#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৬৫
#হুমাইরা_হাসান
_________________
শরীরের সমস্ত রাগটা যেন আজ খাবলে উঠেছে। উত্তপ্ত ক্রোধের বেসামাল পরিস্থিতি আজ সীমার বাহিরে৷ এই ক্ষিপ্ততা সামলানোর মতো অবস্থা বা ইচ্ছে কোনো টাই নেই। চোখের কোণা বয়ে গড়িয়ে পড়া জলের কথাটুকুকে সহস্তে মুছে নিলো। হাঁটার গতি আরও বাড়িয়ে দিয়ে এক প্রকার ছুটেই প্রবেশ করলো বাড়ির ভেতর।
– মা! বাবা! নাজমা বেরিয়ে আসো..
মেয়েলী গলার উচ্চরবে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন কাকলি বেগম। চুলগুলো এলোমেলো অবস্থায়, দেখেই বোঝা যাচ্ছে ঘুম থেকে উঠে এসেছে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে জলন্ত চোখে এদিক ওদিক চাইলো। নাজমা রান্নাঘর থেকে খুন্তি টা হাতে নিয়েই বেরিয়ে এসেছে কারো উচ্চস্বরের ডাকে। কেমন অসহিষ্ণু গলায় বলল,
– কী হয়েছে আপা এভাবে ডাকাডাকি করতেছেন যে!
– মালা কোথায় নাজমা?
নাজমা বেশ হতবাক হলো এইরূপ চেহারায় মালার খোঁজ করায়। তবে তাথইয়ের চেহারাটা দেখে আর প্রশ্ন করার সাহস টা যুগিয়ে উঠতে পারলো না। এ যেন আগের তাথই কে দেখতে পাচ্ছে যে কথায় কথায় ভাঙচুর আর রাগ দেখাতো। কেমন নড়বড়ে হয়ে বলল,
– ও তো খালার বাড়ি যাবে বলছিলো সকালে
ওর খালা নাকি খুব অসুস্থ। চলে গিয়েছে নাকি ঠিক বলতে পারছিনা ম্যাডাম।
– মালা যায়নি। আমি ওকে আমার একটা কাজে পাঠিয়েছিলাম বলে যেতে পারিনি। এক্ষুণি চলে আসবে তারপর যাবে। কিন্তু মালাকে দিয়ে তোর কী কাজ? আর এই অবস্থা কেনো তোর?
এই মুহূর্তে একটা প্রশ্নের উত্তর দিতেও রাজি নয় তাথই। ভেতরটা দাউদাউ করছে অসহনীয় যন্ত্রণায়। বেশ কয়েক মিনিট ওমন উদ্ভ্রান্তের মতো পায়তারা করতে থাকলো। কাকলির হাজারটা প্রশ্ন শুনেও সেসবের একটাও কানে তুললো না। দরজার কাছে কারো পায়ের শব্দ শুনেই পা দুটো থামিয়ে তাকালো তাথই। সামনের মানুষটির এতক্ষণ চেহারা স্বাভাবিক থাকলেও তাথইকে দেখে কেমন ভেতরটা খাবলে ধরলো। তাথই এর চোখ মুখ একেবারেই স্বাভাবিক ঠেকছে না। মালা খুব সন্তপর্ণে তাথই কে অগ্রাহ্য করে ধীর পায়ে এগিয়ে এসে কাকলির সামনে একটা প্যাকেট ধরে বলল,
– এই নিন ম্যাডাম। এটার জন্য আমার ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হলো। এতক্ষণে আমি পৌঁছে যেতাম। যাক গে এখন আসি হ্যাঁ, আমার খালার মেয়ে কয়েকবার ফোন দিয়েছিলো।
কাকলি কেমন অদ্ভুত ভাবে তাকালেও মালার স্বাভাবিকতায় কোনো খাদ পেলেন না। অগত্যা ভ্রু কুঁচকেই ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। মালা সবিনয়ে ঘাড় হেলিয়ে উলটো দিকে হাঁটতে গেলেই পেছন থেকে শোনা গেলো,
– তোর মায়ের কোনো ভাই বোন নেই। এমনটাই তো বলেছিলি, তবে আজ খালা এলো কোত্থেকে?
