#ফিরে_আসা
৩৬
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে টেবিলের দিকে তাকিয়ে রয়েছে অরা। টেবিল জুড়ে রাজ্যের খাবার-দাবার। একপাশে বাঙালি নাস্তা – পরোটা, গোস্ত, ডিম ভাজা, দই, চিড়া, কেটে রাখা ফল। আরেক পাশে ইংরেজি নাস্তা – টোস্ট, বিনস, সসেজ, স্প্রাউটস। টেবিলের ঠিক মাঝখানে বড় একটা কাঁচের জগে ফলের রস। এ সমস্ত নাস্তা আব্দুল তৈরি করেছে অরার একার জন্যে। সে কি বাঘ না সিংহ, যে এত খাবার তার একার জন্যে বানাতে হবে।
অরা রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল। এই লোকটাকে আজ কঠিন ভাষায় একটা ধমক দিতেই হবে।
“আব্দুল ভাই!”
আব্দুল তার সহকারী বাবুর্চিকে সবজি কাটার ধরণ শিখিয়ে দিচ্ছিল। সকালের নাস্তা তৈরির সঙ্গে সঙ্গে তার মাথায় ঘুরপাক খায় দুপুরের খাবারে কী রান্না হবে।
অরাকে দেখে সে একগাল হেসে বলল, “জি আফা?”
অরা থমথমে গলায় বলল, “এত খাবার আপনি আমার একার জন্যে বানিয়েছেন? যে পরিমাণে খাবার আপনি বানিয়েছেন, তাতে তো পুরো এলাকার নাস্তা হয়ে যাবে।”
আব্দুল মুখের হাসিটা এখনো বজায় রেখে বলল, “আফনে কী খাইবেন তা তো আফা জানি না। তাই বাংলা-ইংলিশ দুই টাইপই করছি।”
“দুই টাইপের নাস্তা বানাতে হবে না। আমার জন্যে বাঙালি নাস্তা বানালেই চলবে। স্যার যখন বাড়িতে থাকবে, তার জন্যে ইংলিশ বানাবেন। আর পরিমাণটা একটু বুঝতে শিখুন আব্দুল ভাই। আপনার কারণে প্রতিদিনই খাবার নষ্ট হয়। এটা তো ঠিক না।”
“আইচ্ছা আফা, আপনি যেরকম বলবেন সেইরকমই রান্না হইবে।”
অরা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আরেকজনের ধমক পাওনা আছে, মতিউর। এই লোকটা দিন দিন ফাঁকিবাজির চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। স্টাফরা বসার ঘরে পরিষ্কার করছে, মতিউর পাশে দাঁড়িয়েই তার তদারকি করছে।
অরা মতিউরের সামনে গিয়ে বলল, “মতিউর ভাই? আন্টির ঘরের ফ্যানটা সারিয়েছেন?”
মতিউর জিভে কামড় দিয়ে বলল, “ভুইলা গেছি আফা।”
অরা ভ্রু কুঁচকে বলল, “ভুলে গেলে কী করে চলবে মতিউর ভাই? এক মাস ধরে দেখছি ওই ফ্যান বন্ধ পড়ে আছে। আপনাকে কতবার বললাম, ইলেকট্রিশিয়ান এনে ফ্যানটা সারিয়ে দিন। আন্টি যদি হুট করে একদিন চলে আসেন, আর এসে দেখেন উনার ঘরের ফ্যান নষ্ট – তখন কী একটা অবস্থা হবে?”
“আফনে চিন্তা কইরেন না আফা। আমি অহনি ইলেকট্রিশিয়ানরে খবর দিতেছি।”
“আর শুনুন, সপ্তাহে অন্তত একদিন বাড়ির সবগুলো ফ্যান-লাইট চেক করে দেখবেন ঠিক মতো কাজ করছে কিনা।”
“ঠিক আছে আফা। আফনের সংসার। আফনে যেমন চান, তেমনই হইবো।”
কথাটায় কেমন হকচকিয়ে উঠলো অরা। সংসারের মতো ভারী শব্দটা ঠিক হজম করতে পারছে না সে। প্রতিটা মেয়ে না-কি স্বপ্ন দেখে নিজের একটা সংসারের। যে সংসারের প্রতিটি কোণা জুড়ে থাকবে কেবল তারই বিচরণ। যাকে সে নিজের মতো করে গোছাবে, নিজের মতো সামলাবে।
এই বাড়িটাই কি অরার সংসার? কই, না তো! সে তো এই বাড়ির কোনো সদস্য নয়। এক বছরের জন্যে অতিথি হয়ে এসেছে, এক বছর পরে চলে যাবে। ব্যস্! এতটুকুই। তাহলে কেন সে এ বাড়িটা নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছে। এ বাড়ির কোনো একটা ফ্যান নষ্ট হয়ে পড়ে থাকলে তার কেন রাতের ঘুম হারাম হয়ে যাবে? তাহলে কি মনের অজান্তে অরা এই বাড়িটাকে নিজের সংসার ভাবতে শুরু করেছে?
