে ধরে এনে পু’তে ফেলতে! আজও ছিলো হসপিটালে, কয়েকদিনের ধকলে মোহরের বোন অসুস্থ হয়ে পড়েছে তাই রাতে ইফাজ বা মিথিলা থাকতে না পারায় অভিমন্যু ছিলো। যত যাই হোক,মোহরকে এমতাবস্থায় একা ছাড়া কোনো ভাবেই বিবেকে সাঁই দেয়নি। ভোররাতে যখন মোহর কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে এসে বলল মেহরাজের জ্ঞান ফিরেছে, ওর শরীর টা এখন অনেকটা ঝুঁকিমুক্ত তখন কী একটা শান্তি পেয়েছে এটা হয়তো কোনো ভাবেই প্রকাশযোগ্য নয়। তাই তো ফেরার পথে মেহরাজের নাম করে প্রার্থনা করে এসেছে ঠাকুরের কাছে।

– ঠিক আছেন আপনি?

মেয়েলী গলার স্বরে ঘাড় তুলে তাকানোর প্রয়োজন মনে করলো না অভিমন্যু । শ্রীতমা এগিয়ে এসে ওর পাশে বসলো। অভিমন্যুর মলিন মুখটা দেখে কেমন ভয় ভয় করছে৷ ওদিকে সবটা ঠিক আছে তো! কেমন একটা দুঃশ্চিন্তার বেড়াজালে আঁটকে গেলো ভেতরটা। অভিমন্যুর কাঁধে আস্তে করে হাতটা রেখে জিগ্যেস করলো,

– এতো সকালেই চলে এলেন যে আজ! ওদিকে সব ঠিক আছে তো? মোহর…মেহরাজ দাদা কেমন আছে ওনার..

বাকিটা সম্পূর্ণ করার আগেই খুব অপ্রত্যাশিত একটা কাজ হয়ে গেলো। আচানক অভিমন্যু শ্রীতমাকে ঝাপটে ধরে ওর কাঁধে কপাল ঠেকিয়ে দিলো। ওর এমন টালমাটাল অবস্থাটা শ্রীতমার দুঃশ্চিতার শেকলটা আরও দৃঢ়তর করে তুললো। তবুও ভেতরের উৎকণ্ঠা, অস্থিরতা সামলে অভিমন্যুর পিঠে হাত রেখে ধীরে ধীরে বুলিয়ে দিয়ে বলল,

– কী হয়েছে! বলুন আমায়?

– স্যারের জ্ঞান ফিরেছে শ্রী! স্যার এখন বিপদমুক্ত।

যেনো পরম শান্তির আবেশে চোখ দু’টো বুজে এলো শ্রীতমার। দু’হাতে আরও যতনে ভালো করে জড়িয়ে ধরলো অভিমন্যুর ভারী শরীরটা। ওর পিঠে সান্ত্বনা, যত্নময়ী স্পর্শ বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

– লাখো কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি উপরওয়ালা কে৷ প্রার্থনা মঞ্জুর করেছেন। বুক থেকে ভারী একটা বোঝা নেমে গেছে।

অভিমন্যু জবাব করলো না। ঝোকের বশে আবেগে ভেসে শ্রীতমাকে জড়িয়ে ধরলেও পরক্ষণে যে জড়তা টা জেঁকে ধরেছিলো তা শ্রীতমার স্পর্শে কেটে গেছে। ও ভেবেছিলো হয়তো শ্রীতমা গুটিয়ে নেবে নিজেকে, আড়ষ্টতা বোধ করবে। কিন্তু শ্রীতমার এই সহজ আচরণ টায় ভীষণ ভালো লাগা কাজ করলো অভিমন্যুর, ওকে জড়িয়ে ধরেই চোখ বুজে রইলো। একটুও ছাড়তে ইচ্ছে করছে না, এমনিতে যতই এড়িয়ে চলুক এটা তো সত্য যে মেয়েটাকে ও ভালোবাসে!