না চাইতেও পা দুটো জমে গেলো মালার। ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠলো, ঠান্ডা শিরশিরে বাতাস যেন শরীর ছুঁয়ে গেলো। কাকলি যেন হুট করে সম্বিত ফিরে পাওয়ার ন্যায় বললেন,
– হ্যাঁ তাই তো। কিরে মালা তুই না বলেছিলি তোর মায়ের কোন ভাই বোন নেই।তাহলে খালাটা আবার কী করে এলো।
– চাচাতো.. আমার মায়ের চাচাতো বোন ম্যাডাম। ছোট বেলায় খুব আদর করতো আমায়। তার অসুস্থতায় আমি না গিয়ে পারি?
কাকলির সমস্ত কৌতূহল যেন নিমিষেই ধামাচাপা পড়লো। তবে থামলো না তাথই৷ একচুল অপেক্ষা না করে ক্ষিপ্ত গতিতে ছুটে এসে সপাটে একটা চ-ড় বসিয়ে দিলো মালার গালের ওপর। অকস্মাৎ ঘটনায় তাল সামলাতে না পেরে ধপ করে ফ্লোরে মুখ থুবড়ে পড়লো মালা। তাথই একচুল বিরতিহীনা মালার একটা বাহু চেপে ধরে তুলে পরপর তিনবার সজোরে থা’প্পড় কষে দিলো। এহেন অপ্রত্যাশিত ঘটনায় বাকরুদ্ধ নাজমা নিজের মুখেই হাত চেপে হা করে চেয়ে রইলেন৷ কাকলি বিব্রতকর চিত্তে এগিয়ে এসে তাথইয়ের হাত ধরে বলল,
– কী করছিস টা কী? মারছিস কেনো ওকে?
তাথই এক ঝামটায় সরিয়ে দিলো কাকলি খাতুনকে৷ মালার গালটা হাতের চাপে ধরে বলল,
– কেনো করেছিস বল! কার কথায় করেছিস এসব? অমানুষ, কুলাঙ্গার কার কথায় খাবারে মেডিসিন মিশিয়েছিস বল!
মালা গাল দুটো লালাভ হয়ে চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়লো। তবুও সবকিছু থেকে সে অজ্ঞাত এমন একটা ভাব নিয়ে বলল,
– ম্যাডাম কিসব বলছেন আপনি! আমি কী করবো, কার কথায় করবো! ছাড়ুন আমায়
তাথই তীব্র ক্রোধে ক্রোধান্বিত হয়ে মালার চুলের মু-ঠি চেপে ধরে এক টানে বা-রি দিলো দেওয়ালের সাথে,চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এলো মালার। কয়েক মুহুর্তের জন্য যেন দুনিয়াটা আধার হয়ে দাঁড়ালো তার সামনে। কোনো নড়চড় করার আগেই তাথই দুইহাতে গলা টি’পে ধরলো মালার। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চ্যাঁচিয়ে বলল,
– শকুনের জাত। কার কথায় করেছিস! বল না তো আজ আমার হাত থেকে তোকে কেও বাঁচাতে পারবে না। তুই সেদিন ও এই উদ্দেশ্যেই রান্নাঘরে গেছিলি তাই না? আমাকে দেখে সরে পড়েছিলি আজ সুযোগ পেয়ে সেই কাজটাই সেরেছিস। নামটা বল না তো আজ তোরে জ্যান্ত পুঁ’তে রাখবো আমি
