#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩৩
বৃহস্পতিবার, ভার্সিটি থেকে ফিরে শেহজাদ ও মীরা, ফ্রিশাকে নিয়ে মীরার বাবার বাড়িতে আসে। পৌঁছানো মাত্রই মীরার পরিবার তখন থেকেই আপ্যায়নে ব্যাস্ত। শেহজাদকে যেন মৌ*মা*ছির মতো ঘিরে ধরেছে। অবশেষে রাতের খাবারের শেষে শেহজাদ জামাই আদর থেকে আজকের মতো ছুটি পেলো। শেহজাদ মীরার রুমে এসে বিছানায় বসে। মীরা এখনও রুমে আসেনি। পাশের রুমে ভাবিদের সাথে গল্প করছে। ফ্রিশা, মৃদুলা ও নিহানদের সাথে খেলছে। ফ্রিশা আজ মৃদুলার সাথেই ঘুমাবে। মৃদুলাও ফ্রিশার মতো আলাদা ঘরে ঘুমায়। কিছুক্ষণ গল্প করার পর মীরার বড়ো ভাবি শারমিন বললেন,
“মীরু, তুমি এবার তোমার ঘরে যাও। ভাইয়া ঘরে একা আছেন। ফ্রিশার চিন্তা করো না। ও মৃদুলার সাথে খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে যাবে।”
“যাই ভাবি। ওদের একবার বলে যাই।”
এই বলে মীরা সেখান থেকে ওঠে মৃদুলার ঘরে গেল। তারপর ফ্রিশা ও মৃদুলার উদ্দেশ্যে বলল,
“জলদি ঘুমিয়ে পড়ো। বেশিক্ষণ খেলবে না কিন্তু। যাও শুয়ে পড়ো।”
মৃদুলা আদুরে মুখ করে বলল,
“প্লিজ ফুপি। আরেকটু।”
“না মৃদু। রাত এগারোটা বাজে, বাবু।”
এবার ফ্রিশাও এলো।
“প্লিজ, ফেইরিমাম্মাম। একটু খেলব। ফাইভ মিনিটস।”
“কাল সকালে খেলবে, বাচ্চা। অনেক রাত হয়েছে তো।”
“প্লিজ প্লিজ প্লিজ! ফাইভ মিনিটসই তো।”
মীরা গালে হাত দিয়ে বিছানায় বসে বলে,
“তোমাদের ফাইভ মিনিট ফিফটি মিনিট হতে সময় লাগবে না। খেলো! তারপর যখন মৃদুর আম্মু লা*ঠি নিয়ে আসবে! তখন এমনিই সোজা হয়ে যাবা।”
মৃদুলা ও ফ্রিশা মুখে হাত দিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠে। মীরা হতাশ হয়ে সেখান থেকে চলে আসে। মৃদুলা ও ফ্রিশা আবার তাদের ওয়ার্ড গেম খেলতে শুরু করে।
_____
মীরা রুমে এসে দেখে শেহজাদ কপালে ও চোখের উপর হাত দিয়ে শুয়ে আছে। মীরা বসে প্রশ্ন ছুঁড়ে,
“আপনি ঘুমিয়ে গেছেন?”
শেহজাদ চোখের উপর থেকে হাত সরিয়ে লম্বা করে শ্বাস নিয়ে বলে,
“না। এমন অবস্থায় ঘুম আসে!”
ভ্রুকুঞ্চন করে তাকায় মীরা। ফের শুধায়,
“কেমন অবস্থায়?”
“এইযে দেখো! প্রায় গলা পর্যন্ত খাবার উঠে আছে। দুই-তিন দিক থেকে প্লেটে খাবার দিতে থাকলে আমি কী করব বলোতো? তুমি তো একটু বলতে পারতে।”
মীরা ফোন হাতে নিয়ে বলে,
“আমি কী বলব? জামাই আদর করবে না? আপনার জামাই আদরে আমি কথা বললে আমি বুঝি ধ*ম*ক খাব না? সবার সামনে ব*কা খেতে কার ইচ্ছে করে বলুন তো?”
