#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১৯
মাগরিবের নামাজ শেষে মীরা হলুদ রঙের জামদানী শাড়ি পড়ে বিছানায় বসেছে। মীরার বড়ো ভাবি মীরার চুড়ি ও ফুলের গহনাগুলো এনে রাখে। রাইমাও ও-কে সাজানো শুরুই করেছে তখন হুট করে জিনিয়া একটা মাঝারি আকৃতির বোলে উষ্ণ গরমপানি নিয়ে হাজির। মীরা ও রাইমার প্রশ্নাত্মক দৃষ্টি জিনিয়ার দিকে। ওদেরকে আরও এক ধাপ অবাক করে দিয়ে জিনিয়া পানির বোল নিয়ে মীরার পায়ের কাছে মেঝেতে বসে পড়লো। অতঃপর মীরার পা ধরে পানিতে রাখলো। তৎক্ষণাৎ মীরা হকচকিয়ে পা সরিয়ে নিতে চাইলে জিনিয়া বলে,
“আরে আরে পা সরাচ্ছিস কেন? আমি পেডিকিউর করব তো!”
“হ্যাঁ?”
“হ্যাঁ রে হ্যাঁ। পানিতে শ্যাম্পু, লবন ও লেবুর রস দিয়ে এনেছি। এখনও মিক্স করিনি। সরি! ওয়েট মিক্স করে নিই।”
জিনিয়া পানিতে হাত ডুবিয়ে ফেনা তৈরি করে বলে,
“১০ মিনিট এভাবে বসে থাক। তারপর বাকি প্রসিডিউর করব।”
মীরা ক্লান্ত স্বরে বলে,
“এখন পা ডুবিয়েই রাখতে হবে?”
“হ্যাঁ হবে। তুই তো বসেই আছিস। রাইমা তোর মেইকআপ করে দিতে দিতে আমার কাজও শেষ হয়ে যাবে।”
রাইমা বলে,
“ঠিক বলেছ, জিনিয়া। বসেই থাকবি তো ও যা করতে বলছে কর। তারপর তোর সাজ হয়ে গেলে আমাদের জন্য বসে থাকবি।”
“আচ্ছা কর।”
জিনিয়া এবার উঠে গিয়ে নিজের মুখের মেইকআপ করতে বসে। আর বলে,
“মানুষের পা অনেক সেনসিটিভ। পায়ের বিভিন্ন স্থানে ম্যাসাজ করলে ব*ডির আদারস অর্গান সুস্থ থাকে। তাছাড়া তুই যতোই বলিস যে পার্লারে যাবি না বলে কিছু কম স্ট্রেস হবে। তা কিন্তু হবে না। ভাই, আমি তো বিয়ে করেছি। বসে থাকতে থাকতে কোমড় আর কোমড় থাকে না। তারউপর আনকম্ফর্টেবল শাড়ি-জুয়েলারি। সাউন্ডস প্রবলেম তো আছেই! তোর খালি মনে হবে, ‘আমি কখন এসব থেকে মুক্তি পাব আর ঘুমাব!’ তাই পেডিকিউরের মধ্যে হালকা একটু ম্যাসাজ থাকলে না, কিছুটা রিলিফ লাগে। এটা অবশ্য উচিত ফাংশনের পর করা। পার্লারেও কিন্তু এটা প্রবাইড করে।”
(পেডিকিউর পায়ের সৌন্দর্যের জন্য করা হলেও ম্যাসাজিংটা ইফেক্টিভ।)
মীরা জিনিয়াকে কাছে ডেকে মাথায় একটা চু*মু এঁকে দিয়ে বলে,
“ইউ আর সো কেয়ারিং। অ্যাই লাভ ইউ, জিনু!”
“লাভ ইউ টু, মীরু! এখন চুপচাপ বসে থাক। ভাবি, তোর জন্য ফ্রেশ ম্যাংগো জুস আনছেন।”
রাইমা হাঁক ছেড়ে বলে ওঠে,
“ভাবি, আমার জন্যও প্লিজ।”
নিধি আম কা*টতে কা*টতে প্রত্যুত্তর করে,
“আচ্ছা। সবার জন্যই আনব। ওদিকে হলুদের টেবিল সাজানোর সব কম্পিলিট হয়েছে কী-না তাও দেখতে হবে।”
রাইমা মুচকি হেসে বলে,
“এই ফার্স্ট আমি মুসলিম বাংলাদেশি বিয়ে এটেন্ড করছি। কুঞ্জকে বলেছি সব যেন ক্যামারেয়াতে কভার করে। বেচারা, হয়তো দৌড়াদৌড়ির উপরই আছে!”
