শেষটা_সুন্দর(সিজন-২) #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ২৫।

0
373

#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৫।

বাংলার বর্ষপঞ্জিতে ১৪৫৭ বঙ্গাব্দের ইতি টেনে আগমন ঘটল ১৪৫৮ বঙ্গাব্দের। পহেলা বৈশাখ আজ। চারদিকের নর-নারীরা আজ তাই সেজেছে শুভ্র আর লালিমাতে। ঐ বড়ো কৃষ্ণচূড়া গাছটাও আজ তাদের সাথে তাল মিলিয়ে ভরে উঠেছে রক্তিম আলিঙ্গনে।

পুতুল আর লীনা দুজনেই আজ লাল পাড়ের শ্বেত শাড়ি গায়ে জড়িয়েছে। হাত ভর্তি লাল সাদা চুরির বাহার। ললাটের ঠিক মাঝ বরাবর একটা ছোট্ট লাল রঙা টিপ। হরিণের ন্যায় অক্ষিযুগলে টানা নিকষ কাজল। পাতলা ফিনফনে ওষ্ঠ জোড়া সেজেছে তাদের টকটকে লাল ওষ্ঠরঞ্জনীতে।

______

পুতুল নিঃস্পৃহ সুরে বলে উঠল,

‘ইশ, এই শাড়ি সামলানো এত মুশকিল কেন?’

লীনা স্বাভাবিক স্বরে বলে,

‘কই, আমার তো কষ্ট হচ্ছে না।’

‘আর আমার মনে হচ্ছে, এই বুঝি শাড়ি খুলে যাবে।’

‘আচ্ছা চল, ওয়াশরুমে গিয়ে আবার ঠিক করে দিচ্ছি।’

_______

অনুষ্ঠানের সূচনা ঘটল “এসো হে বৈশাখ” গানের সুরে। সেই দলীয় সঙ্গীতে পুতুল আর লীনাও ছিল। দলীয় সঙ্গীতের পর্ব চুকিয়ে উপস্থাপক একে একে উপস্থিত সকলকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানায়। অতঃপর শুরু হয় অনুষ্ঠানের মূল পর্ব। ভার্সিটির ভি.সি সহ প্রধান অতিথির বক্তৃতা পাঠ শেষ হতেই সাংস্কৃতিক পর্বের আগমন ঘটে। এই পুরো সময়েই লীনা আর পুতুল চেয়ারে বসে উপভোগ করছিল। এবার তো তাদের পারফরম্যান্সের পালা। লীনার বুকে ব্যথা উঠে ততক্ষণাৎ। পুতুলের হাত টেনে ত্রসন গলায় বলে,

‘দোস্ত, আমার তো ভয় করছে। যদি স্টেজে গিয়ে সব ভুলে যাই?’

‘ধুর, তেমন কিছুই হবে না। স্টেজে দাঁড়িয়ে ভাববি তোর সামনে কেউ নেই। তুই তোর মতো বলে যাবি। একদম স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে। ডানে বামে কিচ্ছু দেখবি না, বুঝেছিস?’

লীনা মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাল। পুতুলের সাথে গিয়ে দাঁড়াল স্টেজের পেছন দিকটাই। সেখানেই সবাই উপস্থিত। সবাই যার যার মতো পারফরম্যান্সের চিন্তায় মত্ত। হঠাৎ সেই মূহুর্তে লীনার মাহাতের কথা স্মরণ এল। এই লোকটা কোথায়? সকাল থেকে তো চোখেই পড়ল না। তার ডিপার্টমেন্টের অনুশীলন নিয়ে এতদিন এত হম্বিতম্বি দেখিয়ে, এখন পারফরম্যান্সের বেলাতেই উধাও। আশ্চর্য! লীনার আকস্মিক মন খারাপ ঘটল। কেন যেন মন বলছে, লোকটা সামনে থাকলে সাহস পেত সে।

একে একে সবাই গিয়ে তাদের পারফরম্যান্স করে এসেছে। এবার লীনার পালা। তার পরেই পুতুল। লীনার হাত পা কাঁপছে। বক্ষঃস্থলের কম্পন বেড়েছে। পুতুল লীনাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলে,

‘আল দ্য বেস্ট, দোস্ত।’