চোখ দু’টো থেকে অনবরত পানি ঝরতে লাগলো মালার। মুখটা রক্তাভ বর্ণ ধারণ করেছে। ঘটনাটা এমন আচানক, অকস্মাৎ ঘটে গেলো যে কাকলি খাতুন এখনো কোনো কথার খেই পাচ্ছেন না। কেমন পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকতেই নাজমা এগিয়ে এসে চাপা স্বরে বলল,
– মালারে তো মাইরায় ফেলতাছে ম্যাডাম। তাথই আপারে সামলান
কাকলি উদ্ভ্রান্তের ন্যায় হা করে চেয়ে আছে। তাথই এর এহেন কাজ বা কথার জের কিছুই বুঝলো না। এগিয়ে আসবে তখনই তাথই খলবলিয়ে বলে উঠলো,
– খবরদার যদি এক পা এগিয়েছ! আমাকে তোমার সাথেও পশুর মতো আচরণ করতে বাধ্য কোরো না মা। যেখানে দাঁড়িয়েছ ওখানেই থাকো।
বলে মালার গলায় আঙুলের চাপ আরও গাঢ় করতেই মালা ফ্যাসফ্যাসে গলায় গায়ের সমস্ত জোর খাটিয়ে অস্ফুটে বলল,
– রু…রুকাইয়া
তাথই মালার চুলের মুঠি আরও সজোরে চেপে ধরে দেওয়ালের সাথে আবারও সজোরে ধাক্কা দিলো মালার কপালে। বা-রি দিয়ে চেপে ধরলো। পরপর দুবার আঘাত লেগে কপালের মাংস থেঁতলে রক্ত চুঁইয়ে পড়লো গাল বেয়ে। কাকলি খাতুন আঁতকে উঠল ভীষণ ভাবে, আতঙ্কপ্রসূচভাব বললেন,
– তাথই থাম। কী করছিস তুই! মে’রে ফেলবি!
তাথইয়ের শরীরে যেন ভয়ানক কোনো অশরীরী ভর করেছে, যে তার তাণ্ডব চালাতেই বেসামাল। বাইরের কোনো শব্দ বা আচরণ ওর মস্তিষ্ক অব্দি পৌঁছুবে না। মালার চুল ধরে টে’নে হিঁচড়ে স্টোররুমের অন্ধকারে ছুড়ে ফেলে দরজা লাগিয়ে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে বলল,
– আমি আসার আগ অব্দি যদি এই তালা খোলে, আমি ভুলে যাবো তোমরা আমার পরিবারের কেও।
•••
হসপিটালের শুভ্র বিছানায় অবিকৃত ঘুমে ঘুমন্ত মোহরের শ্রান্ত মুখখানা। যেন কতটা শান্ত, নিথর এক শান্তির ঘুম। কিন্তু আদৌ কী শান্ত! চোখ খুললে যে কোন বিধ্বংসী একটা খবর অপেক্ষা করছে ওর জন্য তার আঁচ ও কী করতে পারছে ও! যেই নিদারুণ নিষ্ঠুর দৃশ্যটা ওর জন্য অপেক্ষায়মান তা সহ্য করার মতো মনোবল কী আদৌ ওর সক্ষমতায় কুলাবে? নিস্তব্ধ, নিস্তেজ, একটা জীবন্মৃতের ন্যায় নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে মেহরাজ। যেই দৃষ্টিতে নেই কোনো প্রাণের রেশটুকু। যেন একটা পাথরমূর্তি। পৃথিবী যেন আজ ওর নিকট একটা জলন্ত অগ্নিকুণ্ড। যার লেলিহান দাবালন ওকে গ্রাস করে যাচ্ছে আর সবচেয়ে বড় দহন টা জুড়িয়েছে ওর কোল জুড়ে, মোহরের মুখটা থেকে চোখ নামিয়ে নিচে তাকাতেও ভয় লাগছে৷ বুকটা চরম ভাবে কেঁপে উঠছে! এই পাশবিক দৃশ্যটা কী করে ওর চোখ দু’টো দিয়ে দেখবে