#ফিরে_আসা
৩০
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে অরা। বিরাট ঝামেলা করে ফেলেছে সে। আরশাদের লাইব্রেরির সকল বই একসঙ্গে বুকশেলফ থেকে মেঝেতে নামিয়ে রেখেছে। অরা প্রথমে ভেবেছিল বিষয়বস্তু অনুযায়ী বইগুলো সাজাবে। এই যেমন সাইন্স ফিকশনের বইগুলো একদিকে, প্রেমের উপন্যাস একদিকে, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বই একদিকে, ইংরেজি বইগুলো একদিকে। কিন্তু সমস্যা হলো, অরা জানে না কোন বইয়ের বিষয়বস্তু কী। বেশির ভাগ বইয়ের মলাটে তার ভেতরকার বিষয়বস্তু লেখা থাকে না।
অরা এখন চিন্তাভাবনা করছে, লেখক অনুযায়ী বইগুলো সাজাবে। প্রত্যেক লেখকের বই আলাদা আলাদা তাকে থাকবে। কিন্তু এখানেও বেঁধেছে বিপত্তি। এই বিশাল ঘরের মেঝে জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে হাজারো বই। একজন লেখকের সবগুলো বই খুঁজে বের করে তা সাজিয়ে রাখতে রাখতেই অনেক সময় লেগে যাবে। তাতে অবশ্য কোনো সমস্যা নেই। হাতে প্রচুর সময় আছে। অলস সময়গুলো পাড় করার কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছে না বলেই অরা এই বইগুলো নিয়ে বসেছে।
কাজের মাঝে হঠাৎ ব্যাঘাত সৃষ্টি করলো ফোনের রিংটোন। এই ভরদুপুরে আবার কে ফোন করলো কে জানে? কাজের জন্যে তাকে সবথেকে বেশি ফোন আরশাদই করে। তবে আজকাল আর তার প্রয়োজন হয় না। এক বাড়িতে থেকে আরশাদ চাইলেই ডেকে পাঠাতে পারে তাকে।
অরা বই ঘাটাঘাটি রেখে সোফায় গিয়ে বসলো। মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে আশফিয়ার নাম। সর্বনাশ করেছে! বিয়ের ওই ঘটনার পর থেকে তার কোনপ্রকার কথা হয়নি আরশাদের আপার সঙ্গে। আশফিয়া নির্ঘাত প্রচন্ড রেগে আছে। অরা মনে মনে প্রস্তুতি নিলো ফোন রিসিভ করতেই প্রচন্ড এক ধমক খাওয়ার।
অরা ফোন রিসিভ করে ভয়ে ভয়ে বলল, “আপা ভালো আছেন?”
অপরপ্রান্ত থেকে শোনা গেল আশফিয়ার কঠিন গলা। “তুমি আমাকে আপা ডাকবে না, খবরদার ডাকবে না!”
অরা হকচকিয়ে গিয়ে বলল, “কেন আপা?”
“কারণ মন থেকে আমাকে বোন বলে মনে করো না। এত বড় একটা কান্ড ঘটিয়ে ফেললে অথচ আমি কিছুই জানলাম না?”
অরা জানত এমন কিছুই হতে যাচ্ছে। অরা ভেবে পায় না, বিয়ের মতো এত গুরুত্বপূর্ণ একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আরশাদ কী করে পারলো মা এবং আপার অনুমতি না নিয়ে। বিয়েটার কোনো ভিত্তি না হয় তার কাছে নেই, কিন্তু মানুষের কাছে তো আছে। মানুষ তো সত্যিকারের বিয়ে ভেবেই বসে আছে।
অরা ইতস্তত করে বলল, “আপা আসলে…”
আশফিয়া গম্ভীর গলায় বলল, “থাক! কিছু বলতে হবে না তোমাকে। আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি! আমার আপন ভাইয়ের বিয়ের খবর না-কি আমাকে নিউজ থেকে জানতে হচ্ছে।”
অরা চুপ করে রইল। মানুষ প্রচন্ড রেগে গেলে তার সঙ্গে কোনপ্রকার কথায় না যাওয়াই উত্তম। এতবছর আরশাদের রাগের সঙ্গে যুদ্ধ করে অন্তত এতটুকু অরা শিখেছে।
আশফিয়া আবারও থমথমে গলায় বলল, “আরশাদ না হয় আস্ত একটা বেয়াদব। আমাকে জানানোর কোনো প্রয়োজন মনে করেনি। কিন্তু তুমি কি করলে অরা? তুমি একটাবার আমাকে জানাতে পারলে না? তোমার কাছ থেকে অন্তত এতটুকু তো আশা করা যায়।”
অরা অনুতপ্ত সরে বলল, “সরি আপা, আমার ভুল হয়ে গেছে।”
“হয়েছে, হয়েছে। আর সরি বলে কী হবে? তুমি এখন কোথায়? আরশাদের বাড়িতে?”