শেহজাদ একটু উঠে বসে চুপ করে থাকে। মীরা ফোন রেখে শেহজাদের মুখের দিকে চেয়ে মিষ্টি হেসে জিজ্ঞাসা করে,
“গ্রিনটি খাবেন? ভালো লাগবে।”
“আনো।”
মীরা উঠে গ্রিনটি বানাতে চলে যায়। অতঃপর পাঁচ মিনিট পর দুইটা মগে গ্রিনটি নিয়ে হাজির হয়। তারপর শেহজাদের দিকে একটা মগ এগিয়ে দিয়ে বলে,
“নিন। গ্রিনটি আগে অনেক খেতাম। তারপর কফি খাওয়া শুরু করেছি। তাও মা গ্রিনটি খায় বলে বাড়িতে আনা হয়।”
“থ্যাংকিউ।”
শেহজাদ মগটা নিয়ে এক চুমুক খেয়ে জিজ্ঞাসা করে,
“ফ্রিশা ঘুমিয়েছে?”
“না! পাঁচ মিনিটের নাম করে ওরা পঞ্চাশ মিনিট খেলবে। তারপর বড়ো ভাবি যাবে এরপর সোজা হয়ে ঘুমাবে। আমার দিকে ওরা কিউট কিউট ফেস করে তাকিয়ে সবসময় পার পেয়ে যায়! আমিও মোটেও স্ট্রিক্ট হতে পারি না!”
মীরা মুখ ফুলিয়ে গ্রিনটিতে চুমুক দিচ্ছে। শেহজাদ খানিক হেসে বলে,
“ভাবির থেকে ট্রেনিং নাও।”
“তা লাগবে না। ফ্রিশা এখানেই একটু এমন করবে। বাসায় ফিরলে ঠিক হয়ে যাবে। একদিনই তো।”
“হুম।”
তারপর দুজনেই গ্রিনটি শেষ করলে মীরা মগগুলো রেখে আসে। মীরা বিছানা গুছাতো গুছাতে শেহজাদ রুমের ভিতরে কয়েক চক্কর হেঁটে শুয়ে পড়ে।
______★
দিনকে দিন ওদের সম্পর্কে বন্ধুত্বটা প্রকট হচ্ছে। যদিও ভালোবাসার প্রকাশ এখনও প্রচ্ছন্ন! সময়ের চক্রে দুই মাস পেরিয়ে গেছে। এখন আগষ্ট মাসের শেষোর্ধ। প্রকৃতি শরতের অনন্য রূপে সেজে ওঠছে। নীল অম্বরে পেঁজা তুলোর মতো মেঘমল্লার ভেসে বেড়ায়। কিছু জায়গায় কাশফুলের সমারোহ দেখা যায়। তাই বলে বর্ষার দাপট কিন্তু শেষ হয়নি! খানিক কালোমেঘের রাজত্বও দৃশ্যমান হয় অম্বরপটে। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টিও ঝড়ে। আজ ফ্রিশার ৬তম জন্মদিন। মীরা আজ ভার্সিটি থেকে ছুটি নিয়েছে। সকাল সকাল নাস্তার সাথে সাথে ফ্রিশার জন্য ক্ষীরও বানিয়েছে, যা ফ্রিশার পছন্দের খুব। তারপর শেহজাদ ভার্সিটিতে চলে গেলে, মীরা ফ্রিশাকে নিয়ে ঘুরতে বেরোয়। সাথে মিসেস শাহিদা ও আবিরও আছে। যাচ্ছে জাতীয় শিশুপার্কে। ফ্রিশা খুব এক্সাইটেড। শিশুপার্কে ঘোরাঘুরির পর তাঁরা যাবে চিড়িয়াখানায় ঘুরতে। যদিও খুব বেশি সময় ঘুরবে না। আজ কোনো ছুটির দিন না। তাই দুই স্থানেই ভীড় তুলনামূলক কম হবে। প্রথমেই শিশুপার্কে পৌঁছে ফ্রিশা ছুটে ছুটে বিভিন্ন রাইডে উঠতে যাচ্ছে। মীরা ওর পিছু ছুটছে সাথে ভিডিও করছে। রাতে এসব শেহজাদকে দেখাবে। ফ্রিশার চোখে-মুখে উজ্জ্বলতা ও উৎফুল্লতার হাসি। দুপর হতেই চারজন শিশুপার্ক থেকে বেরিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খেয়ে রওনা করে