#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩৮
ইন্ডিয়া থেকে ফেরার পর সপ্তাহ খানেকের মতো পেরিয়ে গেছে। মীরা ও শেহজাদ দুজনেরই ইউনিভার্সিটি খুলে দিয়েছে। দুজনে আবার আগের মতো কাজে ব্যস্ত। বিগত মাসগুলোর রুটিন অনুসারে শেহজাদ মীরাকে ভার্সিটিতে পৌঁছে দেয় তারপর নিয়েও আসে। কয়েকদিন পর শেহজাদের জন্মদিন। মীরা কিছু গিফট কিনবে। অনেক ভেবে ভেবে ডিসাইড করলো কী কিনবে। অনলাইনে অর্ডার করবে একবার ভেবেও নিজেই একটা ক্লাস রিসিডিউল করে শপিংমলে চলে গেলো। স্বচক্ষে দেখে কেনার মধ্যে একটা প্রশান্তি তো কাজ করে। শপিংমলে এসে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মতো সময় ব্যয় করে অতঃপর সে একটা সুট পছন্দ করতে পেরেছে! নিজের এই সময়জ্ঞান নিয়ে হেলাফেলার বিষয়টা বুঝে নিজে নিজেই বলে,
“উনি আসলে চুপ করে থেকে শুধু এক্সপ্রেশণ দিতেন। কতো রকমের এক্সপ্রেশন! চোখ ছোটো ছোটো করা, ভ্রু কুঁচকে থাকা, বারবার হাতঘড়ি দেখা, পায়ে জোড়ে শব্দ করা, এদিক-ওদিক হাঁটা! কেন যে বুঝে না? মেয়েদের শপিং করতে একটু তো সময় লাগেই। আমরা কাপড়ে সুতা পর্যন্ত চেক করি!”
মীরার বিড়বিড় করার মধ্যে এক মহিলা সেলসওমেন এসে জিজ্ঞাসা করেন,
“এনিথিং রং, ম্যাম?”
মীরা থেমে যায়। জোরপূর্বক হেসে হাতের সুটটা এগিয়ে দিয়ে বলে,
“এটাকে কাউন্টারে জমা করুন।”
সেলসওমেনটি মিষ্টি হেসে সম্মতি দিয়ে সুটটি নিয়ে কাউন্টারে চলে যায়। এরপর বিল পে করে মীরাও সেখান থেকে বেরিয়ে আসে। তারপর আরও আধ ঘণ্টার মতো সময় ব্যয় করে ফ্রিশার জন্য একটা টপস কিনে শপিংমল থেকে বেরিয়ে আসে। উবার ড্রাইভারকে কল করলে ড্রাইভার তাকে কিছুটা সামনে যেতে বলে। বাধ্য হয়ে মীরা তাই করতে সামনে এগুচ্ছে। তখনি হঠাৎ অপ্রত্যাশিত ভাবে একটা গাড়ি তীব্র গতিতে রং সাইড থেকে এসে মীরাকে ধাক্কা দিবে দিবে তৎক্ষণাৎ এক বৃদ্ধ রিকশাচালক মীরাকে টান দিয়ে সাইডে নিয়ে আসে। আচমকা ঘটনায় মীরা হতবাক! কী থেকে কী হচ্ছিলো সব তার বুঝার বাহিরে। আশেপাশের লোকজনও জড়ো হয়ে গেছে। কয়েকজন লোক গাড়ির পেছনে ছুটতে ছুটতে ধরতে না পেরে ফের ফিরে এসেছে। রিকশাচালক লোকটা জিজ্ঞাসা করেন,
“মা, আপনে ঠিক আছেন?”
