#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২২
ব্রেকফাস্ট টেবিলে সবাই যখন হাসি-খুশি ভাবে খাচ্ছে, তখন হঠাৎই ফ্রিশার হাঁচি শুরু হয়ে গেলো! লাগাতার হাঁচি দিয়েই যাচ্ছে সে। আচমকা এমন হওয়াতে উপস্থিত সকলে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। খাওয়া রেখে শেহজাদ উচ্চস্বরে সার্ভেন্টকে ডাকে। সার্ভেন্ট ছুটে এসে ভয়ার্ত স্বরে নিজের উপস্থিতি জানান দিলে শেহজাদ ক্রুদ্ধ স্বরে শুধায়,
“খাবারে পিনাট ছিল? তুমি জানোনা? ফ্রিশার পিনাটে এলার্জি?”
সার্ভেন্ট কেঁপে ওঠলো। ভীরু দৃষ্টিতে মীরার দিকে একবার চেয়ে মাথা নিচু করে রাখে। মীরা ভড়কে গেলেও তার জন্য আরেকজন দোষ না করে দোষী হবে, তা তো মানতে পারে না। সে অনুতপ্ত স্বরে বলল,
“আজকের খাবার আমি বানিয়েছি। সরি, আমি জানতাম না যে ফ্রিশার পিনাটে এলার্জি। জানলে আমি সত্যি দিতাম না।”
শেহজাদ দাঁতে দাঁত চেপে নিজের ক্রোধ আয়ত্তে আনার প্রয়াস করে। কিন্তু তার মনে হচ্ছে সে ব্যার্থ হবে! অতঃপর কিছু না বলে কালক্ষেপণ না করে ফ্রিশাকে কোলে করে নিয়ে উপরে ফ্রিশার রুমে চলে যায়।
শেহজাদ, ক্রন্দনরত ফ্রিশাকে নিয়ে চলে গেলে মীরা পিছু যেতে নিলে মিসেস শাহিদা ও-কে আটকায়। তিনি বলেন,
“তুমি এখনি যেয়ো না। শেহজাদ রেগে আছে। পিনাটে ফ্রিশার এলা*র্জি আছে। শরীরে র্যাশে ভরে যায়। অনেক ইচিং হয়। রাতে ঠিকমতো ঘুমাতেও পারে না।”
মীরার খুব খারাপ লাগে। তার জন্য এতটুকু বাচ্চা কতো কষ্ট পাচ্ছে। মীরা ক্লেশবোধ নিয়ে বলে,
“আমি জানলে সত্যি পায়েসে পিনাট দিতাম না। আমি তো পায়েসটা আরও সুস্বাদু করার জন্য বাদামের পেস্ট করে দিয়েছিলাম। আমার মা আমার জন্য এভাবে দেয়। এই টেস্টটা আমার পছন্দে বলে ভেবেছিলাম আপনাদের জন্যও বানাই। কিন্তু এরকম যে হবে তা কল্পনাও করতে পারিনি।”
মিসেস শাহিদা, মীরার দিকটা বুঝলেন। তিনি মীরার মাথায় হাত বুলিয়ে নমনীয় স্বরে বললেন,
“আমি বুঝতে পারছি। তুমি জানলে অবশ্যই করতে না। ফ্রিশার স্পেসিফিকলি কাজুতে এলা*র্জি বেশি। কাঠবাদামে অল্প। খুব বেশি পরিমানে কাঠবাদাম খেলে তাহলে ই*চিং হয়। কিন্তু কাজুতে অনেক বেশি।”
“আমি এরপর থেকে খেয়াল রাখব। ওর আর কীসে কীসে এলা*র্জি সব আপনার কাছ থেকে জেনে নিব। এখন একটু যাই প্লিজ। দরজার বাহির থেকেই দেখব কী অবস্থা।”
“আচ্ছা যাও। তবে বলবো যে কথা বলো না। শেহজাদের রাগ সম্পর্কে তোমার কিছুটা হলেও ধারণা থাকার কথা।”
“হুম।”
মীরা দ্রুতপদে ফ্রিশার ঘরের দিকে অগ্রসর হলো। মিসেস শাহিদা মনে মনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। বিয়ের একদিন না পেরোতেই এমনটা হতে হলো! শেহজাদের মনে এ নিয়ে কোনো পরিবর্তন না হয়!
