শেষটা_সুন্দর(সিজন-২) #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ১৯।

0
389

#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৯।

‘আমরা কোথায় যাচ্ছি, সারাজ ভাই?’

‘জাহান্নামে।’

গলার স্বরেই বোঝা গেল ভদ্রলোক এখন মাত্রাধিক রেগে আছেন। তাকে আরেকটু রাগানোর জন্য পুতুল বলে উঠল,

‘উঁহু, এখন জাহান্নামে যাওয়া যাবে না। সামনে আমার বিয়ে, বিয়ের পর কোথাও যাওয়ার চিন্তা করব। এর আগে না।’

নিছকই বিদ্রুপ বৈ আর কিছু না। তাও সারাজ এমন ভাবে দৃষ্টিপাত করল, যেন চোখ দিয়েই আজ এই নির্বোধ কন্যার সে প্রাণনাশ করবে। সারাজের এহেন দৃষ্টি বরাবরই পুতুলের মনে ভয় কিংবা দুঃখ সঞ্চার করলেও, আজ হলো তার ব্যতিক্রম। আজ এই অগ্নি দৃষ্টিই ভীষণ প্রসন্ন জাগাচ্ছে তার মনে। কারণ, সে জানে, এই দৃষ্টি নেহাতই সারাজের পরশ্রীকাতরতা। বিয়েতে পুতুলের সম্মতি সে গ্রাহ্য করতে পারছে না। তাই এত হম্বিতম্বি তার।

পুতুল অবজ্ঞার সুরে পুনরায় বলল,

‘দেখো সারাজ ভাই, আমি আমার মতামত জানিয়ে দিয়েছি। আমি বিয়ে করলে ঐ কামাল মিয়াকেই করব। লোকটাকে আমার মারাত্মক লেগেছে। নামের মতো উনিও ভীষণ কিউট।’

পুতুল এমনভাবে হাসল, যেন ঐ ছেলের কথা মনে পড়তেই লজ্জায় অন্তস্থল কম্পিত হচ্ছে তার। সারাজ তার গতি আরো বাড়ার। ভাগ্যিস, গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে। বাইক হলে তো এতক্ষণে পুতুল উড়েই যেত।

‘তোর ঐ পছন্দের মানুষকে কল করে বনানী কাজী অফিসে আসতে বল।’

ভড়কে গেল পুতুল। ড্যাবড্যাব করে চেয়ে বলল,

‘কাকে বলব?’

সারাজ ধমকের সুরে বলল,

‘কালা তুই? কানে শুনিস না? বলেছি, তোর সেই পছন্দের মানুষকে কল করে বল বনানী কাজী অফিসে আসতে। আমি আজই তোদের বিয়ে দিব।’

পুতুল চোখ পিটপিট করে সারাজের দিকে চেয়ে আছে। এই ছেলের হাবভাব মোটের সুবিধার ঠেকছে না। উনার অন্তঃকরণের চিন্তার স্রোত ঠিক কতটা গভীর কে জানে। কী ভাবছেন তিনি এখন? পুতুলকে তার পছন্দের মানুষের সাথে বিয়ে দিতে চাইছেন? এত বোকাচন্দ্র উনি। পুতুল ক্লান্ত ভঙিতে সিটে গা এলিয়ে দিল। সারাজ তাকে একপলক দর্শন করে বলল,

‘কিরে, কিছু বলেছি তো তোকে।’

‘পারব না।’

সারাজের ক্রোধ বিস্তৃত হলো ততক্ষণাৎ। সেই ক্রোধ নিউরন ডিঙিয়ে মাথার মস্তকে গিয়ে বারি খাচ্ছে। মেয়েটা কি তার সাথে ফাজলামো করছে? সব ব্যাপারে এত স্পর্ধা একদম সে সইবে না। সে চোয়াল শক্ত করে বলল,

‘তাহলে তুই কল দিবি না?’

