শেষটা_সুন্দর(সিজন-২) #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৩০।

0
399

#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩০।

সমস্ত বাড়িতে আজ আনন্দের রোল পড়েছে। সকাল থেকেই চলছে তার তোড়জোড়। মন্ত্রীর একমাত্র মেয়ের বিয়ে বলে কথা। রাবীর তাই কোনোকিছুতেই কোনো কমতি রাখতে চায় না। পুরো বাড়ির সাজানোর জন্য ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের লোক চলে এসেছে। পুতুলের কথা মতো তার বিয়ে এই বাড়িতেই হবে। তাই পুরো বাড়ি এমন ভাবে সাজানো হচ্ছে, যেন সেটা কোনো সেন্টারের চেয়ে কম কিছু না লাগে।

______

এনগেজমেন্টের জন্য পুতুল অযথা মেহমান ডাকতে বারণ করেছে। যারা আসবে তারা কেবল তার খুব কাছের মানুষ। আর বর্তমানে সবার ঊর্ধ্বে তার সবথেকে কাছের মানুষ হলো, একমাত্র বান্ধবী লীনা। লীনা সেই সকালেই তার বাড়িতে এসে হাজির। লীনাকে নিয়েই পুতুল সব তদারকি করছে। সবকিছু হচ্ছে তার পছন্দের। মেহুল ব্যস্ত রান্নাবান্নার কাজে। রাবীর সকাল থেকে বাড়িতে থেকে এখন তার অফিসে বেরিয়েছে।

পুতুল গোসল সেরে এসে বলল,

‘এই শাড়িটাতে আমাকে মানাবে?’

‘অবশ্যই।’

পুতুল আকাশী রঙের সিল্কের শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে বলল,

‘আসলেই মানাচ্ছে। বাবার পছন্দ আছে বলতে হবে।’

লীনা কপাল কুঁচকে বলল,

‘এই পুতুল, আমার লেহেঙ্গা কই?’

পুতুল চমকে বলে,

‘আরে, খেয়ালই তো ছিল না। নো টেনশন, আমরা আজকে আবার বের হব। আমারও বিয়ে আর হলুদের শপিং বাকি। সেগুলোর সাথে তোর লেহেঙ্গাটাও কিনে ফেলব। কী রঙের কিনতে চাস বল?’

লীনা এক পল ভেবে বলল,

‘তোর শাড়ি যে কালার নিবি আমার লেহেঙ্গাও তেমন কালারের’ই নিস।’

‘ওকে ডান।’

‘এবার জলদি এইদিকে আয়। তাড়াতাড়ি তৈরি হতে হবে। তোর শ্বশুরবাড়ির লোক চলে আসল বলে।’

____

আকাশী রঙের শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে মাথায় একটা আকাশী রঙের ওড়না জড়াল। গলায় কানে শোভিত হলো ছোট্ট একটা নেকলেসের সেট। পাতলা ফিনফিনে ওষ্ঠযুগল রাঙানো হলো গোলাপী রঞ্জকে। হরিণাক্ষী জোড়া রাজিত হলো মসীবর্ণ কাজলে। বরাবরের ন্যায় ললাটে ঠায় পেল ছোট্ট এক কালো টিপ।

লীনা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে বলে,

‘কী মারাত্মক লাগছে তোকে, দোস্ত। ভাইয়া আজ নির্ঘাত মারা পড়বে।’

পুতুল ভেংচি কেটে বলল,

‘মোটেও তেমন কিছু হবে না। উনাকে মুগ্ধ করা এত সহজ না। সেদিন নববর্ষের দিনও তো কত সুন্দর সেজেছিলাম। সাহেল ছুটে এসে আমার প্রশংসাও করে গিয়েছিল। অথচ ঐ লোকটা আমার সাজকে পাত্তাই দিল না।’

‘আহারে, থাক মন খারাপ করিস না। আজকে ঠিক পাত্তা দিবে। দেখবি, লুকিয়ে এসে টুপ করে একটা চুমুও খেয়ে বসবে।’

চোখ পাকিয়ে তাকায় পুতুল। গরম গলায় বলে উঠে,

‘খুব অসভ্য হয়েছিস কিন্তু।’

‘তোর থেকে কম আছি। তুই তো আরও ডিটেইলসে সবকিছু বলিস।’

