মুঠোভরা_চোরাবালি #আলিশা_আঞ্জুম #পর্ব_২০

0
401

#মুঠোভরা_চোরাবালি
#আলিশা_আঞ্জুম
#পর্ব_২০

মেঘলা আকাশ। ব্যস্ত সরক, দুঃখী মন৷ এদের সংমিশ্রণে ফাইজা নীরবতা নিয়ে তাসরিফের সাথে বসে আছে রিকশায়। তাসরিফ উদাশ ভঙ্গিতে তাকিয়ে সম্মুখ পথে। দুপুরের খাবার শেষে ফাইজাকে নিয়ে তার বিশেষ কোথাও যাওয়ার তাড়া। ফাইজা এখন পর্যন্ত একবারও জিজ্ঞেস করেনি কোথায় যাচ্ছে তারা।

— ফাইজা? আমি যে আরেকটা বিয়ে করবো এইভাবনাটা তোমার মনে এলো কিভাবে?

ফাইজা টনক নড়িয়ে আলতো স্বরে বলল

— যেভাবে তোমার মাথায় এসেছিল আমাকে অবহেলার নাটক করে দূরে ঠেলে দেয়ার।

তাসরিফ নিশ্চুপ হলো। এরপর আর তার বলার কিছু থাকে না। ফাইজার চোখে মুখে ফুটে উঠলো ক্ষোভ। যেদিন সে স্নিগ্ধার সাথে এক ঘন্টার ফোনালাপে সবকিছু শুনেছে সেদিন সে অবাক হয়ে শুধু চোখের জল ফেলেছে। ভেবেছে মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসাই কি তবে ভুল? যে নারীর দ্বারা তাসরিফ কখনো বাবা হতে পারবে না সে নারীকে এতোটা ভালোবেসেই কি তাসরিফ ভুল করলো? পরিপূর্ণ করে প্রকৃতি কাউকে রাখে না। হয়তো মানুষ খারাপ হয় নয়তো খারাপ হয় নিয়তি। তাসরিফ খারাপ না হলেও নিয়তি খারাপ কিছু করতে চায়।

— ফাইজা, নামো?

ভাবনায় ছেদ পরে ফাইজার। রিকশা গন্তব্যে পৌঁছে গেছে। তাসরিফ দাড়িয়ে আছে পাশে। ফাইজা নেমে পরে রিকশা থেকে। গুটি গুটি পায়ে তারা হেঁটে প্রবেশ করে একটা বাড়ির ভেতরে। ফাইজা ভ্রু কুঁচকে ভেতরে প্রবেশ করার পরই তাসরিফ হঠাৎ চোখের আড়াল হয়। ফাইজা ঈষৎ চমকে এদিক ওদিক নজর ফেরাতেই পিছু ডাক পরে তাসরিফের পক্ষ হতে। ফাইজা ফিরে চায়। চোখজোড়া ভাবশূন্য হয় মুহূর্তকালের জন্য। তাসরিফ মিষ্টি হেসে একবার তাকায় ফাইজার পানে আবার তাকায় তার কোলে। বড্ড হিমশিম খাচ্ছে সে। ছোট এক রাজপুত্র সামলাতে সে বড়ই হিমশিম খাচ্ছে। ফাইজার অবাক প্রহর কাটেনি তখনও। তিনমাসের ছোট বাবুটা কেঁদে উঠলো। তাসরিফ অস্থির হওয়ার পর্বেই অশান্ত হয়ে ছুটে গেলো ফাইজা। কাঁপা হাতে নিজের কাছে টেনে নিলো ছোট বাচ্চাটাকে। নিরব প্রশ্ন নিয়ে তাসরিফের দিকে তাকাতেই তাসরিফ বলে উঠলো

— আমাদের ছেলে। আমাদের নতুন সদস্য।

ফাইজা অবাক হয়। বাকরূদ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে ছোট শিশুর মুখপানে।

