ফিরে_আসা ৩৩ লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

0
735

#ফিরে_আসা
৩৩
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

মশলার গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। অরার সমস্ত মনোযোগ আপাতত চুলার দিকেই সীমাবদ্ধ। রান্নার সময়ে প্রায়ই তার মশলা পুড়ে যায়। ফলে আবারও নতুন করে শুরু করতে হয়। অরা প্রাণপণ চাইছে আজ যেন কোনো ঝামেলা না বেঁধে যায়।

অরার ঠিক পাশে দাঁড়িয়েই সবজি কাটছে আরশাদ। সুপারস্টার আরশাদ হককে সবাই সিনেমার পর্দায় দেখেছে। কখনো অ্যাকশন করতে, কখনো রোমান্স করতে। তবে তাকে রান্নাঘরে দেখার সৌভাগ্য কজনের হয়েছে কে জানে?

আরশাদের বাবুর্চি আব্দুল মিয়া আজ অসুস্থ। কী করে যেন ডেঙ্গু বাঁধিয়ে ফেলেছে। তবুও অসুস্থ শরীর নিয়ে সকাল সকাল সে কাজে হাজির হয়ে যায়। আরশাদ যখন জানতে পেরেছে আব্দুল অসুস্থ, তখনই তাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে। এবং সাবধান করে দিয়েছে, সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত যেন কাজে না আসে। এলেও তাকে রান্নাঘরে ঢুকতে দেওয়া হবে না।

আব্দুল চলে যাওয়ার পর আরশাদ চেয়েছিল বাইরে থেকে খাবার অর্ডার করতে। তবে অরা আঁতকে উঠে জানিয়েছে, আজ সে রান্না করবে। এ বাড়িতে আসার পর থেকে রান্না করার সুযোগ তার হয়নি। দিনের বেলা রান্নাঘর থাকে আব্দুলের দখলে আর রাতে তাকে ব্যস্ত থাকতে হয় কাজ নিয়ে। আজ এই সুযোগটা পেয়েও কী করে হাতছাড়া করে অরা?

অরা রান্না করবে শুনে আরশাদও এসে পড়েছে রান্নাঘরে। মেয়েটা একা একা কষ্ট করছে এই দৃশ্য হজম করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। যদিও অরা বারবার বলেছিল, তাকে সাহায্য করতে হবে না। অরা একাই সবটা সামলে নিতে পারবে। তবে সে ভুলে গিয়েছিল, কার সঙ্গে তর্ক করছে। আরশাদ হক তার জেদের কাছে জোঁকের মতো অনড়।

এ বাড়ির রান্নাঘরটা বেশ চকচকে। রান্নাঘরের জিনিসগুলোও চকচকে। যে খুন্তি দিয়ে অরা মশলা নাড়ছে তাতেও নিজের চেহারা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে।

খুন্তি নাড়তে নাড়তে অরা বলল, “আপনার এত কষ্ট করার কোনো দরকার ছিল না কিন্তু স্যার।”

আরশাদ সবজির দিক থেকে চোখ না সরিয়েই বলল, “তোমারও।”

আজকের মেনু নির্ধারণ করতে খুব একটা হিমশিম খেতে হয়নি অরাকে। কোথাও প্রথমবারের মতো রান্না করতে গেলে খিচুড়ি সবথেকে নিরাপদ অপশন। খিচুড়ি পছন্দ করে না এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এছাড়া এটা অরা রান্নাও ভালো করে। খিচুড়ির সঙ্গে গরুর কালা ভুনা। গোস্ত প্রথমেই পাশের চুলায় বসিয়ে দিয়েছে অরা। আপাতত কাজ চলছে খিচুড়ির ওপর।

আরশাদ হঠাৎ কী যেন মনে করে বলল, “আমি কোনোদিনও কল্পনাও করতে পারিনি এই দিনটা দেখতে হবে।”

অরা কৌতুহল নিয়ে বলল,“মানে?”

“তুমি আমার কিচেনে রান্না করছো! দৃশ্যটা ঠিক নিতে পারছি না। সবসময় তোমাকে দেখে এসেছি সুটেড-বুটেড কাজপাগল একটা মেয়ে হিসেবে। যে সারাদিন ল্যাপটপে মুখ খুঁজে থাকতে পারে। আর রোবটের মতো কেবল কাজের কথাই বলতে পারে।”

অরা হাসি মুখে বলল, “আপনার কাছ থেকেই তো শেখা স্যার!”

“তাই না-কি? কীভাবে?”

