#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২৭
পরদিন খুব ভোরে ঘুম ভাঙলো মীরার। ভোরের আবছা আলোয় রাতের অন্ধকার এখনও পুরোপুরি দূর হয়নি। জানালা দরজা লাগানো ও পর্দা দেওয়া থাকায় অন্ধকারে থৈ থৈ। শুধু দেয়ালে ডিজিটাল ঘড়িটায় সংখ্যা জানান দিচ্ছে এখন সময় ৪টা বেজে ১৪ মিনিট। ফজরের আজান পড়ে গেছে। মীরা বেড সাইড টেবিলের ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বসে শেহজাদের দিকে তাকালো। শেহজাদকে দেখে মনে হচ্ছে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। মীরা মনে মনে ভীষণ প্রফুল্ল হলো। সে মৃদু স্বরে শেহজাদকে ডাকলো। প্রথমবার ডাকে উঠলো না। বারকয়েক ডাকতে শেহজাদের ঘুম হালকা হয়ে এলো। শেহজাদ পিটপিট করে চোখ মেলে কুঁচকানো ভ্রু নিয়ে বলল,
“সকাল হয়ে গেছে?”
“হ্যাঁ তো। আজ আপনার আগে আমার ঘুম ভাঙলো। গতকাল আপনাকে বলেছিলাম, আমাকে ভোরে ডেকে দিবেন, কিন্তু দেখুন। আমিই আপনাকে ডাকলাম।”
শেহজাদ ঈষৎ তন্দ্রাভাব নিয়েই হালকা হাসলো। তারপর বলল,
“যাও নামাজের জন্য প্রস্তুত হয়ে এসো।”
মীরাও বিনিময়ে মুচকি হেসে ওযু করতে যায়।
নামাজ শেষে মীরা জিজ্ঞেসা করে,
“আপনার কি কালকেই ছুটি শেষ?”
“হ্যাঁ।”
“আমার তো পরশু পর্যন্ত ছুটি। ভেবেছিলাম আব্বু-আম্মুর কাছে আমি, আপনি, ফ্রিশা একদিন থেকে আসব। আজকে তো উনারা আসবেন। ওইযে বিয়ের পরদিন বা দুইদিন পর যায় যে।”
মীরার চোখে-মুখে বিষণ্ণতার মেঘ এসে ভিড়েছে। শেহজাদ নরম কণ্ঠে বলল,
“বৃহস্পতিবার যাব। তুমি নিজেও তো ক্লাস মিস দেওয়ার সাইড এফেক্ট বুঝো।”
মীরা ভেবে দেখলো। অতঃপর বলল,
“হুম। আচ্ছা। বৃহস্পতিবার যাব। এখন ফ্রিশার ঘরে গিয়ে দেখি?”
উঠতে উঠতে শেষোক্ত কথা বলতেই শেহজাদ বলল,
“ও-কে ৬টার দিকে ডেকো। সবে তো ৫টা বাজে। এক কাজ করো, আমার জন্য ব্ল্যাক কফি বানিয়ে নিয়ে এসো আর যদি তুমিও ব্ল্যাক কফি পছন্দ করো তবে তোমার জন্যও। বানাতে পারবে?”
মীরার মুখশ্রীতে প্রথমে হাসির রেখা ফুটলেও শেহজাদের শেষোক্ত কথায় চোখ ছোটো ছোটো করে প্রত্যুত্তর করলো,
“আপনার কী মনে হয়? আমি অক*র্মা! সামান্য কফিও বানাতে পারি না?”
