মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া #লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী #পর্ব_১৩

0
360

#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১৩
নতুন দ্বীপশিখা প্রজ্জ্বলিত হতে শুধু কিছু ধাপ বাকি। বৈঠকের সবার উৎসুক দৃষ্টি মীরার উপর নিবদ্ধ। মীরা এতে যেন দোটানার সাথে অস্বস্তিতেও পড়ে গেছে। কিছুক্ষণ আগেই সে, ড: আকবর রেহমানের সাথে ফোনে কথা বলেছে। জেনেছে, শেহজাদ স্যার মীরার বিষয়ে জানেনা। মীরা তখন অবাক হয়েছিল কিন্তু পরে জানতে পারলো, মেয়ে দেখেছে জানে কিন্তু মেয়েটা কে তা জানেনা। এগুলো রোমন্থন করে মীরার অস্বস্তি লাগছে। শেহজাদ স্যার কী ভাববে তার ব্যাপারে? কেমন এক গুমোট অনুভূতিরা লতার মতো তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরেছে। মীরার বাবা ফের শুধালেন,

“তোমার মতামত বলো। আমার ও তোমার মায়ের আপত্তি নেই। আমি বিশ্বাস করি, তুমি তোমার মায়ের মতোই কোমল।”

মীরা ভেবে চিন্তে সময় নিয়ে বলল,
“ফ্রিশার মা হতে আমার আপত্তি নেই। ও অন্যান্য বাচ্চাদের তুলনায় আলাদা। কিন্তু ওর বাবা! উনি আমার স্যার। আমাদের দুজনের জন্যই ব্যাপারটা অস্বস্তিকর। আমি স্যারের সাথে কথা বলব। উনি যা ভালো মনে করেন। আমি আমার মায়ের অন্য কোনো দিক পেয়েছি কী-না জানিনা কিন্তু এক মা-হারা সন্তানকে আগলানোর গুণ ঠিকই পেয়েছি।”

মীরার বড়ো ভাই মলিন হাসলো। মীরার মা তার আপন মা না। সৎ মা! সম্পর্কে খালাও হয়। রুবেলের যখন তিন বছর বয়স তখন তার জন্মদাত্রী মায়ের আচমকা স্ট্রোকে মৃত্যু হয়েছিল। তারপর কিছুদিন পর তার নানা-নানি নিজেদের নাতির কথা ভেবে তাদের ছোটো মেয়ের সাথে বড়ো মেয়ের স্বামীর আবার বিয়ে দেন। মলি জাহান, রুবেলকে কখোনো নিজের ছেলের চেয়ে কম মনে করেননি। মলি জাহান মীরার পাশে এসে বসলেন। অতঃপর মাথায় হাত রেখে স্নেহের স্বরে বললেন,

“অন্যান্য বাবা-মায়েরা, কখোনো চান না তাদের আদরের মেয়েকে বাচ্চা আছে এমন লোকের সাখে বিয়ে দিতে। কিন্তু আমরা এখন চাইছি। তোর বড়ো ভাই তো, ভার্সিটিতে গিয়ে তোর ডিপার্টমেন্টের কিছু স্টুডেন্টদের থেকে কৌশলে খবরও নিয়ে এসেছে। তোর স্যার অনেক ভালো মনের মানুষ। তুই বিয়ে করতে রাজি না হলে হয়তো উনারা অন্য কোথাও খুঁজবে। কিন্তু যদি সেই অন্য মেয়ে, ফ্রিশাকে ভালোবাসতে না পারে? আমার তোর উপর ভরসা আছে। কেন জানি বাচ্চাটাকে প্রথমবার দেখেই খুব মায়া কাজ করছিল। ভেবেছিলাম হয়তো মায়ের আদরে বাচ্চাটা এত মায়াবি, এত সুন্দর, এত মিষ্টি। কিন্তু যখন মিসেস শাহিদা বললেন, ওর মা নেই। বুকটা ভীষণ ভার হয়ে গিয়েছিল।”

মীরা অপলক তার মায়ের মুখের আদলে চেয়ে আছে। তার খারাপও লাগছে কারণ মাঝে সে এই মায়ের, বাবার উপরই খুব অভিমান করেছিল। মীরা বুঝতে পারে, উনাদের দিক দিয়ে উনারা ঠিক। ভুল যদি কেউ হয় সেটা যারা ক্ষতি করতে চায় এবং পরিস্থিতি। মীরা হুট করে মৃদু হেসে মাকে জড়িয়ে ধরে। তারপর বলে,
“অ্যাই অ্যাম লাকি টু হ্যাভ ইউ গাইজ।”