ত্রস্ত হাসে সে। হাতের ফোনটা পুতুলের দিকে বাড়াতেই টুং করে একটা শব্দ হয়। লীনা ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই দেখে একটা মেসেজ। চোখের দৃষ্টি গভীর হয়। মেসেজে লেখা, “অল দ্য বেস্ট।” আবারও আননোন নাম্বার। আশ্চর্য, সে না ঐ নাম্বারটা ব্লক করছিল, তবে এই নাম্বারটা কার। এতকিছু ভাবার আগেই, উপস্থাপক তার নাম ডেকে ওঠে। লীনা ব্যস্ত হয়ে তার ফোন আর পার্স পুতুলের হাতে দিয়েই স্টেজে দিকে পা বাড়ায়।

এই প্রথম এত মানুষের সামনে মাইক ধরে দাঁড়িয়েছে লীনা। চোখে মুখে স্পষ্ট ভয়ের ছাপ। মানুষগুলো এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার দিকে। লীনা চোখ পিটপিট করে হালকা ঢোক গিলে। হঠাৎই দৃষ্টি আটকায় স্টেজ থেকে কিছুটা সামনের এক পার্শ্বে দাঁড়িয়ে থাকা এক সুদর্শন যুবকের উপর। লীনা আচমকা এই যুবককে দেখে চোখ সরাতে পারে না। শুভ্র পাঞ্জাবী গায়ে কী চমৎকার লাগছে তাকে। অধরে ছড়িয়ে থাকা নিঁখুত হাসিটা যেন কেবল তার’ই জন্য। হঠাৎ ছেলেটা চোখের ইশারায় তাকে কী যেন বোঝাল। লীনা বুঝল, ছেলেটা তাকে শুরু করতে বলছে। স্মিত হাসে লীনা। এই তো সে সাহস পেয়েছে। এবার সে নির্দ্বিধায় এই আবৃত্তি করে ফেলতে পারবে।

আবৃত্তি শেষ হতেই জনসমাগমের মাঝে করতালির রোল পড়ল যেন। সবার এত উদ্দীপনা দেখে ভীষণ খুশি হলো লীনা। যাক, সে তাহলে পেরেছে।

লীনা স্টেজ থেকে নামতেই পুতুলের ডাক পড়ল। লীনাও তাকে জড়িয়ে ধরে “অল দ্য বেস্ট” জানাল।

যতই আত্মবিশ্বাস থাকুক না কেন, এই স্টেজে দাঁড়ালে, হাত পা সবারই কাঁপে। পুতুলেরও এই মুহুর্তে একই অনুভূতি হচ্ছে। গলা কাঁপছে তার। তাও প্রচন্ড সাহস নিয়ে সুর তুলে সে,

“মায়াবন বিহারিণী হরিনী,
গহন-স্বপন-সঞ্চারিণী।
কেন তারে ধরিবারে করি পণ অকারণ
মায়াবন বিহারিণী….

থাক্ থাক্, নিজ-মনে দূরেতে
আমি শুধু বাঁশরির সুরেতে
থাক্ থাক্, নিজ-মনে দূরেতে
আমি শুধু বাঁশরির সুরেতে
পরশ করিব ওর প্রাণমন
অকারণ,
মায়াবন বিহারিণী…”

পুতুলের গান শেষ হতেই আবারও চারদিক করতালির শব্দে রমরমা হয়ে উঠে। স্টেজ থেকে নেমে আসে পুতুল। লীনা খুশিতে জড়িয়ে ধরে বলে,

‘বাহ, কী গেয়েছিস? মনে হচ্ছিল প্রফেশনাল সিঙ্গার। তোকে না এই গান নিয়ে কিছু একটা করার দরকার।’

পুতুল হেসে বলে,

‘আচ্ছা আচ্ছা হয়েছে, আর পাম দিস না। চল এখন ক্যান্টিনে গিয়ে কিছু খেয়ে আসি। সকাল থেকে এক্সাইটমেন্টের ঠেলায় কিছুই খেতে পারিনি।’

‘হ্যাঁ, আমিও। চল।’

_______

ক্যান্টিন থেকে অল্প স্বল্প কিছু খেয়ে পুতুল আর লীনা ভার্সিটির পাশের বাগানটার কাছে যায়, ছবি তুলতে। আধ ঘন্টার মধ্যে প্রায় শো খানেকের মতো ছবি তুলে ফেলেছে তারা। বেচারা ফোনও বোধ হয় এখন ভেতরে ভেতরে কষ্টে মরে যাচ্ছে। মনে মনে হয়তো ভাবছে, এই নারী জাতির কবলে পড়লে যে কারোর’ই রেহাই নেই।

পুতুল ছবিগুলো দেখে বলল,

‘আরে দোস্ত, আমাদের তো নায়িকার চেয়ে কিছু কম লাগছে না।’

লীনা দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,

‘আসলেই-রে, আমরা কী সুন্দর দেখেছিস!’

