ফিরে_আসা ৩৪+৩৫ লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

0
767

#ফিরে_আসা
৩৪+৩৫
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

“উফ অরা! তোকে আজ যা লাগছে না! আরশাদ ভাইয়া এক পলক দেখেই শেষ হয়ে যাবে।” উৎসাহে উপচে পড়ে বলল সীমা।

ভিডিও কলে অরাকে দেখেই মুগ্ধ হয়ে গেল সীমা। আর যে সামনাসামনি দেখবে, তার তো মুগ্ধতার সকল সীমা ছাড়িয়ে যাবে। অরাকে আজ অপরূপ সুন্দর লাগছে। বহু বছর পর আজ সে শাড়ি পড়েছে। টকটকে লাল শাড়ির ওপরে সূক্ষ্ম সোনালী কাজ করা। কোমর ছাড়িয়ে যাওয়া চুলগুলো ছেড়ে রেখেছে। চোখে গাঢ় কাজলের প্রলেপ আর ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক। দু হাত ভর্তি লাল কাঁচের চুড়ি। অরার গায়ের রং আজ অতসী ফুলের মতো চকচক করছে।

অরা গম্ভীর গলায় বলল, “আবারও বাজে কথা? আর স্যার তোর ভাইয়া হলো কবে থেকে রে?”

সীমা নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “যেদিন থেকে আমার বোনের সমান বান্ধবীর বর হয়েছে সেদিন থেকে। একে তো আমি আজকালকার আধুনিক মেয়ে, তার ওপর আবার আমার বোনের বর আরশাদ হক! দুলাভাই শব্দটা এখানে ঠিক মানায় না। তাই ভাইয়া।”

“তোকে নিয়ে আর পারি না!”

“পারতেও হবে না। মিরর সেলফির মতো করে ফোনটা ধর তো! শাড়িটা দেখি।”

সীমার কথা মতো অরা ফোনটা নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো।

সীমা অনেকটা সময় নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবুক গলায় বলল, “হুঁ! এবার বুঝেছি!”

অরা ভ্রু কুঁচকে বলল, “কী বুঝলি?”

“আরশাদ ভাইয়ার আশে-পাশে মাছির মতো নায়িকারা ঘুরঘুর করে। তবুও সে তোকে বিয়ে করলো কেন?”

অরা ভড়কে গিয়ে বলল, “মানে?”

“তোর এই ফিগার দেখে। বাপ রে বাপ! এমন ফিগার তো নায়িকাদেরও নেই।”

সীমা কথাবার্তা আজকাল এমনই লাগামছাড়া হয়ে যাচ্ছে। দিনে যতক্ষণ তার সঙ্গে ফোনে কথা হয়, ততক্ষণই তার মুখে থাকে এ ধরনের কথা।

অরা বিরক্ত গলায় বলল, “তোর ফালতু কথা শেষ হয়েছে?”

সীমা হাসি হাসি গলায় বলল, “আমার কথা যদি ফালতুই হয়ে থাকে তাহলে তুই লজ্জা পাচ্ছিস কেন?”

অরা লক্ষ্য করলো লজ্জা সে আসলেই পাচ্ছে। লজ্জায় রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে তার দুই গাল। কিন্তু লজ্জার বিষয়টা নিজের কাছে স্বীকার করতে অরা নিজেই নারাজ।

তাই একপ্রকার জোর দিয়ে বলল, “আমি মোটেও লজ্জা পাচ্ছি না।”

সীমা সন্দেহমিশ্রিত গলায় বলল, “আগে তো ভাইয়ার নাম শুনলে এমন করতিস না। এখন তোর কী হয়েছে?”

“আমার আবার কী হবে?”

“আমি কী জানি? দুজনে এক বাড়িতে বন্দী থেকে এতদিনে না জানি কোন প্রেম কাহিনী শুরু করে দিয়েছিস!”

লজ্জায় আবারও কান গরম হয়ে গেল অরার। এসব কী ধরনের কথা? নিজের ওপর নিজেই বিরক্ত হয়ে উঠলো অরা। সে এত লজ্জা পাচ্ছে কেন? লজ্জা পাবার মতো কিছু তো হয়নি। সে তো সত্যি সত্যিই আরশাদের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে না।

অরা বিরক্ত গলায় বলল, “ধুর! তোকে ফোন করাটাই আমার ভুল হয়েছে।”

“আচ্ছা বাবা, রাগ করিস না। এত বড় একটা অনুষ্ঠানে যাচ্ছিস হাসিখুশি থাক। কাল পত্রিকায় নিশ্চয়ই নিজের গোমড়ামুখো ছবি দেখতে চাস না।”

বড় অনুষ্ঠান বটেই। অরা আজ যাচ্ছে সানরাইজ স্টার অ্যাওয়ার্ডে, আরশাদের সঙ্গে। অ্যাওয়ার্ড শোয়ের ঝলমলে আবহাওয়ায় তার মতো অতি সাধারণ একটা মেয়েকে কতটা মানাবে কে জানে? সে তো শুরুতে যেতেই চায়নি। আরশাদের কথায় রাজি হয়েছে। আরশাদের মতে, বিয়ের পর তাদের দুজনকে একসঙ্গে কোথাও দেখা যায়নি। এমনটা চলতে থাকলে সবাই সন্দেহ করবে, বিয়েটা স্বাভাবিকভাবে হয়নি।

অরা লক্ষ্য করলো ইতোমধ্যেই একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রমহিলা এসে দাঁড়িয়েছে সীমার পাশে। কৌতূহলী দৃষ্টিতে দেখছে অরাকে।

সীমা উৎফুল্ল গলায় বলল, “মা এই দেখো আমার বান্ধবী অরা! ঢাকায় আমি ওর সঙ্গেই থাকি। না মানে, থাকতাম। এখন সে বিয়ে করে স্বামীর সংসার করছে।”

অরা প্রায় বলেই ফেলছিল, “মার খাবি সীমা!”
তবে পাশেই তার মা দাঁড়িয়ে থাকায় আর বলতে পারলো না। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে গেল সীমার বাঁদরামি।

অরা হাসিমুখে বলল, “আসসালামুয়ালাইকুম খালা।”

সীমার মা বিভ্রান্ত গলায় বললেন, “ওয়ালাইকুম আসসালাম। মা, তোমাকে কি আমি চিনি?”