আর কিছু ভাবতে পারলো না অরা। গিয়ে বসলো নাস্তার টেবিলে। বাড়িটা আজ নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে আছে। আরশাদ সেই ভোর বেলা শুটিংয়ে বেরিয়ে গেছে। আজ তার শুটিং পুবাইলের একটা রিসোর্টে। পুবাইল জায়গাটা গাজীপুরের থেকেও দূরে। সকাল সকাল ঢাকা থেকে রওনা না দিলে সময়মতো গিয়ে পৌঁছনো যায় না। শুটিং শুরু হতেও হয় দেরি।
অরা এখনো আরশাদের সঙ্গে শুটিংয়ে যাচ্ছে না। অরাকে হঠাৎ শুটিং সেটে দেখে মানুষ বলতে পারে, “আরশাদ কেমন মানুষ? এখনো বউকে ম্যানেজার হিসেবে কাজ করাচ্ছে!” পরিস্থিতি এখন মোটামুটি স্থির পর্যায়ে এসেছে। মানুষ ওই ভিডিওর কথা প্রায়ই ভুলেই গেছে। অরাকেও তারা আরশাদের স্ত্রী হিসেবে ভালোভাবে গ্রহণ করেছে। এই মুহূর্তে এমন কোনো কাজ করা যাবে না, যাতে তাদের মনে সন্দেহ ঢুকে যায়। তাই অরা বাড়িতে থেকেই যতটুকু সম্ভব কাজ করে।
নাস্তা শেষে করে অরা ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে রইল বসার ঘরের সোফায়। টিভিতে দেখার মতো তেমন কিছুই নেই। আরশাদ বাড়িতে থাকলে সকালের নাস্তা শেষে ছাদের অর্গানিক গার্ডেনে কতক্ষণ কাজ করে। আর অরা তার পাশে বসে গল্প করে। আজ তো সেই সুযোগ নেই।
হঠাৎ বেজে উঠলো ফোনের রিংটোন। অরা জানে, এই মুহূর্তে সীমা ছাড়া আর কারোর ফোন করার কথা নয়। শুটিং ইউনিট নির্ঘাত এখনো পুবাইলে গিয়ে পৌঁছায়নি। ওখানে শুটিং শুরু হওয়া মাত্রই একের পর এক ফোন আসতে শুরু করবে।
অরার ধারণাই সঠিক হলো। মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে সীমার নাম। দুদিন হলো সীমা গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকায় ফিরেছে। এর মধ্যে আর দেখা হয়নি তার সঙ্গে।
অরা ফোন রিসিভ করতেই সীমা উৎফুল্ল ভঙ্গিতে বলল, “কী রে অরা? তুই তো একেবারে সেলিব্রিটি হয়ে গেলি!”
অরা বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, “কী যা তা বলছিস?”
সীমা ফুর্তির ভঙ্গিতে বলল, “যা তা বলতে যাবো কেন? পুরো ইন্টারনেটে তোর আর আরশাদ ভাইয়ার রেড কার্পেটের ছবি ভেসে বেড়াচ্ছে। আমি বলেছিলাম না! তোদের দুজনকে পাশাপাশি দারুণ মানায়। তখন তো বিশ্বাস করিসনি আমার কথা। দুজনকে একসঙ্গে রেড কার্পেটে কী যে লেগেছে! একেবারে মেড ফর ইচ আদার।”
অরা ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “সীমা, আজ এসব বাজে কথা না বললে হয় না? আমার মুড আজ ভীষণ খারাপ।”
“সে কী? মুড খারাপ কেন?”
