মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া #লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী #পর্ব_১৪

0
296

#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১৪
দুইদিন পর, মীরা ফ্রিশার সাথে ফোনে কথা বলছে। প্রায় ঘণ্টা খানেক হতে চলল তাদের কথোপকথন। তখন অন্য এক অচেনা নাম্বার থেকে বারবার বিরামহীন কল আসছে। মীরা তা দেখে বিরক্ত হয়ে আবার ফ্রিশার কথা বলছে। এদিকে ফ্রিশার চোখে ঘুম চলে এসেছে। কথন বলার এক পর্যায়ে তার কোনো আওয়াজ না পেয়ে মীরা হালকা হেসে ফোন রেখে দেয়। অতঃপর কফি বানাতে যায়। লাইট কফির সাথে মধু মিশিয়ে খেলে তার ঘুম ভালো হয়। ঘড়িতে এখন রাত এগারোটা। মীরার বড়ো ভাবি, খাবারগুলো ফ্রিজে রাখছে। সে মীরাকে বলে,

“মীরু, তোমার ভাইয়ার জিজ্ঞাসা করছিল, কাল তো শুক্রবার। তাহলে কথা বলে কালকেই আংটি বদল এগুলো হয়ে যাক। তারপর সামনের শুক্রবার বিয়ে…!”

মীরা কিঞ্চিত ভাবলো। জবাবে বলল,
“এখন না। এখন ভার্সিটিতে এড-ড্রপের কার্যক্রম চলছে। তারপর ক্লাস রিসিডিউলিং। এগুলো চলছে। আমার নিজেরও একটা ক্লাসের ক্লাস টাইম চেঞ্জ হয়েছে। আরও হয় কী-না! তাছাড়া আমি ফ্রিশার মনের কথাও বুঝতে চাই। আমার সাথে টাইম স্পেন্ড করতে পছন্দ করে বলেই যে মায়ের জায়গা দিয়ে দিবে, এমনটা তো না। হতেও পারে আন্টি হিসেবে পছন্দ করে। কিন্তু মায়ের জায়গাটা খুব সেনসিটিভ। এক সপ্তাহে যদি মনে হয়। তাহলেই বাকি সব। বিয়ের পরও কিন্তু দিনের ১০ ঘণ্টা আমি ওর সাথে থাকতে পারব না। এটাও তো বুঝতে হবে।”

“আচ্ছা। আমি তোমার ভাইকে বলব। এখন যে কফি খাচ্ছ, ঘুম হবে? তোমার তো কাল ছুটি।”

“তুমি তো জানোই, আমি মধু দিয়ে কফি খেলে ঘুম আরও ঝেঁকে আসে।”
“তা ঠিক। আচ্ছা খাও তবে। সিয়াম এখনও ঘুমাচ্ছে না। তোমার ভাইয়ের সাথে জেগে জেগে ফোন দেখছে।”

মীরা হাসলো। তারপর কফি করে নিজের ঘরে চলে আসলো। এসে দেখলো আবারও ফোন বাজছে। ওই একই অচেনা নাম্বার থেকে। মীরা ভাবলো, হয়তো কোনো স্টুডেন্ট। কিন্তু এত রাতে! ক্লাসে তো বলাই হয়েছে যে কোনো দরকার হলে অফিস আওয়ারে আসতে। আর যদি অফিস আওয়ারে আসতে না পারে তবে রাত আটটার আগে কল করতে। এখন বাজে এগারোটা। ফার্স্ট সেমিস্টারের স্টুডেন্টরাই এই কাজগুলো বেশি করে। মীরা ফোন রিসিভ করে সালাম দিয়ে প্রশ্ন করলো,

“কে বলছেন?”

অপরপাশ থেকে শোনালো,
“চিনতে পারছ না, মীরা?”

মীরার ভ্রুদ্বয় কুঁচকে এলো। সে সন্দিহান কণ্ঠে বলল,
“হেয়ালী না করে আপনার পরিচয় দিন। এত রাতে একটা মেয়েকে এতবার ফোন করাটা কোন ধরনের ভদ্রতা?”

“তিন বছরে ভুলে গেলে? এখন কণ্ঠও চিনতে পারছ না? ভালোই তো আপডেট হয়েছ! হ্যাঁ?”

মীরা থমকে যায়। তার শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি স্বাভাবিকের তুলনায় বেড়ে গেছে। ফোনটা হাতে নিয়ে আবার চেক করে দেখলো, বাংলাদেশি নাম্বারই। সে তবে বাংলাদেশে এসেছে? অপরপাশ থেকে আবারও শোনালো,

“মনে পড়েছে? নাকি ডিটেইলস ইনট্রো দিতে হবে? তুমি চাইলে দিতেই পারি, মীরু।”

চোখ বন্ধ করে দুই বার বড়ো করে শ্বাস নিয়ে ফের নিঃশ্বাস ছেড়ে কঠোর কণ্ঠে শুধালো,
“হঠাৎ আমাকে মনে পড়লো, ভাইয়া? এতোবার লাগাতার কল করেই যাচ্ছেন! ১২ বার! খুব জরুরী দরকার?”