পুতুল মাথার ওড়নাটা ঠিক করতে করতে বলল,

‘মোটেও না। আমি খুব ইনোসেন্ট। এসব দুষ্টু দুষ্টু কথা তোর মুখেই মানায়।’

‘থাক, হয়েছে। আমাকে আর কিছু বোঝাতে আসিস না। আমার থেকে বেশি তোকে কেউ চেনে না, বুঝলি।’

পরবর্তী জবাবের জন্য পুতুল মুখ খোলার আগেই লীনা বলে উঠল,

‘এই গাড়ির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ভাইয়ারা বোধ হয় চলে এসেছেন।’

শোনা মাত্রই পুতুল বারান্দায় ছুটে যায়। ঐ তো সারাজের গাড়িটা গেইট পেরিয়ে ভেতরে আসছে। নিশ্চয়ই ড্রাইভিং সিটে সারাজ বসা। পুতুল একটু উঁকি ঝুঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু অত দূর থেকে কিছু দেখা মুশকিল। গাড়ি মেইন গেইট অবধি এসে থেমে যায়। এবার নিশ্চয়ই সারাজ নামবে। পুতুল খানিকটা আড়াল হয়ে দাঁড়ায়। গাড়ি থেকে সাদরাজ আর রিতা নামে। তারা নামতেই গাড়ি সেখান থেকে সরে গ্যারাজের দিকে চলে যায়। মনক্ষুন্ন হলো পুতুলের। সারাজ তো নামলই না। মন খারাপ করে রুমে এসে বসল সে। একটু উপর থেকে ভালো মতো দেখতে পারত। নিচে গেলে কি আর ঠিকমতো চাওয়া যাবে? যাবে না। এত মানুষ, তার উপর ঐ লোকটার চোখে চোখ পড়লেই তো সে লজ্জায় মরে যাবে।

‘পুতুল, তুই এখানে বস। আমি একটু নিচে গিয়ে দেখে আসি।’

‘না না, এখন যাবি না। একেবারে আমার সাথে নামবি। বস এখানে।’

লীনা পুতুলের পাশে বসল। ভ্রু নাচিয়ে সন্দিহান গলায় বলে উঠল,

‘তুই কি কোনো ভাবে সারাজ ভাইয়াকে নিয়ে ইনসিকিউরড?’

পুতুল নাক মুখ কুঁচকে তাকায়। বলে,

‘না, একদমই না। আমি জানি তুই মাহাতের প্রেমে অলেরডি হাবুডুবু খাচ্ছিস। সো, এসব ইনসিকিউরিটির প্রশ্নই আসে না।’

লীনা ক্ষিপ্ত হয়ে পুতুলের হাতে চাপড় বসিয়ে বলে,

‘তোকে কে বলেছে আমি ঐ মাহাতের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি? সবসময়ই বেশি বেশি বুঝিস।’

‘আচ্ছা তাই! তবে কাল রাত একটার সময় তোমার ফোন বিজি ছিল কেন? অত রাতে কার সাথে কথা বলছিলে শুনি?’

ধরা পড়া চোরের মতো মিইয়ে যায় লীনা। তারপর দাঁত বের করে বোকার মতো হেসে বলে,

‘না মানে, ঐ আরকি একটু কথা বলছিলাম। এই জানিস, ঐ রং নাম্বারের ব্যক্তিটা তো আর কেউ না; এই মাহাত’ই।’

পুতুল হেসে বলে,

‘সেটা তো আমি আগেই সন্দেহ করেছিলাম। তা ভালোই হয়েছে। আমার বিয়ের পরপরই তোরাও বিয়েটা করে ফেলিস। তারপর একসাথে দুই বান্ধবী প্রেগন্যান্ট হব, আর তারপর দুইজনের ছেলে মেয়ের বিয়ে দিব; আমার মা আর মামনির মতো। ওরাও কিন্তু বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল।’

লীনা আগে জানত না এই কথা। পুতুল তো সারাজকে সবসময় তার কাজিন বলে এসেছে। আজ হঠাৎ এই কথা শুনে একটু বেশিই অবাক হলো সে। বলল,

‘সারাজ ভাইয়া তোর মা’র বান্ধবীর ছেলে? তোরা কাজিন না?’