.
সেদিন বাচ্চা দত্তক নেওয়ার কার্যবিধি শেষ করে তাসরিফ বাসায় ফেরে ফাইজাকে নিয়ে। ফাইজা আনন্দে আত্মহারা। অনেক ভেবে মা বাবার মতামতের ওপর ভিত্তি করেই তাসরিফ ছেলে ঘরে আনলো। বাড়িতে পৌঁছে দেখে তাসলিমা নতুন করে ঘর পরিপাটি করেছে। ড্রয়িং রুমের ঠিক মাঝ বরাবর ইতিমধ্যে দোলনা লাগানো হয়ে গেছে। ফাইজা বাচ্চাকে কোল থেকে নামিয়ে সেই দোলনাতেই রাখে। সে অনেকখানি অবাক হয়। সকলেই তবে অবগত! তাসলিমা বেশ খানিকটা দ্বিধা মনে পুষে রেখেছে। তিনি মন থেকে মানতে পারছেন না তাসরিফের কাজটা। তবুও নিশ্চুপ। কেবল ছেলের খুশির কাছে। ফাইজা-তাসরিফ আশপাশ যেন ভুলে গেছে। তারা বাবুকে ডাকার জন্য কোনো নাম পায় না। কি বিদঘুটে ব্যাপার। সেদিন রাতেই ফাইজা তাসরিফ কে বলল বাবুর নাম ঠিক করতে হবে। তাসরিফ ফাইজার খুশি দেখে বুকে প্রশান্তি খুঁজে পায়। সে ফাইজার প্রস্তাবে রাজি হয়ে ঠিক করে আকিকা করে বাবুর নাম রাখতে হবে। দ্রুত তবে আকিকার বন্দবস্ত করা হোক।

.
রাতের আঁধার মাখা আকাশ যেন ফাইজার একটু বেশিই প্রিয়। তাসরিফের মতোই প্রিয়। আজ পূর্ণ চাঁদ আকাশে। তার রাজপুত্র কান্নার সুর বুনেছে বলে সে বেলকনিতে দাড়িয়ে তাকে আকাশ দেখায়। তাসরিফ ঘুমে বিভোর। ফাইজা ছেলেকে আকাশ দেখাতে দেখাতে হঠাৎ দেখায় তার মনের কষ্টগুলো। ছেলেকে হঠাৎ অবুঝের মতো বলে

— আকাশের মালিককে বলো তো বাবা, তোমার বাবাকে যেন তিনি সুস্থ করে দেন। আমরা যেন একসাথে অনেক দিন কাটাতে পারি। অনেক জায়গায় ঘুরতে পারি। তোমার বাবা তোমাকে যেন স্কুলে দিয়ে আসতে পারে। তোমার আম্মুর সাথে যেন অনেক অনেক ঝগড়া করতে পারে। বলো বলো?

ছোট বাচ্চা ফাইজার কোল হতে অস্পষ্ট সুরে কেবল ‘হুম, হু, আ’ শব্দ করে যায়। ফাইজা বেলকনির চেয়ারে বসে যায়। ছেলের সাথে খেলতে থাকে। ভাবনায় ভাসে তার তাসরিফ। একটা ছোট পরিবার। ছেলে তো হলো। জীবন কি একটু দীর্ঘ হতে পারে না এবার?