রুবেল ও মারুফ, তাদের মায়ের পাশে এসে দাঁড়িয়ে পাশ থেকে আগলে নেয়। রফিক তালুকদার পাশ ফিরে কনিষ্ঠ আঙুলির দ্বারা নেত্রকোনে জমে উঠা জলবিন্দুদের মুছে নেয়। শারমিন ও নিধি একে-অপরের দিকে চেয়ে মুচকি হাসে।

________

শেহজাদ একটা রেস্টুরেন্টে বসে আছে। বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত ক্লাস নিয়ে সে বেরিয়েছিল। এখন ঘড়িতে পাঁচটা বিশ বাজে। বসে বসে সে বারবার হাতঘড়িতে সময় দেখছে। তার হাবভাবে দেখে মনে হচ্ছে যেন সে ঘণ্টা যাবত কারও জন্য অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছে। কিন্তু বাস্তবে কিন্তু তা না। মিনিট দশেক হয়েছে এসেছে। বাহিরে তুমুল বৃষ্টি। গাড়ি থেকে নামতেই সে খানিক ভিজেছে। এখন এসির বাতাসে টেনেও গেছে। তার অস্থিরতার কারণ হচ্ছে যার সাথে দেখা করতে এসেছে সে। শেহজাদের অস্থিরতা দেখে ওয়েটার দ্বিতীয় দফায় আসলো।

“স্যার, কিছু অর্ডার করবেন? চা অর কফি?”

শেহজাদ ভাবলো। তারপর বলল,
“ইয়াহ। ওয়ান কাপ অফ স্ট্রং কফি উইথ লেস সুগার।”

ওয়েটার অর্ডার নিয়ে চলে যায়। শেহজাদ ফের দরজার দিকে এবং ঘড়ি দেখছে। ফোনটাও চেক করছে।

এদিকে মীরা অনেকটা সময় উবারের জন্য অপেক্ষা করে একটু আগে উবারে উঠেছে। বৃষ্টির কারনে রাস্তায় জ্যাম। বৈশাখ মাসে তেমন একটা বৃষ্টি না হলেও দুইদিন যাবত হচ্ছে। গতকাল খুব অল্প হয়েছিল। আজও দুপুর অবধি আকাশ রোদে ঝলমল করছিল। হুট করে বৃষ্টি নামলো। লাগাতার আধাঘণ্টা যাবত বৃষ্টি হচ্ছে। জামা ও পাজামার নিচের অংশ একটু ভেজা। গুগোল ম্যাপে দেখল, আর পাঁচ মিনিট লাগবে গন্তব্যে পৌঁছাতে। আজ তার ভার্সিটিতে ক্লাস নেওয়ার তৃতীয় দিন ছিল। নতুন নতুন চাকরির পরিবেশ। আবার যাচ্ছেও নিজের ইউনিভার্সিটির টিচারের সাথে দেখা করতে। অস্বস্তির পারদ সর্বোচ্চ স্থানে পৌঁছে গেছে। মীরা দেখল জ্যাম ছুটেছে। আর পাঁচ মিনিটে পৌঁছে যাবে। সেখানে গিয়ে কী কী বলবে, মনে মনে তারই হিসাব কষে নিচ্ছে।

শেহজাদ কফি শেষ করে ওয়েটারকে ডেকে কফির বিলটা দিয়ে দিল। কারও জন্য অপেক্ষা করার মধ্যে কিছু খেয়েছে তা না বুঝানোই ভালো। মীরা রেস্টুরেন্টের কাচের দরজা খুলে ঢুকলো। হন্তদন্ত হয়ে ঢোকার কারণে দরজার সাথের চেয়ারের সাথে পায়ের কনিষ্ঠ আঙুলে লেগে গেছে। চোখ-মুখ খিঁচে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়ালো তারপর ব্যাথাতুর নিঃশ্বাস ছেড়ে সামনে অগ্রসর হলো। শেহজাদ চেয়ারের শব্দেই সেদিকে তাকিয়েছিল। তারপর মীরা এদিকে আসতেই টেবিলের দিকে নজর ফেরালো। মীরা এসেই প্রথমে সালাম দেয়। শেহজাদও সালামের উত্তর দিয়ে জোরপূর্বক হাসে। দুজনেরই ওষ্ঠকোণে কৃতিম হাসি। মীরা বলল,