“আই ডিডেন্ট মিন দ্যাট। একচুয়ালি সবাই কফি সুন্দর করে বানাতে পারে না। মাঝখানে বাড়িতে একজন এক্সট্রা মেইড রেখেছিল, সে কফির স্বাদকে বিস্বাদ করে ফেলতো।”
শেহজাদের সেল্ফ এক্সপ্লেনেশন শুনে মীরা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“আচ্ছা বুঝেছি। যদিও আমি ব্ল্যাক কফি তেমন একটা পছন্দ করি না। কিন্তু বানাতে পারি। প্রচণ্ড মা*থাব্যথা হলে তখন ব্ল্যাক কফি মাঝেমধ্যে খাই।”
“আচ্ছা। বানিয়ে নিয়ে আসো তবে।”
মীরা কয়েক সেকেন্ড ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে শেহজাদের কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে কফি বানাতে চলে যায়। মীরা যেতেই শেহজাদ নিজের চেপে রাখা হাসি এবার মুক্ত করে। নিঃশব্দে হেসে বুকশেলফের কাছে যায়।
_______
দুপুরের আগে মীরার পরিবার, রাইমা ও কুঞ্জ মীরার শ্বশুরবাড়িতে আসে। মিসেস শাহিদা ও মীরা মিলে সার্ভেন্টের সাহায্যে আপ্যায়নের সব ব্যাবস্থা করে ফেলেছে। প্রথমেই মীরা সবার জন্য আপেলের ঠান্ডা ঠান্ডা শরবত পরিবেশন করে। তারপর একে একে হালকা কিছু নাস্তা। রাইমা মীরার ব্যস্ততায় দেখে মীরাকে টেনে এক জায়গায় এনে অভিমানী স্বরে বলে,
“তুই আমার সাথে কথাই বলছিস না। কাজেই লেগে আছিস!”
রাইমার অভিমানী মুখ। মীরা ওর গা*ল টেনে দিয়ে হেসে বলে,
“বল বল। তোরা সবাই মাত্র এলি। তাই ভাবলাম রেস্ট নে তারপর কথা বলব।”
“রেস্ট নেওয়া লাগবে না। সময় নেই। আজ সন্ধ্যায় ফ্লাইট। এখান থেকে সরাসরি আমি আর কুঞ্জ এয়ারপোর্টে যাব।”
“কী বলিস! আজকেই?”
“হ্যাঁ রে। তোর বিয়ের জন্য তিন দিন প্লাস রবিবার তো ছুটিই। কালকে মাস্ট জয়েন করতে হবে।”
মীরা মন খারাপ করে বলে,
“আবার কবে দেখা হবে! বিয়ের ব্যস্ততায় তোর সাথে ঠিকমতো কথাই হলো না।”
“পরেরবার আবার আমার বিয়েতে দেখা হবে। বুঝলি। তাছাড়া ভিডিওকল তো করবই। তুই নিজেই কিন্তু এগুলো আমাকে বলে এসেছিলি।”
মীরা ও রাইমা দুজনেই মন খারাপের রেশে নিরব হাসে। মীরা বলে,
“তোর যা মন! বিয়ে যে কবে করবি তার ঠিক নেই। বেচারা কুঞ্জদা….”
রাইমা জলদি করে মীরাকে থামিয়ে বলে,
“৩১ ডিসেম্বর আমার বিয়ে। এবার ফিক্সড। তোর জন্য তো আলাদা করে স্পেশাল কার্ডও বানিয়ে এনেছি। ওয়েট, নিয়ে আসছি।”
মীরাকে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রাইমা ছুট লাগায়। রাইমা যাওয়ার কয়েক সেকেন্ড পর শেহজাদ কোলে করে সিয়ামকে এনে বলে,
“ফ্রিশা, মৃদুলা ও নিহান ও-কে এতোবার বলল খেলতে। কিন্তু সে আমাকে ডেকে ইশারায় তোমাকে দেখাচ্ছে। তোমার কাছে আসবে। নাও তোমার ভাতিজাকে।”
মীরা আদুরে মুখ করে সিয়ামকে কোলে নিতেই সিয়াম হাতে তালি দেয়। মীরা ও শেহজাদ হালকা শব্দ করে হেসে ওঠে। তখনি রাইমা, কুঞ্জকে নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলে,
“এই যে আমাদের বিয়ের কার্ড। আর তোর বিয়ের গিফট। আমার বিয়েতে তোকে, জিজুকে ও ফ্রিশুমনিকে এটাই পড়তে হবে কিন্তু!”
মীরা সন্দিহান হয়ে গিফট বক্সটা দেখে তা ধরে শুধায়,
“কী আছে এতে?”