ও! এতটা পাষাণ কী হওয়া আদৌ সম্ভব! নিজ চোখে ভালোবাসার মৃত্যু দেখা যায়? আদর, স্নেহ…পিতৃত্বের মৃত্যু কী দেখা যায়! তা কী সম্ভব? এই অসম্ভব কাজটা আজ মেহরাজকেই কেনো করতে হলো! চোখ দু’টো খিঁচিয়ে বুজে নিলো মেহরাজ। খাবারের সাথে শরীরে টক্সিক মেডিসিনের বিষক্রিয়া ছড়িয়ে যাওয়ায় মোহরের শরীর টা কোনো মতে বেঁচে গেলেও পারেনি পেলব নম্র দেহটা। নিয়তির নিষ্ঠুরতম খেলায় টিকতে না পেরে হেরে গেছে একটা ছোট্ট প্রাণ। মেহরাজ যে চোখ দুটো দিয়ে নিজের নির্মল ভালোবাসার আর্জি রাখতো, যার চাহনিতে তৃপ্ত করতো হৃদয়কুঠুরির অবাধ্য বাসনা গুলো। আজ সেই চোখ দু’টো যেনো অগ্নির ফুলকি, তাকালেই ঝলসে দেবে।
– মেহরাজ?
কাঁধের ওপর একটা ভারী হাতের চাপ আর কানে একটা সুশ্রাব্য কণ্ঠেও মেহরাজ তাকালো না। নড়চড় করলো না। পৃথক হাতের চাপটা গাঢ় করে বলল,
– আর অপেক্ষা করিস না ভাই। যেইখানটা ওর স্থান সেখানে ওকে রেখে আসতেই হবে।
মেহরাজ বিদ্যুতের ঝলকানির মতো দ্রুত চোখ দুটো প্রসারিত করলো। কেমন অপার্থিব দৃষ্টিতে তাকালো পৃথকের দিকে৷ বড়সড় একটা গর্জন দিতে গিয়েও মোহরের অক্সিজেন পরিহিত চেহারাটা দেখে থেমে গেলো। পৃথক ওর পিঠে হাত রেখে খুব অসহায় ভাবে একটা ইশারা করে বের করে আনলো। মেহরাজকে বেরোতে দেখেই মিথিলা ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে এসে বলল,
– ওকে একটু আমার কাছে দাও না। একবার ছুঁয়ে দেখি!
দু’হাত মেলে কতটা করুণ আর্জি রেখে বলল এক অভাগী বোন। তবুও গললো না মেহরাজ। খুব হিংসুটে বাচ্চারা যেমন নিজের প্রিয় খেলনাটাকে আগলে রাখে তার চেয়েও অনেক বেশি যত্নে হাতের মাঝে ছোট্ট পুটলির মতো তোয়ালে পেঁচানো শরীরটা ও সযত্নে, সগৌরবে বুকের সাথে চেপে ধরে বলল,
– না নাহ..আমার আমার বাচ্চাকে আমি কারো হাতে দেবো না, কোত্থাও যেতে দেবো। ও ওর বাবার কাছে থাকবে। বাবা ছাড়া কোথাও সুরক্ষিত না ও।
বলে ছোট শরীরটার কাছে মুখ নিয়ে একবার দুইবার তিনবার… অসংখ্য বার, অসংখ্য স্পর্শে, ভালোবাসা স্নেহের পরশে ছুঁয়ে দিলো ছোট্ট তুলতুলে দেহটার সবটায়। মিথিলা গলা ছেড়ে কেঁদে দিলো সশব্দে। শাহারা বেগম কোন মতে বসে থাকলেও পারেননি আম্বি খাতুন। মনের ভেতর অদ্ভুত ব্যাথা, যন্ত্রণা আর অপরাধবোধের গ্লাণি তাকে টিকে থাকার মনোবল টুকুও দেয়নি। এতদিন তো ভালোই ছিলো তার আনা খাবার খেয়েই তো এই অবস্থা… তার, তার মানে এসবের জন্য