“না তো খালা।”

“কোথায় যেন দেখেছি বলে মনে হচ্ছে।”

সীমা ফুর্তির ভঙ্গিতে বলল, “আরে মা! পেপারে ছবি দেখেছো হয়তো। ও আরশাদ হকের বউ।”

সীমার মুখে যতবারই “আরশাদ হকের বউ” কথাটা শোনে, ততবারই অরার গা বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে চলে যায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না।

সীমার মা বিস্মিত গলায় বললেন, “নায়ক আরশাদ হক?”

“হ্যাঁ!”

“আরশাদ হকের বউ তোর বান্ধবী হলো কী করে?”

“এটা একটা কথা বললে মা? আরশাদ হকের বউ আমার বান্ধবী হতে যাবে কেন? আমার বান্ধবী তার বউ হয়েছে।”

সানরাইজ কোম্পানি গত পনেরো বছর ধরে এই অ্যাওয়ার্ড শোয়ের আয়োজন করে আছে। ইন্ডাস্ট্রির সকল অভিনেতা-অভিনেত্রী মুখিয়ে থাকে জীবনে অন্তত একবার সানরাইজ জেতার জন্যে। আর সেখানে আরশাদ গত চার বছর ধরে পরপর জিতে আসছে সেরা অভিনেতার পুরস্কার। এবারও সে মনোনয়ন পেয়েছে একই ক্যাটাগরিতে।

অ্যাওয়ার্ড শোতে এর আগেও অরা গিয়েছে। তবে সেটা আরশাদের ম্যানেজার হিসেবে। সেবার তাকে নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি। তবে আজকের পরিস্থিতি ভিন্ন। কারণ আজ অরা ম্যানেজার হিসেবে নয়, যাচ্ছে আরশাদের স্ত্রী হিসেবে। ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে তার।

আরশাদের সঙ্গে এই কতগুলো দিনে তার সুন্দর একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। তবে নামহীন এই সম্পর্কের সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের কোনো মিল নেই। আজ অরাকে আরশাদের স্ত্রীয়ের ভূমিকায় অভিনয় করতে হবে। আরশাদের না হয় অভিনয়ের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা। কিন্তু তার কী হবে? সে কি পারবে সূক্ষ্মভাবে আরশাদের স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করতে? যদি কোনো ভুল করে ফেলে?

সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে হঠাৎ আরশাদের চোখ পড়লো অরার ওপরে। সঙ্গে সঙ্গে থমকে দাঁড়ালো সে। তবে সেটা কয়েক সেকেন্ডের জন্য। মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিলো আরশাদ। অরাকে আজ অন্যরকম লাগছে। এতদিন ধরে তাকে যেমনটা দেখে আরশাদ অভ্যস্ত, তার থেকে একেবারেই আলাদা। নেহায়েত অরা সর্বক্ষণ এমন সাজগোজ করে থেকে না। না হলে ডিরেক্টররা কবে তাকে নায়িকা হিসেবে কাস্ট করে ফেলতো!

ভাগ্যিস অরা খেয়াল করেনি দূর থেকে কেউ একজন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সে ব্যস্ত শাড়ির কুঁচি নিয়ে। এমনিতেও এই জিনিস পড়ার অভ্যাস তার নেই। তার ওপরে এত বড় একটা অনুষ্ঠানে যাচ্ছে!

নেমে এসে আরশাদ ক্ষীণ স্বরে বলল, “চলো! দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

অরা শাড়ির কুঁচি থেকে চোখ ফিরিয়ে বলল, “জি স্যার, চলুন।”

গাড়ি চলছে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের উদ্দেশ্যে। ড্রাইভ করছে আরশাদ নিজেই। প্যাসেঞ্জার সিটে বসে থাকা অরার হৃদস্পন্দন একটু একটু করে বেড়ে যাচ্ছে। অন্য সময় হলে কারণটা হতো, আরশাদের ড্রাইভ করা। তার ড্রাইভিংয়ের ওপর এখনো ঠিক ভরসা করে ওঠা যায় না। তবে আজকের কারণটা ভিন্ন।

অরা অস্পষ্ট গলায় বলল, “স্যার?”

আরশাদ সামনের দিকে চোখ দেখে বলল, “হুঁ?”

অরা নার্ভাস ভঙ্গিতে বলল, “আমার খুব ভয় করছে।”

আরশাদ স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, “ভয়ের কী আছে? এমন তো নয় যে এর আগে কখনো তুমি অ্যাওয়ার্ড শো তে যাওনি।”

“গিয়েছি। তবে আজকের যাওয়াটা তো আলাদা। এর আগে কখনোবার সাংবাদিকদের ক্যামেরায় বন্দী হতে হয়নি আমাকে। কিন্তু আজ তো হবে।”

আরশাদ আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “ভয়ের কিছু নেই অরা। আমি থাকবো তোমার পাশে।”

ধ্বক করে উঠলো অরার বুকটা। এই অনিশ্চয়তার জীবনে কেউ তাকে কোনোদিন বলেনি “আমি তোমার পাশে থাকবো”। কেউ তার পাশে থাকতেও চায়নি। আজ প্রথমবারের মতো কথাটা শুনলো সে। তাও আবার আরশাদের মুখে।

কিছুটা সময় চুপ করে থেকে অরা কী যেন মনে করে উৎফুল্ল ভঙ্গিতে বলল, “দেখবেন স্যার! আজ বেস্ট অ্যাক্টরের অ্যাওয়ার্ড আপনিই পাবেন।”

আরশাদ হালকা গলায় বলল, “যে কেউই পেতে পারে। এই ইন্ডাস্ট্রিতে আমার থেকেও ভালো অভিনেতা আছে।”

“সেটা আপনার ভুল ধারণা স্যার।”

“এত জোর দিয়ে বলছো কী করে? আমার কয়টা সিনেমা দেখেছো তুমি?”