“জি।”
“আরশাদ কোনো খারাপ ব্যবহার করছে না তো?”
“জি না আপা। স্যা…”
কথাটা শেষ করতে গিয়েও করলো না অরা। এমনিতেই আশফিয়া এতটা রেগে আছে। তার ওপরে অরার মুখে ‘স্যার’ শব্দটা শুনে সেই রাগের তীব্রতা না জানি কতটা বেড়ে যায়।
“কোনো খারাপ ব্যবহার করবেন কেন?”
“করলে বলবে। ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত ধুয়ে ফেলবো ওকে।”
সুপারস্টার আরশাদ হক, যার রাগে পুরো ইন্ডাস্ট্রি কেঁপে ওঠে তাকে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত ধুয়ে ফেলার কথা বলছে আশফিয়া। বড় বোনেরা এমনই হয়। ভাইদের প্রতি তাদের ভালোবাসা ও রাগ – এই দুটোই প্রকাশের কোনো সীমারেখা থাকে না।
আশফিয়া কণ্ঠস্বরে রাগের সেই রেশটা রেখেই বলল, “আমি আরশাদকে বলেছি, তোমাকে যেন কোনোদিন কোনো কষ্ট না দেয়। ও আমাকে কথা দিয়েছে। যদি কথার বরখেলাপ করে আমাকে জানাবে।”
“জি আপা।”
“আর শোনো অরা, আমি দেশে ফিরছি।”
অরা অবাক গলায় বলল, “তাই না-কি? কবে?”
“সেটা বলতে পারছি না, কিন্তু কাজ শেষ করে যত দ্রুত সম্ভব ফেরার চেষ্টা করবো। তারপর আমি আর মা বড় করে তোমাদের নিয়ে আমাদের সিলেটের বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান করবো।”
অরা চিন্তিত গলায় বলল, “কিন্তু আপা স্যার… মানে উনি তো রাজি হবেন না।”
আশফিয়া তেজী গলায় বলল, “কোন ভালো জিনিসে রাজি হয় তোমার উনি? আরশাদ যদি আসতে না চায়, না আসবে। ওকে কোনো দরকার নেই আমাদের। তুমি আসলেই হবে। তুমি আসবে, মা তার নতুন বৌকে বরণ করে ঘরে তুলে নেবে। আত্মীয়-স্বজনরা তোমাকে দেখবে।”
অরা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “আচ্ছা, ঠিক আছে।”
অরা বেশ বুঝতে পারছে আরশাদের বিয়ে নিয়ে তার মা এবং আপা আনন্দে আত্নহারা। তারা তো ধারণা করে রেখেছিল আরশাদ এ জীবনে আর কোনোদিন বিয়েই করবে না। তাদের সেই ধারণা ভুল প্রমাণ করে আরশাদ যে শেষমেশ বিয়ে করেছে, এতেই তারা খুশি। তবে অরা ভয়ে আছে এই বিয়ের সত্যতা জানার পর তাদের প্রতিক্রিয়া কী হবে।
অরার মনে হচ্ছে বিরাট বড় ভুল হয়ে গেছে। এই দুজনের কাছ থেকে সত্য গোপন করা উচিত হয়নি। তারা দুজনে যে পরিস্থিতির চাপে পড়ে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে এই সত্যিটা জানিয়ে দিলেই ভালো হতো।
“অরা শোনো?”
“জি আপা?”