_____
পাঁচ মিনিটের বেশি সময় যাবত মীরা দরজার বাহিরে দাঁড়ানো। শেহজাদ ফ্রিশাকে একটা ইন*জেক*শন পুশ করে এখন মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। হাতের কিছু স্থানে লাল লাল র্যাশ দেখা যাচ্ছে। ফ্রিশা কিছুক্ষণ অস্থির হয়ে চুলকিয়ে আস্তে আস্তে ঘুমে নেতিয়ে পড়েছে। মীরা দেখলো ফুলের মতো বাচ্চাটার অশ্রুভেজা পাঁপড়ি ও গালের অংশ। কতোটা কষ্ট পেয়েছে সে! মীরার নয়নযুগলে এবার বর্ষা নামলো। মা হওয়ার প্রথম দিনেই তার জন্য বাচ্চাটাকে এতো কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। সামনে কী সে পারবে? ভেবেই মনে ভয়ে-ভীতিরা মাকরশার জালের মতো ছড়াতে শুরু করলো। নিজের ভাবনা-চিন্তার মাঝে এতোটাই ডুবে আছে যে শেহজাদ তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তার খেয়ালই নেই! শেহজাদ কিয়ৎক্ষণ আনমনা মীরাকে পর্যবেক্ষণ করে হাতের চুটকি বাজিয়ে মীরার মনোযোগ ফেরায়। মীরা থতমত খেয়ে তাকালে শেহজাদ শান্ত স্বরে বলে,
“ও এখন ঘুমাচ্ছে। আমি ইন*জেক*শন দিয়ে দিয়েছি।”
কথাটা বলে শেহজাদ যত্র দাঁড়িয়ে রইলো। মীরা আড়ষ্টতা ভেঙে বলল,
“বিশ্বাস করুন, আমি জানলে কখোনো করতাম না। আমার পিনাট খুব পছন্দ তাই দিয়েছিলাম। সরি।”
শেহজাদ গম্ভীর স্বরে জবাব দেয়,
“নেক্সট টাইম খেয়াল রেখো।”
অতঃপর দ্রুত প্রস্থান করে। মীরা গুটিগুটি পায়ে ফ্রিশার রুমে গিয়ে ওর মাথার কাছে বসে। তারপর ওর এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে দিয়ে, র্যাশের জায়গাগুলোতে লাগানোর জন্য মলম আনতে সার্ভেন্টকে পাঠায়।
________
সন্ধ্যাবেলা। ধূসর মেঘের আড়ালে অর্ধচন্দ্রমা লুকোচুরি খেলছে। মৃদু জোৎস্না ব্যালকনির গ্রিল গলে অন্ধাকারাচ্ছন্ন স্থানে আসছে। শেহজাদ মেয়ের ঘরে এসে দেখে মীরা সেখানে বসেই বই পড়ছে। দুপুর থেকে শেহজাদ মীরাকে নিজের আশেপাশে কোথাও দেখেনি। খাবার টেবিলেও না। এমনকি দুপুরে যখন ফ্রিশার সাথে দেখা করতে এসেছিল, তখনও মীরা ছিল না। এরপর তো সে একটা কাজে বাহিরে গিয়েছিল। শেহজাদ হালকা কাঁশির আওয়াজ করে, যার দরুণ মীরা বই থেকে মনোযোগ সরিয়ে সম্মুখে তাকায়। শেহজাদকে দেখে ফ্রিশাও বলে ওঠে,
“বাবা, দেখো আমি ড্রয়িং করছি।”
শেহজাদ হালকা হাসি দিয়ে এগিয়ে এলো।
“খুব সুন্দর হয়েছে। তোমার শরীর এখন কেমন লাগছে, মা?”
“অ্যাই অ্যাম ফাইন, বাবা। ফেইরিমাম্মাম আমাকে আবার পায়েস করে খাইয়েছে। এবার কোনো ই*চিং হয়নি। সি, অ্যাই অ্যাম ফাইন।”
শেহজাদ প্রশান্তচিত্তে হাসলো। মেয়ের মাথায় চু*মু এঁকে শুধালো,
“এখন কি র্যাশে ই*চিং হচ্ছে?”
“না, বাবা। দাদুমনি বলল, তুমি নাকি ফেইরিমাম্মামের সাথে রাগ করেছ? ফেইরিমাম্মাম তো জানতো না। তাই না?”
শেহজাদ মীরার পানে এক পলক চেয়ে নিরুত্তর রইল। ফ্রিশা পুনরায় বলল,
“ফেইরিমাম্মামকে সরি বলো, বাবা।”
মীরা অবাক হয়ে ফ্রিশাকে দেখে। দ্রুত কণ্ঠে বলে ওঠে,
“না না, ফ্রিশামনি। এটার কোনো দরকার নেই। উনার তো কোনো দোষ নেই। তোমাকে ঐ অবস্থায় দেখে ভয় পেয়েছিল, বাচ্চা।”
ফ্রিশা নিজের কথায় অটল। মীরার কথা সে শুনবে না।
“সরি বলো, বাবা। নাহলে আমি তোমার সাথে কথা বলব না।”
ফ্রিশার জেদ তো তার বাবাকে মানতেই হবে। শেহজাদ মীরার চোখের দিকে আরও একবার তাকায়। অতঃপর ধীর কণ্ঠে সরি বলে সেখান থেকে উঠে যায়। ফ্রিশা উচ্ছাসিত হয়ে মীরাকে জড়িয়ে ধরে গালে চু*মু দিয়ে আবার আঁকতে বসে।
_________
প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পর মীরা ফ্রিশার সাথে খেলা করে, মিসেস শাহিদার সাথে গল্প করে ও নিজের মা-ভাবিদের সাথে ফোনে কথা বলে এখন তার ও শেহজাদের বেডরুমে যায়। মিসেস শাহিদা বলেছেন, শেহজাদকে খাওয়ার জন্য ডেকে আনতে। মীরা গিয়ে বলল,
“ফুফিআন্টি আপনাকে ডাকছেন।”
শেহজাদ ল্যাপটপ থেকে নজর সরিয়ে মীরাকে দেখলো। তারপর বলল,
“এখানে এসে বসো।”
“কোথায়?”