“আপনি তো জানেন না। এই কয়দিনে আপনার সবগুলো সিনেমা আমার দেখা হয়ে গেছে।”

“তাই না-কি?”

“হুঁ।”

অরা হঠাৎ কী যেন মনে করে উৎফুল্ল গলায় বলল, “স্যার? আমার থার্ড সিক্রেট শুনবেন?”

“বললে অবশ্যই শুনবো।”

অরা হাসিমুখে বলল, “আমি আপনার অনেক বড় ফ্যান হয়ে গেছি।”

আরশাদ শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “I’m honoured. তুমি তো এখন আমার ফ্যান হয়েছ। অথচ আমি সেই কবে থেকে তোমার ফ্যান।”

অরা হতভম্ব গলায় বলল, “আমার ফ্যান?”

“হুঁ। তোমার দায়িত্বশীলতা আমাকে মুগ্ধ করেছ।”

অরা কৃতজ্ঞ ভঙ্গিতে বলল, “Thank you sir.”

আরশাদ হঠাৎ ভ্রু কুঁচকে বলল, “মানুষের সামনেও কী এমন স্যার স্যার করবে?”

অরা ভড়কে গিয়ে বলল, “তাহলে কী ডাকবো স্যার?”

আরশাদ অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় বলল, “নাম ধরে ডাকবে।”

অরা আঁতকে উঠে বলল, “না স্যার! আমি কিছুতেই আপনাকে নাম ধরে ডাকতে পারবো না।”

“তাহলে কিছুই ডাকতে হবে না। তবুও স্যার ডেকো না প্লিজ।”

চারিদিক আলোয় ঝলমল করছে। দেশের প্রায় সব সেলিব্রিটিরা আজ জড়ো হয়েছে নিজেদের সেরা পোশাকটায়। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের বাইরে সাংবাদিকদের ব্যাপক ভীড়। তাদের ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। কিছু কিছু সিনিয়র সাংবাদিকদের কেবলমাত্র প্রবেশের অনুমতি রয়েছে। সেলিব্রিটিরা ভেতরে প্রবেশ করার আগে সাংবাদিকদের সামনে পোজ দিয়ে দাঁড়াচ্ছে, আর তারা ক্যামেরায় ক্লিক করে ছবি তুলে যাচ্ছে।

আরশাদের গাড়িটা এসে থামার সঙ্গে সঙ্গে সাংবাদিকদের স্রোত ভেসে এলো এদিকে। আরশাদ হকের মতো তার এই গাঢ় সবুজ রঙের গাড়িটাও কম বিখ্যাত নয়। আরশাদের দুজন বডিগার্ড ঝড়-তুফান এসে সাংবাদিকদের ভীড় সামলাচ্ছে। এরা এতক্ষণে পেছনের গাড়িতে ছিল। এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অ্যাওয়ার্ড শোয়ের সিকিউরিটি গার্ডরাও।

আরশাদ গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো। তার দেখাদেখি অরাও নামলো। তবে তার ভয়টা বেড়ে এখন একেবারে তুঙ্গে। কয়েকজন সাংবাদিক তাদের ক্যামেরা অরার দিকে ফিরিয়ে ক্লিক ক্লিক করে নিমিষেই কতগুলো ছবি তুলে ফেলল।

অন্য সময় হলে অরা বলতো, “আপনি কি আমার ছবি তোলার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন?”

তবে আজ কিছুই বলতে পারলো না। হিমবাহের মতো জমে দাঁড়িয়ে রইল। আচমকা অরা তার ডান হাতে নরম একটা স্পর্শ পেলো। চমকে উঠে তাকাতেই আরেক দফা চমকে উঠলো। আরশাদ তার হাত ধরেছে। অরার গায়ে কাঁটা দিয়ে যাচ্ছে, প্রবল শীতল হাওয়া বয়ে যাচ্ছে তার ওপর দিয়ে। কেন হচ্ছে এমনটা? আরশাদ তো আর ইচ্ছা করে তার হাত ধরেনি। সামনে ক্যামেরা, তাকে অভিনয় করতে হবে স্ত্রীর সঙ্গে এসেছে – তাই হাত ধরেছে। তবুও এই অন্যরকম অনুভূতির কারণটা কী?

আরশাদ নিচু গলায় বলল, “চলো ভেতরে যাই!”

অরা হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। তবে তার বুকের মধ্যে উথাল-পাথাল তুফান এখনো চলমান রয়েছে।

আরশাদের হাত ধরে রেড কার্পেট দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে অরা। সাধারণত যে গেট দিয়ে সেলিব্রিটিরা প্রবেশ করে, সেটা বরাবর রেড কার্পেট বিছানো থাকে। সাধারণ দর্শক সেই গেট থেকে প্রবেশ করতে পারে না। তাদের প্রবেশ করতে হয় পেছনের গেট দিয়ে। এর আগে যতবারই অরা এই অ্যাওয়ার্ড শোতে এসেছে, ততবার ওই পেছনের গেট দিয়েই এসেছে। আজ প্রথমবারের মতো রেড কার্পেট দিয়ে হেঁটে কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে।

রেড কার্পেটের সামনে অ্যাওয়ার্ড শোয়ের নিজস্ব ফটোগ্রাফারদের ভীড়। ভিন্ন ভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে সেলিব্রিটিদের ছবি তোলা তাদের কাজ। ছবি তোলার জন্যে নির্ধারিত জায়গাটায় গিয়ে দাঁড়ালো আরশাদ এবং অরা। ফটোগ্রাফাররা এক মুহুর্তও অপচয় না করে ব্যস্ত হয়ে পড়লো ক্যামেরা নিয়ে। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ মুখে এসে পড়ছে।