মীরা মাথা নাড়ায়। রিকশাচালক ফের বলে,
“ওই গাড়িয়ালার মনে হয় মাথায় সমস্যা। নাইলে এই পাশ দিয়া কেন আইবো? ম*দ-গা*ঞ্জা খা*ইয়ানি গাড়ি চালায় আল্লাহ মালুম।”
জড়ো হওয়া লোকজনও অনেকে অনেক কথা বলছে। মীরা কিছুক্ষণ সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে রিকশাচালকটাকে বলল,
“চাচা, আমার সাথে একটু ওই সামনের গাড়িটা পর্যন্ত আসবেন? আপনার রিকশাও সাথে করে আনেন।”
রিকশাচালক তাই করলো। সামনে গিয়ে মীরা উবার ড্রাইভারকে না করে তার প্রাপ্য ভাড়াটা মিটিয়ে বিদায় করে দিয়ে রিকশাতে চেপে বসে। এখন আর সে ভার্সিটিতে যাবে না। একেবারে বাড়িতে ফিরবে। বাড়ির সামনে এসে নেমে রিকশাচালককে এক হাজার টাকার নোট দেয়। রিকশাচালক অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলে মীরা মুচকি হেসে বলে,
“আপনি এমনিতে নিতেন না। তাই আপনার রিকশায় করে আসলাম। আপনি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন। এর কাছে সামান্য টাকা কিছুই না।”
“কিন্তু মা, আমার ভাড়া তো এতো হয় নাই। ১৫০-২০০ টাকার বেশি তো ভাড়া হইতো না। আপনে আমারে হাজার টাকা দিয়েন না।”
“চাচা, প্লিজ। এটা নিতে মানা করবেন না। আমি খুশি হয়ে দিচ্ছি।”
“কিন্তু মা, এতো টাকা!”
“এটা কিছুই না। আপনি প্লিজ রাখেন। আজকে বাড়িতে ভালো কিছু নিয়ে যাবেন। আমি নিজেও বাজার করে দিতে পারতাম। কিন্তু আমার একটু তাড়া ছিল ফেরার জন্য। আরেকটু লেট হলে সিগন্যালে পড়লে অনেক দেরি হয়ে যেত।”
রিকশাচালকটির চোখ ভিজে ওঠলো। তিনি গলায় ঝুলানো গামছা দিয়ে চোখ মুছে নিয়ে বললেন,
“আল্লাহ আপনের ভালো করুক, মা। অনেক ভালো থাকেন। দীর্ঘায়ু হোক আপনের।”
এই বলে মীরার মাথায় হাত বুলিয়ে রিকশাচালকটি চলে যান। মীরা হেসে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে মোবাইলের স্ক্রিণে সময় দেখলো পাঁচটা বাজে। শেহজাদ এখন ভার্সিটি থেকে বোরোবো। সে দ্রুত শেহজাদকে টেক্সট করে জানিয়ে দিল যে সে চলে এসেছে। তবে আজকের ঘটনাটা শেহজাদকে সে জানাতে চায় না। কারণ শেহজাদ অনেক রাগ করবে। ব*কাব*কিও করবে। যতোই হোক, শেহজাদের রাগকে সে ভয় পায়!
এদিকে নিজেদের আস্তানায় গাড়ি পার্ক করে লোকটি গাড়িতে দুই-তিনটে লা*থি মে*রে আস্তানা প্রবেশ করে। চেয়ার টেনে বসে। টেবিলের বিপরীত পাশে বসা একজন তার মুখের অবস্থা দেখে বুঝতে পারলো এবারও অসফল হয়ে ফিরে এসেছে। বিপরীত পাশে বসা মানুষটি জিজ্ঞাসা করলো,
“এবারও কিছু করতে পারোনি?”
এবার যেন লোকটির রাগ বর্ষে ওঠলো। টেবিলে সজো*ড়ে আ*ঘা*ত করে বলল,
“এবারও পারলাম না, মামা! এবারও ব্যার্থ হলাম। তিন তিন বার বেঁচে গেছে। আজকে তো সাথে ওই শেহজাদও ছিল না।”
টেবিলের বিপরীতে বসা মানুষটি হাসলেন। ফের বললেন,
“ভাগ্য ওই মেয়ের সাথে আছে বুঝলে। আরও কতোবার এটেম্প্টে সফল হও দেখো!”