“বাহ্ বেশ দরকারের কথা বলছ। যেন আমি তোমার অপরিচিত।”

“আমি কি বলেছি, আপনি আমার অপরিচিত? আপনি আমার ভার্সিটির সিনিয়র ভাই। অপরিচিত হতে যাবেন কেন?”

বর্ণ বাঁকা হাসলো। ফের শুধালো,
“শুধু এটুকুই? আর কিছু না?”

মীরা তাচ্ছিল্য হেসে খানিক অভিনয় ধরলো।
“এতটুকুই তো! আর কী থাকবে? আপনি বলুন, কেন কল করেছেন?”

বর্ণর কাছে জবাবটা মনঃপূত হলো না। সে জেনেছিল, মীরা মুভঅন করেছে। সামনে তার বিয়ে। কিন্তু মীরা তো খুব ইমোশনাল ফুল একটা মেয়ে। সে নিশ্চয়ই নিজের এক সময়ের ভালোবাসার মানুষটার কণ্ঠ শুনে আবেগে ভেসে যাবে! এমনটা আশা করেও আশাহত হলো বর্ণ। নিজের আকাঙ্ক্ষাকে খানিক দমন করার বৃথা চেষ্টা করে শুধালো,

“কেমন আছ?”

মীরার এবার স্বতঃস্ফূর্ত জবাব। সেই জবাবে নেই কোনো মলিনতা আর নেই কোনো ঠেকে যাওয়ার ভাব।
“আলহামদুলিল্লাহ্‌। অনেক ভালো আছি, ভাইয়া। আপনি কেমন আছেন?”

বর্ণ থতমত খেয়ে গেলো। সেও কি মীরার মতো এভাবে নির্দ্বিধায় বলতে পারবে? না পারবে না। কারণ সে ভালো নেই। গতকালই সে তার ছয় মাসের শিশুপুত্রকে নিয়ে জাপান থেকে এসেছে। আবার চলে যাবে।
এদিকে বর্ণকে চুপ থাকতে দেখে মীরা তাচ্ছিল্য হাসে। সে মনে মনে বলল, ‘বে*ই*মা*নরা সুখেই থাকে।’ কিন্তু মুখে বলল,

“ভাইয়া, কোনো কথা না থাকলে ফোনটা রাখব। অ্যাই অ্যাম সো টায়ার্ড।”

হুট করে বর্ণ বলে ফেলল,
“অ্যাই ওয়ান্ট ইউ ব্যাক, মীরা।”

হকচকাল মীরা। হঠাৎই নিজের কর্ণকুহরে প্রবেশ করা শব্দগুচ্ছ সে শুনেও এর গুরুত্ব ঠাওর করতে পারলো না। বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হয়ে শুধালো,

“হোয়াট?”
“ইয়েস, অ্যাই ওয়ান্ট ইউ ব্যাক। প্লিজ মীরা।”
মীরা তৎক্ষণাৎ তেতে ওঠলো। ক্রোধে বিহ্বল হয়ে বলতে লাগলো,
“আর ইউ সি*ক? আর ইউ গন ম্যা*ড? হাউ কুড ইউ বি সো সেইমলেস?”

“দেখো মীরা, ভুল তো মানুষই করে। আমিও করেছি। আসলে আমি….!”

“স্টপ। নো মোর ওয়ার্ডস। আমাকে পুতুল পেয়েছেন না? যখন মন চাইবে খেলবেন, তারপর মন ভরে গেলে ছুড়ে ফেলে দিবেন। ফের আবার খেলতে ইচ্ছে হলে খেলবেন! শুনে রাখুন মিস্টার বর্ণ আহমেদ, এই মীরা কোনো পুতুল নয়। সে এখন আর তিন বছর আগের মীরা নয়। সে বদলেছে। আমূলে বদলেছে। এন্ড থ্যাংকস টু ইউ। আপনার কারণেই আমার এই সুন্দর বদল হয়েছে। ফারদার আমাকে কল করবেন না।”

“মীরা, প্লিজ শুনো… মীরা!”

মীরা এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করে কল কে*টে নাম্বার ব্লক করে দেয়। এদিকে বর্ণ বার বার ট্রাই করেও মীরার নাম্বারে কল লাগাতে পারছে না। সে রেগে নিজের ফোনটা ছুড়ে ফেলে। এই শব্দে বর্ণর ছেলে বর্ষণের ঘুম ছুটে যায়। সে কেঁদে উঠলে বর্ণ বিরক্ত হয়ে নিজের মাকে ডাকে।

