#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৪০
আরও সপ্তাহ খানেক পেরিয়েছে। বাহ্যিক ভাবে সব স্বাভাবিক চললেও স্বাভাবিক নেই মীরা ও শেহজাদের মাঝে। শেহজাদ কেমন গুমোট হয়ে থাকে। তারউপর প্রচুর ব্যস্ততা দেখায়। মীরার সাথে যেন স্বস্তিতে পাঁচ মিনিট বসে কথা বলার সময়টাও হয় না। শেহজাদের এই হঠাৎ পরিবর্তন মীরার কাছে কেমন দুর্বিষহকর ঠেকছে। সারাদিন পর একটু হাসি বিনিময় করে কিছুক্ষণ কথা বলাটাও যেন এখন সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সপ্তাহ জুড়ে এই প্রতিচ্ছবি দেখে মীরা সিদ্ধান্ত নিলো, সে আজ ফ্রিশার সাথে ঘুমাবে। তাহলে নিশ্চয়ই শেহজাদ আসবে! এসে তাকে নিয়ে যাবে। যা ভাবা তা করলোও সে। ফ্রিশাকে ঘুম পাড়িয়ে বারবার ঘড়িতে সময় দেখছে। ঘড়ির কাটা ঘুরতে ঘুরতে সাড়ে এগারোটা ছুঁই ছুঁই। কিন্তু শেহজাদের কোনো পাত্তা নেই! অস্থির হয়ে উঠে মীরা। একবার ভাবলোও যে গিয়ে দেখে আসবে কিন্তু পরক্ষণেই মন বদল করে ফেলে। নিজের অভিমান ধরে রেখে আর না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সকালে দেখা যাবে শেহজাদের প্রতিক্রিয়া কী হয়। অতঃপর রাগ করে জোর করে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলো।
এদিকে শেহজাদ নিজের পরিচিত গো*য়েন্দা বিভাগের লোকজনদের সাথে যোগাযোগ করে অনেক তথ্যই জানতে পেরেছে। মুরাদের পারিবারিক ইতিহাস ঘাটতে গিয়ে বেরিয়ে আসে, রাদিব! রাদিব মুরাদেরই চাচাতো বোনের ছেলে! রাদিব বিগত ৭ মাস যাবত পলা*তক। রাদিবের স্ত্রীর একটি পুত্র সন্তান হয়েছে। রাদিবের পরিবারের সাথে রাদিবের যোগাযোগ নেই। শেহজাদ কিছু একটা আন্দাজ করে নিয়েছে এই মামা-ভাগ্নের উদ্দেশ্য। এর জন্য সেও তৈরি। অতঃপর ঘড়িতে সময় দেখে। ঘড়ির কাঁটা দেড়টা ছুঁই ছুঁই। মীরাকে রুমে না দেখে কিঞ্চিত ভ্রু কুঁচকালো। ফের দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
“ড্যাম শিউর, সি ইজ নাউ এংরি উইথ মি। ইটস ওকে। টাইম উইল হিল।”
_______
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই মীরা নিজেদের বেডরুমে গিয়ে দেখে শেহজাদও উঠে পড়েছে। দুজনে নিরবেই একসাথে নামাজ আদায় করে নেয়। মীরা রুম থেকে কোনো কথা না বলেই বেরিয়ে যেতে নিলে শেহজাদ ডাকে থামে। শেহজাদ বলে,
“তোমার অনার্স, মাস্টার্সের সব ডকুমেন্ট দিয়ে যেও।”
কপাল কুঁচকে তাকায় মীরা। জিজ্ঞাসা করে,
“কেন?”
“কেন আবার কেন? দিতে বলেছি দাও।”
“আমি কারণটা জানতে চাইছি আপনার থেকে।”
“জানতে পারবে। এখন ডকুমেন্ট গুলো দাও। জাস্ট একটু ওয়েট করতে হবে। ট্রাস্ট মি। ইট উইল বি বেটার ফর ইউ।”
মীরা শেহজাদের চোখে-মুখের ভাব দেখে বুঝলো শেহজাদ কিছু তো লুকাচ্ছে। বিষয়টা তার মনে কষ্ট দিলেও সামনাসামনি প্রকাশ করলো না। আর কথা না বাড়িয়ে ডকুমেন্ট গুলো বের করে দিয়ে চলে গেলো। শেহজাদ ডকুমেন্ট গুলো হাতে নিয়ে মীরার চলে যাওয়া দেখে ভেতর থেকে হতাশ তিক্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে ব্যালকনিতে গিয়ে বসে। নিজে নিজে ধিমি স্বরে বলতে থাকে।
“আবারও সময় এসেছে এই দেশ ছাড়ার। এবার সবাইকে নিয়ে।”
শেহজাদ আমেরিকায় যেখান থেকে সে গ্রাজুয়েশন করেছে সেখানে মীরার পিএইচডি ডিগ্রির স্কলারশিপের জন্য আবেদন করে দেয়। সেই সাথে নিজেও এতোদিন আসা অফারটা গ্রহণ করে নেয়।
_______
ফেব্রুয়ারি মাস। মীরার জন্মদিন আজ। সকালে ঘুম থেকে উঠে শেহজাদের থেকে সর্বপ্রথম জন্মদিনের শুভেচ্ছা পেয়েছে সে। তারপর একে একে সবার থেকে। ফ্রিশার থেকে খুব সুন্দর একটা ফ্যামিলি ড্রয়িং পেয়েছে। এরপর ভার্সিটিতে এসে স্টুডেন্টদের থেকেও। পুরোটাদিন মীরার খুব ভালো কেটেছে। আজ সে বাবার বাড়িতে যাবে। সেখানে থাকবে। শেহজাদ হাফ দিনের ছুটি নিয়ে ফ্রিশাকে নিয়ে মীরাকে ভার্সিটি থেকে পিক করে নিয়ে যাবে।
ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে মীরা শেহজাদকে কল করলো। শেহজাদ রিসিভ করতেই মীরা বলল,
“আপনি ফ্রিশাকে নিয়ে পৌঁছেছেন? কতক্ষণ লাগবে?”