“হুঁ! আপনি তো সবদিক পারফেক্টলি ম্যানেজ করে চলতে পারেন। শুটিং, ডাবিং, ইন্টারভিউ, মিটিং – কোনোকিছুই আপনার মনোযোগের অভাবে পড়ে থাকে না। আমিও চেষ্টা করি।”

আরশাদ কিছুই বলল না। ক্ষীণ হেসে আবারও মনোযোগ ফিরিয়ে নিলো সবজির দিকে। মিষ্টি নীরবতার হাওয়া বয়ে গেল রান্নাঘর জুড়ে। নীরবতা জিনিসটা একই সঙ্গে অসহনীয় আবার আরামদায়ক হতে পারে। কিছু কিছু মানুষের সঙ্গে হাজারো কথা বলা গেলেও তাদের সঙ্গে নীরবতায় সময় পাড় করা মুশকিল।

তবে আরশাদের সঙ্গে কখনো তেমনটা অনুভব করে না অরা। এ বাড়িতে আসার পর থেকে আরশাদের সঙ্গে তার যেমন প্রচুর কথা হয়েছে, তেমনি বহুবার তার সঙ্গে নীরবতায় সময় কাটানো হয়েছে। আরশাদের সঙ্গে কাটানো নীরবতায় কোনো অস্থিরতা থাকে না। থাকে কেবল বিচিত্র এক প্রশান্তি।

আড়চোখে অরা তাকালো আরশাদের দিকে। রান্নাঘরের জানালার ফাঁক থেকে এক চিলতে রোদের আলো এসে পড়েছে তার মুখের ওপরে। নিজের অজান্তেই আরশাদ স্নিগ্ধতা ছড়াচ্ছে চারপাশে। পুরুষমানুষ এতটা সুন্দর হয় কী করে? হাজারো মেয়ে শুধু শুধু তার প্রেমে পড়ে হাবুডুবু খায় না।

অরা ধুয়ে রাখা চাল-ডাল মশলার সঙ্গে মেশাতে মেশাতে বলল, “স্যার? একটা কথা বলি?”

আরশাদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “তোমাকে তো একবার বলেছি, কথা বলার আগে পারমিশন নিতে হবে না।”

অরা সামান্য ঢোক গিলে বলল, “বাড়িতে আপনি অনেক আলাদা।”

“বুঝলাম না।”

“ক্যামেরা আর স্পটলাইট যখন আপনাকে ঘিরে রাখে তখন আপনি একরকম। আবার এই যে এখন সবজি কাটছেন, এখন আপনি অন্যরকম।”

ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম এক হাসির আভা ফুটিয়ে তুলে আরশাদ বলল, “এই আমিটাই আসল আমি। স্টারডমের চাকচিক্য আমাকে বদলে দেওয়ার অনেক চেষ্টা করেছে, কিন্তু পারেনি। তবে বিরক্ত করে প্রচুর। আমি তো ভুলেই গেছি একটা সাধারণ জীবন যাপন করতে কেমন লাগে।”

“আজ হয়তো কিছুটা হলেও মনে পড়বে স্যার। কারণ আমি সাধারণ মানুষের মতোই সবজি কাটাকাটি করছেন, আমাকে রান্নায় হেল্প করছেন।”

“সেটা সত্যি! কেমন করছি বলো তো?”

অরা মুগ্ধ গলায় বলল, “দারুণ! যার গুণ থাকে, তার সবদিক থেকেই গুণ থাকে। আজ প্রথমবারের মতো রান্নাঘরে ঢুকেই কত সুন্দর কাটাকাটি করছেন আপনি।”

“তার থেকেও বড় কথা আমার নিজের শান্তি লাগছে। কিছু কিছু কাজ মানুষ বাধ্য হয়ে করে, আর কিছু কিছু স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য। এই কাজটাই স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজে পাচ্ছি।”

“আপনি তো অভিনয় করেও স্বাচ্ছন্দ্য পান স্যার।”

“সবসময় যে পাই তা না। মাঝেমধ্যে অভিনয় করতেও বিরক্ত লাগে।”

অরার সঙ্গে রান্না করে সময়টা দারুণভাবে পাড় করলো আরশাদ। যেকোনো প্রকার শিল্প তাকে আকৃষ্ট করে। রান্না তো সে অর্থে এক ধরনের শিল্প। স্বাচ্ছন্দ্য পাওয়ার সাথে সাথে অরার কাছ থেকেও রেসিপিটাও শিখে নিলো আরশাদ। শেখার কোনো শেষ নেই। আর কোনো কিছু শিখে রাখাও দোষের নয়।