“জানি না কেন। আজ কিছুই ভালো লাগছে না।”
“এক কাজ কর! বাসায় চলে আয়। দুজনে মিলে আড্ডা দিই।”
“এখন যেতে পারবো না। স্যার শুটিংয়ে। যেকোনো সময় আমাকে প্রয়োজন হতে পারে। তুই এখানে চলে আয়।”
“পাগল হয়েছিস? আমার হাতে কতগুলো প্রজেক্ট তার হিসাব নেই। তুই এলেও কাজ করতে করতে কথা বলতাম।”
অরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ও আচ্ছা।”
“ভালো কথা, বিয়ে-শাদি করে তুই কি পড়ালেখার কথা ভুলে গেছিস?”
অরা ক্ষীণ স্বরে বলল, “ভুলিনি। ডিপার্টমেন্ট হেডের সাথে কথা বলে এসেছি, রেগুলার ক্লাসে যেতে পারবো না। পরীক্ষার সময় পরীক্ষা দিয়ে আসবো। পরে যেন অ্যাটেনডেন্স নিয়ে কোনো ঝামেলা না করে। আর মাত্র একটা সেমিস্টারই তো বাকি আছে।”
“তুই কি এর পর এমবিএ করবি?”
“নাহ্! পড়াশোনার ঝামেলা থেকে মুক্তি পেলেই বাঁচি! এমনিতেই কাজের অনেক চাপ। তোকে তো বলেছি, স্যার আমাকে তার প্রোডাকশন হাউজের দায়িত্ব দিতে যাচ্ছে।”
সীমা কৌতূহলী গলায় বলল, “আচ্ছা অরা? তুই যদি ভাইয়ার প্রোডাকশন হাউজের সিইও হয়ে যাস, তাহলে তো আর ম্যানেজারগিরি করতে পারবি না।”
অরা ভ্রু কুঁচকে বলল, “ম্যানেজারগিরি আবার কেমন শব্দ?”
“আহা! বল না।”
“না। স্যার তার জন্যে নতুন ম্যানেজার খুঁজছে।”
“বুঝেছি। এবার শোন, তোকে একটা জরুরি কথা জানাতে ফোন করেছি।”
“কী কথা?”
“ওই সিঙ্গাপুরির কথা মনে আছে? ইন্টারের পর যে ছেলেটা আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল, বিয়ের পর পড়াশোনা করাতে চেয়েছিল, পড়াশোনা শেষে সিঙ্গাপুর নিয়ে যেতে চেয়েছিল।”
“হুঁ, মনে আছে। কেন বল তো?”
“ওই ব্যাটা তো এখনো বিয়ে না করে বসে আছে।”
অরা অবাক কণ্ঠে বলল, “বলিস কী? এখনো তোর জন্যে বিয়ে করেনি?”
সীমা ধমকের সুরে বলল, “গাধার মতো কথা বলবি না অরা। আমার জন্যে বিয়ে না করে বসে থাকবে কেন? ওই ব্যাটা আর সিঙ্গাপুরে ফিরে যায়নি। ঢাকায় নিজের বিজনেস দিয়েছে। স্বর্ণের বিজনেস। আগে তো বড়লোক ছিলোই, এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে তার দ্বিগুণ বড়লোক। ব্যবসা সামলাতে সামলাতে আর বিয়ে করা হয়নি। মাঝখানে না-কি বাবার সাথে দেখা হয়েছিল, বাবাকে বলেছে আপনি অনুমতি দিলে এখনো আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি।”
“সে কী রে? এখনো তোকে বিয়ে করতে চায়? তা তোর মত কী?”
সীমা বিভ্রান্ত গলায় বলল, “আমি জানি না। মা ছবি দেখিয়েছিল, চেহারা খারাপ না। ছেলেও না-কি আদব-কায়দা জানে।”
“তার থেকেও বড় কথা এখন আর তার সিঙ্গাপুরে ফিরে যাওয়ার ভয় নেই। ঢাকায় ভালো বিজনেস আছে। তোর সমস্যা তো এটাই ছিল, সিঙ্গাপুরে গিয়ে থাকবি না।”
“জানি, কিন্তু ব্যাপারটা কেমন জানি হয়ে গেল না? যে ছেলেকে বিয়ে করবো না বলে বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে ঢাকায় চলে এলাম, এত বছর বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ রাখলাম না, শেষমেশ তাকেই বিয়ে করবো?”