অরা কম্পিত স্বরে বলল, “আমি সরে দাঁড়াই! ওরা আপনার ছবি তুলুক।”

আরশাদ ধমকের সুরে বলল, “কেন সরে দাঁড়াবে? চুপচাপ এখানে দাঁড়িয়ে।”

আতঙ্কে জমে একরাশ ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে রইল অরা। ডান হাতটা এখনো আরশাদের হাতে। বাম হাত দিয়ে সে শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছে শাড়ির আঁচল। আজ যে সে এতটা নার্ভাস হয়ে যাবে নিজেই বুঝতে পারেনি।

ছবি তোলার পর্ব শেষে আরশাদ এবার রেড কার্পেটে ইন্টারভিউ দিচ্ছে। রেড কার্পেটের এই বিশেষ ইন্টারভিউগুলো মূল অনুষ্ঠান প্রচারের আগের দিন টিভিতে প্রচার করা হয়। অরা খানিক দূরে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে পরিবেশটা। আশেপাশে সব পরিচিত মুখ। এত এত সেলিব্রিটির দেখা একসঙ্গে কেবল এমন অ্যাওয়ার্ড শোতেই মেলে। কোনো কোনো সেলিব্রিটিরা দল বেঁধে আড্ডা দিচ্ছে, কেউ আবার সেলফি তুলছে। সকলের ঠোঁটে লেগে আছে প্রচ্ছন্ন একটা হাসি।

হঠাৎ অরার চোখ পড়লো আরশাদের ওপর। নাহ্! এই মানুষটার মতো যাদুকরী আর কাউকে লাগছে না। আরশাদ যে অসম্ভব হ্যান্ডসাম এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তবে আজ সাদা শার্ট আর কালো সুটে সেই হ্যান্ডসামনেস যেন কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। কথা বলার সময় চুলগুলো চোখের সামনে এসে পড়েছিল। এক হাত দিয়ে যখন চুলগুলো সরিয়ে নিলো, দৃশ্যটা ছিল দেখার মতে।

অরা চোখ সরিয়ে নিলো! ছি! ছি! সে এতক্ষণ নির্লজ্জের মতো আরশাদের দিকে হা করে তাকিয়ে ছিল? কারও চোখে পড়েনি তো বিষয়টা?

অ্যাওয়ার্ড শো গুলোতে সেলিব্রিটির পাশাপশিও উপস্থিত থাকে সিনেমার পরিচালক, গায়ক-গায়িকা এবং অন্যান্য কলাকুশলীরা। সেলিব্রিটিদের মধ্যে আবার প্রকারভেদ থাকে। কেউ একটু বেশি জনপ্রিয়, কেউ একটু কম। সবথেকে বেশি জনপ্রিয় সেলিব্রিটিদের জন্যে একেবারে সামনের সিটগুলো বরাদ্দ। অনুষ্ঠানের আয়োজক নিজে এসে আরশাদ এবং অরাকে নিয়ে গেলেন মূল হলে। একেবারে সামনের সিটে বসিয়ে দিলেন।

অনুষ্ঠান শুরু হতে এখনো দশ মিনিট বাকি। সবাই এক এক করে হলে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। স্টেজ থেকে টুংটাং শব্দ ভেসে আসছে। পারফরমেন্সের শেষ প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। প্রথম পারফরমেন্সটা তাহলে গানেরই হবে।

“স্যার?”

থমথমে দৃষ্টিতে আরশাদ তাকালো অরার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে অরার মনে পড়লো গাড়িতে তাদের মাঝে হওয়া কথোপকথনের কথা।

“বলো।”

অরা নিচু স্বরে বলল, “এত এত ক্যামেরা আপনি সহ্য করেন কী করে?”

আরশাদ ক্ষীণ হাসি হেসে বলল, “একবার ক্যামেরার মুখোমুখি হয়েই বিরক্ত হয়ে গেছ?”

“বিরক্ত ঠিক না, নার্ভাস। মানুষের এত অ্যাটেনশন পেয়ে আমি অভ্যস্ত নই তো।”

“শুরু শুরুতে আমারও নার্ভাস লাগতো। অথচ এখন এতোটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে সামনে ক্যামেরা না থাকলে বরং অস্থির লাগে।”

অনুষ্ঠান সময় মতোই শুরু হলো। অরার ধারণাই সঠিক হলো। প্রথম পারফরমেন্সটা হলো গানের। তাও আবার উচ্চাঙ্গসংগীতের। অরা ভেবে পায় না, এমন জমকালো অনুষ্ঠানের সূচনা কী করে উচ্চাঙ্গসংগীতের মতো গুরুগম্ভীর জিনিস দিয়ে হতে পারে? প্রথম পারফরমেন্সের পর আয়োজকরা ছোট ছোট বক্তৃতা দিলেন।

দেশের দুজন বিখ্যাত অভিনেতা অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা করছে। দু মিনিট পর পর তারা জোকস বলে দর্শকদের হাসানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে। ভদ্রতার খাতিরে দুয়েকজন সেই জোকসে হাসলেও বেশির ভাগের ঠোঁটে নীরবতা। বেশির ভাগের সেই দলে রয়েছে আরশাদও। তার মুখভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে যেন পারলে স্টেজে উঠে ওই দুজনকে তুলে আছাড় মারবে।