সময়ের রেলগাড়ী বিরামহীন, ছন্দপতনহীন, অবিরাম যাত্রা চলতেই থাকলো। একে একে আবহাওয়ার বাতাসে গা ভাসিয়ে তুলোর মতো উড়ে গেলো কতগুলো দিন,সপ্তাহ, মাস। বহমান ধারার নীরব স্রোতে এগিয়ে গেলো মানুষ গুলোও। আর তাদের মাঝের মান-অভিমান, ভালোবাসা, সম্পর্কের দাঁড়িপাল্লা। শ্রীতমা আর অভিমন্যুর বিয়ের চারটা মাসের ও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। এক একটা দিনের সাথে পাল্লা দিয়ে ওদের অভ্যন্তরীণ জড়তা,আড়ষ্টতা কাটিয়ে নিজেদের মধ্যকার সম্পর্ক টুকুর রঙিন ঝুড়িটা দুজনে মিলে সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়েছে। মাধুর্য ব্যানার্জি ও তার স্বামীর ইচ্ছে, স্বপ্নকে পূরণ করে ওরা দুজনে একসঙ্গে একই ছাদের নিচে কাছাকাছি পাশাপাশি থাকতে শুরু করেছে৷ মেহরাজ এখন প্রায় পুরোপুরি সুস্থ, তবে অবস্থান টা পালটেছে৷ হসপিটাল থেকে আর ও বাড়িতে ফেরেনি ওরা পৃথকের ফ্ল্যাটের পাশেই নিজের জন্য একটা ফ্ল্যাট নিয়েছে। ইচ্ছেটা পৃথকের৷ মেহরাজের অসুস্থতায় মোহরকে একা ওর সাথে দূরে রেখে ভরসা পাইনি। এই মাসগুলোয় মোহর ওর সযত্ন সেবায় মেহরাজকে একটু একটু করে সুস্থ করে তুলেছে। ভাঙা হাতটা এখন সংকোচন-প্রসারণক্ষম। মোটামুটি ঠিকঠাক বলা যায়, পায়ের ফ্র‍্যাকচার টাও এখন পূর্বের ন্যায়। মাথার পাশে চোট,গালের পাশে সব জাগায় ক্ষত শুকিয়েছে। গোটা মাস চারেকের বেড রেস্ট কাটিয়ে এখন প্রাত্যহিক জীবনের পরিস্থিতিতে আবারও ফেরার পালা একটু একটু করে। এরমধ্যে যে পরিবর্তন টা সবচেয়ে বেশি চোখে বাঁধার মতো তা হলো মোহর। সাতমাসের শেষ দিকে ভরা পেট টা ফুলে ফেঁপে উঠেছে। ভবিতব্য ভেবে যা কিছুর স্বপ্ন বুনে এসেছে সেই সময়টা এখন এক্কেবারে দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। মেহরাজ কাজের বাহিরে সারাটা সময় কাটায় মোহরের সাথে। আগত ব্যক্তিটার জন্য সারা রাজ্যের তোড়জোড় ওর! সবচেয়ে বেশি উৎকণ্ঠা, উত্তেজনাটা মেহরাজের৷ সাধারণত গর্ভাবস্থায় মায়েদের মধ্যে সন্তানকে ঘিরে যে চাঞ্চল্য,যত্ন, উত্তেজনা লক্ষ্য করা যায় তার পুরোটাই মেহরাজের চেহারায় প্রতিফলিত হয়। তবে না চাইতেও ধামাচাপা পড়েছে এই কালো অধ্যায় টা যার রচয়িতারা এখনো খোলা আকাশে,মুক্ত বাতাসে প্রাণ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নোমানকে এদেশের আনাচে কানাচে কোথাও পাইনি পৃথক। ও যে সেই রাতেই দেশ ছাড়ার সমস্ত ব্যবস্থা করে কাজ টা ঘটিয়েছিল তার সন্দেহ দৃঢ়তর হলেও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। শান্ত পশুর মতো থমকে আছে মেহরাজ, স্থির হয়ে আছে ওর সমস্ত উদ্দেশ্য আর পরিকল্পনা। যাতে খুব আশ্চর্যজনক ভাবে মোহর ও দ্বিরুক্তি করেনি। চুপচাপ মেহরাজের হাত ধরে পূণরায় পূর্ববর্তী জীবনে জড়িয়েছে । ওদের এভাবে থমকে যাওয়া,যথেষ্ট প্রমাণ হাতে থাকা সত্ত্বেও শান্ত বনে যাওয়াতে যথেষ্ট হতবাক হয়েছে মুর্তজা ভাইয়েরা। তবে আগ বাড়িয়ে বিপদের মালা গলায় পরবে না বলেই ওরাও নিজেদের দূরে রেখেছে, আড়ালে রেখেছে। কারণ প্রতিটি প্রয়ংকারী ঝড়ের আগেই তো এমন শান্ত বাতাবরণ দেখা যায় কী না!
…..