অরা পরিষ্কার গলায় বলল, “ছেলেটা তোকে অসম্ভব পছন্দ করে সীমা। আমার ধারণা তোর জন্যেই সে আর সিঙ্গাপুরে ফিরে যায়নি। কারণ তুই ওখানে গিয়ে থাকতে চাস না। সময় নিয়ে ঢাকায় নিজের বিজনেস গড়েছে। যাতে তোকে আবারও বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারে।”
সীমা অবিশ্বাসের সঙ্গে বলল, “ধুর! বাজে কথা। ওই ছেলে আমাকে কখনো সামনা-সামনি দেখেনি। ছবিতে দেখেছে। তাও আবার ইন্টার পাশ করার পরের ছবি। তখন আমি দেখতে কেমন ছিলাম? একেবারে রাঙা আলু টাইপ!”
“আমি বলি কী, ছেলেটার সঙ্গে একবার দেখা কর। দেখা করতে তো আর ক্ষতি নেই। সামনাসামনি দেখলে তুই নিজেই বুঝতে পারবি এই মানুষের সঙ্গে সারাজীবন কাটানো যাবে কিনা।”
“বলছিস?”
“হুঁ!”
“তাহলে তো দেখা করতেই হবে।”
“তোর বিয়ে হয়ে গেলে তো আমাকে একা একাই থাকতে হবে।”
“আর তোর বিয়ের পর আমি একা থাকছি না? আর তাছাড়া তোকে একা থাকতে হবে কেন? তুই তো ওই বাড়িতেই থাকবি।”
অরা মলিন স্বরে বলল, “সেটা তো মাত্র এক বছরের জন্যে। তারপর তো ফিরে গিয়ে ওই ফ্ল্যাটেই থাকবো।”
সীমা কী যেন মনে করে খিলখিল করে হেসে উঠলো।
“হাসছিস কেন?”
“কেন যে হাসছি, সেটা আজ বুঝতে পারবি না। ভবিষ্যতে বুঝবি।”
এ বাড়িতে সেলিনা হকের যে ঘরটা রয়েছে তার বিছানায় বসে রয়েছে অরা। মাথার ওপরে ফ্যান ফুল স্পিডে ঘুরছে। মতিউর একটু আগেই ইলেকট্রিশিয়ান এনে সারিয়েছে ফ্যানটা। অরার চোখদুটো দেয়ালজুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেয়ালজুড়ে ছোট ছোট ফ্রেমে বাঁধাই করা আরশাদের ছোটবেলাকার ছবি।
সেলিনা হক এই ঘরটা নিজের মতো করে সাজিয়েছেন। তিনি যেভাবে সাজিয়েছেন, সেভাবেই ঘরটা রেখে দেওয়া হয়েছে।
সেলিনা হক আগে প্রতিমাসে একবার করে ঢাকায় আসতেন। কয়েকটা দিন ছেলের কাছে এসে থাকতেন। অথচ আজ বছর পেরিয়ে গেল, আরশাদের সঙ্গে তার দেখা হয় না। বিশেষ করে ডিভোর্সের পর থেকে আরশাদ মায়ের মুখোমুখি হতেই চায় না। সম্পর্কের এই অবনতির পেছনে দোষটা সেলিনা হকেরই।
মায়েদের প্রধান কাজই হলো যেকোনো পরিস্থিতিতে সন্তানদের পাশে থাকা। তাকে সাহস যোগানো, তাকে একটু ভরসার আশ্রয় দেওয়া। অথচ এই প্রধান কাজটাই করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন তিনি। ডিভোর্সের আসল কারণ না জেনে, পত্র-পত্রিকায় লেখা বাজে কথা বিশ্বাস করে নিজের সন্তানকেই তিনি ভর্ৎসনা করেছেন। আরশাদের ভেঙে যাওয়া মনটাকে আরেকদফা ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। যদিও বর্তমানে আরশাদ মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক করার চেষ্টা করছে। নিজেকে বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করছে, কিছু সম্পর্ক চাইলেই নিঃশেষ করে দেওয়া যায় না।
সেলিনা হক এবং আশফিয়া চেয়েছিল তাদের সিলেটের বাড়িতে বড় করে আরশাদ এবং অরার বিয়ের অনুষ্ঠান করতে। আত্মীয়-স্বজনদের খবর দিয়ে তাদের নতুন বৌ দেখাতে। ওই পরিকল্পনা আপাতত স্থগিত। আশফিয়ার জরুরি কাজ পড়ে গেছে। তাই সে শীঘ্রই দেশে ফিরতে পারছে না। অবশ্য ভালোই হয়েছে, যে বিয়ের কোনো স্থায়ীত্ব নেই তার আবার অনুষ্ঠান কীসের?