শুরু হলো পুরষ্কার বিতরণ পর্ব। সবার আগে যথারীতি আজীবন সম্মাননা পুরষ্কার। এবারের আজীবন সম্মাননা পেলেন আশির দশকের জনপ্রিয় অভিনেত্রী জাহানারা কবির।
এরপর আরও একটা পারফরমেন্স। এ সময়ের আলোচিত অভিনেত্রী শেহেনাজের নাচ মোটেও মনকাড়া ছিল না। আমাদের দেশের বেশির ভাগ নায়িকারাই নাচ জানে না। হাসিমুখে তারা গানের তালে হাত-পা নাড়ে, আর তা দেখেই বিনোদিত হয় দর্শকের অনেক বড় একটা অংশ। পারফরমেন্স যথেষ্ট বাজে হলেও সকলে হাততালি দিলো, আরশাদ ব্যতীত। এবারও সে থমথমে দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল স্টেজের দিকে। তার মুখভঙ্গি দেখে এবার মনে হচ্ছে, পারলে সে এখনই উঠে বাড়ি চলে যায়।

শেহেনাজের পারফরমেন্সের পর বেশ কতগুলো অ্যাওয়ার্ড পরপর বিতরণ করা হলো। সেরা কস্টিউম ডিজাইনার, সেরা চিত্রগ্রাহক, সেরা সম্পাদক, সেরা শব্দগ্রাহক, সেরা প্রোডাকশন ডিজাইনার। পর্দার পেছনের এই মানুষগুলোকে অনুপ্রেরণা দেওয়ার দরকার আছে। এরা না থাকলে একটা সিনেমা নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াতে পারে না। এরপর শুরু হলো সঙ্গীত বিভাগের পুরষ্কার বিতরণ। সেরা সুরকার, সেরা গীতিকার, সেরা গায়িকা আর সেরা গায়ক।

আরও একটা পারফরমেন্স। গিটার হাতে স্টেজে উঠে গেল সঙ্গীতশিল্পী শাহরিয়ার। নিজের ক্যারিয়ারের সবথেকে জনপ্রিয় গানগুলো পরপর গেয়ে গেল সে। নিঃসন্দেহে এটা আজ রাতের সেরা পারফরমেন্স। শাহরিয়ারের মাদকময় কণ্ঠ এবং গানের অর্থবহ কথায় বুদ হয়ে রইলো গোটা হল। পারফরমেন্স শেষে হাততালিতে ফেটে পড়লো সকলে। এমনকি এবার আরশাদও শান্ত ভঙ্গিতে হাততালি দিলো।

এবার শুরু হলো প্রধান প্রধান অ্যাওয়ার্ড বিতরণের পালা। সেরা সিনেমা, সেরা পরিচালক, সেরা চিত্রনাট্য, সেরা অভিনেত্রী এবং সেরা অভিনেতা। এই পাঁচটি ক্যাটাগরিকেই প্রধান বলে বিবেচনা করা হয়। প্রত্যেকটা ক্যাটাগরিতেই আরশাদের গত বছরের সফল সিনেমা ‘দুর্জয়ের দুর্দিন’ মনোনীত হয়ে আছে।

সেরা সিনেমা এবং চিত্রনাট্যের জন্যে পুরস্কৃত হলেন এফ এস আলম। তিনিই ‘দুর্জয়ের দুর্দিন’ সিনেমার চিত্রনাট্যকার এবং পরিচালক। সেরা সিনেমার পুরস্কারটাও জিতে নিলো ‘দুর্জয়ের দুর্দিন’। বাইরের দেশের অ্যাওয়ার্ড শো গুলোতে সাধারণত সিনেমার সঙ্গে জড়িত সকলে ডাকা হয় এই পুরষ্কার গ্রহণের জন্যে। তবে সানরাইজ স্টার অ্যাওয়ার্ডের দীর্ঘদিনের নিয়ম, সিনেমার প্রযোজক একা এসে এই পুরষ্কার গ্রহণ করবেন।

প্রযোজক সাহেব পুরষ্কার হাতে দীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন। অবশ্য বক্তৃতা বললে ভুল হবে। তিনি যা করলেন, তাকে বলে প্রশংসা। পুরোটা সময় জুড়ে তিনি আরশাদের প্রশংসা করে গেলেন। তার মতে একমাত্র আরশাদের কারণেই তার সিনেমা এতটা ব্যবসাসফল হয়েছে। আরশাদ সিনেমায় ছিলো বলেই আজ সেরা সিনেমার পুরষ্কার তার হাতে। সবশেষে পুরস্কারটা তিনি আরশাদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গও করলেন। অদ্ভুত ব্যাপার! ইন্ডাস্ট্রির বেশির ভাগ নায়ক-নায়িকাদের স্বভাব, যেখানে যাবে মিষ্টি ভাষায় প্রযোজকের প্রশংসা করা। যাতে পরবর্তীতে তার প্রযোজনার সিনেমায় ওই নায়ক বা নায়িকাকে ডাকা হয়। আর এখানে প্রযোজক নিজেই আরশাদের প্রশংসা করছেন। একেই বলে সুপারস্টার!

এবার শুধু দুটো পুরষ্কার বিতরণ বাকি। সেরা অভিনেত্রী এবং সেরা অভিনেতা। এই দুটো পুরষ্কার কে জিতলো জানার জন্যেই মূলত দর্শক মুখিয়ে থাকে। তবে তার আগে আরও একটি পারফরমেন্স। তিনজন নায়ক এবং তিনজন নায়িকা জুটি বেঁধে নাচলেন। দুই জুটির নাচ হয়েছে একেবারে অখাদ্য, এবং এক জুটির সবথেকে সুন্দর। পারফরমেন্সের শেষের দিকে ছয়জন একসঙ্গে স্টেজে এসে নাচলেন। এই মুহূর্তটা অবশ্য সুন্দর ছিল।

সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতলো নায়িকা মোহর। তার অভিনীত সিনেমা ‘ব্যস্ততা’র জন্যে। অরা ভেবেছিল এই পুরস্কারটাও ‘দুর্জয়ের দুর্দিন’ এর নায়িকা কেয়া পাবে। অবশ্য কেয়ার পুরষ্কার পাবার কথাও নয়। নায়িকা হলেও ‘দুর্জয়ের দুর্দিনে’ তার চরিত্র একেবারেই সামান্য। তাছাড়া কেয়ার থেকে মোহরের জনপ্রিয়তাও বেশি।