অরার রান্না অসাধারণ হয়েছে। বিশেষ করে খিচুড়িটা হয়েছে অমৃতের সমান। খাওয়ার সময় কথা বলা আরশাদের পছন্দ নয়। তবে আজ সে তার কী হলো কে জানে? একটা দুটো করে নিজেই প্রচুর কথা বলছে অরার সঙ্গে।

“আজ রান্না করতে গিয়ে একটা মজার স্মৃতি মনে পড়ে গেল।”

অরা কৌতূহলী ভঙ্গিতে বলল, “কোন স্মৃতি স্যার?”

“আমার প্রথম দিককার সিনেমা, সম্ভবত দ্বিতীয় বা তৃতীয়। সিনটা এরকম, আমি রান্নাঘর থেকে নুডুলসের প্লেট ডাইনিং টেবিলে এনে রাখবো। এমন কঠিন কোনো কাজ না। কিন্তু পায়ের সঙ্গে কী যেন একটা বেঁধে গিয়ে হোঁচট খেলাম।”

অরা আগ্রহ নিয়ে বলল, “তারপর?”

“নিজেকে সামলে নিতে পারলেও প্লেটটাকে আর সামলাতে পারলাম না। হাত থেকে ফ্লোরে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। আর পুরো ফ্লোর নুডুলসে মাখামাখি হয়ে গেল।”

“সে কী? শুটিং হলো কীভাবে শেষমেশ?”

“একটা দীর্ঘ ব্রেক নিয়ে সবটা ঠিক করতে হয়েছিল। সেট পরিষ্কার করতে হয়, নতুন করে নুডুলস আনতে হয়, আর আমাকে এমন একটা ভাব করতে হয় যেন পুরো ঘটনার জন্যে আমি অনুতপ্ত।”

অরা খিলখিল করে হেসে উঠলো। অদ্ভুত ব্যাপার! যে মানুষটাকে এক মাস আগেও অরা প্রচন্ড ভয় করতো, আর তার সঙ্গেই রান্না করছে, আড্ডা দিচ্ছে। আরশাদের সঙ্গে কাটানো সময়গুলো এতটা প্রশান্তি এনে দেয় কেন তার মনে? এই সময়টায় তাকে পৃথিবীর আর কোনো কিছু নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হয় না।

অরা দুশ্চিন্তা না করলেও পৃথিবীর অপর প্রান্তে কেউ একজন দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে দুপুর দুটা হলেও, কানাডায় রাত বারোটা। নওশীনের মোবাইল স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে ছবিটা। আরশাদ এবং অরার বিয়ের ছবি। এক মাস হয়ে গেছে ওই ঘটনার। তবুও এক মুহূর্তের জন্যে এই সত্যিটা নওশীন মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারেনি যে – আরশাদের বিয়ে হয়ে গেছে।

নওশীনের হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস তার বহু আগেই হারিয়ে গিয়েছিল। তবে আরশাদের বিয়ের পর থেকে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ ব্যাহত হয়ে গেছে। নার্ভ ঠিকঠাক কাজ করছে না। নার্ভ শান্ত রাখত ধুম্রজালে ঠোঁট কালো করা ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছে না নওশীন।

আরশাদকে ফিরে পাওয়ার প্ল্যানটা কেবল গুছিয়ে এনেছিল নওশীন। কিন্তু পুরো প্ল্যানে জল ঢেলে দিলো আরশাদ নিজেই। রাগে সমস্ত শরীর তার থরথর করে কাঁপছে। সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে সে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো ছবিটার দিকে। কী যেন মনে করে হঠাৎ ছবিটা জুম করে কেবল অরাকেই দেখতে লাগলো।

কী আছে এই মেয়ের মাঝে? এই মেয়ের থেকে হাজারগুণ রূপবতী নওশীন। তবুও আরশাদ কেন বিয়ে করলো মেয়েটাকে। রাগে-ক্রোধে নিজের চুল নিজেরই ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছা করছে। দুধ-কলা দিয়ে সে এতদিন কাল সাপ পুষেছে। সাপটা তারই আদর-যত্নে ফুলে-ফেঁপে বেড়ে উঠে আজ তাকেই ছোবল মারতে উদ্যত হয়েছে।

ইয়াসমিন বেগম ঘরে প্রবেশ করলেন। কথা বিছানায় শুয়ে মোবাইলে গেম খেলছে। আর বিছানার পাশের সোফাতেই নওশীন বসে আছে। তার হাতে জ্বলন্ত সিগারেট দেখে ইয়াসমিন বেগমের রাগ নিমিষেই তুঙ্গস্পর্শী হয়ে উঠলো।

তিনি গম্ভীর স্বরে বলল, “এসব কী হচ্ছে নওশীন? বাচ্চা মেয়েটার সামনে কী শুরু করেছো তুমি?”

