#
#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩৪
সময়ের পাতা খুব দ্রুত উলটে যায়। ঋতু পরিবর্তন হয়ে শরৎ, হেমন্ত। তারপর এখন শীত ঋতু। পর্ণমোচী উদ্ভিদেরা নিজেদের রিক্ত করে প্রকৃতিতে কাঙালের রূপ নিচ্ছে। কনকনে শীতের ভোর সকালে মীরা ফজরের নামাজ পড়ে পুকুর পাড়ে শাল জড়িয়ে এসে বসেছে। গতকাল রাতেই তাঁরা কলকাতায় পৌঁছেছে। রাইমার বিয়ে যে আজ। একটু পরেই বাড়ির মহিলা সদস্যরা জল সইতে চলে আসবে। রাইমার দধিমঙ্গলের অনুষ্ঠান চলছে, আসার পথে মীরা রাইমার দুয়েকটা ছবি তুলে নিজেও ও-কে এক লোকমা খাইয়ে চলে এসেছে (এই বিষয় আমার তেমন জ্ঞান নেই)। শেহজাদ নামাজ পড়ে আবার ঘুমিয়েছে। আর ফ্রিশা এখনও জাগেনি। পুকুর পাড়ে বসে বসে গতরাতের কথা ভাবছে মীরা। রাইমা তাকে হাসি-ঠাট্টার মাঝেই হুট করে জিজ্ঞাসা করে বসে,
“তুই ভালোবাসিস জিজুকে? জিজু তোকে ভালোবাসে তো?”
এর বিপরীতে এক কথায় কোনো উত্তর দিতে পারেনি মীরা। সারারাত তার ঘুমও ঠিকমতো হয়নি এসব ভাবতে ভাবতে। আজ সতেজ, শীতল পরিবেশে চোখ বন্ধ করে নিজের মন থেকে উত্তর খুঁজছে। দুজনের কারোর জীবনেই তো কেউ প্রথম ভালোবাসা না। দ্বিতীয়বার কি ভালোবাসতে পেরেছে আদৌও? এই প্রশ্ন জর্জরিত মীরার মন মোহনা। বিগত ছয় মাসের স্মৃতি রোমন্থন করে মনের অভ্যন্তর থেকে খুব আকুল ভাবে সাড়া পেলো, সে দ্বিতীয় বার ভালোবাসতে পেরেছে। সত্যি পেরেছে। মুদিত আঁখি যুগল মেলে স্থির জলরাশির দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকালো। এই শুষ্কতম ঋতুতেও তার মনে ফাগুনের হাওয়া বয়ে যায়। ও*ষ্ঠকোণে ফুটে উঠে লাজরাঙা হাসি। খানিক সময় পেরোতেই রাইমার বাড়ির মহিলা সদস্যদের এদিকে আসারা পদধ্বনি শুনে মীরা উঠে দাঁড়ায়। অতঃপর তাদের জন্য স্থান ফাঁকা করে সেখান থেকে চলে আসে। যদিও রাইমার কাকিমা, মীরাকে থাকতে বলেছিলেন। কিন্তু মীরার এখন ফ্রিশাকে তুলতে হবে। তারপর রাইমার সাথে থাকতে হবে, তাই রাইমাদের বাড়ির পথে হাঁটা দেয়।
________
কুঞ্জদের বাড়ি থেকে কুঞ্জর গায়ে ছোঁয়ানো হলুদ এসেছে। এখন রাইমাকে উঠোনে আনা হয়েছে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের জন্য। মীরা ও রাইমার দুয়েকজন ভাবী ও কাজিন বোনেরা বরপক্ষ থেকে আসা মানুষদের আপ্যায়নে গিয়েছে। বরপক্ষ থেকে আসা এক সুদর্শন যুবক ছেলে তো মীরাকে দেখে সেখানেই হাঁ হয়ে বসে আছে। ফ্রিশা ওদিকে বাড়ির বাচ্চাদের সাথে খেলছে। মীরা ফাঁকা ট্রে হাতে সেখান থেকে চলেই আসছিল তখন সেই যুবকটি মীরাকে ডাকে। সে মীরার নামটা শুনতে পেয়েছে রাইমার ভাবি ও কাজিনদের মুখ থেকে ডাক শুনে। অচেনা কোনো পুরুষ কণ্ঠে নিজের নাম শুনে ভ্রু কুঁচকে পিছু ফেরে মীরা। ছেলেটি মীরার সামনে এসে কিছুটা এটিটিউটের সাথে হাত বাড়িয়ে বাঁকা হেসে বলে,
“হ্যালো। আমি রাহুল।”
মীরার মুখভঙ্গির বিন্দু মাত্র পরিবর্তন হয়নি। কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে যখন যুবকটি মীরার থেকে কোনো প্রত্যুত্তর পেলো না তখন সে আবার বলে,
“আমি কুঞ্জের মাসতুতো ভাই। আপনি নিশ্চয়ই রাই বৌদির বোন হোন?”