“আমার ভাইটাকে দেখে রাখবে।”
আশফিয়ার কণ্ঠস্বর ক্রমেই নরম হতে শুরু করেছে। আগের সেই রাগটা আর লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
আশফিয়া নরম সুরেই বলল, “তুমি তো জানোই আরশাদ কেমন পাগল। রেগে গেলে পৃথিবীর কোনো কিছু তোয়াক্কা করে না। তবে কী জানো তো, ওর মনটা অনেক বড়। তোমাকে সারাজীবন ভালো রাখবে। আরশাদকে যে কথা বলেছি, তোমাকেও বললাম। ওকে কোনোদিন কষ্ট দেবে না। ছেলেটা এই জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছে।”
বিচিত্র এক হওয়া বয়ে গেল অরার গা বেয়ে।
এ জীবনে প্রতিটা পদে পদে আরশাদ কতটা কষ্ট পেয়েছে খুব ভালো করেই জানে অরা। এও জানে, একটা নতুন জীবন আরশাদের জন্যে কতটা প্রয়োজনীয়। সে জীবনে কোনো আক্ষেপ থাকবে না, কষ্ট থাকবে না। সমাজ আশা করছে সেই নতুন জীবনটা একমাত্র অরাই দিতে পারবে তাকে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, তা কী কোনোদিন সম্ভব?
অরা আবারও বসলো বই নিয়ে। কিন্তু মনোযোগ কিছুতেই ফেরাতে পারছে না। তার মস্তিষ্ক ওই একটা কথাতেই আটকে আছে, “ওকে কোনোদিন কষ্ট দেবে না। ছেলেটা এই জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছে।” অরা কে আরশাদকে কষ্ট দেওয়ার? বা কষ্ট না দেওয়ার? কেউ না। সে তো কেবলই আরশাদের ম্যানেজার। যাকে সে পরিস্থিতির চাপে পড়ে এক বছরের জন্যে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে। এই সহজ সত্যিটা তো সহজভাবেই গ্রহণ করেছে। বরং সে তো চায়, যত দ্রুত সম্ভব এই বিয়ে থেকে বেরিয়ে আসতে।
তবুও কেন অরার হৃদয়ের ছোট্ট একটা অংশ চাইছে আরশাদকে ওই নতুন জীবনটা দিতে? অরা মনে মনে চিৎকার করে বলল, “আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি!” এই বিয়েটা পর থেকে তার চিন্তা-চেতনা স্বাভাবিক পর্যায়ে নেই। তার চিন্তার জগতের প্রায় সবটা জুড়ে আজকাল কেবল আরশাদেরই বিচরণ। এমনটা হওয়ার কোনো কারণ তো নেই। সে তো দেশের অসংখ্য মেয়ের মতো আরশাদের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে না। তাহলে কেন হচ্ছে এমনটা?
“এসব কী অরা?”
আরশাদের কণ্ঠস্বর কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই আঁতকে উঠলো অরা। আঁতকে ওঠার কোনো কারণ তো নেই। এটা আরশাদের বাড়ি, আরশাদের লাইব্রেরী। তার যখন যেখানে খুশি ঘুরে বেড়াতে পারে। আরশাদ নিয়ে চিন্তায় এতটাই মগ্ন হয়ে পড়েছিল অরা যে আচমকা চোখের সামনে তাকে দেখে রীতিমত চমকে উঠেছে। মনে মনে আবারও বলল অরা, “আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি!”
আরশাদ মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা বইগুলোর দিকে তাকিয়ে অবাক গলায় বলল, “বইগুলো সব নামিয়েছ কেন?”
শুকনো ঢোক গিললো অরা। বিশাল ভুল হয়ে গেছে। লাইব্রেরীর বইগুলো গোছাতে আসার আগে একবার আরশাদের অনুমতি নিলে ভালো হতো। বইগুলো নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে দেখে এবার নির্ঘাত রেগে যাবে আরশাদ।
অরা কম্পিত স্বরে বলল, “স্যার… বুকশেলফে বইগুলো এলোমেলো হয়ে পড়ে ছিল। ভাবলাম গুছিয়ে রাখি।”
আরশাদ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল অরার দিকে। মেয়েটার দুচোখে বিচিত্র ভয় খেলা করে বেড়াচ্ছে। হাত-পা রীতিমত কাঁপছে।
আরশাদ ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসির রেখা নিয়ে বলল, “তুমি আমাকে খুব ভয় পাও না?”
অরা চুপ করে রইল। ভয় যে পায় এতে কোনো সন্দেহ নেই।
বইগুলো দিকে তাকিয়ে আরশাদ বলল, “ভয় পাওয়া ভালো। আমি চাই টিমের সবাই যেন আমাকে ভয় পায়।”
“সরি স্যার।”
আরশাদ বিরক্ত গলায় বলল, “কথায় কথায় সরি বলার অভ্যাসটা বাদ দাও।”
“জি স্যার।”
“ভালোই হয়েছে। বইগুলো এতদিন অযত্নে পড়ে ছিল। তোমার বই পড়ার শখ আছে না-কি?”