‘উঁহু।’

পুতুল ভেবেছিল, গাড়িটা বোধ হয় এবার ঘুরে যাবে। তাকে নিয়ে আর কাজী অফিসে যাওয়া হবে না। কিন্তু, তাকে চমকে দিয়ে তেমন কিছুই হলো না। গাড়ি চলল নিজ গতিতে। সারাজও প্রত্যহের মতো এবারও নির্লিপ্ত হয়ে বসে থাকে। তার চোখ মুখ যথেষ্ঠ উদাসীন। এই গম্ভীর, অগাধ মুখশ্রী’ই পুতুলের দুশ্চিন্তা বাড়ানোর পথ্য। তাও পুতুল ঠোঁট গুঁজে বসে আছে। দেখা যাক না, শেষ পর্যন্ত লোকটা ঠিক কী করে।

গাড়ি থেমে গেল। সামনে বড়ো সাইনবোর্ডে লেখা, “বনানী কাজী অফিস।” সেই অফিসের প্রারম্ভ স্থানে বেশ কয়েক ছেলে দাঁড়ান। সবার চোখে মুখেই একটা উৎসব উৎসব ভাব। এই ছেলেগুলোকে এখানে আসতে কে বলেছে?

সারাজ পার্ক করে এসেই পুতুলের ডান হাত মুঠোয় ভরে নেয়। চোখ মুখ শীতল, শান্ত তার। পুতুলের মনে এবার সূক্ষ চিন্তার রেশ ফুটে ওঠে। সারাজ ভাই কী করতে চাইছেন?
পুতুলের চিন্তাকে আরো বিস্তৃত করতে সারাজ তাকে নিয়ে কাজী অফিসের ভেতরে প্রবেশ করে। তাদের পেছন পেছন প্রবেশ করে ঐ ছেলেগুলোও। ব্যাপারটা পুতুলের বোধগম্য হচ্ছে না। সে তীক্ষ্ণ চোখে চারদিক পরখ করছে। সারাজ শান্ত সুরে বলল,

‘কল দিয়েছিস?’

পুতুল বীতস্পৃহ। লোকটা বার বার একই কথা কেন বলছেন? সে তার পছন্দের মানুষকে কল দিলে যে কেলেঙ্কারি হবে। এই লোককে এই কথা কে বোঝাবে?
পুতুল বিমুখ অভিব্যক্তি দেখে সারাজ ক্ষেপল এবার। জিজ্ঞেস করল,

‘কী চাস তুই? একসাথে কয় জনের জীবন নষ্ট করতে চাস?’

হতভম্ব পুতুল। সে আবার কার জীবন নষ্ট করতে চায়? সারাজ বিক্ষিপ্ত সুরে বলল,

‘প্রথমে বিয়ে করতে চাসনি; বলেছিস, অন্য কাউকে পছন্দ করিস। আর আজ আবার বলছিস তুই ঐ করিম মিয়াকেই বিয়ে করবি। তাহলে সেদিন তোর পছন্দের কথা কেন বললি? তোর কাছে কি এই সবকিছু ভীষণ ঠুনকো জিনিস? বিয়েটাকে কি ছেলেখেলা মনে হয়?’

পুতুল ঠোঁট কামড়ে অন্যদিকে চাইল। তার অভিসন্ধি সে সারাজকে কোনোভাবেই জানাতে পারবে না। মুখ ফুটে বলতে পারবে না, সেই পছন্দের মানুষটা সারাজ নিজেই। তার এই ছোট্ট বুক এতটাও নির্ভীক নয় যে।

পুতুলের নিস্তব্ধতা সারাজের ক্রোধকে অরো উস্কে দিচ্ছে। হয়তো, এই মুহূর্তে সারাজের অনুলিপ্ত মনও কিছু শুনতে চায়; অন্যরকম কিছু। যা কর্ণে পৌঁছালেই অন্তরের অন্তস্থলে গিয়ে তীরের মতো বিঁধবে। অথচ এই নির্দয় পুতুল কিছুই বলছে না।

‘তাহলে তুই কল দিবি না?’

‘আমি করিম মিয়াকেই বিয়ে করব। উনাকে আমার পছন্দ হয়েছে।’

আরো বেশি চটল সারাজ। এই মেয়ে খালি আহাম্মক না, বিশাল বড়ো মাপের আহাম্মক। অনেক ছাড় দিয়েছে। এখন আর তাকে ছাড় দেওয়া যাবে না। পাখি অন্যের খাঁচায় বাঁধা পড়ার আগেই, তাকে নিজের খাঁচায় আটকাতে হবে।

‘আজকাল তোর চরিত্রে দেখছি বেশ সমস্যা দেখা দিয়েছে। যাকে দেখছিস তাকেই পছন্দ করে ফেলেছিস।’

‘একদম আমার চরিত্র নিয়ে কোনো কথা বলবে না। আমার চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র।’

সারাজ বক্র হাসে। বিদ্রুপের সুরে বলে উঠে,

‘তাই বুঝি? ঠিক আছে, ঐ চেয়ারে গিয়ে বস।’

ভ্রুকুটি করে পুতুল বলল,

‘কেন?’