প্রবীণ অভিনেতা খলিল আহমেদ স্টেজে উপস্থিত হলেন। সেরা অভিনেতার নাম তিনিই ঘোষণা করবেন। সমগ্র হলজুড়ে নীরবতার
বিচিত্র হাওয়া। সেরা অভিনেতার নামটা শোনার জন্যে সকলেই উদগ্রীব হয়ে আছে।

প্রবীণ অভিনেতাদের এক অভ্যাস হলো, পুরষ্কার বিজয়ীর নাম ঘোষণার আগে তাকে নিয়ে একটু গল্প করা। খলিল আহমেদও তার ব্যতিক্রম নন। তিনি মাইক হাতে দারাজ গলায় বললেন, “যে ছেলেটা অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে, তার সঙ্গে একটা মাত্র সিনেমায় অভিনয় করার সুযোগ হয়েছে আমার। সকালে সেটে এসে পা ছুঁয়ে সালাম করলো আমাকে। আজকাল নায়কদের মতো এমন ভদ্রতা লক্ষ্য করা যায়? আমি অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি এত ভালো অভিনয় করো কী করে? সে মিষ্টি হেসে বলল, আপনার কাছ থেকেই শেখা স্যার। আমার যুগে কেমন অভিনয় করতাম আমি জানি না। তবে জোর দিয়ে বলতে পারি, এই ছেলেটার মতো গুণী অভিনেতা বাংলাদেশ কখনো পায়নি। কোনোদিন পাবেও না।”

অরার হৃদস্পন্দন বেড়েই চলেছে। সেই সঙ্গে বিরক্তিও। এমন মুহূর্তে এসে এই বুড়ো লোকটা রাজ্যের গল্প জুড়ে দিয়েছে! কোনো মানে হয়? উত্তেজনায় অরার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হয়েছে।

খলিল আহমেদ উঁচু গলায় ঘোষণা করলেন, “সানরাইজ সেরা অভিনেতা ২০২৩, আরশাদ হক।”

প্রচ্ছন্ন একটা হাসি ফুটে উঠলো অরার ঠোঁটে। হাসি মুখে আরশাদের দিকে তাকাতেই লক্ষ্য আরশাদ মৃদু হেসে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ইশ! সময়টা ঠিক এখানেই থেমে যেত। দুজনে এভাবেই হাসিমুখে তাকিয়ে থাকতো একে অপরের দিকে!

আরশাদের নাম শুনে হাততালিতে ফেটে পড়লো পুরো হল। দর্শকদের একটা অংশ ইতোমধ্যেই “আরশাদ! আরশাদ!” চেঁচাতে শুরু করে দিয়েছে। আরশাদ স্টেজে উঠতে উঠতে অরা পার্স থেকে মোবাইলটা বের করে ভিডিও করা শুরু করলো। যদিও অসংখ্য ক্যামেরা এই দৃশ্যটা ধারণ করছে। তবুও, কিছু স্মৃতি থাক একান্ত নিজস্ব হয়ে।

আরশাদ পুরষ্কার হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাততালির শব্দ বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে উঠলো। আরশাদ তার স্বভাবমতো দীর্ঘ বক্তৃতায় যায়নি। এক বাক্যে সিনেমার সকল কলাকুশলী, সহ অভিনেতা-অভিনেত্রী, পরিচালক, এবং প্রযোজককে ধন্যবাদ জানালো। বিশেষ করে ধন্যবাদ জানালো তার ভক্তদের।

স্টেজ থেকে শান্ত ভঙ্গিতে নেমে এলো আরশাদ। তার মধ্যে তেমন আনন্দের কোনো প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। ভাবটা এমন যেন, এমন অ্যাওয়ার্ড যে প্রতিদিনই পায়। অ্যাওয়ার্ড শো প্রতিদিন আয়োজন করা হলে অবশ্য সে প্রতিদিনই পেতো। নেহায়েত এক বছর পর পর আয়োজন করা হয়। তবে অরার মধ্যে উৎফুল্ল ভাবটা এখনো রয়ে গেছে। তার আনন্দের সকল সীমা আজ ছাড়িয়ে গেছে। বহু বছরে এমন আনন্দিত সে হয়নি। আরশাদ এসে তার অ্যাওয়ার্ড ধরিয়ে দিলো অরার হাতে। অরা অবাক দৃষ্টিতে দেখছে সেটা। আরশাদের বাড়ির বসার ঘরে তার পাওয়া সবগুলো অ্যাওয়ার্ড সুন্দর করে সাজানো আছে। তবে কোনদিন সেগুলো ছুঁয়ে দেখার সাহস করে উঠতে পারেনি অরা। আজ প্রথমবারের মতো এই অ্যাওয়ার্ড ছুঁয়ে দেখে তার সমস্ত শরীরে যেন তড়িৎ খেলা করে বেড়াচ্ছে।

জমকালো এই আয়োজন শেষ হতে হতে রাত দশটা বেজে গেল। এতটা সময় পাড় হয়ে গেছে? অথচ অরা বুঝতেই পারেনি। হল থেকে বেরিয়ে আরশাদকে আবারও ফিরে যেতে হলো রেড কার্পেটে। পুরষ্কার সঙ্গে ছবি তুলতে। এবার আর অরা তার সঙ্গে গেল না। দূরে দাঁড়িয়ে রইল।

আজকের পুরষ্কার জয়ীরা ইতোমধ্যেই উচ্ছ্বাসে মেতে উঠেছে। অরা যখন অপেক্ষা করছিল, তখন শুনতে পেলো সেরা গায়িকা সেলিব্রিটি বন্ধুদের জোরাজুরি করছে তার বাসায় গিয়ে সেলিব্রেট করতে। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে দুজনে গাড়িতে গিয়ে বসলো। অরা ভেবেছিল আরশাদ সোজা বাড়ি চলে যাবে। ইন্ডাস্ট্রির সবথেকে ঘরকুনো নায়ক বলে কথা। তবে আরশাদ গাড়ি থামালো একটা নামিদামি চাইনিজ রেস্টুরেন্টের সামনে। মনে মনে কিছুটা অবাক হয়ে উঠলো। আরশাদও কী আজ তার পুরষ্কার জয়ের আনন্দ সেলিব্রেট করতে এসেছে?