“আছে কিছু। আগে কার্ডটা দেখ তারপর তোর ঘরে গিয়ে আরাম করে ওটা খুলবি।”
মীরা, শেহজাদের হাতে মাঝারি বড়ো আকৃতির গিফট বক্সটা কোনোরকমে দিয়ে বিয়ের কার্ডটা খুলে। সত্যি সত্যি রাইমা ও কুঞ্জর বিয়ে। মীরা রাইমাকে জড়িয়ে ধরে শুভ কামনা জানিয়ে গিফ্টবক্স সহ ওদেরকে নিয়ে নিজেদের রুমে যায়। অতঃপর সুন্দর করে আনবক্স করে দেখে তার মধ্যে একটা ডার্ক এ্যাশ রঙের পাজামা-পাঞ্জাবি, ডার্ক এ্যাশ রঙের লতানো ডিজাইনের বোনারসি ও ফ্রিশার জন্য একটা এ্যাশ রঙের নেটের উপর ডিজাইনার লেহেঙ্গা। মীরা উপহার গুলো দেখে একদম হা হয়ে গেলো। সে অবাক কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে,
“এতোকিছু তোকে কে করতে বলেছে? হ্যাঁ!”
রাইমা ভাব নিয়ে বলে,
“আগে বল, পছন্দ হয়েছে? অবশ্য আমার চয়েজ বলে কথা!”
“তোর পছন্দ করা কিছু আমার পছন্দ হবে না? অনেক পছন্দ হয়েছে। কিন্তু এতোকিছু কেন করতে গেলি!”
শেহজাদও তাল মেলায়,
“ইয়াহ, রাইমা। এসবের দরকার ছিলো না। তুমি ইন্ডিয়া থেকে নিজের বেস্টফ্রেন্ডের জন্য এসেছ।”
রাইমা বলে,
“আপনার বউকে দেখবেন, কী করে! আমার বিয়েতে নাকি সে বিয়ের শাড়ি দিবে! আমি ও-কে অনেক কষ্টে বুঝিয়েছি। বিয়ের শাড়ি আমি আমার মায়ের পছন্দে নিব। মা আমার জন্মের পর থেকে কোনো শাড়ি দোকানে গেলেই আমার জন্য বিয়ের শাড়ি দেখে। তাতে আপনার বউ মেনেছে। এখন সে কী করে, তাতো আমি জানিনা। তবে আমি কেন পিছিয়ে থাাকব? হুহ্!”
মীরা ও-কে চি*ম–টি কে**টে বলে,
“হয়েছে। চুপ কর। তোর বিয়েতে আমিও আমার পছন্দের কিছু দিব। তবে তোর গিফটা খুব কিউটরে। থ্যাংকিউ ইয়ার।”
মীরা, রাইমাকে জড়িয়ে ধরলে। রাইমা বলে ওঠে,
“দূরে যা এবার। তোর বরের অধিকার আমি নষ্ট করলে জিজু পরে আমার উপর রাগ করবে। তুই দূরত্ব বজায় রাখ।”
রাইমার কথা শুনে শেহজাদ থতমত খেয়ে কিছু একটা বাহানা করে সিয়ামকে নিয়ে সেখান থেকে সটকে পড়ে। তা দেখে রাইমা শব্দ করে হাসলে মীরা কপট রাগ দেখিয়ে ও-কে দু ঘা লা*গিয়ে দেয়। কুঞ্জও রাইমাকে ইশারায় থামতে বলে।
______
দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষে সবাই ফ্যামিলি আড্ডায় বসেছে। কথায় কথায় শারমিন, নিধি ও রাইমা মিলে মীরাকে গা*ন গাইতে বলে। মীরা বারবার নাকচ করলে শেহজাদ যখন বলে,
“সবাই বলছে যখন গাও।”
মীরার মনে শিতল হাওয়া বয়ে যায়। যা তার লোমকূপ পর্যন্ত বইয়ে গেছে। লাজুক হেসে মীরা গা*ন ধরে….
চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি থাকলে ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।