শেহজাদ ড্রাইভ করছে। পাশে বসা ফ্রিশার দিকে একবার তাকিয়ে হেসে বলে,
“হ্যাঁ। জাস্ট ওয়েট ফর ফাইভ মিনিটস, এন্ড উই উইল বি দেয়ার।”
“ওকে।”
মীরা ভার্সিটির গেইটের কাছে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছে। দুপুরের সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়ছে। রোদের তিব্রতা তেমন একটা না। হঠাৎই মাথায় জোড়ালো কিছু আ*ঘা*তে চোখের সামনে সব অন্ধকার দেখতে লাগলো, মীরা! তৎক্ষণাৎ সে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। ভার্সিটির সামনে হট্টগোল পড়ে গেল আচমকা ঘটনায়। আঘা*তকারী মুখোশধারী ব্যাক্তিকে পথচারীরা ধাওয়া করেও ধরতে পারলো না! পুরো ভার্সিটিতে খবরটা ছড়াতে সময় লাগে না। ইতোমধ্যে শেহজাদও এসে পৌঁছেছে। ভার্সিটির সামনে গাড়ি থামাতেই এতো ভীড় দেখে শেহজাদের মন কেমন একটা করে ওঠলো। সে ফ্রিশাকে গাড়ির ভেতর বসতে বলে দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে ভীড় ঠেলে ভেতরে এসে দেখে মীরা মাটিতে র*ক্তা*ক্ত অবস্থায় পড়ে আছে! শেহজাদ পা যেন যত্র থেমে গেলো। নিজের চোখকে তার বিশ্বাস হচ্ছে না। কণ্ঠস্বর যেন পুরোপুরি রুদ্ধ তার! তখনি অ্যাম্বুলেন্সের হর্ণে লোকজন একপাশে সরে যাচ্ছে। মীরাকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলবে তখন শেহজাদ বলে ওঠে,
“অ্যাই অ্যাম হার হাজবেন্ড। অ্যাই ওয়ান্ট টু গো উইথ হার।”
মীরার ডিপার্টমেন্টের কলিগরাও এতে সহমত প্রকাশ করে। মীরাকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে শেহজাদ মীরার কলিগ, কনক ম্যামকে নিজের গাড়ির চাবি দিয়ে বলে,
“আমার মেয়েকে আপনাদের কাছে রাখুন প্লিজ। ও হার্টের প্যাশেন্ট। মীরাকে এই অবস্থায় দেখলে সহ্য করতে পারবে না।”
কনক ম্যাম এগিয়ে এসে বলেন,
“আমরা দেখে রাখব। আপনি দ্রুত যান।”
শেহজাদ সময় নষ্ট না করে অ্যাম্বুলেন্সে উঠে গেলো। অ্যাম্বুলেন্স চলে যেতেই কনক ম্যাম ও সাবিহা ম্যাম শেহজাদের গাড়ির কাছে যেতেই দেখে গাড়ির দরজা খোলা! ভেতরে ফ্রিশা নেই! উনারা ঘাবড়ে গিয়ে হতবুদ্ধির ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। কী করবে না করবে ভাবতে ভাবতেই দারোয়ানকে বলে আশেপাশে খোঁজ লাগাতে। ভার্সিটির অথারিটির কাছেও খবর পৌঁছে গেছে। পু*লিশ কমপ্লেনও ফাইল করা হয়েছে। কিন্তু ভার্সিটির ভেতরে ও আশেপাশে রাস্তায় অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তাঁরা ফ্রিশাকে খুঁজে পায় না। ভার্সিটি অথারিটি গেইটের কাছে সিসিটিভি চেক করে দেখতে পায়, প্রথম দফায় একজন মু*খোশধারী লোক মীরাকে আ*ঘা*ত করে পালিয়েছে। তারপর একই বেশে একজন শেহজাদের গাড়ির দরজায় টোকা দেয়। ফ্রিশা গ্লাস নামালে স্প্রে করে গাড়ির দরজা খুলে ফ্রিশাকে নিয়ে একটা মাইক্রোতে করে চলে যায়। উনারা জুম করে মাইক্রোর নাম্বারটা নোট করতে পেরেছে কোনোভাবে। সেটা পু*লিশকে দেওয়া হয়েছে।
এদিকে রাদিব ও মুরাদ, ফ্রিশাকে অজ্ঞান করে নিজেদের ডেরায় নিয়ে যাচ্ছে। তাদের ধারণা, মীরাকে যেভাবে আ*ঘা*ত করেছে, তাতে মীরা বাঁচবে না। এখন শেহজাদের মেয়েকেও শেহজাদের থেকে দূরে করে পুরানো প্র*তিশো*ধ তুলতে চায় মুরাদ! রাদিব গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে শুধায়,
“মামা, তুমি এই পুচকে মেয়েকে কেন তুলে আনলে? আমাদের তো মীরাকে নিয়ে টার্গেট ছিলো।”
মুরাদ গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে ক্রুর হেসে জবাব দেয়,
“বুঝলে রাদিব, এই শেহজাদের বোনের জন্য এতো বছর আমি সবকিছু থেকে দূরে। তোমার থেকে শেহজাদ সম্পর্কে জেনে প্রথমে সন্দেহ হচ্ছিলো। তারপর আজকে যখন সামনাসামনি দেখলাম, তখন সবকিছু মিলে গেলো। তাই নিজের প্র*তিশো*ধ কীভাবে বাকি রাখি?”