দোতলা রেস্টুরেন্টের ওপরের তলা জনমানবশূন্য। সবগুলো টেবিল ফাঁকা পড়ে আছে। আরশাদ নির্ঘাত আগে থেকে বুকিং দিয়ে রেখেছিল।আরশাদ এবং অরা মুখোমুখি টেবিলে বসলো। এই রেস্টুরেন্টে আরশাদ প্রায়ই আসে। তাই এখানকার স্টাফরা তাকে দেখে এক প্রকার অভ্যস্ত। একজন স্টাফ এসে বিনয়ী ভঙ্গিতে অর্ডার নিয়ে গেল।

আরশাদ বলল, “কেমন লাগলো আজ?”

অরা হাসিমুখে উৎফুল্ল স্বরে বলল, “অসাধারণ! পুরোটা সন্ধ্যা আমি ভীষণ এনজয় করেছি। বিশেষ করে আপনাকে যখন অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হলো, তখন তো সবথেকে বেশি এনজয় করেছি। যখন আপনার নাম ঘোষণা করা হলো, তখন আমার থেকে বেশি খুশি ওই হলে আর কেউ হয়নি।”

আরশাদ ক্ষীণ হাসি হেসে বলল, “খুশি তো হবেই। আমার নবাগত ফ্যান বলে কথা।”

“স্যার?”

“হুঁ?”

“আপনার অ্যাওয়ার্ডের সাথে আমি একটা ছবি তুলি?”

“তোলো! দাঁড়াও আমিই তুলে দিচ্ছি।”

অরা পার্স থেকে নিজের ফোনটা বের করে আরশাদের কাছে দিতে যাচ্ছিল। তার আগেই আরশাদ তার নিজের ফোন বের করে অরার কতগুলো ছবি তুললো।

ছবিগুলো অরাকে দেখিয়ে বলল, “কেমন হয়েছে?”

অরা মজার ছলে বলল, “খুব সুন্দর। আপনার বদৌলতে অনেক ফলোয়ার পেয়েছি। এবার এই ছবিটা দিয়ে তাদের কাছে একটু ভাব নেবো।”

এক মাস আগেকার আরশাদ হলে অরা আশা করতো এই একটা কথায় সে রেগেমেগে একাকার পর্যায়ে চলে যাবে। তবে আরশাদ মোটেই রাগ করলো না। মৃদু হেসে বলল, “তোমাকে না জিজ্ঞেস করেই চাইনিজ রেস্টুরেন্টে নিয়ে এলাম। চাইনিজ খাবারে তোমার কোনো অসুবিধা নেই তো?”

“না স্যার।”

কিছুক্ষণের মাঝেই তাদের খাবার চলে এলো। অরার ভাবতেই অবাক লাগছে সে এমন নামিদামি রেস্টুরেন্টে বসে আছে, তাও আবার শুধুমাত্র আরশাদের সঙ্গে। এর আগেও কয়েকবার এই রেস্টুরেন্টে সে এসেছে। প্রতিবারই আরশাদের মিটিংয়ের বদৌলতে।

“স্যার?”

“হুঁ?”

“আপনার আনন্দ হচ্ছে না?”

আরশাদ জুসের গ্লাসে ছোট্ট চুমুক দিয়ে বলল, “কেন? অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি বলে?”

“হুঁ।”

আরশাদ পরিষ্কার গলায় বলল, “না। কারণ প্রথমত, জীবনে এবারই প্রথমবারের মতো অ্যাওয়ার্ড পাইনি। এর আগেও অসংখ্যবার স্টেজে উঠে অ্যাওয়ার্ড নিতে হয়েছে। আর দ্বিতীয়ত, এসব অ্যাওয়ার্ড শোয়ের মূল উদ্দেশ্য যোগ্য শিল্পীকে সম্মান দেওয়া না। অ্যাওয়ার্ড শো গুলোর পেছনে বড় ধরনের পলিটিক্স কাজ করে।”

অরা নুডুলসের প্লেটে চামচ নাড়তে নাড়তে কৌতুহলী গলায় বলল, “সেটা কেমন?”

আরশাদ সুন্দর করে অরাকে বুঝিয়ে বলল, “আজ যে অনুষ্ঠানটা হলো সেটা কয়েকদিন পর টিভিতে দেখানো হবে। অর্গানাইজারদের মূল লক্ষ্যই থাকে টিআরপি কামানো। সুতরাং এমন কাউকে অ্যাওয়ার্ড দিতে হবে যাকে স্টেজে অ্যাওয়ার্ড নিতে দেখলে দর্শকের আনন্দ হবে। বেশি বেশি দর্শক পুরো শোটা দেখবে। দর্শক যত বেশি বেশি দেখবে, টিআরপি ততই বাড়বে। যেমন আমি। আমাকে অ্যাওয়ার্ড দিয়েছে কারণ আমি অ্যাওয়ার্ড নিতে স্টেজে উঠছি, এই দেখার জন্যে হলেও দর্শক পুরো শোটা দেখবে।”

অরা বিভ্রান্ত গলায় বলল, “কিন্তু স্যার, অনেক যোগ্য মানুষও তো আজ অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে।”

“দুয়েকজন পেয়েছে অরা। দুয়েকজন যোগ্য মানুষকে না দিলে দর্শক আবার তাদের ভুয়া বলবে। এসব অ্যাওয়ার্ড শোয়ের মূল লক্ষ্য শিল্পীদের সম্মাননা জানানো নয়, বরং দর্শককে বিনোদন দেওয়া।”

অরা কয়েক মুহূর্ত গভীর চিন্তাভাবনা করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমি অতশত বুঝি না। আমার মতে, এই অ্যাওয়ার্ডের ওপরে অধিকার আপনারই সবথেকে বেশি।”

আরশাদ জানে এই মেয়েটার সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে কোনো লাভ নেই। তাই সে চুপ করে রইলো।

“আপনার অ্যাওয়ার্ড দেখে আজ আমার নিজের অ্যাওয়ার্ডের কথা মনে পড়ে গেল।”

“তুমিও অ্যাওয়ার্ড পেয়েছো না-কি?”