মাকে দেখে সিগারেটটা আস্ট্রেতে নেভালো নওশীন। যদিও সেই ইচ্ছা তার বিন্দুমাত্র ছিল না। এই সিগারেট জিনিসটাই গত মাস ধরে আগলে রেখেছে তাকে, শান্ত রেখেছে। না হলে নওশীন রাগের মাথায় কী করে বসতো সে নিজেও জানে না। ইয়াসমিন বেগম সোফায় মেয়ের পাশে এসে বসলেন।

নওশীন অস্থির গলায় বলল, “মা আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। দেখতে পাচ্ছো না তুমি? আমার শাদ আমারই চোখের সামনে একটা থার্ড ক্লাস মেয়েকে বিয়ে করলো, অথচ আমি কিছুই করতে পারলাম না।”

ইয়াসমিন বেগম থমথমে গলায় বললেন, “তুমি আবার কী করবে? আরশাদ যা করেছে, বেশ করেছে। তোমার সাথে ডিভোর্স হয়ে গেছে বলে কী সে আর জীবনে বিয়ে করতে পারবে না?”

নওশীন চোখভর্তি জল নিয়ে বলল, “কিন্তু মা? আমি তো এখনো ওকেই ভালোবাসি।”

ইয়াসমিন বেগম তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন, “আমি তোমার অভিনয়ের বড় ভক্ত নই নওশীন। আমার সামনে অভিনয় করতে হবে না।”

“তোমার এটাকে অভিনয় বলে মনে হচ্ছে? এই যে আমি দিনের পর দিন ভেতরে ভেতরে কষ্ট পেয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছি, এটাকে তোমার অভিনয় বলে মনে হয়?”

“কষ্ট তুমি ঠিকই পাচ্ছো, তবে আরশাদের জন্যে নয়। তোমার এই কষ্টের পেছনে অন্য কোনো স্বার্থ জড়িত।”

নওশীন এমনভাবে মায়ের দিকে তাকালো, যেন কোনো কিছু চুরি করতে গিয়ে সে ধরা পড়ে গেছে।

“একটা কথা মনে রেখো নওশীন, তুমি পুরো দুনিয়ার কাছে সত্যি গোপন করলেও আমার কাছে পারবে না। তোমাকে পেটে ধরেছি আমি।”

নওশীন অভিমানী স্বরে বলল, “তুমি তো এখন সুস্থ। আমি কি এবার দেশে ফিরে যেতে পারি?”

“যা ইচ্ছা করো। তবে খবরদার! আরশাদের কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করবে না।”

নওশীন ঝাঁঝালো গলায় বলল, “শাদের কোনো ক্ষতি করার কথা আমি কল্পনাতেও আনতে পারি না। তবে ওই মেয়েকে আমি ছাড়বো না। কত বড় বেঈমান! আমি ওকে এতিমখানা থেকে তুলে এনে আশ্রয় দিলাম, চাকরি দিলাম – আর ওই মেয়েটা আমার কাছ থেকে আমার সবথেকে প্রিয় মানুষটাকে কেড়ে নিলো? নির্লজ্জ বেহায়া!”

ইয়াসমিন বেগম ধমকের সুরে বললেন, “থামো নওশীন! এসব কিছুই তুমি করবে না। আরশাদ বিয়ে করে সুখে আছে। তুমি যদি সত্যিই তাকে ভালোবেসে থাকো তাহলে তাকে সুখে থাকতে দাও।”

“না মা। শাদ আমার। যা আমার, তা আমি আদায় করেই ছাড়বো।”

“এ জীবনে অনেক পাপ তুমি করেছ নওশীন। পাপের বোঝা আর বাড়িও না।”

নওশীন অবাক গলায় বলল, “পাপ? কী পাপ করেছি আমি?”