রাদিব অবাক স্বরে বলে,
“তারমানে, শেহজাদের বোন সানিয়া?”
“হ্যাঁ।”
“ও মাই গড! এতো কোইন্সিডেন্স! তাহলে চলো এই পুচকে মেয়েটাকেও মীরার মতো…..”
মুরাদের ধ*ম*কে রাদিব তার বক্তব্য শেষ করতে পারলো না। মুরাদ বলে,
“স্টপ! ওকে মা*র*ব না। পা*চা*র করে দিব! শেহজাদ সারাজীবন নিজের মেয়েকে খুঁজে ফিরবে। স্ত্রী-সন্তান হারিয়ে এবার ব*দ্ধপা*গল হবে! হাহাহা!”
মুরাদের ক্রুর হাসিতে রাদিবও তাল মেলায়।
_________
হসপিটালে আনার পর মীরাকে ডাক্তার চেকআপ করে জানায় অপারেশন করতে হবে, ব্রেন হেমারেজের চান্স বেশি। শেহজাদ যেখানে যা সাইন করার করে মীরাকে দ্রুক অপারেশন করতে বলে। মীরাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেলে শেহজাদ করিডোরের ফ্লোরে মুখ ঢেকে হাঁটুগেড়ে লুটিয়ে পড়ে। বারবার নিজেকে দোষ দিতে থাকে, কেন আর পাঁচটা মিনিট আগে পৌঁছাতে পারলো না! এদিকে এই ঘটনা টিভিতে নিউজ হচ্ছে। সেখান থেকে জানতে পেরে মিসেস শাহিদা আঁতকে উঠে শেহজাদকে কল করে। শেহজাদ নিজেকে কিছুটা সামলে ফোন রিসিভ করতেই মিসেস শাহিদা ঘাবড়ানো কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করেন,
“শেহজাদ, শেহজাদ! তোমরা ঠিক আছো? কোথায় তোমরা এখন?”
শেহজাদের গলা দিয়ে কথা যেন বের হতে চাইছে না। সে বেশ সময় নিয়ে ঢোক গিলে দুঃসংবাদটা জানাতে উদ্ধত হয়। এদিকে মিসেস শাহিদা অনবরত ‘হ্যালো! হ্যালো!’ করেই চলেছেন। শেহজাদ বলে,
“ফুফিজান! মীরা!”
“হ্যাঁ, মীরা! কী হয়েছে? কোথায় ও? কথা বলাও আমাে সাথে।”
মিসেস শাহিদার ভীত কণ্ঠস্বরে শেহজাদ মুখ চেপে আরেকটু সময় নিয়ে তারপর বলে,
“হাসপিটালে ও!”
“মানে? ওই ঘটনা মীরার সাথে? কোন হসপিটাল বলো? আমি এখনি আসছি।”
শেহজাদ হসপিটালের নাম বলে তারপর বলে,
“ফ্রিশাকে ইউনিভার্সিটি থেকে পিক করে ওকে নিয়ে বাসায় চলে যাও। এসো না। ও জানতে পারলে সহ্য করতে পারবে না।”
মিসেস শাহিদা অতঃপর কল কে*টে ড: আকবর রেহমান ও মীরার বাবার বাড়িতে খবরটা জানায়। তারপর রওনা করে মীরার ভার্সিটির উদ্দেশ্যে।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
পরের পর্বে সমাপ্তি হবে। এটুকু ছোটো করে গুছাতে হিমশিম খেতে হয়েছে অনেক। আর পাঠকমহল নিশ্চয়ই ধৈর্যশীল! এখনি কোনো সিদ্ধান্তে চলে যাবেন না।
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।