চিড়িয়াখানার উদ্দেশ্যে। কিছুটা জ্যাম থাকায় দেড় ঘণ্টার মতো লেগেছে। বিকেল প্রায় তিনটার দিকে চিড়িয়াখানায় পৌঁছে পরিচিত কিছু প*শুর খাঁচা ঘুরে, পা*খিদের দেখতেই দুই ঘণ্টা শেষ। সিং*হের খাঁচার সামনে গিয়ে ফ্রিশা ‘লা*য়*ন! লা*য়*ন’ বলে চিৎকারও করেছে। বেচারি, বা*ঘের দেখা না পাওয়াতে মাঝে বেশ মন খারাপও করেছিল। প*শু-পাখি সব দেখলেও মীরা ইচ্ছে করেই ও-কে সা*প দেখাতে নেয়নি। তার নিজেরই ভয় করে, সেখানে ফ্রিশাকে নিবে! সারাদিন ঘোরাঘুরি করার পর ফ্রিশার মন বেশ আনন্দিত কিন্তু শরীর অবসন্ন। ফেরার পথে গাড়িতেই মীরার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছে। মীরা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় ছয়টা বেজেছে। চিড়িয়াখানা থেকে কাছেই। বাড়ির প্রায় কাছাকাছি আসতেই শেহজাদ মীরাকে কল করে। মীরা ফোন রিসিভ করে সালাম দিতেই শেহজাদ সালামের জবাব দিয়ে বলে,
“তোমরা এখন কোথায়?”
“এইতো কাছাকাছি। আপনি কি বেরিয়েছেন?”
“হ্যাঁ আজ একটু জলদি বেরিয়েছিলাম। তাড়াতাড়ি চলে আসব। ফ্রিশার জন্য কিছু নিব বলে শপিংমলে এসেছি।”
“ও আচ্ছা। কী নিবেন?”
“ভাবছি ওর পছন্দের প্রিন্সেস গাউন নিব সাথে একটা ব্ল্যাক-হোয়াইট টেডি। দুই বছর ওর জন্মদিনে কিছু করা হয়নি।”
মীরা ফ্রিশার মুখপানে চেয়ে মুচকি হেসে বলে,
“ফেরার পথে বেকারি শপ থেকে সন্দেশ, ছানা, রসমালাই এসব নিয়ে আসবেন। কেক আমি গিয়ে বানাব। আর হ্যাঁ, আইসক্রিমও।”
শেহজাদ হেসে বলে,
“আচ্ছা আনব। মা-মেয়ে দুজনেই মিষ্টি পা*গ*ল! ফ্রিশা মনে হচ্ছে তোমার সঙ্গদোষে মিষ্টির প্রতি আরও অ্যাডিক্টেড হয়ে গেছে।”
মীরার দৃষ্টি সরু হলো। সে বলল,
“হলে হয়েছে। আপনার সমস্যা কী? আপনাকে আনতে বলেছি আনবেন।”
মীরা খট করে ফোন কেটে দেয়। পাশে বসা মিসেস শাহিদা মুচকি হাসেন। শেহজাদ ফোনের দিকে চেয়ে হেসে স্বগতোক্তি করে,
“পুরো বাচ্চাদের মতো রাগ করে এই মেয়ে! কে বলবে এই মেয়ে ভার্সিটির টিচার আবার ছয় বছরের এক বাচ্চার মা হয়েছে?”
অতঃপর শেহজাদ শপিংমলে ঘুরে প্রিন্সেস ড্রেস পছন্দ করে।
________
রাতে ড্রয়িংরুমে ঘরোয়া পরিবেশে টেবিল সাজানো হয়েছে। মীরার বাবা-মাও এসেছেন। সাথে মৃদুলাও। মীরা ফ্রিজ থেকে একটু আগের বানানো কেকটা বের করে আনলো। তারপর ফ্রিশাকে তৈরি করতে গেলো। শেহজাদের আনা প্রিন্সেস ড্রেস ও মীরার আনা পার্লস ব্রেসলেট ও নেকলেসে ফ্রিশাকে বেশ সুন্দর লাগছে। লালচে-বাদামী চুলে ক্রাউনও পড়েছে সে। মীরা আয়নায় তাকিয়ে বলে,
“হাই প্রিন্সেস।”
“ফেইরিমাম্মাম, অ্যাম অ্যাই লুক লাইক অ্যা বেবি ফেইরি?”