অরা হাসি হাসি গলায় বলল, “পেয়েছিলাম, স্কুলে থাকতে। কেবল ক্লাস ওয়ান বা টুতে পড়ি। মা তখনও বেঁচে ছিল। আমার স্কুলে সেবার যেমন খুশি তেমন সাজো প্রতিযোগিতা। আমি কাঁধে একটা ঝুড়ি আর মাথায় গামছা বেঁধে সেজেছি পাতা কুড়ানি। সেদিন অতিরিক্ত এক্সাইটমেন্টে অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার অনেক আগে স্কুলে পৌঁছে যাই। হেড স্যার আমাকে দেখে বললেন, পাতা কুড়ানি যখন সেজেছিসই, তখন গিয়ে মাঠের সবগুলো পাতা কুড়িয়ে আয় যা। আমিও খুশি মনে মাঠে পড়ে থাকা পাতাগুলো কুড়িয়ে ফেলে দিলাম। ওই দিন আমার সাজ হয়েছিল সবার থেকে খারাপ। তবুও পাতা কুড়িয়েছি বলে হেড স্যার আমাকে থার্ড প্রাইজ দিলেন। একটা কাঁচের প্লেট। সেই প্লেট নিয়ে নাচতে নাচতে আমি বাড়ি ফিরছে। হঠাৎ কীসের সঙ্গে যেন হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম। আমার অ্যাওয়ার্ড ভেঙে দুই টুকরো হয়ে গেল।”

“তাহলে দেখো, সব অ্যাওয়ার্ড শোতেই পলিটিক্স আছে। তুমি ভালো সাজোনি, তবুও পাতা কুড়িয়েছ বলে তোমাকে থার্ড প্রাইজ দেওয়া হয়েছে।”

অরা বিস্মিত গলায় বলল, “তাই তো!”

“একটা ব্যাপার খেয়াল করেছো অরা?”

“কী ব্যাপার স্যার?”

“আমাদের জীবন যতটাই যন্ত্রণায় জড়িয়ে থাকুক না কেন, কোনো না কোনো সুখের স্মৃতি ঠিকই খুঁজে বের করা যায়। তোমার ছোটবেলাটা ট্রমার মধ্যে কাটলেও, তোমার কাছে আনন্দ করে গল্প করার মতো স্মৃতি আছে।”

“আপনার কাছেও নিশ্চয়ই আছে।”

“আমার কাছে তো সুখের স্মৃতি তৈরির আস্ত একটা মেশিন আছে।”

“কী সেটা?”

আরশাদ মলিন স্বরে বলল, “কথা। মেয়েটার সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত আমার কাছে আনন্দের। ও যখন আমার আশেপাশে থাকে, কেবল তখনই আমি আমার যন্ত্রণাগুলো ভুলে থাকতে পারি।”

অরা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “মিস করি কথাকে খুব।”

“আমিও।”

কোথাও যেন হারিয়ে গেল আরশাদ। মেয়ের কথা মনে পড়তেই আজকাল মনে কালো মেঘ জমা হয়। মাস দুয়েক হলো কথা তার দৃষ্টিসীমার বাইরে। ফোনে যদিও রোজ কথা হয়। তবে ফোনে কি আর মানুষের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো অনুভব করা যায়?

চিন্তার জগৎ থেকে বেরিয়ে এলো আরশাদ। আজকের দিনটাকে সে কোনো রকম গম্ভীর ভাবনা দিয়ে নষ্ট করবে না। অন্তত অরার জন্যে না। আরশাদের অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্তিতে মেয়েটা ভীষণ খুশি হয়েছে। আনন্দে তার চোখমুখ ঝলমল করেছে। আচ্ছা তাকে আরেকটু আনন্দিত করে দিলে কেমন হয়?

আরশাদ ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “বাদ দাও, একটা সিক্রেট শোনো।”

নিমিষেই অরার চোখ দুটো ব্যাপক আগ্রহ খেলে গেল। আরশাদের সিক্রেটগুলো নিয়ে তার আগ্রহের কোনো কমতি নেই।

“বলুন!”

আরশাদ রহস্যমিশ্রিত গলায় বলল, “শোনার পরে আবার মনে মনে ধাক্কা খেও না।”

“ধাক্কা খেতে পারি এমন কোনো সিক্রেট?”

“খানিকটা।”

অরা হাসিমুখে বলল, “তাহলে আগেভাগেই নিজেকে সামলানোর প্রস্তুতি নিয়ে রাখছি। আপনি বলুন।”

“You’re my best friend.”

নিজেকে সামলে নেওয়ার প্রস্তুতি অরার বিফলে গেল। মনে মনে সে প্রচন্ড গতিতে ধাক্কা খেল। সে কি ঠিক শুনলো? আরশাদ কি ঠিক বলল? অরার পুরো পৃথিবীটা তার চোখের সামনে ঘুরপাক খাচ্ছে।

অরা হতবিহ্বল হয়ে বলল, “Best friend? আমি?”

“হ্যাঁ। কী হলো? সামলাও নিজেকে!”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here