– আপি আর কতক্ষণ অপেক্ষা করাবি, আমি কী একাই চলে যাবো নাকি!

– উফ দাঁড়া তো সাঞ্জে। এই তোয়াটা বড্ড জ্বালাচ্ছে। একে জামাটা পড়িয়েই আসছি। তুই দ্যাখ নাজমা খাবার গুলো ক্যারিয়ার এ ঠিকঠাক তুলেছে কী না

সাঞ্জে বিরক্তিতে চ জাতীয় শব্দ করে নিচে নেমে এলো। ও হেলেদুলে সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে তাথই ও তড়িঘড়ি করে বেড়িয়ে এলো মেয়েকে কোলে নিয়ে। সাঞ্জেকে এখনো সিড়ির কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চ জাতীয় শব্দ করে বলল,

– অপদার্থ একটা। এইটাকে ধর, আমি দেখে আসছি।

বলে তোয়াকে ওর কোলে ধরিয়ে দিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা চালিয়ে এগিয়ে গেলো। ব্যস্ত স্বরে ডেকে বলল,

– নাজমা খালা! হলো তোমার গোছগাছ..

কথাটুকু এগোনোর আগেই কেমন বিব্রত মুখে ভ্রু কুঁচকে নিলো। কেমন সন্দিহান গলায় বলল,

– তুমি এখানে কী করছ?

কেমন একটা আকস্মিকতা ভেসে উঠলো মালার চোখেমুখে। দৃষ্টিও কেমন অপ্রস্তুত, আমতা-আমতা করে কিছু বলার আগেই তাথই বলল,

– নাজমা কোথায়?

– সে ব্যাগ আনতে গেছে ওই ঘরে। আমি পানি নিতে এসেছিলাম দাদীর জন্য। আপনি যখন এসে গ্যাছেন আমি তাহলে যাচ্ছি।

বলে বেরিয়ে গেলে তাথই এগিয়ে এসে খাবার গুলো সব ঠিকঠাক দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজেই গুছিয়ে নিলো। খাবার গুলো ক্যারিয়ার এ ভরে সাঞ্জে আর তোয়াকে নিয়ে গাড়িতে উঠলো। খাবার গুলো সেই সকাল থেকে দু বোনে মিলে রান্না করেছে আজ, মোহরের জন্য। মোহরকে প্রায় ই দেখতে যায় দুজনে আর এটা ওটা রান্না করে নিয়ে যায়। এ বাড়িতে কারো সাথেই ঠিকঠাক কথা বলেনা। বাবা মায়ের সাথে কোনো সম্পর্ক রাখতেও বিবেকে বাঁধে। যে মানুষ গুলোর টাকা সম্পদের লোভে এতো এতো পাপে পাপিষ্ঠ তাদের সাথে কীসের কথা! ওই বাড়িটায় পড়ে আছে শুধুমাত্র শাহারা বেগমের জন্য। বয়স আর রোগের ভারে বৃদ্ধা প্রায় বিছানাগত। তাকে সেবা শুশ্রূষা করার সমস্ত দায়টুকু দু বোনেই পালন করে।

•••

– আপনি কী কোথাও বেরোচ্ছেন এখন?