অরা হঠাৎ কী যেন মনে করে উঠে গিয়ে দাঁড়ালো আরশাদের ছোটবেলার ছবিগুলোর সামনে। একটা ছবিতে একেবারে ছোট্ট আরশাদ। তার বয়স মাত্র কয়েক সপ্তাহ। আশফিয়া তাকে প্রথমবারের মতো কোলে নিচ্ছে। আশফিয়া মুখে হাসির ছড়াছড়ি, তবে আরশাদ বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। নিজের অজান্তেই প্রচ্ছন্ন একটা হাসি ফুটে উঠলো অরার ঠোঁটে। আজ আরশাদের শূন্যতা প্রখরভাবে অনুভূত হচ্ছে। তার কথা বলার ওই মোহনীয় ভঙ্গির সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে অরা। ইচ্ছা করছে ছুটে গিয়ে কিছুক্ষণ আরশাদের সামনে বসে থাকতে, তার কথা শুনতে।
অরার হঠাৎ কী হলো? সে কি পাগল-টাগল হয়ে যাচ্ছে না-কি? কয়েক মাস আগেও যে মানুষটা অসম্ভব ভয় করে চলতো, আজ কেন তার সান্নিধ্য পাওয়ার জন্যে এমন ছটফট করছে সে?
বিষণ্ণতায় ঘেরা দিনটা যেন শেষই হচ্ছে না। দুপুরের পর পর অরা ছাদে চলে গেল। মগভর্তি চা হাতে আনমনে তার চোখদুটো আটকে রইলো আরশাদের অর্গানিক গার্ডেনের দিকে। মনের ভেতর আরেকদফা প্রবল ঝড় বয়ে গেল। মনে পড়ে গেল ওই দিনটার কথা। যে দিন তাদের সিক্রেট সিক্রেট খেলার সূচনা ঘটেছিল।
আজ বারবার অরার আরশাদের কথা মনে পড়ছে কেন? এমনটা তো আগে কখনো হয়নি। নিজের অনুভূতিগুলোকে নিজেই বুঝতে পারছে না। বহুদিন হলো মনের কথা হয় না তার। আচ্ছা অরা কি তাহলে আরশাদের প্রেমে পড়ে গেছে? হাজারো মেয়ে যেমন আরশাদকে একটু ছুঁয়ে দেখার স্বপ্ন দেখে, সেও কি একই স্বপ্নটা দেখে?
আরশাদকে মনের কথাগুলো বলে আরাম পায় অরা। তার আশেপাশে থাকলে বিচিত্র এক প্রশান্তি অনুভূত হয়। এই অনুভূতির নাম কি প্রেম? না-কি অন্যকিছু?
রিংটোনের শব্দে ধ্যান ভঙ্গ হলো অরার। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে আরশাদের নাম। মুহূর্তেই অরার হৃদস্পন্দনের গতি তুঙ্গে পৌঁছে গেল। যে মানুষটার কথা এতক্ষণ তার মস্তিকে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, আচমকা তার ফোন পেয়ে আঁতকে উঠলো অরা।
আজ সকাল থেকেই তার ইচ্ছা করছিল ক্ষণিকের জন্যে হলেও আরশাদের কণ্ঠস্বর শুনতে। তার সঙ্গে কথা বলতে। সেই আশা অবশেষে পূরণ হতে যাচ্ছে।
অরা ফোন রিসিভ করতেই আরশাদ ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল, “অরা? কস্টিউম নিয়ে কী যেন একটা ঝামেলা হয়েছে। দেখো তো!”