ইয়াসমিন বেগম মুখ বিকৃত করে বলল, “তুমি জানো না বুঝি! আরশাদের মতো সোনার টুকরো একটা ছেলেকে তুমি ঠকিয়েছে। নিষ্পাপ একটা বাচ্চাকে নষ্ট করেছেন। নেশা করছে, এমনকি এখনো করছো।”

নওশীন দৃঢ় গলায় বলল, “আমি কোনো পাপ করিনি। ওটা শুধুমাত্র আমার ভুল ছিল।”

“ভুল একবার করলে না হয় তাকে ভুল বলা যায়। কিন্তু বারবার ভুল করলে তা আর ভুল থাকে না। অপরাধ হয়ে যায়।”

“বাহ্! নিজের মেয়েকে অপরাধী বানিয়ে দিলে?”

“সত্যিটা বলেছি। তুমি অপরাধী হও আর যাই হও, দূরে তো আর ঠেলে দিতে পারি না। যেখানে যাবে, যাও। তবে আমার দরজা সবসময় তোমার জন্য খোলা থাকবে।”

ইয়াসমিন বেগম ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই নওশীন আবারও সিগারেট ধরিয়ে ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ঢাকার টিকেট বুক করতে হবে। সামনে তার অনেক কাজ।

লাইব্রেরির সোফায় বই নিয়ে গা এলিয়ে দিয়েছে অরা। তার হাতে ‘হিমুর দ্বিতীয় প্রহর’ বইটা। এই বইতে না-কি হুমায়ূন আহমেদ হিমুর সঙ্গে মিসির আলীর দেখা করিয়ে দিয়েছেন। একটা ইতিহাস রচিত হয়ে আছে বইটায়, অথচ সে এখনো পড়েনি। উদগ্রীব হয়ে সে পাতায় পর পাতা উল্টে যাচ্ছে। মিসির আলীর সঙ্গে হিমুর দেখা হওয়ার অপেক্ষায় তার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে।

হঠাৎ অরার মনে হলো, এই বইটা আরশাদকে পড়তে বলতে হবে। পারলে তো এখনই বইটা নিয়ে ছুটে যেত তার কাছে। তবে সেটা আপাতত সম্ভব নয়। বসার ঘরে আরশাদের মিটিং চলছে। ‘কানামাছি’ সিনেমার পরিচালক এবং প্রযোজক বাড়িতে এসেছে। কী নিয়ে মিটিং চলছে তাদের মধ্যে কে জানে?

আরশাদের মধ্যে যে অসাধারণ একজন পাঠক লুকিয়ে আছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। দীর্ঘদিন যাবত বেচারা রিডিং ব্লকে আটকে আছে। রিডিং ব্লক জিনিসটা একজন পাঠকের জন্যে সবথেকে যন্ত্রণাদায়ক। তাকে আগের মতো আগ্রহ নিয়ে বই পড়তে দেয় না। দুয়েক পাতা পড়লেই ক্লান্তি বোধ হয়। কে জানে হয়তো এই বইটা আরশাদের রিডিং ব্লক ভাঙতে সক্ষম হলেও হতে পারে।

“অরা?” আরশাদ লাইব্রেরিতে প্রবেশ করতে করতে ডাকলো তাকে।

অরা সোজা হয়ে বসতে বসতে বলল, “জি স্যার?”

আরশাদ এসে অরার পাশে বসতে বসতে বলল, “থার্ড সিক্রেট!”

অরার আগ্রহের কোনো কমতি রইল না। এরশাদের সঙ্গে এই সিক্রেট আদান-প্রদানের খেলাটা তার দারুণ লাগে। যে আরশাদ সহজে মানুষের সঙ্গে মিশতে পারে না, সেই আরশাদ তাকে বিশ্বাস করে মনের ভেতরকার গোপন কথাগুলো বলে দিচ্ছে। ভাবা যায়?

অরা উৎফুল্ল গলায় বলল, “আপনার থার্ড সিক্রেটও আছে?”

“আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত ছিল না, কিন্তু এখন আছে।”

“কী সেই সিক্রেট?”

আরশাদ শান্ত স্বরে বলল, “কিন্তু তার আগে একটা ডিসক্লেইমার। ইতোমধ্যে তুমি আমার দুটো সিক্রেট জেনে ফেলেছো। কাউকে বিশ্বাস না করলে তাকে সিক্রেট বলা যায় না। তোমাকে আমি অসম্ভব বিশ্বাস করি বলেই সিক্রেটগুলো বলেছি। কখনো বলিনি, কাউকে বলবে না কিন্তু! কারণ আমার বিশ্বাস আছে, তুমি কাউকে বলবে না।”

অরা হাসিমুখে বলল, “আপনার সিক্রেটগুলো সবসময় আমার কাছে সুরক্ষিত থাকবে স্যার।”

আরশাদ রহস্য মিশ্রিত গলায় বলল, “তবুও আজ বলছি, এই সিক্রেটের কথা পৃথিবীর কেউ যেন না জানে। শুধু তুমি জানবে।”

“বলুন তো সিক্রেটটা!

“আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

“কী সিদ্ধান্ত?”

“আমি একটা প্রোডাকশন হাউজ খুলবো।”

অরা হতবিহ্বল গলায় বলল, “মানে আপনি সিনেমা প্রডিউস করবেন?”

আরশাদ গুছিয়ে বলতে শুরু করলো, “হুঁ। এখন থেকে আর অন্যের প্রোডাকশনে কাজ করবো না। নিজের সিনেমায় নিজেই ইনভেস্ট করবো। শুধু যে আমার অভিনয় করা সিনেমাতেই ইনভেস্ট করবো এমনটা না। হাই বাজেটের অন্যান্য সিনেমাও প্রডিউস করবো। আইডিয়াটা কেমন?”

আরশাদ নিজেও জানে এই আইডিয়ার কোনো তুলনা হয় না। এতগুলো বছর ধরে অর্জিত খ্যাতির কারণেই তার কোনো একটা সিনেমা মুক্তি পেলেই দর্শক হুমড়ি খেয়ে পড়ে তার ওপরে। আরশাদ হকের সিনেমা মানেই ব্যবসাসফল সিনেমা। নিজে এত কষ্ট করে অভিনয় করে সব লাভ কেন অন্য প্রযোজককে ভোগ করতে দেবে সে?

“দারুণ স্যার! আপনি জানেন, আপনার প্রোডাকশন হাউজ দেশের সবথেকে বড় প্রোডাকশন হাউজে পরিণত হবে?”

“জানি। কিন্তু সিক্রেট এটা না।”

অরা কিছুটা বিভ্রান্ত গলায় বলল, “তাহলে?”

“ব্যবসা আমি ভালো বুঝলেও অভিনয় নিয়েই থাকতে চাই। প্রোডাকশন হাউজে বেশি সময় দিতে পারবো না। সিক্রেটটা হলো, আমার প্রোডাকশন হাউজের সিইও হবে তুমি।”

অরা বিস্ময়ে খাবি খেয়ে বলল, “আমি?”

আরশাদ অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় বলল, “অবিশ্বাসের কী আছে? নিজেকে যোগ্য বলে মনে করো না?”

“সেটা না স্যার। কিন্তু মানুষ কী বলবে?”

আরশাদ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “মানুষ বলবে এতবড় প্রোডাকশন হাউজের সিইও হওয়ার কোনো যোগ্যতা এই মেয়েটার নেই। বিয়ের খাতিরে আরশাদ তাকে ইচ্ছা করে সিইও বানিয়েছে।”

অরা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আরশাদের দিকে। তার বলা প্রতিটা কথাই সত্যি। এত বড় একটা দায়িত্ব নেওয়ার যোগ্যতা তার থাকলেও মানুষ বলে যাবে, তার কোনো যোগ্যতা নেই। আরশাদের স্ত্রী হওয়ার সুবাদে এতবড় একটা আসনে বসার সুযোগ সে পেয়েছে।

আরশাদ বলল, “কিন্তু তাতে কী সত্যিটা বদলে যাবে?”

অরা প্রশ্ন-সূচক দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে।

“সত্যি হলো তোমার থেকে যোগ্য সিইও আমি কোথাও পাবো না। তোমার মধ্যে যে ক্যাপাবিলিটি আছে তা আর কারও মধ্যে নেই। গত কয়েক বছর ধরে আমার ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছো তুমি। অথচ আমি এক মুহূর্তের জন্যেও দায়িত্বে অবহেলা করতে দেখিনি তোমাকে। আমার বিশ্বাস তুমিই পারবে এই বড় কোম্পানিটা চালাতে।”

অরা কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে নিষ্পলক তাকিয়ে রইল আরশাদের দিকে। তার চোখে জল টলমল করছে। যেকোনো সময় গড়িয়ে পড়বে দুই গাল বেয়ে। সে তো নিতান্তই সাধারণ একটা মেয়ে। তাকে এতটা যোগ্য কেন মনে করে আরশাদ? এতটা বিশ্বাস কেন করে? একটা মানুষের বিশ্বাসের থেকে বড় অর্জন এই পৃথিবীতে কিছুই হতে পারে না।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here