“জি স্যার। আমি তো রোজ সন্ধ্যায় বই নিয়ে এখানে বসে থাকি।”
“Very good. তাহলে বইগুলোর যত্নের দায়িত্বও এখন থেকে তোমার। আমি তো পড়া ছেড়ে দিয়েছি। তবুও এই লাইব্রেরিটা রেখে দিয়েছি কথার জন্য।”
অরা ভয়ে ভয়ে বলল, “আবার পড়া শুরু করলেই তো পারেন স্যার।”
আরশাদ ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “সময় কোথায়?”
অরা চুপ করে রইল।
আরশাদ আবারও বলল, “তোমাকে আজ একটা কাজ করতে হবে অরা।”
“কী কাজ স্যার?”
“একটু পর সারাবেলা থেকে একজন সিনিয়র সাংবাদিক আসবে আমার ইন্টারভিউ নিতে। সে যাতে বুঝতে পারে বাড়িতে তুমিও আছ। বেশি কিছু করতে হবে না। ইন্টারভিউ চলাকালীন তার সামনে দিয়ে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যাবে। কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেবে।”
অরা বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে কেন এই কাজটা আরশাদ করতে বলল তাকে। সাংবাদিক বাড়িতে এসে অরাকে দেখতে না পারলে নতুন করে আবার কথা উঠবে। প্রশ্ন উঠতে পারে, নতুন বিয়ের পরও কেন একসঙ্গে থাকছে না আরশাদ এবং অরা? তাহলে কি সত্যিই ভিডিও ভাইরাল হবার পর চাপে পরে বিয়ে করেছে তারা? সত্যিটা কিছুতেই জানতে দেওয়া যাবে না কাউকে। তাই তো গুজবমুক্ত থাকার জন্যে আরশাদ সাংবাদিকের সামনে যেতে বলল অরাকে। ছেলেটার বুদ্ধি আছে! শুধু শুধু তো আর দেশের এতবড় সুপারস্টার নয়।
বসার ঘরের সোফায় গম্ভীর ভঙ্গিতে বসে আছে আরশাদ। তার হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। সিগারেটে লম্বা এক টান দিয়ে বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকালো তার মুখোমুখি বসে থাকা মানুষটার দিকে। আফজাল রহমান সারাবেলা পত্রিকার সিনিয়র সাংবাদিক। সেই তখন থেকে লোকটা ডায়রির পাতা উল্টেই যাচ্ছে। আরশাদকে কোন কোন প্রশ্ন করবে তা আগে থেকে ঠিক করে নিচ্ছে হয়তো।
সাধারণত কেবল সিনেমা মুক্তি আগেভাগেই পত্র-পত্রিকায় ইন্টারভিউ দেয় আরশাদ। সাংবাদিকদের মুখোমুখি হওয়াটা তার জন্যে স্বাচ্ছন্দের কোনো বিষয় নয়। তবে আজকের এই ইন্টারভিউতে রাজি হওয়ার পেছনের যুক্তি হলো, কাজ নিয়ে কথা বলা। ভিডিও ভাইরাল ও বিয়ের পর মিডিয়ার সামনে আসেনি আরশাদ। দর্শক এখনো ওই দুটো ঘটনা ভুলতে পারছে না। এখনো মানুষ নিজ দায়িত্বে বিয়ে নিয়ে নিজেদের মত প্রকাশ করছে। আরশাদ চায় না দর্শক তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে মেতে থাকুক। দর্শক তাকে কাজের মাধ্যমে চিনেছে, কাজের মাধ্যমেই ভালোবেসেছে। দর্শকের সকল আকর্ষণ নিজের কাজের দিকে ফিরিয়ে নিতেই আরশাদ আজকের ইন্টারভিউতে কাজটাকে বেশি প্রাধান্য দেবে।
আফজাল মোবাইল ফোনের ভয়েস রেকর্ডার অন করে টেবিলের ওপর রাখতে রাখতে বলল, “শুরু করি আরশাদ ভাই?”
আরশাদ ছোট্ট করে বলল, “হুঁ।”
“কেমন আছেন আরশাদ ভাই?”
“এই তো। আপনি?”
আফজাল অতি উৎসাহ নিয়ে বলল, “আমি তো আগে থেকেই দারুণ ছিলাম। আপনাকে দেখে আরও ভালো হয়ে গেলাম। কতদিন পর দেখা বলেন তো!”