“মামা, তুমি এসব বলছো? তুমি? তুমি অন্তত এসব বলো না। আমি ওই মীরাকে সুখে থাকতে দিব না। কিছুতেই না।”
কথাগুলো বলে রাগে ফুঁসছে লোকটি। লোকটির মামা এবার উঠে এসে লোকটিক কাঁধে হাত রেখে বললেন,
“শান্ত হও, রাদিব! এসব করতে সময় দিতে হয়। তুমি খুব অল্প সময়ে পরপর তিন বার অ্যা*টা*ক করে বসেছ। এখন ওদের সন্দেহ হলে ওরা আরও সতর্ক হয়ে যাবে।”
“কিন্তু মামা, আমি ওই মীরার এই সুখ সহ্য করতে পারছি না। কতোকিছু করলাম। বর্ণকে উসকেও ওর বিয়েটা আটকাতে পারলাম না। আমার জীবন নষ্ট করে নিজে সুখে থাকবে? তা আমি হতে দিব না।”
“শান্ত হও, রাদিব। কিছুদিন কোনো অ্যা*কশন নিও না। ওরা সব স্বাভাবিক ভাবতে শুরু করলে আবার করা যাবে।”
কথাটা বলে রাদিবের মামা সেখান থেকে চলেই যাচ্ছিলেন, তখন রাদিব তাকে ডাক দিয়ে বলে,
“তোমার উচিত এবার বাড়ি ফেরা। ১২ বছর হলো দেশ ছেড়েছ। এবার যখন দেশে ফিরেছো তখন বাড়ি চলো।”
লোকটি শক্ত কণ্ঠে বলল,
“তুমি খুব ভালো করেই জানো, আমি এখানে ফিরেছি শুধুমাত্র তোমার কথায়। নয়তো ফিরতাম না। তাছাড়া তোমার মা আমাকে ঘৃণা করে। নিজের কাজে ফোকাস করো। কাজ শেষ হলে আমি আবার ফিরে যাব।”
এই বলে লোকটি সেখান থেকে চলে গেলো। রাদিবও এরপর চলে যায়।
________
দুইদিন পেরিয়ে গেছে। আগামীকাল শেহজাদের জন্মদিন। মীরা কিছু প্ল্যানিং করছে। আজকে একটা এক্সট্রা ক্লাস করিয়ে আগামীকালকের একটা ক্লাস কমিয়ে রাখবে তারপর জলদি বাড়ি চলে আসবে। ফ্রিশার পাশে বসে বসে মীরা এসব ভাবছিল। তখন ফ্রিশা বলে ওঠে,
“হোয়াট আর ইউ থিংকিং, ফেইরিমাম্মাম?”
মীরা ভাবনার সুতো ছিঁড়ে ফ্রিশার দিকে চেয়ে মিষ্টি হেসে বলে,
“কাল তোমার বাবার বার্থডে তো। কী করা যায় ভাবছি।”
ফ্রিশা ভীষণ এক্সসাইটেড হয়ে গেল। সে জিজ্ঞাসা করে,
“কী করবে?”
“উম ভাবছি।”
“চলো বাবার জন্য সারপ্রাইজ প্ল্যান করি।”
“কী করবে?”
“তুমি গান গাইবে। আমি ডান্স করবো।”
মীরা অবাক হয়ে বলে,
“রিয়েলি? তুমি একদিনে নাচ কীভাবে শিখবে? আমিও নাচ পারি না।”
“উফ ফেইরিমাম্মাম! ইউটিউব আছে না? আমি দেখে দেখে শিখব। কাল সারাদিনে শিখে ফেলব।”
মীরা বলে,
“কিন্তু বাচ্চা, আমাকে তো ভার্সিটিতে যেতে হবে।”
“ওকে। নো প্রবলেম। আমি দাদুমনির সাথে শিখে ফেলব। বাবা একদম সারপ্রাইজড হয়ে যাবে। ইয়ে!”
ফ্রিশা খুশিতে হাতে তালি দিচ্ছে। তখন শেহজাদ দরজার কাছে এসে বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে শুধায়,
“কী প্ল্যান করছো মা-মেয়েতে?”
মীরা ও ফ্রিশা দুজনে একে-অপরের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করে ভ্রু কুঁচকে একসাথে সন্দেহের সুরে প্রশ্ন ছুড়ে,
“আমাদের কথা শুনছিলেন?”
“আমাদের কথা শুনছিলে?”
শেহজাদ মাথা নুইয়ে হেসে জবাবে বলে,
“না। জাস্ট কিছু একটা শিখে ফেলবে এটুকু শুনেছি। কী শিখবে তা শুনিনি।”
ফ্রিশা খুশি হয়ে উঠে গিয়ে তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“তোমার সারপ্রাইজ, বাবা। টুমোরো দেখবে।”
শেহজাদ হাঁটু গেড়ে বসে মেয়েকে আগলে নিয়ে বলে,
“ওকে। এখন ঘুমিয়ে পড়ো তো। ইটস লেট, বেবি।”
ফ্রিশা তার বাবার গালে চু*মু এঁকে বই-খাতা গুছিয়ে রেখে শুয়ে পড়ে। এরপর মীরা ও শেহজাদ কিছুক্ষণ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে ঘুমিয়েও পড়ে।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি থাকলে ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।