শেষটা_সুন্দর(সিজন-২) #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৩৪।

0
397

#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩৪।

ভারি লেহেঙ্গা নিয়ে ছুটা মুশকিল। তাও দিক বেদিক সব ভুলে পুতুল ছুটে নিচে নামল। সিঁড়ি ভেঙে বসার ঘরের সামনে যেতেই প্রথমে প্রস্ফুটিত হলো সারাজের চমৎকার হাস্যজ্জ্বল মুখটা। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে পুতুলের সকল বন্ধু বান্ধব। পুতুলকে দেখা মাত্রই সারাজের হাসি আরো চওড়া হয়। সে মন্থর গতিতে এগিয়ে এসে পুতুলের সম্মুখ পানে দাঁড়ায়। তবে নিকটে আসতেই অকস্মাৎ সারাজের হাসিটা মিইয়ে যায়। পুতুলের চোখ মুখ বিধ্বস্ত লাগছে। সারাজকে দেখে খুশি হওয়ার বদলে, সে যেন আরো বিষন্নতায় মূর্ছে গিয়েছে।

উদ্বিগ্ন হয়ে সারাজ বলে উঠল,

‘কী হয়েছে, পুতুল? তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন?’

সারাজের কথা হয়তো ঠিক পুতুলের কর্ণগোচর হয়নি। সে আশেপাশে তাকিয়ে বিচলিত ভঙিতে বলে উঠল,

‘মা কোথায়?’

গলার স্বরটাও কাঁপছে তার। সাথে কাঁপছে তার হস্ত যুগল। সারাজ চিন্তার মাত্রা বাড়ল এবার। ফের জিজ্ঞেস করল,

‘কী হয়েছে বলবি তো? এভাবে কাঁপছিস কেন তুই?’

পুতুল সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে উল্টো চেঁচিয়ে বলল,

‘মা কোথায়?’

তার চিৎকারে স্তব্ধ চারপাশ। সবাই ভড়কে যাওয়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রান্নাঘর থেকে ছুটে আসে মেহুল। মেহুলকে দেখা মাত্রই পুতুলের কম্পন আরো বেড়ে যায়। মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরনে নিউরনে একটাই প্রশ্ন ছুড়ে, “এটা তার আসল মা না?”

মেহুল এগিয়ে যায় পুতুলের কাছে। পুতুলের চোখ মুখ দেখে সেও চিন্তিত হয়ে পড়ে। বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘কী হয়েছে, মা?’

পুতুলের ওষ্ঠযুগলে কম্পন ধরে। তার শ্বাস প্রশ্বাসের গতি এখনও স্বাভাবিক হয়নি। শ্বাস ফেলতে পারলেও নিতে কষ্ট হচ্ছে। তাও একরাশ ক্লেশ উহ্য করে সে কম্পিত সুরে বলে উঠল,

‘আমি কি তোমার মেয়ে না, মা? আমি তোমার গর্ভের সন্তান না? আমাকে কি তোমরা হসপিটাল থেকে এনেছ? মা, ঐ আন্টিগুলো এসব কেন বলছিলেন? উনারা মিথ্যে বলছেন, তাই না? বলো না, মা; তাই তো?’

উক্তিগুলো কান পেরিয়ে মস্তিষ্ক পৌঁছাতেই শরীরের সমস্ত লোমকূপে ভয়ংকর শিহরণ দিয়ে ওঠে মেহুলের। এই এত বছর যাবত এত নিঁখুত ভাবে যে সত্যিটাকে তারা লুকিয়ে এসেছে, সেটা আজকেই জানতে হলো পুতুলকে? ভাগ্য এত নির্মম কেন?

মায়ের নিরবতা পুতুলের যন্ত্রণাকে আরো ত্বরান্বিত করছে যেন। তার কান্না পাচ্ছে, ভয়ংকর কান্না। সারাজ বাকরুদ্ধ। নিমিষ চেয়ে আছে পুতুলের মুখের দিকে। পুতুল এবার ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে উঠল,

‘মা, কিছু বলো। চুপ করে আছো কেন? বলো, আমি কি তোমাদের নিজের মেয়ে না? তোমাদের সাথে কি আমার কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই? আমাকে তোমরা পেয়ে এনেছ? আমি তোমাদের পালিত মেয়ে?’