মেহরাজ ঘরে ঢুকতেই প্রশ্ন করলো মোহর। জবাব পেলো না তৎক্ষনাৎ। মেহরাজ ক্ষীণ হেসে এগিয়ে এলো। বিছানায় দুই পা ছড়িয়ে দিয়ে বসে আছে মোহর। পরনে পা সমান গোল জামার মতো একটা পোশাক। হালকা গোলাপি রঙের সুতি জামার সাথে সাদা রঙের ওড়না পেঁচিয়েছে। গোলগাল মোহরকে বেশ লাগে মেহরাজের। সারাদিন ই তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।
মেহরাজ এগিয়ে এসে ফ্লোরে বসে খাটে বসে থাকা মোহরের পেটের কাছে মুখটা এগিয়ে দীর্ঘ একটা চুম্বন দিলো। অতঃপর বলল,

– আপাতত পঙ্গুত্ব বরণ করে ঘরেই তো লেপ্টে আছি৷ যাবো আর কোথায়

মোহরের রাগ হলো ভীষণ। মুখটা ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকালো। মোহরের উত্তর না পেয়ে মেহরাজ মাথা তুলে তাকালে মোহরের ভার করে রাখা মুখটা দেখে আলতো হেসে উঠে পাশে বসল। গর্ভাবস্থার এই লম্বা সফরে মোহরের শারীরিক সহ আচরণগত পরিবর্তন ও হয়েছে। সবসময় চুপটি থাকা মেয়েটা কথায় কথায় রেগে যায়,মুখ ফুলিয়ে বসে থাকে খাওয়া বাদ দিয়ে। মেহরাজ মনে মনে বেশ উপভোগ করে মোহরের চেহারাটা। কিন্তু প্রকাশ করে না।

– এদিকে তাকাবেন না?

মোহর ভ্রুক্ষেপ না করলে মেহরাজ মুখটা এগিয়ে নিয়ে বসিয়ে দিলো মোহরের গালে। নরম তুলতুলে গালটায় নিজের গালটা ঘষে দিলে মোহর কড়া চোখে তাকিয়ে বলল,

– সরুন বলছি। একদম আদিক্ষেতা করবেন না। যেই কথাটা আমি সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করি সেটাই বারবার বলবেন যখন তো কথাই বলার দরকার নেই।

মেহরাজ নিঃশব্দে বুঝে নিলো মোহরের অভিমান। নিজেকে পঙ্গু বলে মশকরা করা টা সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেয় মোহরকে। মুখে যতই রাগ দেখাক ওর ভালোবাসার তীব্রটা টুকু আজীবন বুঝেও হয়তো শেষ করা যাবে না। যেই মানুষটা ওকে ঘৃণা করবে বলে ছেড়ে এলো সেই কিনা রাতের পর রাত জেগে কত যত্নে, আদরে সেবা করলো। যত্নময়ী আদরে আগলে মেহরাজকে সুস্থ করে তুললো। মোহরের প্রতিটি যত্ন, আদর, ভালোবাসার স্পর্শ মেহরাজকে ক্ষণে ক্ষণে বুঝিয়ে দেয় ওর পাগলাটে ভালোবাসা টা ভুল মানুষের জন্য নয়। যেই মানুষটাকে ও প্রতিটি ভাষায়,যত্নে,ভালোবাসায় ভালোবাসে। সেই মানুষটা ওকে এক্কেবারে নিঃশব্দে ভালোবাসে। মেহরাজ একটা হাত বাড়িয়ে মোহরকে বুকে টেনে নিয়ে বলল,

– আমি একা বলে খুব জ্বালাচ্ছেন। কথায় কথায় রাগ করে মুখি ফুলিয়ে বসে থাকেন। একবার আমার বাহার আসুক, তখন আমরা দুজন এক হয়ে যাবো

– আর আমাকে আলাদা করে দিবেন?

ভীষণ আদুরে,অভিমানী শোনালো মোহরের গলাটা। মেহরাজ কণ্ঠের খাদ নামিয়ে বলল,

– মোটেও না! বিবিজান ছাড়া যে আমার একেবারেই চলে না!

.
.
.
চলমান

#Humu_❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here