‘না। আর সারাজ ভাইয়ের বাবা সাদরাজ চাচুও বাবার বেস্টফ্রেন্ড ছিলেন। মানে বুঝতে পারছিস দুই বেস্টফ্রেন্ড জোড়ার বিয়ে হয়েছে। ঐ মাহাত যদি না আসত, তবে আমিও সারাজ ভাইয়ের কোনো এক বেস্টফ্রেন্ডের সাথে তোর লাইন লাগিয়ে দিতাম।’

লীনা হেসে বলল,

‘বাহ, তোদের ব্যাপারটা দারুণ তো।’

তাদের কথার মাঝেই একজন গৃহপরিচালিকা সেখানে উপস্থিত হলেন। বললেন,

‘খালা, আপনাদের নিচে যাইতে বলছে।’

পুতুল বলল,

‘আচ্ছা আপনি যান, আমরা আসছি।’

লীনা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

‘চল চল, এবার যেতে হবে। সারাজ ভাই হয়তো অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন।’

পুতুল লীনাকে হালকা চিমটি কেটে বলল,

‘ফাজিল।’

_____

সিঁড়ির মাঝ বরাবর আসার পরপরই সবার দৃষ্টি নিক্ষেপিত হয় পুতুলের উপর। পুতুলের যদিও খুব একটা লজ্জা বা অস্বস্তি হচ্ছে না, তাও সে নতুন বউয়ের মতো মাথা নুইয়ে রেখেছে। হয়তো মাথাটা তুললেই দেখতে পেত, এক জোড়া অক্ষি কেমন বেহায়া ভাবে দেখছে তাকে।

সারাজের পাশেই লীনা পুতুলকে বসাল। সারাজ এতে মনে মনে বিরক্ত। পাশে না বসিয়ে সামনেও তো বসাতে পারত। এখন কি সে এত মানুষের মাঝে ঘাড় কাত করে পুতুলকে দেখবে? ধুর! সারাজও মাথা নুইয়ে বসল।

রিতা এগিয়ে এসে পুতুলের চিবুক নাড়িয়ে বলল,

‘মাশাল্লাহ, আমার ছোট্ট পুতুলকে কী সুন্দর লাগছে।’

পুতুল মৃদু হাসে। পাশ ফিরে একবার সারাজকে অবলোকন করার মারাত্মক ইচ্ছে জাগছে মনে। কিন্তু, এভাবে কি তাকানো যায়? সবাই যদি তাকে নির্লজ্জ ভাবে? সারাজকে না দেখুক সারাজের হাত যুগল সে আড় চোখে দেখতে পাচ্ছে। শুভ্র পাঞ্জাবী গায়ে জড়িয়েছে নিশ্চয়ই। গোটানো হাতা জোড়া দেখেই তা স্পষ্ট। এক হাতের আঙ্গুলের ভাঁজে আরেক হাত রেখে ক্রমাগত সেগুলো নাড়িয়ে চলছেন। উনি কি চিন্তিত? চিন্তিত হলেই তো মানুষ এমন করে।

সারাজের পাশে রিতা আর পুতুলের পাশে বসল মেহুল। দুজনের হাতেই দুটো ছোট্ট লাল বক্স। সেই বক্সগুলোতেই জ্বলজ্বল করছে দুখানা চমৎকার আংটি। দুই মা দুইজনকে আংটি দুখানা তুলে দিল। এবার আংটি বদলের পালা। সারাজ প্রথমে হাত বাড়িয়ে দিল পুতুলের দিকে। পুতুল বুঝল, সারাজ তার হাত চাইছে। এতক্ষণে চোখ তুলে তাকাল সে। শ্বেত শুভ্র সারাজকে দেখে অন্তর শীতল হলো তার। হাতটা সযত্নে রাখল সারাজের হাতের উপর। অনামিকা আঙ্গুলটা ততক্ষণাৎ ঝলমলিয়ে উঠল ছোট্ট হীরক খচিত অঙ্গরীয়কে। লজ্জা মিশ্রিত হাসি উজ্জীবিত হলো পুতুলের অধর কোণে। সেই মুহুর্তেই তাকে আরো ব্রীড়ায় ফেলতে হাতের পিঠে চুম্বন করে বসে সারাজ। পুতুল আঁতকে উঠে। লজ্জায় সঙ্গে সঙ্গে হাত সরিয়ে ফেলে। হায় হায়, এতগুলো গুরুজনের সামনে এই অসভ্য লোকটা কী করে বসল!

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here