“আরে করতে দাও। ছেলেদের কাজই এসব করা। এখন থেকে ট্রাই করলে ফিউচারেও তোমার সব কথা মানবে।”
মীরা বলে ওঠে,
“এই জিনু, থাম ভাই! তুই রাইকে চিনিস না! কুঞ্জদাকে ও যেভাবে নাকে দম করে রাখে! নেহাত কুঞ্জদা বলেই ও-কে মেনে চলছে। তুই আর ও-কে এসব করতে ইনকারেজ করিস না।”
জিনিয়া ভাব নিয়ে বলে,
“কতো দরদ উতলে উঠছে তোর, মীরু! শোন, এদের বশে রাখতে হলে একটু ডমিনেটিং হতেই হয়। তাছাড়া ভালোও তো বাসি। কেয়ারও করি। তুইও আস্তে আস্তে শিখেই যাবি।”
জিনিয়া ও রাইমা হেসে ওঠে একে অপরের সাথে হাতে তালি দেয়। মীরা মাথায় হাত দিয়ে হালকা হেসে নিরব থাকে। অতঃপর তার সাজ চলতে থাকে।
________
শেহজাদদের বাড়িতে হলুদের কোনো ফাংশন কিছু হচ্ছে না। মূলত শেহজাদের এসব পছন্দ না। ফ্রিশা জানতে পারলে জেদ করতে পারে ভেবে শেহজাদ নিষেধ করেছে যেন ফ্রিশাকে এই বিষয়ে না জানানো হয়। মিসেস শাহিদাও মেনে নেন। কারণ, এতসব কিছু দেখাশোনা করার জন্যও তো মানুষ লাগে। ড: আকবর রেহমানের ছোটো ভাই ও বোন কেউই দেশে থাকেন না। উনারা কানাডা, অস্ট্রেলিয়াতে সেটেল।
শেহজাদ নিজের রুমে বসে বসে ল্যাপটপে আর্টিকেল দেখছে। হুট করে ফ্রিশা এক বাটি হলুদ নিয়ে এসে শেহজাদের গালে লাগিয়ে দেয়। হকচকিয়ে উঠে শেহজাদ। বাবাকে এতো আশ্চর্য হতে দেখে ফ্রিশা খিলখিল করে হেসে ওঠে। সে বলে,
“আজ তো হলুদ লাগাতে হয়, বাবা। তাই আমিই তোমাকে লাগিয়ে দিলাম।”
শেহজাদ কিছুক্ষণ মেয়ের পানে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে ভ্রুকুঞ্চন করে শুধায়,
“তোমাকে এসব কে বলেছে?”
“ফেইরিমাম্মামের ফ্রেন্ড বলেছে।”
“কখন?”
“একটু আগে আমি দাদুমনিকে বললাম ফেইরিমাম্মামকে কল করতে। তখন কলটা ফেইরিমাম্মামের ফ্রেন্ড রিসিভ করে। জানো বাবা, সেখানে অনেক সাউন্ড হচ্ছিলো। তখন বলেছে আজ নাকি হলুদ লাগায়। আমাকে তো ফেইরিমাম্মামের ছবিও দেখিয়েছে। সি লুকস সো প্রিটি। লাইক অ্যা রিয়েল ফ্লাওয়ার ফেইরি। তোমারও তো হলুদ লাগাতে হবে। তাই আমিও দাদুমনিকে বলে আন্টিকে (সার্ভেন্ট) দিয়ে হলুদ আনিয়েছি।”
শেহজাদ হালকা হেসে মেয়েকে নিজের কাছে এনে কোলে বসিয়ে বলে,
“ওহ আচ্ছা। শোনো মাম্মাম, হলুদ লাগানো মেন্ডেটরি না। যার যার চয়েজ। ইয়েস, ইট হ্যাজ মেডিসিনাল ভেলু এন্ড ইট ইজ সো ইফেক্টিভ।”
ফ্রিশা কৌতুহলী হয়ে শুধায়,
“তাহলে তুমি কেন লাগাতে চাও না, বাবা?”
শেহজাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে জবাব দেয়,
“এমনিই। অ্যাই ডোন্ট লাইক ইট। তুমি এখন যাও, ঘুমিয়ে পড়ো। রাত দশটার বেশি বাজে।”
ফ্রিশা মুখ ভার করে হলুদের বাটি নিয়ে চলে আসে। মিসেস শাহিদা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সবটাই শুনলেন। শেহজাদ গায়ে হলুদ এসব পছন্দ করে না, তারও একটা কারণ আছে। সে এটা চাইলেও ভুলতে পারে না।
এদিকে সন্ধ্যা আটটা থেকে টানা বসে থাকতে থাকতে মীরার প্রচণ্ড ক্লান্ত। ফুলের সাজে তাকে ফ্রিশার সম্বোধিত ফেইরির মতোই লাগছে। মীরার কলিগরাও কিছুক্ষণ আগেই হলুদ লাগানোর পর খাওয়া-দাওয়া করে বিদায় নিয়ে চলে গেছে। এখন মেহেদী আর্টিস্ট ওর এক হাতে মেহেদী পড়াচ্ছে। এদিকে ফটোগ্রাফারের যেন সব ক্যাপচার করতে হবে! মুখ থেকে হাসি সরানোই যাবে না। মীরা তার বড়ো ভাবিকে ডেকে বলে,
“ভাবি, আমি এখান থেকে উঠতে চাই। ইমরান, জায়েদদের বলো গান এসব বন্ধ করাতে।”
মীরার খালাতো বোন জান্নাত এসে বলে,
“কী বলো, আপু? মাত্রই সবাই হলুদ দিয়ে শেষ করলো। এখন মেহেদী পড়ানোর ফাংশন হচ্ছে তো।”
“কর তোরা। আমি রুমে যাব। আমার ব্যাকপেইন প্রবলেম আছে।”
মেহেদী আর্টিস্ট বলে,
“আপু, মেহেদীটা পড়ানো পর্যন্ত একটু অপেক্ষা করুন। দুইজন মিলে দুহাতে মেহেদী পড়ানো শেষে আপনাকে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিব।”
মীরা ক্লান্ত দৃষ্টিতে নিজের হাতের দিকে চেয়ে বলে,
“আরেকজনকে ডাকুন। আর জলদি করুন, প্লিজ।”
মেহেদী আর্টিস্ট তার সাথে আসা আরও দুইজন আর্টিস্টদের মধ্যে আরেকজন আর্টিস্টকে ডেকে আনেন। অতঃপর যত দ্রুত সম্ভব কাজ করতে থাকেন।
_________
রাত প্রায় বারোটার কাছাকাছি সময়ে মীরা বাড়ির ছাদের স্টেজ থেকে উঠে নিজের রুমে আসতে পেরেছে। দুই হাত ভর্তি তার মেহেদী। কোনো রকমে বিছানার সাথে বালিশে হেলান দিয়ে বসে হাত উঁচু করে রাখে। হাতের উপরের পৃষ্টের মেহেদী এখনও ভেজা। রাইমা, জিনিয়া, নিধি, শারমিন, জান্নাত, মীরার মামাতো বোন, ভাবি, চাচাতো বোনদের সবারই দুই হাতের চার পৃষ্টের মধ্যে দুই দুই করে মেহেদী পড়া শেষ। মেহেদী আর্টিস্ট তিন জন ছাড়াও ভাবি ও কাজিনরা নিজেরা নিজেরাও মেহেদী পড়েছে।
কিন্তু ওদের মধ্যে ক্লান্তি ভাবটা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। তখনি মিসেস মলি জাহান এক গ্লাস কুসুম গরম দুধ এনে মীরাকে বলে,
“নে এটা খেয়ে নে। ক্লান্তি কম লাগবে।”
মীরা অসহায় চোখে চেয়ে বলে,
“আমি ফ্রেশ হতে পারলে আমার ক্লান্তি কম লাগবে। কিন্তু মেহেদী না শুকানো অবধি পারছি না।”
“শুকিয়ে যাবে। তুই আগে গ্লাসের দুধটুকু খা। তারপর তোকে আমি খিচুড়িও খা*ইয়ে দিব।”
“মা! আবার খাবারও! আমি খাব না।”
মলি জাহান মৃদু ধ*মকে উঠলেন। তিনি বললেন,
“চু*প! খাবিনা মানে কি! খেতে হবে। খিচুড়ি রান্নাটা দেরি করে হয়েছে বলে স্টেজে বসার আগে খাওয়াতে পারিনি। এখন চুপচাপ খেয়ে নিবি নয়তো তোর বাবাকে বলব। গ্লাসটা ধর।”
মিসেস মলি জাহান, মীরার হাতে দুধের গ্লাসটা ধরিয়ে দিয়ে খাবার আনতে গেলেন। মীরার মা যেতেই রাইমা দুষ্টুমি করে বলে,
“তোকে এনার্জি গেইন করতে হবে, বেবি! নয়তো কালকে এনার্জি পাবিনা তো!”
রাইমার কথা শুনে রুমে থাকা মীরার ভাবিরা, কাজিনরা ও বান্ধবী সবাই হেসে ওঠে। জিনিয়া আবার আরেকধাপ এগিয়ে বলে,
“স্যারকে ফোন করব? না মানে তোর হাতের মেহেদী দেখাতে। আমার বিয়ের সময় তো…”
মীরা রাগ দেখিয়ে জিনিয়াকে থামিয়ে জিনিয়াকে নিজের কাছ থেকে ধা*ক্কা দিয়ে বলে,
“চু*প! বেশ*রমের দল। আর একটা এমন টাইপের কথা বললে রুম থেকে বের করে দিব।”
“আচ্ছা যা বললাম না। তবে কাল রাতে কিছু লাগলে আমাদের নির্দ্বিধায় কল করতে পারিস। মানে এডভাইস আরকি! যতোই হোক, স্যারের বাসায় তো আমরা তোর সাথে যেতে পারব না।”
“থাম না প্লিজ। আম্মু আসবে এখনি।”
“ওকে। বাট কল কিন্তু…”
মীরা এবার চোখ রাঙালে জিনিয়া থেমে গেলেও রুমে থাকা সবার মাঝে যেন হাসি একপ্রকার ম*হামা*রির মতো ছড়িয়ে পড়ে।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
মীরা ও শেহজাদের বিয়েতে সবাইকে দাওয়াত রইল। গিফট ছাড়া নো এন্ট্রি! ভুল ত্রুটি থাকলে ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।