মীরার প্রশ্নটা যে কতোটা অবান্তর তা মীরা পরক্ষণেই বুঝতে পারলো যখন শেহজাদ তার দিকে শিতল দৃষ্টিতে তাকায়। এরপর মীরা শেহজাদের পাশে গিয়ে বসলে শেহজাদ মীরার দিকে ঘুরে বসে। তারপর জিজ্ঞাসা করে,
“তুমি কি আমাকে ভয় পাচ্ছ?”
মীরা হতচকিত হয়ে তাকায়। তারপর আস্তে করে বলে,
“ভয় না, স্যার। প্রথমদিন আমার অজানায় এমন একটা দুর্ঘ*টনা ঘটে যাবে তা আমি ভাবতেও পারিনি। আমার নিজের কাছেই খুব খারাপ লাগছে।”
“ফ্রিশা কিন্তু তোমাকে নিয়ে খারাপ কিছু ভাবেনি। আমি তখন একটু রেগে ছিলাম কিন্তু পরে তোমার দিক থেকে বুঝলাম, তুমি জানলে এমনটা করতে না।”
কথাটা বলে শেহজাদ হালকা হাসলো। সেই সাথে মীরাও। মীরা প্রশ্ন করলো,
“ফ্রিশার এই মিষ্টি দিকটা ওর মায়ের দিক থেকে পেয়েছে, তাই না?”
“না! ওর দাদী ও ফুফির দিক থেকে। ওর মা বিয়ের আগে অন্যরকম ছিল। বিয়ের পর ও বদলেছে।”
মীরা জানার আগ্রহ থেকে জিজ্ঞাসা করলো,
“কেমন ছিলেন তিনি?”
“ডিনার করে এসে বলব। তোমাকে ফুফিজান কেন পাঠিয়েছে তাই তো ভুলে গেছ!”
মীরা জলদি জিভ কা*ম*ড়ে বলে,
“ইশ সরি! খেয়ালই ছিল না। চলুন।”
বলে মীরা উঠে দাঁড়ায়। শেহজাদ কিঞ্চিত হেসে মীরার সাথে ডাইনিংয়ে যায়।
________
খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষে ফ্রিশার বায়না, তার বাবা ও ফেইরিমাম্মাম দুজনে তাকে ঘুম পারাবে। মেয়ের এমন আদুরে বায়না দুজনের কেউই ফেলতে পারলেন না। অতঃপর শেহজাদ ও মীরা ফ্রিশার হাত ধরে সিঁড়ি দিয়ে উঠে ফ্রিশার ঘরে যায়। যদিও ফ্রিশা কোলে উঠতে চাইছিল কিন্তু শেহজাদ রাজি না। রাতে খাওয়ার পর একটু হাঁটাহাঁটি করতে তো হয়। তাই এই পন্থা।
ঘুমোনোর আগে ফ্রিশাকে ঔষুধ খাইয়ে দেয় শেহজাদ। অতঃপর সে মেয়েকে ইংলিশ কবিতা শোনায়। শেহজাদের কণ্ঠে ইংলিশ কবিতা শুনে মীরা কোনোরকমে হাসি আটকে রেখেছিল। এই লোক যে কবিতাও শোনাতে পারে তা তার ধারনারও বাহিরে ছিল। ঔষুধের প্রভাবে ফ্রিশা জলদিই ঘুমিয়ে পড়ে। ফ্রিশা ঘুমানোর পর শেহজাদ মীরাকে বলে,
“কফি করে নিয়ে এসো। তোমাকে আজ একটা স্টোরি শোনাব।”
“আপনার ও ফিওনা আপুর?”
“হ্যাঁ।”
মীরা মুচকি হেসে কফি বানাতে যায়।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
গত শুক্রবার থেকে অল্প অল্প অসুস্থ ছিলাম। ঠান্ডা, কাঁশি, গলা খুশখুশানি। যা রবিবারে বেড়ে গেছে ও কানেও ছড়িয়েছে। সোমবার সকালে তো কানের ভেতরে প্রচণ্ড ব্যাথায় আমি কান্নাও করেছি। আজ কানে ব্যাথা কম কিন্তু ভার ভার ভাবটা যায়নি। এই সারাজীবন ঠান্ডা-কাঁশির রো**গ হয়তো আমার কোনোদিন ভালো হবে না।😪
ভুল ত্রুটি থাকলে ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।