সেই দায়ী! মোহরের বুক চিরে আসা যন্ত্রণা, এতগুলো মাস নিজের ভেতর লালন করে আসা প্রাণটা হারানোর বেদনা, মেহরাজের সন্তানহারা হওয়ার যন্ত্রণা… আহ্! কী নিদারুণ অপার্থিব সে যন্ত্রণা! এই পাশবিক নির্যাতন স্বরূপ ব্যাথাটা নিতে না পেরে মানব শরীরটা হাল ছেড়েছে। একই হসপিটালের জেনারেল ওয়ার্ডে ভর্তি করিয়েছে তাকে৷ মেহরাজ স্থবির, নিশ্চল চিত্তে বসে রইলো বেঞ্চটাতে। একদম থমকে যাওয়া কোনো ঘটনার ন্যায় পুরো পৃথিবীটায় যেন আঁটকে গেছে এই একটা চেহারায়। মেহরাজ ঘাড় নামিয়ে তাকালো ছোট্ট একটা পুতুলের দিকে।সে চাহনির মর্মান্তিক রূপ টা সকল কাঠিন্যের ভিত নড়বড়ে করে দিলো। সমস্ত পরিচয়, ক্ষমতা, ক্ষুব্ধতা ছাপিয়ে মেহরাজ আজ একজন বাবা,যেই বাবা নামক বিশ্বাস ভরসার বুকে একটা ছোট্ট দেহ সানন্দে, নির্দ্বিধায় তলিয়ে আছে অতল ঘুমে৷ যেই ঘুম কখনো ভাঙবার নয়! মেহরাজের বুকটা অসহনীয় ব্যথায় ক্ষতবিক্ষত হয়। আস্তে আস্তে আঙুল বুলিয়ে দেয় নরম গালে অস্ফুটে বলে ‘আমার বাহার’। সে যেন সত্যিই বাহার! যার চেহারাটায় বাহারের ফুলঝুরি। ফর্সা টকটকে শরীর, নরম তুলতুলে এইটুখানি লাল টকটকে মুখ পেলব গাল ।নরম হাতের মুঠো শক্ত করে চেপে আছে। অথচ এই মুঠোয় মেহরাজ কখনো ওর আঙুল খানা গুঁজে দিতে পারবে না!
– মি.আব্রাহাম
কাঁধের ওপর একটা হার সস্নেহে হাত রাখলো। মেহরাজের অভিব্যক্তি ছাড়াই সে বলল,
– জন্ম, মৃত্যু সবটাই ভাগ্যের খেল। আমি বুঝতে পারছি আপনার অবস্থাটা। কিন্তু যা করার তা তো আঁটকে রেখে কোনো সমাধান হবেনা।
ডাক্তারের এহেন সহমর্মিতাপূর্ণ বাক্যেও মেহরাজের নড়চড় হলো না। মূর্তিটার মতো বসে রইলো। পৃথক এগিয়ে এসে হাঁটু গেড়ে ওর সামলে বসলো, খুব অনুরোধপ্রবন কণ্ঠে বলল,
– ভাইরে আর কতক্ষণ বসে থাকবি ওকে নিয়ে। সারাটা দিন পেরিয়ে গেছে। ওকে ওর জাগায় ফিরিয়ে তো দিতেই হবে। আমি জানি কাজটা কতটা বেদনাদায়ক কিন্তু আমরা অপারগ।
মেহরাজ চোখের কার্ণিশে জমে থাকা পানি হাতের উল্টো পাশে মুছে নিয়ে ব্যাকুল স্বরে বলল,
– মোহ! পৃথক, আমার মোহ? ও তো উঠছে না ও কী দেখবে না? আমাদের সন্তানের মুখটাও কী ও দেখবে না? ওকে না জানিয়ে আমাদের বাচ্চাটাকে ওই তিনহাত মাটির নিচে রেখে আসলে আমি ওকে কী জবাব দেবো হ্যাঁ? যাকে এতগুলো দিন নিজের ভেতর লালন করলো নিজের অস্তিত্বের সাথে মিশিয়ে রাখলো তার মুখটা একটা বারের জন্যেও দেখার সুযোগ হবে না ওর?