মীরা মুখে জোরপূর্বক হাসির রেখার টেনে বলে,
“ওহ আচ্ছা। আমি রাইয়ের বোন না কিন্তু বোনের মতো বান্ধবী।”
“পরিচিত হতে পারি?”
মীরা তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সামনে দাঁড়ানো লোকটির কথা বলার ধরণ বুঝতে চাইলো তখন সবটা তার মস্তিষ্কে ধরা দেয়। লোকটা তার সাথে ভবিষ্যতে ফ্লার্টিং করার ধা*ন্দা করছে। মীরা মুচকি হেসে সেই আশায় জল ঢালতে বলল,
“কেন পারবেন না? আপনি তো আমার নাম জানেনই। সাথে এটাও জানলেন যে আমি রাইয়ের ফ্রেন্ড। এখন আমি আমার বাকি পরিচয়টাও দিচ্ছি। ওই যে দেখছেন (আঙুল তা*ক করে) একটা লোক পিলারে সাথে হেলান দিয়ে বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে এদিকেই তাকিয়ে আছে? সেই লোকটা আমার স্বামী! আর একটু পরপর যে বাচ্চারা এদিকে দৌড়াদৌড়ি করছে না? তার মধ্যে যেই বাচ্চাটার রেড-ব্রাউন চুলের রং, সেই বাচ্চাটা আমার মেয়ে! আর কিছু জানতে চান?”
যুবকটি থতমত খেয়ে হা হয়ে একবার শেহজাদের দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার মীরার দিকে তাকাচ্ছে। মীরার মনে মনে ভীষণ হাসি পেলেও সে যত্র হাসলো না। ঘুরে চলে যেতে নিলে পেছন থেকে যুবকটি প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“কিন্তু আপনার সিঁথি তো ফাঁকা! আজকালকার মেয়েরক বিয়ের পরও সিঁথি ফাঁকা রেখে অবিবাহিত ছেলেদের গুমরাহ করে। কী যে মজা পায়! গ*ড নওজ!”
মীরা আবার পিছু ঘুরে মুচকি হেসে জবাবে বলে,
“আমি মুসলিম তাই বিয়ের পরও আমার সিঁথি ফাঁকা। আর কিছু জানার বাকি? বাকি থাকলে বাড়ি গিয়ে কুঞ্জদার থেকে জেনে নিবেন। ধন্যবাদ।”
মীরা আর দাঁড়ালো না। সেখান থেকে চলে আসলো। পিছনে ছেলেটা নিজের কপাল চাঁপড়ে নিজেদের লোকদের কাছে চলে গেল। মেহমান ঘর থেকে বেরোতেই শেহজাদ এসে মীরার পথ রোধ করে দাঁড়ালো। মীরা হুট করে শেহজাদকে গম্ভীর মুখে দেখে শুধালো,
“কী হলো? সামনে এসে দাঁড়ালেন কেন?”
