শেষটা_সুন্দর(সিজন-২) #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ২০।

0
388

#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২০।

চোখ খোলার প্রারম্ভিক মুহুর্তেই সবকিছু খানিকটা ঝাপসা ঠেকল পুতুলের। বার কয়েকবার চোখ পিটপিট করল তাই। এক পল অতিক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক হলো। এই তো সব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে।

আশেপাশে চোখ বুলাল। এটা তো তার রুম। চট করে উঠে বসল পুতুল। হ্যাঁ, এটা তো তারই রুম। সে এই রুমেই এতক্ষণ শুয়ে ছিল? তবে কাজী অফিসে কখন গিয়েছে? কীভাবে গিয়েছে? আশ্চর্য, তবে কি সে যা দেখেছিল সব স্বপ্ন?

পুতুল ব্যাকুল হয়ে পা বাড়াল রুমের বাইরে। বাইরেও কেউ নেই কেন? মা কোথায়?

‘মা, ও মা। কোথায় তুমি?’

পুতুল গলা ছেড়ে চেঁচাচ্ছে। মেহুল রুম থেকে বেরিয়ে এসে বিরূপ সুরে বলল,

‘কী সমস্যা তোর? সবসময় এভাবে চেঁচাস কেন?’

ভ্রু কুঁচকাল পুতুল। জিজ্ঞেস করল,

‘আমি এখানে কেন, মা? আমি তো সারাজ ভাইয়ের সাথে বাইরে ছিলাম।’

মেহুল ভীষণ রকম বিদ্বিষ্ট। সে ক্ষিপ্ত গলায় বলল,

‘জি, ছিলেন। তারপর হুদাই বেহুঁশ হয়ে গিয়েছিলেন। তাই সারাজ এনে বাসায় রেখে গিয়েছে। আর বলে গিয়েছে, শাক সবজি, ফলমূল ভালো ভাবে গেলাতে। সামান্য মাথা ব্যথায় কেউ বেহুঁশ হয়ে যায়? আর তোর তো এমন মাথা ব্যথার ব্যারাম ছিল না। তাহলে, এই ব্যারাম আবার কবে আমদানি করলি?’

এতক্ষণে পুতুলের বোধদয় হয়। ব্যাপারটা এবার পানির মতো সোজা তার কাছে। কী চতুর লোক উনি। এমন ভাবে গেইম খেললেন, যেন সাপও মরে, আর লাঠিও না ভাঙে। আচ্ছা, তাতে কী? পুতুল ও কোনো ছোটখাটো খেলোয়াড় না।

পুতুল দাঁত বের করে হাসল। তার এই হাসির কোনো যৌক্তিক কারণ মেহুল উদঘাটন করতে পারল না। তাই কপালে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করল,

‘কী সমস্যা, হাসছিস কেন?’

চোখে মুখে মেকি লজ্জা ভাব উন্মীলিত করে সে শুধাল,

‘মা, বাবা কী বলেছেন? বিয়েটা হচ্ছে তো?’

মেহুল নির্বাক। নিমিষ চেয়ে রইল মেয়ের দিকে। তার মুখের অবিব্যক্তি দেখে মনে হচ্ছে, যেন এর থেকে আশ্চর্যজনক প্রশ্ন সে এর আগে জীবনেও শুনেনি। মা’কে অনুসক্ত দেখে পুতুল ফের প্রশ্ন করল,

‘কী হলো, মা? কিছু বলছো না কেন?’

‘তুই কি সত্যিই বিয়েটা করতে চাস?’

সংশয় নিয়ে শুধাল মেহুল। পুতুল ফের লজ্জিতাবস্থার ন্যায় মৃদু সুরে বলল,

‘হ্যাঁ, অবশ্যই। ঐ ছেলেকে আমার পছন্দ হয়েছে?’

‘ঐ রকম হাবা টাইপ একটা ছেলেকে তোর পছন্দ হয়েছে?’

বিস্মিত মেহুল। পুতুল হেসে বলল,

‘হ্যাঁ, পছন্দ। আর খবরদার উনাকে হাবা টাবা কিছু বলবে না। উনি হলেন সহজ সরল মানুষ। আর আমার জীবনে এমন একজন সহজ সরল মানুষের খুব প্রয়োজন। এখন তুমি আর বাবা জলদি জলদি বিয়ের আয়োজনটা করে ফেল। শুভ কাজ ফেলে রেখে লাভ কী, বলো?’

মেহুলকে অথৈয় ভাবনায় ডুবিয়ে পুতুল নেচে নেচে নিজের রুমে প্রবেশ করে। আজ মনে হচ্ছে চিত্ত তার অন্যরকম রঙে রঞ্জিত হয়েছে। আহা, এত সুখ এত আনন্দ কোথায় রাখবে সে? সারাজ ভাই তাকে বিয়ে করতে যাচ্ছিলেন? তার মানে তার ধারণা, তার ভাবনা মিথ্যে নয়। সারাজ ভাইও তাকে পছন্দ করেন?