কল কেটে মীরা মুখ ঢেকে মাথা নিচু করে বসে আছে। না, সে কাঁদছে না। বরং আফসোস হচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে। তার জীবনে আবারও কেন অতীতের ছায়া ধেয়ে আসছে? নিজের মত সবকিছু খুব সুন্দর করে গুছিয়েই তো নিয়েছিল। তার ক্যারিয়ার নিয়ে সব স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে। তার পরিবার খুশি। বিয়েও করতে চলেছে এক ভালো মনের মানুষকে। একটা ছোটো বাচ্চার মায়ের পরিচয় পেতে চলেছে। সে উপলব্ধি করলো, তার কপালের রগ গুলো ধপধপ করছে। মাথাব্যথা যে আবারও তাকে নিজের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিবে তা বুঝে ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার কফির সাথে একটা মাইল্ড ডো*জের স্লি*পিংপি-ল ও দুটো প্যা*রাসিটে*মল খেয়ে নিলো। টা*ফনি*ল তার পছন্দ না। কারণ টা*ফনি*লের অভ্যাস লেগে গেলে সেটার সাইড এ*ফেক্টও ভুগতে হবে। তারপর সে আলো নিভিয়ে মশারি দিয়ে শুয়ে পড়লো। নিজের ব্রেণকে বর্ণ সম্পর্কিত কিছুই চিন্তা করতে দিলো না।

__________

শেহজাদ, ফ্রিশাকে নিয়ে বাগানে কিছু ছোটো ছোটো চারা গাছ লাগাচ্ছে ও অন্যান্য গাছের মাটি ঠিক করে দিচ্ছে। কিছু ফুল ও ফলের গাছ নার্সারি থেকে কিনে এনেছে। গাছের যত্নের জন্য তাঁরা মালি রাখে না। টাইমপাস হিসেবে গার্ডেনিং বেশ ভালো একটা উপলক্ষ। কিছু গাছ ম*রে গেছিল, তাই সেসবের বিপ্লেসমেন্টে নতুন ও অন্যান্য গাছের চারা এনেছে। ফ্রিশা, পানির পাইপলাইনের ছোটো লিকেজের কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ দুষ্টমি করে শরীরে কাঁদা মাখিয়ে এসেছে। শেহজাদ খানিক রাগ দেখিয়ে ওকে ব*কে,

“তোমাকে নিষেধ করেছিলাম না? তাও ওখানে গিয়েছ কেন?”

“সরি বাবা। আমি তো পাইপের ফুঁটোটা বন্ধ করতে গিয়েছিলাম!”

শেহজাদ আর কী বলবে! ফ্রিশাকে বাসার ভেতরে নিয়ে যায়। মিসেস শাহিদা ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছিলেন। ফ্রিশার অবস্থা দেখে তিনিও রাগ করেন। অতঃপর ওকে ড্রেস চেঞ্জ করতে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দিলেন। সার্ভেন্টকে ডেকে বললেন ফ্রিশার নোংরা করা কাপড় গুলো পরিষ্কার করে দিতে। শেহজাদ নিজের ঘরের দিকে যেতে নিলে মিসেস শাহিদা ডাক দিলেন।

“শেহজাদ, মীরার ফ্যামিলি জানালো এইনগেজমেন্টের ব্যাপারটার সামনের শুক্রবার করতে। আজ বা কালকের কথা বলাতে মীরা নাকি ভার্সিটির কাজের জন্য পিছিয়েছে।”

“ঠিক আছে সমস্যা নেই। বাকিটা আপনারা বুঝে নিন।”

শেহজাদও ফ্রেশ হতে চলে যায়। বেলা বারোটা বেজে গেছে। নামাজে যেতে হবে।

__________

সারাদিন মীরা ফোনে ফ্লাইট মুড দিয়ে রেখেছিল। ওয়াইফাই অন ছিল তাই জরুরী কিছু থাকলে ইমেইল ও হোয়াটসএপে সেরে নিয়েছে। রাতে ফ্লাইট মুড অফ করতেই প্রায় ঘণ্টা খানেক পর আবারও আরেকটা অচেনা নাম্বার থেকে কল আসা শুরু। মীরা এবার আর ফোন তুলল না। ফের ব্লক করলো।
আজ রাতেও ফ্রিশার সাথে কথা বলছে মীরা। হঠাৎ ফ্রিশা জিজ্ঞাসা করে,

“ফেইরি আন্টি, তোমার মন খারাপ?”

“না তো। কেন বাচ্চা?”

“ঠিক মতো কথা বলছ না।”

শেহজাদ পাশেই বসা ছিল। মেয়ে তো তার ফোন দিয়েই কথা বলছে। সে বলল,
“ফ্রিশা, তুমি এখন ঘুমাতে যাও। কাল আবার কথা বলো। আন্টিরও মেবি ঘুম পাচ্ছে।”

ফ্রিশা তার বাবার কথা শুনে মীরাকে জিজ্ঞাসা করে,
“তোমার ঘুম পাচ্ছে, ফেইরি আন্টি?”

মীরা কী বলবে না বলবে ভেবে শেহজাদের সাথে হ্যাঁ মিলালো। বলল,
“সরি ফ্রিশামনি, আন্টির একটু মাথা ধরেছে। কাল গল্প করব হ্যাঁ?”

“ওকে। টেক রেস্ট, ফেইরি আন্টি। গুড নাইট।”
“গুড নাইট, ফ্রিশামনি।”

মীরা ফোন কে*টে সবার আগে সিমকার্ড খুলে ফেলল। তারপর ফোন বন্ধ করে রাখলো।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

ভুল ত্রুটি থাকলে ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here