অরা শুকনো গলায় বলল, “জি স্যার, দেখছি।”
অপরপ্রান্ত থেকে ফোনটা কেটে গেল। অরা ভুলেই গিয়েছিল এই মুহূর্তে তাকে নিজের ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’ দাবি করা আরশাদ ফোন দেয়নি। যার সঙ্গে মন খুলে কথা বলা যায়, সিক্রেট ভাগাভাগি করে নেওয়া যায়। তাকে তো ফোন করেছিল তার বস আরশাদ। রাগ যার একমাত্র বৈশিষ্ট্য, কাজ ছাড়া যে কিছুই বোঝে না।
রাত একটার কাছাকাছি, ঘুমে অরার চোখ জড়িয়ে আসছে। তবুও কোনো ক্রমে চোখদুটো খুলে রাখার চেষ্টা করছে। নিজেকে জাগিয়ে রাখার জন্যে টিভিতে একটা গানের অনুষ্ঠান ছেড়ে বসেছে। তাতে কোনো কাজ হবে বলে মনে হচ্ছে না। আরশাদ যে কখন আসবে কে জানে! শুটিং থাকলে তার ফিরতে ফিরতে এমনই গভীর রাত হয়ে যায়।
হঠাৎ বাড়ির মূল দরজার লকে পাসওয়ার্ড চাপার শব্দ কানে ভেসে এলো অরার। বাইরে বা ভেতর থেকে কেউ ওই লকে পাসওয়ার্ড চাপলে টপ-টপ শব্দ হয়। রাত করে বাড়ি ফিরলে আরশাদ কখনো কলিংবেল বাজায় না। পাসওয়ার্ড চেপে বাইরে থেকে নিজেই দরজা খুলে নেয়। ঘুম-টুম একেবারে উড়ে গেল অরার দুচোখ থেকে। এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে সে চলে গেল দরজার সামনে। দরজা খুলে যেতেই দেখা পাওয়া গেল তার কাঙ্ক্ষিত মানুষটার। যাকে দেখার জন্যে চোখদুটো দিনভর তৃষ্ণার্ত হয়ে ছিল। প্রচ্ছন্ন এক হাসি ফুটে উঠলো অরা ঠোঁট জুড়ে। হাসি লুকাবার কোনো চেষ্টা তার মধ্যে নেই।
আরশাদ কিছুটা বিস্ময় নিয়ে বলল, “তুমি জেগে ছিলে? আমি তো ভাবলাম ঘুমিয়ে পড়েছো।”
অরা ঘুমিয়ে পড়বে কী করে? আরশাদকে আজ দুচোখ ভরে না দেখলে তার তো ঘুমই আসতো না।
বাড়িতে প্রবেশ করেই বসার ঘরের সোফায় ক্লান্ত ভঙ্গিতে গা এলিয়ে দিলো আরশাদ। অরা ডাইনিং টেবিল থেকে গ্লাসভর্তি পানি এনে আরশাদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “কেমন হলো আজ শুটিং?”
অরার হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে তাতে চুমুক দিয়ে আরশাদ বলল, “শুটিংয়ের কথা আর বোলো না। আমি প্রচন্ড টায়ার্ড।”
অরা সোফায় বসতে বসতে বলল, “তাহলে ফ্রেশ আসুন, একসঙ্গে ডিনার করবো।”
আরশাদ হতভম্ব হয়ে বলল, “তুমি খাওনি এখনো?”
অরা হাসিমুখে না-সূচক মাথা নাড়লো।
“একটা বাজে অরা! তুমি তো জানতে আমার দেরি হবে। শুধু শুধু অপেক্ষা করতে গেলে কেন?”
“কোনো ব্যাপার না স্যার। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন তো।”
অরা এখনো না খেয়ে বসে আছে জেনে আরশাদ তড়িঘড়ি করে ফ্রেশ হতে চলে গেল। অরা এখনো স্থির হয়ে আগের জায়গায় বসে রইল। তার হাত-পা থরথর করে কাঁপছে, চোখে জল টলমল করছে। আজ সারাদিন ধরে তার মনে হচ্ছিল, বুকের ওপর কেউ ভারী পাথর চেপে ধরে রেখেছে। প্রতিবার শ্বাস নেওয়ার সময় মনে হচ্ছিল ফুসফুসের বড় একটা অংশ এখনো ফাঁকা পড়ে আছে। সারাদিন পর আরশাদকে দেখে, তার সঙ্গে একটু কথা বলেই ওই অনুভূতি বাতাসে মিশে গেছে। প্রাণভরে এখন অরা শ্বাস নিতে পারছে।
নিজের মনের সম্পর্কে একটা ভয়ঙ্কর সত্যি সে এই মুহূর্তে উপলব্ধি করতে পেরেছে।
আরশাদ বসবাস তার মনের গভীরতম স্তরে। যেখানে বসবাসের অধিকার এই পৃথিবীতে কারো নেই। অরা তো কোনদিন কাউকে তার মনে জায়গা দিতে চায়নি। তবুও নিজের অজান্তেই আরশাদকে দিয়ে ফেলেছে সেই জায়গাটা। এই অনুভূতির নাম কী?
(চলবে)