খুশিতে প্রাণ যায় যায় পুতুলের। হর্ষাবিষ্ট চিত্তে রুম জুড়ে নেচে গেয়ে বেড়াচ্ছে সে। আজ তার ঈদের দিন। সে তাই গলা ছেড়ে গান ধরল,

“মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ
মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ
তারি সঙ্গে কী মৃদঙ্গে সদা বাজে
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ…..”

______

‘বাবা, তুমি কি উনাদের সাথে কথা বলেছো?’

রাবীর চোখ তুলে জিজ্ঞেস করে,

‘কাদের সাথে?’

‘আরে, পাত্রপক্ষের সাথে।’

‘না, কেন?’

‘ওমা, উনারা তো অপেক্ষা করছেন। তুমি তোমার মত জানাবে না? আমি তো রাজি, বাবা। তুমিও রাজি হয়ে উনাদের জানিও দাও।’

রাবীর চমকে খেতে ভুলে যায়। বিহ্বল কন্ঠে বলে উঠে,

‘তুমি রাজি? তুমি এখনই বিয়ে করতে চাও? অনার্স শেষ করবে না?’

‘করব তো। বিয়ের পর করব।’

পুতুল যেন প্রকৃতিবিরুদ্ব আচরণ করছে। এত সহজেই সে বিয়েতে কী করে রাজি হয়ে গেল? সেদিনও তো এত ক্রুদ্ধ ছিল সে। আর আজ হঠাৎই বিয়ের জন্য এমন উতলা হয়ে উঠল? ব্যাপারটা তাদের মাত্রাধিক চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।
পুতুল খেয়ে নিজের রুমে ফিরে যায়। রাবীর খাওয়া ফেলে বলে,

‘সবকিছু হয়েছে আপনার জন্য? কী দরকার ছিল, মেয়েটার মাথায় এমন বিয়ের ভূত ঢোকানোর?’

মেহুল এমন ভাবে চাইল যেন সে নিঃসহায়। তারই বা দোষ কীসের? সে কি জানতো, সবকিছু এমন হিতে বিপরীত হবে। যা চেয়েছিল তা তো হলোই না, উল্টো এখানে সবকিছু উল্টে তারাই কেইস খেয়ে গেল।

______

সারাজকে পুতুল ক্রমাগত কল দিয়ে যাচ্ছে। অন্তরিন্দ্রিয়তে কেমন একটা তীক্ষ্ণ ব্যথার উৎপত্তি হয়েছে যেন। এই ব্যথা তাকে বর্তমানে স্থির থাকতে দিচ্ছে না। সারাজ ভাইয়ের সাথে কথা বলা ভীষণ জরুরি। কিন্তু, ঐ মূর্খ ব্যক্তিটা বুঝলেই না সেসব।

প্রায় ছাব্বিসটার মতো কল দিয়েছে সে। আর চারবার দিবে। বরাবর ত্রিশটা হওয়ার পর আর দিবে না। তারপরও ফোন রিসিভ না হলে, অতঃপর সে নাকে মুখে কাঁথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে।

তাকে আর কষ্ট করে ঘুমাতে হলো না। আটাশ নাম্বার কলের মাথায় সেটা রিসিভ হলো। পুতুল তখন বিক্ষিপ্ত সুরে বলে উঠল,

‘কল রিসিভ করছিলে না কেন?’

‘সেই কৈফিয়ত তোকে দিব না-কি?’

সারাজের স্বর ভাবাবেগ শূন্য। এমন একটা ভাব যেন কিছুই হয়নি। অথচ, ছয় ঘন্টা আগেও যদি সে কবুল বলে দিত, তবে বর্তামানে হতো সে সারাজের বউ। কথাটা ভাবতেই শরীর জুড়ে অন্যরকম শিহরণ খেলে গেল তার। সে হতো তার সারাজ ভাইয়ের বউ? সারাজ আহমেদের বউ পুতুল আহমেদ? লজ্জায় এবার মরেই যাবে সে। ঠোঁট কামড়ে হেসে ফেলল।

সারাজ বাজখাঁই গলায় বলল,

‘আছিস? নাকি আবারও বেহুঁশ হয়ে গিয়েছিস? তোকে দিয়ে তো আর ভরসা নেই।’

পুতুল সশব্দে শ্বাস ত্যাগ করল। কেন যে তখন সে বেহুঁশ হলো? বড্ড আফসোস হচ্ছে। এমন মারাত্মক একটা মুহুর্তে কী করে সে বেহুঁশ হতে পারল, কী করে? মাথা চাপড়ে বসল পুতুল। মিনমিনিয়ে বলল,

‘সারাজ ভাই।’

সারাজ চোখ মুদে নিল। এই যে এই ছোট্ট ডাক তার হৃদয়কে ক্ষত বিক্ষত করে ফেলে সেটা কি এই নির্বোধ বালিকা বোঝে না? কেন বার বার এমন কোমল স্বরে তাকে ডেকে এভাবে আঘাত করে? সে যে এই আঘাতের তোপ আর সইতে পারছে না।

‘সারাজ ভাই, তখন তুমি কী করতে যাচ্ছিলে? তুমি কি সত্যিই আমাকে বিয়ে করতে?’