মেহরাজের প্রশ্ন গুলোর জবাব নেই পৃথকের কাছে৷ নিঃশব্দে চোখের জল মুছে নেওয়া ছাড়া কোনো প্রত্যুত্তর এলো না। তাথই এগিয়ে এসে বসলো মেহরাজের পাশে ওর হাতটা ছুঁয়ে বলল,
– মোহরের অবস্থা এখনো ঠিক নেই ভাই। ওর কখন জ্ঞান ফিরবে ডাক্তার রাও বলেনি।সে তো সৌভাগ্য আল্লাহ্ ওর প্রাণটা ভিক্ষা দিয়েছেন। তুমি আর কত অপেক্ষা করবে? ওকে এভাবে রেখে তো কিছুই ঠিক হবে না!
মেহরাজ ঝাপসা চোখেই তাকিয়ে রইল ওর বাচ্চাটার মুখে। মোহরের অবস্থা যখন ওটি রুমে প্রায় মরণপণ মেহরাজ এক প্রকার জোর করেই ওটি তে প্রবেশ করে। নিজের দেহে মারণসম যন্ত্রণা ভোগ করে, অজস্র ছুড়িঘাতের চেয়েও তীব্র যন্ত্রণার দাবানলে ছারখার হয়ে যেই প্রাণটাকে ভূমিষ্ট করলো তাকে দেখতে পারবেনা মোহ! ছোট্ট তোয়ালে পেঁচিয়ে একটা তুলতুলে শরীর যখন মেহরাজের কোলে তুলে দিলো আধো আধো চোখটা মেলে একটা বারই তাকিয়েছিলো ওর বাবার পানে, দুটো ধূসর চোখের মিলনকাল এতটাই স্বল্প ছিলো যে কখন একটা চোখ খুব আলগোছে অতল ঘুমে তলিয়ে গেছে তা ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি মেহরাজ। যার জন্য এতো আদর,বুকভরা স্বপ্ন, অজস্র ভালোবাসা বুকের মণিকোঠায় সযত্নে জমিয়ে রেখেছে সেই আদরিনীর জীবনকাল এতটায় ক্ষীণ! মানবজাতির প্রবল নিষ্ঠুরতার বিষে দগ্ধ হলো একটা নিষ্পাপ প্রাণ, দুনিয়ায় আলোটা যার কপালে জুটলো না। নাইবা জুটলো বাবা-মায়ের অকৃত্রিম স্নেহের আদর৷
•••
পার হলো আরও কতগুলো প্রহর, একটা হতপ্রায় জীবের মতই মেহরাজ অপেক্ষা করলো মোহরের জ্ঞান ফেরার, বাচ্চাটার মুখটা একবার ওর মায়ের চোখের সামনে ধরার। কিন্তু ফিরলো না মোহরের জ্ঞান নাইবা দেখলো ওর নাড়ি ছেড়া ধনকে। যাকে ভূমিষ্ট করতে আজ চেতনাহীন শয্যার শায়িত তার আনন খানা একবার দর্শন করবার সৌভাগ্য টুকুও মিললো না। অবশেষে এক সমুদ্র আশা,ভালোবাসা নিয়ে যে প্রাণ টা আসার কথা ছিলো তাকে বিসর্জন দিয়ে বুকভরা স্বপ্নকে পায়ে পিষে ধূলিসাৎ করেই দিলো। অন্ধকারের দূর্ভেদ্য প্রাচীরের মধ্যে হাজারো মাটিতে চাপা পড়া আধপচা শরীর-হাড়গোড়, ভারী বাতাস.. আর তার মাঝে দাঁড়ানো কতগুলো জীবন্ত