“অনেকদিন তো হলো। শেষবার দেখা হয়েছিল আপনাদের অফিসে।”
“মনে আছে দেখছি!”
আরশাদের স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত প্রখর। এই স্মৃতিশক্তি কাজের ক্ষেত্রে তাকে অনেকটা সহায়তা করে। অন্যান্য অভিনেতাদের যেখানে সংলাপ মুখস্ত করতে করতে হিমশিম খেতে হয়, সেখানে স্ক্রিপের পাতায় একবার চোখ বোলালেই দীর্ঘ সময়ের জন্যে সংলাপগুলো মনে থাকে তার। অবশ্য এই স্মৃতিশক্তির জন্যে কম ঝামেলা পোহাতে হয়নি তাকে। কিছু কিছু যন্ত্রণাদায়ক স্মৃতি থাকে, যা মানুষ চিরকালের জন্যে ভুলে যেতে চায়। তবে আরশাদ ভুলতে পারে না। মনে হয় যেন ওই ভয়ঙ্কর স্মৃতিগুলো তার মস্তিষ্কে পাকাপোক্তভাবে গেঁথে আছে।
আফজাল হাসি মুখে বলল, “বিয়ের জন্য আপনাকে অনেক অনেক অভিনন্দন আরশাদ ভাই। আপনার নতুন এই জীবন অনেক অনেক ভালো কাটুক।”
আরশাদ প্রতিউত্তরে কিছু বলল না। মুখভঙ্গি যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে সে।
“তো আরশাদ ভাই? বিয়ের পর জীবন কেমন কাটছে?”
আরশাদ গলার স্বর যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে বলল, “পার্সোনাল লাইফ নিয়ে প্রশ্ন করতেই হবে?”
“একেবারেই না। ইন ফ্যাক্ট, আমরা তো আপনার বিয়ে নিয়ে খুব একটা নিউজও করিনি। অন্যান্য পত্রিকা যেখানে সাত-আটটা করে নিউজ করেছে, সেখানে আমরা মাত্র একটা। তাও আবার আপনার বিয়ের পরদিন নিউজ করেছি। শুধুমাত্র একটা কারণে, আপনি পার্সোনাল লাইফ নিয়ে বাড়াবাড়ি পছন্দ করেন না।”
মনে মনে বিরক্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলল আরশাদ। সাংবাদিকদের এই এক বাজে স্বভাব। নিজেদের পত্রিকার গুণগান করা। আরশাদ অপেক্ষা করছে কখন এই গুণগান পর্ব শেষ হলে সে সিনেমার আলাপটা শুরু করতে পারবে।
আফজালের কথার মাঝে হঠাৎ আরশাদের নির্দেশ অনুযায়ী অরা দোতলা থেকে নিচতলায় নেমে এলো।
অরাকে দেখেই আফজাল তার কথা থামিয়ে উৎফুল্ল গলায় বলল, “আরে ভাবী! কেমন আছেন?”
আফজালের মুখে ‘ভাবী’ ডাকটা শুনেই অরার
সমস্ত শরীর আসাড় হয়ে এল। এই ডাকে কেউ কোনোদিন ডাকেনি। ডাকবার কথাও না। পৃথিবী অরাকে আরশাদের স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে, এই ব্যাপারটা মোটেও হজম করা যাচ্ছে না। অথচ কেউই জানে না, সবটাই তাদের অভিনয়। এক বছরের সংসার সংসার খেলা শেষে দুজন চলে যাবে আলাদা রাস্তায়। অরা চায় না কেউ তাকে আরশাদের স্ত্রী ভেবে বাড়তি সম্মান করুক। সে তো কেবলমাত্র আরশাদের ম্যানেজার।
(চলবে)
[প্রেম ব্যাপারটা কি একদিনেই হয়? না মানে, আমি কখনো প্রেম করি নাই, কিন্তু আমার ধারণা একটা মানুষের প্রেমে পড়তে অনেক সময় লাগে। মাত্র বিয়েটা দিলাম। এখন মানুষের অভিযোগ আরশাদ এবং অরা প্রেমে পড়ে না কেন? গল্প একঘেঁয়ে হয়ে যাচ্ছে। আমাদের তো ট্রেন ধরার তাড়া নাই। গল্প আস্তে ধীরে আগাক। আমি চাই প্রেমে পড়ার আগে তারা একে অপরের ভালো বন্ধু হোক। সেই সময়টুকু অন্তত তাদের দিই।]