শেহজাদ জবাব দেয় না। মীরা কয়েক সেকেন্ড চেয়ে থেকে বলে,
“কী বলবেন বলুন নয়তো আমি রান্নাঘরে এটা (ট্রে টা দেখিয়ে) রেখে আসি।”
শেহজাদ হুট করে মীরার হাত থেকে ট্রে টা এক প্রকার ছিনিয়ে নিয়ে বিয়ে বাড়ির মানুষজনদের মধ্যে কাউকে ডেকে ট্রে টা দিয়ে রান্নাঘরে রেখে আসতে বলে। তারপর মীরার হাত ধরে বাড়ির একটা ফাঁকা কোনায় নিয়ে যায়। মীরাকে দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়া করিয়ে সরু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শুধায়,
“ওই ছেলেটার সাথে এতক্ষণ যাবত কী কথা বলছিলে?”
মীরাও চোখ ছোটো ছোটো করে তাকায়। অতঃপর প্রত্যুত্তরে বলে,
“চিনিনা আমি।”
“না চিনলে ওই ছেলের সাথে এত কথা কী-সের?”
“আরেহ! ওই ছেলেই তো আমাকে ডাকলো! আমি কি সেধে সেধে গিয়েছিলাম কথা বলতে? আপনি তো সেখানে দাঁড়িয়ে দেখলেনই।”
“কী কথা হচ্ছিলো তোমাদের?”
মীরা এবার দেয়ার থেকে সরে আসতে চাইলে শেহজাদ নিজের হাতের দ্বারা দেয়াল ধরে মীরার পথ রোধ করে। মীরা শেহজাদের চোখের দিকে তাকালে খানিক ঘাবড়ে যায়। শেহজাদের চোখে কেমন একটা রাগের আভাস! মীরা ভীতু স্বরে বলে,
“আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন? তেমন কোন কথা হয়নি। আমি ওই ছেলেকে দেখাচ্ছিলাম যে আপনি আমার স্বামী, আর ফ্রিশামনি আমার মেয়ে। এটাই।”
“ওই ছেলে তোমাকে ডিস্ট্রাব করছিল?”
মীরা ভাবলো শেহজাদকে শান্ত করতে হবে। বলা যায় না, যদি কোনো ঝামেলা করে বসে? বরপক্ষের লোক ওরা। মীরা হুট করে শেহজাদের গলা জড়িয়ে বলল,
“ব্যাপার কী হুম? এতো পজেসিভ? ভয় হচ্ছে? যদি আপনার সুন্দরী বউকে কেউ নিয়ে নিতে চায়? ভালোবেসে ফেললেন বুঝি?”
আচমকা মীরার স্বর পালটে যাওয়াতে হতভম্ব হয়ে গেল শেহজাদ। সে মীরার কথা পাত্তা না দিয়ে বলে,
“সবসময় একটু বেশি বুঝো তুমি। আমি তো তোমার সেফটির জন্য বলছিলাম। বিয়ে বাড়িতে কিছু ছেলেরা মেয়েদের সাথে অস*ভ্য*তামি করার চেষ্টা করে। একটা অচেনা ছেলে তোমাকে ডাকলো, তুমি কথা বললে। তোমার সাথে কোনো অস*ভ্যতা*মি করেছে কী-না? যাইহোক বাদ দাও। অস*ভ্যতা*মি না করলে তো ভালোই। তুমি তোমার কাজে যাও।”
এই বলে শেহজাদ সেখান থেকে সরে যাচ্ছিল, তখনি মীরা শেহজাদের বাম হাতের কব্জি ধরে আটকায়। ফের শুধায়,
“ভালোবাসেন আমাকে?”
চলবে ইনশাআল্লাহ,
রিচেক করা হয়নি। ভুল ত্রুটি থাকলে ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।