পেছন থেকে তখনই কেউ গলা ঝেরে বলে উঠে,

‘বাহ, সেল্ফ সেটিসফেকশন। ব্যাপারটা দারুণ কিন্তু।’

দুজনেই ঘুরে তাকায়। মাহাতকে দেখে পুতুল প্রসন্ন হেসে বলে,

‘শুভ নববর্ষ, ভাইয়া। আপনি কোথায় ছিলেন, সকাল থেকে তো আপনাকে দেখলাম’ই না।’

‘ছিলাম আশেপাশেই। খেয়াল করেননি হয়তো। বাই দ্য ওয়ে, আপনাদের দুজনের পারফরম্যান্স’ই কিন্তু দারুণ হয়েছে।’

পুতুল আর লীনা দুজনেই এক সঙ্গে বলে,

‘ধন্যবাদ।’

মাহাত এবার লীনার দিকে দৃষ্টিপাত করে। লাল পাড়ের সাদা শাড়িতে একেবারে খাঁটি বাঙালি বধূ লাগছে তাকে। এবার একটা ছোট্ট ঘোমটা টানলেই হতো। মাহাত তখন হুট করেই বলে উঠল,

‘এই পুতুল, আমাকে আর লীনাকে একটা ছবি তুলে দিন তো?’

অকস্মাৎ এমন কথা শুনে লীনা আর পুতুল মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। লীনা মাথা চুলকে বিভ্রান্ত সুরে বলে,

‘আমার সাথে কেন ছবি তুলবেন, ভাইয়া?’

‘ইচ্ছে হয়েছে তাই। এদিকে এসো দাঁড়াও।’

আশ্চর্য! প্রথমে ছবি তুলতে চাওয়া। এখন আবার আপনি থেকে ডিরেক্ট তুমিতে? এই লোকটার কী হলো আজ?

লীনার বোকার মতো চাউনি দেখে মাহাত বিদ্বিষ্ট সুরে বলল,

‘কী হলো? আমার পাশে এসে দাঁড়াও।’

লীনা পুতুলের দিকে তাকায়। পুতুলও হতবিহ্বল। লীনা ধীর পায়ে গিয়ে মাহাতের পাশে দাঁড়ায়। তবে মাঝে তাদের তিন ফুটের দূরত্ব।

মাহাত ফের বিক্ষিপ্ত সুরে বলল,

‘মা বাবার মুখে শুনেছিলাম, ২০২০ সালের দিকে নাকি পৃথিবীতে করোনা নামের এক ভাইরাসের আগমন ঘটেছিল। তাই সেই সময় মানুষ এই ভাইরাস থেকে বাঁচার জন্য এমন তিন ফুটের দূরত্ব মেনে চলতো। তবে এখন তো আর সেই ভাইরাসের নাম গন্ধও নেই। তাহলে তুমি এমন তিন ফুট দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছো কেন? আমরা কাছে আসলে কি করোনা লাগবে গায়ে? কাছে এসো।’

শেষে কিঞ্চিৎ ধমক দিয়েই উঠে মাহাত। লীনার মাথা ঘুরাচ্ছে। এই লোকটা এমন করছে কেন? এমন একটা ভাব করছে, যেন সে তার দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র প্রেমিক।

লীনা ত্রস্ত পায়ে আরেকটু কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। তাও আরো এক ফুটের মতো দূরত্ব রয়ে গিয়েছে। মাহাত ফুঁস করে নিশ্বাস ফেলে সেই দূরত্বও ঘুচিয়ে দেয়। তারপর পুতুলের দিকে হেসে বলে,

‘নিন, এবার ক্লিক করুন।’

মাহাতের মুখে চমৎকার হাসি। আর লীনা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে ক্যামেরার দিকে। ছবি তুলে পুতুল হেসে বলল,

‘তুলেছি, ভাইয়া।’

লীনা ততক্ষণাৎ সরে আসতে নিলেই মাহাত আবার বলে উঠে,

‘দাঁড়াও।’

লীনা থমকে দাঁড়াল। খানিকটা ক্ষুব্ধ সে মাহাতের আচরণে। মাহাত তখন তার পকেট থেকে এক গুচ্ছ কৃষ্ণচূড়া ফুল বের করল। সেটা এক হাতে চেপে লীনার দিকে এগিয়ে দিয়ে, বিমোহিত সুরে বলে উঠল,

‘আমায় বিয়ে করবে, লীনা?’

চলবে….

ছবি: রত্নাবু❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here