“ইয়েস, বাচ্চা। ইউ আর মাই কিউট বেবি ফেইরি। লেটস গো। এভরিওয়ান ইজ ওয়েটিং।”
ফ্রিশা একহাতে তার ড্রেস উঁচু করে এগিয়ে চলছে। মীরা ওর আরেক হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তারপর ড্রয়িংরুমে সবার সাথে কেক কা*টে ফ্রিশা। প্রথম বা*ইট সে তার ফেইরিমাম্মামকে দেয় তারপর তার বাবাকে। এরপর বাকিদেরও কেক খাওয়ায়। ফ্রিশাকে সবাই গিফট দিয়েছে সাথে দোয়া তো আছেই। কেক খাওয়ার পর সবাই এদিকে গল্প করছে, ওদিকে মীরা রান্নাঘর থেকে খাবারগুলো ডাইনিংয়ে এনে রাখছে। মলি জাহান মেয়ের কাছে যান। মাকে দেখে মীরা একটুকরো মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে নিজের কাজ করছে। তিনি মেয়েকে থামিয়ে জিজ্ঞাসা করেন,
“শেহজাদ কি তোকে মন থেকে মানতে পেরেছে?”
মীরা কপাল কুঁচকে জবাব দেয়,
“মেনে নিবে না কেন? কী যে বলোনা তুমি, মা!”
মীরা আবার কাজে হাত দিলে মিসেস মলি জাহান আবারও মেয়েকে থামিয়ে নিজের মুখোমুখি দাঁড়া করিয়ে বলেন,
“দেখ আমার চিন্তা হয়।”
“উফ মা, সব ঠিকই তো চলছে। আমাদের সম্পর্কে সব স্বাভাবিকই চলছে, যেমনটা অন্যান্য স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে থাকে। তুমি অযথা চিন্তা করছো। যাও তো। ড্রয়িংরুমে গিয়ে সবার সাথে বসো। আমি বাকিগুলো এনে সবাইকে ডাকছি।”
মিসেস মলি জাহান মেয়ের কথা মেনে নিয়ে সেখান থেকে চলে আসেন। কিন্তু তার চিন্তা কমে না। কারণ মীরা তার মায়ের সাথে যাই শেয়ার করে সব ফ্রিশাকে নিয়ে। শেহজাদকে নিয়ে যেন বলেই না। তাই উনার মনে ভয় ঢুকেছে।
________
খাওয়া-দাওয়া ও আড্ডার পর্ব শেষে সবাই ঘুমোতে চলে গেছে। শেহজাদ ও মীরা নিজেদের রুমে যেতেই শেহজাদ বলে,
“ওয়েট, তোমার জন্য কিছু এনেছি।”
“কী?”
শেহজাদ প্রত্যুত্তর না করে কাভার্ড থেকে একটা ব্যাগ বের করে মীরার হাতে দেয়। মীরা ব্যাগ থেকে একটা ছোটো বক্স বের করে। যা একটা ঘড়ির বক্স। ডিজিটাল ঘড়ি। মীরা খুশি হয়ে বলে,
“ওয়াও! কখন নিলেন?”
“ফ্রিশার জন্য ড্রেস কেনার সময় ভাবলাম তোমার জন্য কিছু নিব। কী নিব কী নিব ভেবে ঘড়ির কথাই মা*থায় আসলো। শাড়ির কথা ভেবেছিলাম কিন্তু তোমার যদি পছন্দ না হয়? ঘড়ি তো তোমার পছন্দ খুব।”
মীরা কয়েক সেকেন্ড শেহজাদের চোখের দিকে চেয়ে থেকে বলে,
“আপনি আমার জন্য যা পছন্দ করবেন, তা চোখ বন্ধ করে আমি পছন্দ করে নিব।”
অতঃপর কালক্ষেপণ না করে মুহূর্তের মধ্যে শেহজাদকে জ*ড়িয়ে ধরে। শেহজাদ কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে কথার লুকানো অর্থ বুঝে নিজেও মীরাকে নিজের সাথে আগলে নেয়।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
গতকালকেই পেতেন কিন্তু সন্ধ্যার পরই ঘুমিয়ে গেছিলাম। টায়ার্ড ছিলাম অনেক।
ভুল ত্রুটি থাকলে ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।