প্রাণ। ইফাজ,পৃথক,মেহরাজ। তিনজনে দাঁড়িয়ে আছে গোরস্তানের একদম কোণঘেঁষে, সামনে তিন হাত গর্তের দিকে তাকিয়ে৷ অভিমন্যু খানিকটা দূরেই দাঁড়িয়ে আছে। ওর অসহায় চাহনি মেলে একদৃষ্টে চেয়ে ভাবছে, আচ্ছা সে ভিন্নধর্মী বলে কী এই কাজটায় হাত দিতে পারবেনা? যার সমস্ত বিপদ-আপদকে নিজের মনে করে যাকে ভালোবেসে এতগুলো সময় পাশে থাকবার চেষ্টা করেছে এই মুহূর্তে সে যদি দু মুঠো মাটি ওই ছোট্ট নিষ্পাপ শরীর টার ওপরে সমর্পণ করে তাহলে কী খুব পাপ হবে? আচ্ছা আমরা তো সকলেই মানুষ, ধর্ম-বর্ণ, স্থান-কাল নির্বিশেষে আমরা সকলে একই বাতাসে প্রাণ নেই, একই মাটির ফসলকে অন্ন হিসেবে গ্রহণ করি, একই পৃথিবীতে একই দেহাবয়ব একই রক্ত আমাদের সকলের শিরা-উপশিরায় বহমান। তাহলে প্রার্থনা করার সময় নামের-নিয়মের পরিবর্তন করে ফেলি বলেই কী আমরা আলাদা! সত্যিই কী আলাদা! তাহলে কেনো অভিমন্যু নিজের ভেতরের দগ্ধতাকে শীতল করে এগিয়ে যেতে পারছে না৷ আড়ষ্টতা জেঁকে বসেছে যদি ওরা ফিরিয়ে দেয়! যদি এটা অনাচার হয়!
এদিকে অভিমন্যুর দ্বিধাদ্বন্দে জর্জরিত মনটা নিয়ে দাঁড়িয়ে, ধর্ম নামক অদৃশ্য দেওয়ালের বেরিবাঁধে আঁটকা পরা কদম দুটো ভীষণ পীড়া দিচ্ছে মনটাকে। যেন লোহার শেকলে অবরুদ্ধ পা দুটো খুব দুরূহতম বাঁধনে বেঁধে পড়েছে। অভিমন্যুর এক মুহুর্ত কী একটা চঞ্চলতা কাজ করলো জানা নেই, পায়ের জুতো টা খুলে খুব সন্তপর্ণে নগ্ন পায়ের কদম ফেলে এগিয়ে গেলো সামনের দিকে। ভেতরটা উন্মনায় এতটাই প্রগাঢ়তা ছড়িয়েছে যে সমস্ত নিয়ম শৃঙ্খলা ভুলে গেলো। ধর্ম বর্ণ সবকিছু ছাড়িয়ে ও একজন ভাই হিসেবে এগিয়ে গেলো,যে নিজেকে সবটা সময় নিজের বড় ভাইরূপী মানুষটার পাশে রাখতে চাই। কোনো নিয়ম-নীতির পূর্বজ্ঞান ছাড়াই মুঠো ভরে মাটি নিয়ে রাখলো মাটিতে শায়িত শরীরটার ওপর। এই কাজটা আদৌ কতটা ভুল কিংবা সঠিক ওর জানা নেই। এর জন্য মানুষ ওকে কোন চোখে দেখবে কিংবা বিতর্কিত করবে তাও ওর জানা নেই। ও শুধু একজন ভাই হতে চেয়েছে হতে চেয়েছে একজন সহচর যে তার মাথার ওপর রাখা ভাইয়ের হাতটাকে সমস্ত পরিস্থিতিতে আঁকড়ে রাখতে চাই৷
…..