“এক্সট্রেমলি সরি, স্যার। হঠাৎ বৃষ্টি তারউপর জ্যামে আটকা পড়ে লেইট হয়ে গেছে।”
“ইটস অকে। কফি?”
“হ্যাঁ?”
“কফি নিবে?”
মীরা প্রথমে বুঝতে পারেনি। যখন বুঝলো সে বোকার মতো প্রশ্ন করেছে তখন ভীষণ লজ্জিত হলো। কিন্তু তার কফি পান করতে ইচ্ছে করছে না। ভার্সিটিতে সকাল থেকে তিন কাপ কফি সে অলরেডি খেয়েছে। তাই ইতস্তত করে বলল,

“চা হলে ভালো হতো। কফিও চলবে।”

শেহজাদ ওয়েটারকে ডেকে দুই কাপ চা সাথে চিকেন কর্ন সূপ ও চিকেন মাশরুম সালাদ অর্ডার করলো। মীরা কোলের উপর দুই হাত চেপে বসে আছে। এতক্ষণ যা প্র্যাকটিস করছিল, এখন সব ভুলে গেছে। শেহজাদ মীরাকে দেখে বুঝলো, মীরা অস্বস্তিতে আছে। নিজেই শুধালো,

“স্যার ও ফুফিজান আমাকে সব বলেছে। আমি নিজেও বিয়ে করতে চাইনি। ইভেন আমি তোমার ব্যাপারে থ্রি ডেইস হলো জেনেছি। রিসেন্টলি ফ্রিশাকে প্রতিমাসের রুটিন চেকআপ করার পর ভার্সিটিরই এক সাইকোলজিস্টের কনসাল্ট করেছিলাম। উনার সাজেশনে বেসিক্যালি আমি বিয়েতে মত দিয়েছি। বাট স্যার যে তোমাকে চুজ করেছে জানতাম না। স্যার বলল, ফ্রিশা তোমাকে অনেক পছন্দ করে। ফ্রিশাও বলেছে। বাট ইউ হ্যাভ চয়েজ। ইফ ইউ ওয়ান্ট দেন…!”

মীরা নিজের শুষ্ক ঠোঁট জোড়াকে জিহ্বার সাহায্যে অতি সন্তপর্ণে ভিজিয়ে নিয়ে মৃদু কণ্ঠে বলে,
“আমার অন্য কোথাও চয়েজ নেই। ফ্রিশাকে আমার ফ্যামিলিও পছন্দ করেছে। আমার ফ্যামিলির এতে সায় আছে।”

শেহজাদ ঘাড় নাড়লো। ততক্ষণে ওদের অর্ডারকৃত খাবার চলে এসেছে। চা টা পরে আসবে। শেহজাদ ইশারায় মীরাকে নিতে বলল। খাওয়ার সময়টাতে দুজনে কথা বলল না। খেতে খেতে ওরা নিজেদের কথা গুছাচ্ছে। খাওয়া শেষে চা আসলে শেহজাদ শুধালো,

“ফ্রাস্ট টিচিং এক্সপেরিয়ান্স কেমন লাগছে?”
মীরা মৃদু হেসে বলে,
“কোয়াইট গুড। আপনাদের স্ট্রাগলটা বুঝতে পারছি।”

খানিক হাসির পরিবেশ সৃষ্টি হলো।
“তোমার রেজাল্ট তো অনেক ভালো দেখলাম। আমাদের ভার্সিটিতেও হতে পারতো। এজ অ্যা এক্স স্টুডেন্ট সিজিপিএ ৩.৮ হলেই এনাফ।”
“এখানে হওয়ার পর মনে মনে হলেও চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন সার্কুলার ছিল না।”
“হুম। চাইলে পরেরবার ট্রাই করতে পারবে। এখন এক্সপেরিয়ান্স গেদার করো। নিজের ভার্সিটিতে টিচিং করা আরও চ্যালেঞ্জিং।”
“জি স্যার।”

কথা বলতে বলতে চা পান করাও শেষ। শেহজাদ বলে,
“ওকে চলো। সন্ধ্যা হয়ে আসবে। বৃষ্টিও থেমে গেছে।”
“জি স্যার।”

মীরা উবারে কল করতে চাইলে শেহজাদ বলে,
“উবার আসতে সময় লাগবে। এমনিতেও বৃষ্টি হয়েছে। আমি তোমাকে কিছুদূর ড্রপ করে দিচ্ছি।”
মীরা ফের দোটানাতে পড়লো। তাকে ভাবতে দেখে শেহজাদ ফের বলে,
“যেখানে বিয়ে হচ্ছে, সেখানে সামান্য ড্রপ করা নিয়ে না ভাবাই ভালো।”

এই কথার পর মীরার কি কিছু বলার থাকে? সে ইশারায় হ্যাঁ বলে শেহজাদের সাথে চলতে থাকে।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

ভুল ত্রুটি থাকলে ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here