.
ভোর হতে না হতেই পাখির কিচির মিচির শব্দে চোখ মেলে তকাতে বাধ্য স্নিগ্ধা। ঠিক স্বপের মতো বাড়িতে শান রেখেছে। স্বপ্নের মতো করে ঘর সাজিয়ে দিয়েছে। স্নিগ্ধা বেশ সুখে আছে। ঝনঝট হূন জীবন তার। শশুর বাড়ির মানুষ গুলো খুব ভালো না হলেও যথেষ্ট ভালো। শশুর লোকটাই একটু কেমন যেন। বাকিসব একদম ঠিকঠাক। ভাবনার মাঝে স্নিগ্ধা ঝট করে উঠে বসলো বিছানায়। ভোর হতে আরম্ভ করেছে। ফজরের আজান শেষ হয়েছে। এখন যুদ্ধে নামতে হবে তার শানের ঘুমের সাথে। আজকের সকালটা ওপাশে আয়রা শুরু করলো প্রবল উত্তেজনা নিয়ে। তার ভাইয়ের ছেলের আকিকা। তাসরিফের ছেলের আকিকা। একই সকাল শুরু হলো সাফার ব্যাস্ততা নিয়ে। তার শাশুড়ি অসুস্থ। হসপিটাল টু বাড়ি, বাড়ি টু হসপিটালে তার দৌড়ঝাঁপ। গতকাল তাসলিমা প্রথম বারের মতো জামাই বাড়িতে এসে নাতনিকে নিয়ে গেছেন। বেয়াইন কে দেখতে গিয়েছিলেন হসপিটালে। সাফা পালিয়ে বিয়ে করার পর তাসলিমা কখনো মেয়ের শশুর বাড়ি, স্বামীর বাড়ি মুখো হয়নি। সাফা শান্তি পেয়েছে গতকাল। পরিপূর্ণ মনে হয়েছে নিজেকে। অবশেষে মায়ের অভিমান ভেঙে গুড়িয়ে গেছে। পুরোপুরি ভেঙে গেছে। ভাইয়ের সংসারে আলো এসেছে। হোকনা আলোটা ধার করা। ভাবনার মাঝে সাফার ফোন হাঁক ছাড়লো। অয়নের ফোন। সাফা রিসিভ করতেই ওপাশ হতে ভেসে এলো চিন্তিত সুর

— সাফা তুমি কোথায়? আজ আর হসপিটালে আসার দরকার নেই। আমি বাসায় গিয়ে ব্রেকফাস্ট করে নিতে পারবো। তুমি তাসরিফের ওখানে যাও। তাসরিফ মন খারাপ করবে। বাচ্চার আকিকা তুমি একমাত্র ফুপি……

অনেক কথা তাদের। ওদিকে জমজমাট অনুষ্ঠানের সূচনা পর্ব শুরু হয়ে গেছে। তাসরিফ ভীষণ ব্যাস্ত। গ্রামের বাড়িতে সে অনুষ্ঠান করছে। দু’টো গরু জবাই করা হয়েছে শেষ রাতেই। রান্না চলে এখন। দুপুরের পর খাওয়ার পর্ব শুরু হবে। বেলা আটটা বাজতেই হাজির হলো আয়রা। বেলা দশটাতে স্নিগ্ধা ও শান। স্নিগ্ধা আর আয়রার ঠেলাঠেলি শুরু হলো বাচ্চাকে নিয়ে। কে নেবে? আয়রা নাকি বাবুকে সাজিয়ে দেবে। কাপড় পড়িয়ে স্নো, পাউডার লাগিয়ে দেবে। ফাইজা হাসলো ওর কান্ড দেখে। অতঃপর ধীর পায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে সে চলে গেলো তাসরিফের নিকট। তাসরিফ ইয়া বড় বড় চুলোর পাশে দাড়িয়ে সকলের রান্না দেখছিলো। চোখ মুখ রক্তবর্ণ আগুনের তাপে। ফাইজা এগিয়ে যেতেই তাসরিফ সড়ে দাড়ালো। ফাইজা পাশাপাশি গিয়ে দাড়ালো। বলে উঠলো

— এভাবেই যদি জীবন পার হয়ে যায়? এভাবেই আমি তুমি আর ও মিলে দিন পার করবো। দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা সমেত সংসারও আমি করতে পারবো। তবে তুমি হীনা সংসার করা আমার পক্ষে সম্ভব না। তুমি সহ প্রতিদিন নতুন নতুন সকাল চাই। তুমি ছাড়া নতুন সকালের আমার কোনো দরকার নেই।

ফাইজার হঠাৎ বলা কথাগুলো তাসরিফের ভেতরটা কাঁপিয়ে তুলল। কে জানে কি হবে পরবর্তী সকালগুলোতে?

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here