অক্সিজেনে ঢাকা মুখটা হুটহাট করেই লাল হয়ে উঠছে, শ্রীতমা মোহরের অসহিষ্ণু অবস্থায় আঁতকে উঠলো, বেশ কিছুক্ষণ ধরেই মোহরের এমন হচ্ছে থেকে থেকে। ডাক্তার ওর অবস্থার উন্নতি করার চেষ্টা করলেও শ্রীতমা দাঁড়ালো না, ওর কেমন কষ্ট হচ্ছে। এটাই হয়তো মায়ের টান, যে সন্তানকে একবার নিজের বুকে ঠেকাতে পারলো না সেই সন্তানটাকে মাটির বুকে শুইয়ে দিচ্ছে, তাই হয়তো চেতনাহীনতায় মায়ের শরীরটা কেমন করে ওঠে, অস্থিরতার ঘোরেও অস্ফুটে বারংবার বলছে “রুদ্ধকে ডাকো, ওকে আমার কাছে আসতে বলো”।
কেবিনের বাহিরে এসে দাঁড়িয়ে থাকলো চোখ মেলে কাঁচের ওপাশের দৃশ্যে। তাথই ক্লান্ত শরীরে হাত পা মেলে ফ্লোরে বসে আছে, উঠে গিয়ে দাঁড়াবে সেই মনোবল টুকু বহু চেষ্টায়ও যোগাতে পারেনি। মোহরের শারীরিক যন্ত্রণা ওর ভেতরটা এফোড় ওফোড় করে দিচ্ছে। আর কতকিছু দেখতে হবে ওর! আর কত? হাসপাতালের এই একইরকম ঘরগুলো দেখতে দেখতে কেমন তিক্ততা ধরে গেছে। জীবন এমন ও হয়! এভাবেও নিষ্ঠুরতম নাটকীয়তার শিকার হয় মানুষ! মানুষ কী করে পারে নিজ হাতে একটা রক্ত মাংসের দেহকে যন্ত্রণায় ঠেলে দিতে, কাওকে হত্যা করার মানসিকতার মতো বিকৃতিকে কী করে মনে মধ্যে পুষতে পারে মানুষ! কাঁদতে কাঁদতে চোখ দুটিও শ্রান্ত। মোহরটার জ্ঞান ফিরলে কী জবাব দিবে ওরা! কী করে বলবে ওর মানিক, ওর কলিজা ছেড়া ধনটাকে তিনহাত মাটির নিচে রেখে এসেছে! বুক চিরে চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে আসে তাথইয়ের, একটা মানুষের জীবন এভাবেও বিভৎস হয়! চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে “ইয়া মা’বুদ এবার তো রহম করো, একটু সহায় হও মানুষ দুটোর প্রতি”
.
.
.
চলমান
#পুনশ্চ : উপরোক্ত ঘটনাগুলোর একটা বিষয় হয়তো অনেকের কাছেই দৃষ্টিকটু লাগবে তা হলো অভিমন্যুর গোরস্তানে প্রবেশ। প্রথমেই আমি বলে দিচ্ছি এই ঘটনার মাধ্যমে আমি শুধু একটা বন্ধন,একে অপরের প্রতি ভালোবাসা,মায়া আর টান বোঝাতে চেয়েছি। রক্তের সম্পর্ক ছাড়াও যে শুভাকাঙ্ক্ষী, সকল পরিস্থিতির সাথী হওয়া যায় তা বুঝিয়েছি। ধর্ম নিয়ে বিদ্বেষমূলক কোনো আচরণ বা কোনো ধর্মকে ছোট করা কখনোই আমার লক্ষ্য নয়। তাই গল্পটাকে গল্প হিসেবেই নিয়ে আমার ভুল ত্রুটি গুলোকে নিজ গুনে মার্জনা করবেন।
ভালোবাসা রইলো ❤️
#Humu_❤️