‘তোর কী মনে হয়?’

‘তুমি বলো না। আমার মনে হওয়া, না হওয়াতে কী আসে যায়।’

ফোনের ওপাশে মৃদু হাসে সারাজ। সেই হাসি পুতুলের দৃষ্টিগোচর হয় না। এক সেকেন্ড থেকে সেই হাসি আমার মিইয়ে যায়। সারাজ শ্রান্ত সুরে বলে,

‘সবসময় কেন সব উত্তর মুখে বলেই দিতে হবে? তুই না আসলেই বড্ড নির্বোধ, পুতুল। হয় কিছু বুঝিস না, নয়তো ইচ্ছে করেই বুঝতে চাস না। শোন, তুই বুঝতে না চাইলে আমি নিজ থেকে তোকে কখনোই বোঝাব না। তোকেই বুঝে নিতে হবে সবকিছু। আর এই ব্যাপারে তুই আমার পক্ষ হতে কখনোই কোনো সাহায্য পাবি না।’

পুতুল জড়ীভূত হয়ে বসে আছে। মাথার ভেতরে চক্কর খাচ্ছে। বুকে শব্দ হচ্ছে খুব। নিউরন নিউরন মিলে যুদ্ধে নেমেছে হয়তো। এই কথাগুলোকে ভেঙে ভেঙে বুঝতে হবে। তাই সময় প্রয়োজন। সারাজ ভাই বলেছেন, তাকে সাহায্য করবে না। ঠিক আছে, সেও চাইবে না কোনো সাহায্য। এবার থেকে নিজে নিজেই সব বুঝে নিবে।

সারাজ দ্বিতীয় আর কোনো কথা না বলে কলটা কেটে দেয়। তার নিজের অস্তিরতাই তো কমছে না এখনও। আজ কী করতে যাচ্ছিল সে? এভাবে সে তার পুতুলকে বিয়ে করবে? না, এমনটা তো সে ভাবেনি। তার আর তার পুতুলের বিয়ে হবে মহাসমারোহে, এমন ঠুনকো ভাবে না।

_________

সারারাত নির্ঘুম কাটাল পুতুল। মস্তিষ্ক জুড়ে বিচরণ চলছিল কেবল সারাজের কথাগুলোই। সারাজ ভাই কী বোঝাতে চাইছেন, হয়তো সে বুঝেছে। আবার, একটু পর মনে হচ্ছে, না, বুঝেনি। কী যে এক বিপদ। লোকটা সহজ ভাবে বললেই তো পারেন, সে পুতুলকে পছন্দ করেন। তাকেই বিয়ে করতে চান। সেসব না করে, এখানে কাব্যিক কথাবার্তা শুরু করেছেন। পুতুল ঠিক করল, যা বুঝেছে, বুঝেছে; আর কিছু বুঝবে না। বাকিটা সারাজ ভাই নিজে এসে তাকে বোঝাবেন, তারপর সে বুঝবে; এর আগে না।

সকালে অফিসের জন্য বের হওয়ার সময় সারাজ মায়ের গলা শুনতে পায়। মা যেন কার সাথে খুব উচ্চ সুরে ফোনে কথা বলছে। পুতুলের নাম শুনেই খান খাড়া করে সারাজ। শুনতে পায় রিতা বলছে,

‘তাহলে রাবীর ভাইও বিয়েতে রাজি? যাক, আলহামদুলিল্লাহ। এবার সুষ্ঠুভাবে বিয়েটা হলেই হয়।’

কথাটা গানে বারি খেয়ে সোজা মস্তিষ্কে গিয়ে হরতাল বাঁধিয়ে দেয়। মারাত্মক মেজাজ চটে সারাজের। তারমানে, কাল রাতের কোনো কথাই পুতুলের বোধগম্য হয়নি? সে তার সিদ্ধান্তেই অটুট? সে বিয়ে করবেই। রাগে সারাজ কাঁধের ব্যাগটা সোফায় ছুড়ে মারে। অতঃপর ভীষণ ক্রোধ নিয়ে পা বাড়ায় মায়ের রুমের দিকে।

চলবে…

(কী মনে হয়? রিতার রুমে গিয়ে সারাজ কী বলবে?🤔)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here