‘তোর আজ বিয়ে হবে, তাই।’

সারাজের আওয়াজ অকৃত্রিম শোনাল। লোকটা কি সিরিয়াস? মাথা খারাপ হয়েছে? নাকি রাগে পাগল টাগল হয়ে গিয়েছেন?

পুতুল হা করে চেয়ে আছে। তার মধ্যে কোনো হেলদোল না দেখে সারাজ নিজেই তাকে টেনে নিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসাল। সেও বসে পড়ল পাশের চেয়ারটায়। তারপর কাজী সাহেব নামে মধ্যবয়স্ক লোকটির পানে চেয়ে বলল,

‘কাজী সাহেব, আপনি বিয়ে পড়ানো শুরু করুন।’

পুতুলের চোয়াল ঝুলে আছে। কী হচ্ছে এখানে, সব তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। তার উপর সারাজের ব্যবহারও পুতুলকে আরো বেশি দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভোগাচ্ছে। পুতুলের কি আজ এখানে বিয়ে হবে? কার সাথে? তার পাশের চেয়ারে যিনি বসা, তার সাথে? হঠাৎই বুকে মোচড় দেয় তার। তবে কি তার সারাজ ভাই তাকে বিয়ে করতে চলেছেন? সে আঁতকে উঠে বলল,

‘কী করতে চাইছো, সারাজ ভাই।’

সারাজ ঘুরে চাইল তার দিকে। ঠোঁটের কোণে সূক্ষ হাসির রেশ। বিদ্রুপের সুরে বলল,

‘কী করব বল? তুই যা শুরু করেছিস, এছাড়া আর কোনো উপায় আমার কাছে ছিল না। আমি চাই না, ঐ অসহায় ছেলেগুলোর জীবন নষ্ট হোক। তাই তাদের জীবনের বিনিময়ে আমি আমার নিজের জীবন আত্মত্যাগ করছি। ইউ নো, আ’ম ভেরি কাইন্ড। আমার এত বড়ো দয়ার মন, কখনোই তোকে ঐ নিরিহ ছেলেগুলোর সাথে কোনো অন্যায় করতে দিবে না।’

পুতুলের মাথা ঘুরাচ্ছে। লোকটা কী বলছে এসব? সে আবার কার সাথে কী অন্যায় করেছে? উফ, এবার ভীষণ রকম উৎকন্ঠিত সে। উদ্বেগ চোখে মুখে উপচে পড়ছে।
কাজী সাহেব বিয়ে পড়াচ্ছেন। কাবিননামা পড়ে শোনালেন। সাদরাজ আহমেদের একমাত্র ছেলে সারাজ আহমেদের সাথে সতেরো লক্ষ একশ এক টাকা কাবিনের বিনিময়ে বিবাহ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ব্যস, এইটুকু কথা কোর্ণগোচর হওয়া মাত্রই পুতুলের শরীর অসাড় হয়ে এল যেন। আর চোখ খুলে রাখতে পারছে না। মাথার ভেতরে ভনভন করছে। সে কি আদৌ সব ঠিক শুনছে? শরীরটা এমন করছে কেন? ঠিক সেই মুহূর্তে শুনতে পেল, কাজী সাহেব বলে লোকটা আবার বললেন,

‘কবুল বলো, মা।’

আকস্মিক ঘটনাগুলো মস্তিষ্ক ঠিক ভাবে গ্রহণ করতে পারে না। প্রথমেই বিশাল ঝটকা দেয়। সেই ঝটকায় কেউ কেউ মূর্ছা যায়, কেউবা ঘন্টা খানেক স্তব্ধ থাকে। পুতুলের মস্তিষ্কও এই মুহুর্তে তাকে ব্যাপক ঝটকা দিয়ে বসেছে। আর সেও সেই অতর্কিত ঝটকার গতি সামলাতে পারল না। ঘাড়টা কাত করে আলগোছে চোখ বুজে ফেলল।

চলবে…

(দেখলেন, এই পুতুল টা কী মারাত্মক ফাজিল মেয়ে। কই একটা বিয়ে খাব ভেবেছিলাম, তাও আর হলো না🤧)

ছবি: রত্নাবু❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here