পুতুলের এত এত প্রশ্নে মাথা ঘুরে উঠে মেহুলের। সে মাথা ধরে ঢলে পড়তে নিলেই সারাজ সহস্তে আগলে ধরে। মেহুল টলমল চোখে সারাজের দিকে তাকায়। সারাজ জোরে দম নিয়ে বলে,

‘মিথ্যে বলে সাময়িক সুখের চেয়ে সত্যি বলে আজীবন কষ্ট পাওয়াও শ্রেয়। তুমি আজ পুতুলকে সবটা সত্যি বলে দাও, মা। আর লুকিয়ে রেখো না।’

পুতুলের ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি সারাজের উপর নিবদ্ধ হলো। সারাজ মেহুলকে ধরে নিয়ে বসাল সোফার উপর। তারপর পুতুলের দিকে চেয়ে বলল,

‘এদিকে আয়।’

পুতুল ধীর পায়ে এগিয়ে মেহুলের ঠিক সামনে প্রতীয়মান হলো। চোখ মুখ কিয়ৎক্ষণের মাঝেই পাণ্ডুবর্ণ ধারণ করেছে তার। মেহুল চাইল মেয়ের দিকে। অন্তঃস্থলে তীক্ষ্ণ এক ব্যথার আভাস পাচ্ছে সে। নিজেকে কিছুটা ধাতস্ত করে ভগ্ন সুরে বলল,

‘রক্তের সম্পর্ক’ই কি সব, পুতুল? আত্মার সম্পর্কের কি কোনো দাম নেই? তোকে আমি দশ মাস গর্ভে ঠাই দেইনি তো কী হয়েছে, বাইশ বছর যাবত এই বক্ষঃস্থলে ঠাই দিয়ে এসেছি। কেবল গর্ভে ধরলেই কি মা হয়ে যায়? আর নিজের জীবনের চেয়েও অধিক ভালোবাসা দিয়ে লালন পালন করলে কি মা হওয়া যায় না? আমি কি তোর মা নই, পুতুল? আমার তো একবারের জন্যও মনে হয়নি তোকে আমি পেয়ে এনেছি, বরং মনে হয়েছে তুই আমার নাড়ী ছেড়া ধনের চেয়েও অধিক কিছু। (একটু থেমে বলল) হ্যাঁ পুতুল, তোকে আমি হাসপাতাল থেকেই এনেছি। তখন তো কেবল একদিনের দুগ্ধশিশু ছিলি তুই। সারাজ’ই প্রথম দেখেছিল তোকে। সে কি গগনবিদারি চিৎকার তোর। প্রথমবারের মতো যখন তোর ছোট্ট শরীরটাকে দুই হাতের ভাঁজে নিয়েছিলাম, তখনই মনে হয়েছিল তুই আমার সন্তান। সারাজ তো প্রথম দেখাতেই বলেছিল, তুই তার ছোট্ট পুতুল। তারপর থেকে সেই ছোট্ট পুতুলকে আমি আমার বুকে আগলে বড়ো করেছি। কখনও একটাবারের জন্যও ভাবিনি, এই মেয়েটা আমার না। তোর সাথে হয়তো আমার কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই। কিন্তু, আত্মার যে সম্পর্ক রয়েছে সেই সম্পর্ক তুই কেমন করে অস্বীকার করবি, পুতুল?’

পুতুল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মেহুল উঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরে মেয়েকে। আদুরে গলায় বলে,

‘কাঁদছিস কেন, মা? তুই তো আমারই মেয়ে, আমার আর রাবীরের একমাত্র মেয়ে তুই। আমাদের ছোট্ট পুতুল। এছাড়া তোর আর কোনো পরিচয় নেই, কোনো না।’

পুতুল আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল মা’কে। কান্নারত অবস্থায় বলল,

‘কেউ যদি না বলতো তবে তো আমি কখনোই বুঝতে পারতাম না, যে আমাকে তোমরা পেয়ে এনেছ। নিজের সন্তানকেও কেউ হয়তো এত ভালোবাসা দেয় না, যতটা দিয়েছ তোমরা আমাকে। তবে এত বছর পর এই বিদঘুটে সত্যিটা শুনে আমার বড্ড কষ্ট লাগছে, মা। তাও, আমি তোমাদেরই সন্তান, আর এই একটা কথা বিশ্বাস করেই আমি সারাজীবন বাঁচতে চাই। মা, আমি তোমাদের ভালোবাসি, প্রচন্ড ভালোবাসি।’

মেহুল পুতুলের কপালে গালে আদর দিয়ে বলে,

‘আমরাও আমাদের ছোট্ট পুতুলকে অনেক ভালোবাসি।’

‘এবার আর কোনো অভিযোগ নেই তো তোর?’

পুতুল সারাজের দিকে তাকায়। মাথা নাড়িয়ে “না” বোঝায়। সারাজ প্রসন্ন হাসে। এগিয়ে এসে পুতুলের চোখের পানি যত্ন সহিত মুছে দিল। তারপর খানিক উঁচু গলায় সবার উদ্দেশ্যে বলল,

‘আপনারা সবাই শুনুন, পুতুল এই বাড়ির মেয়ে। বাবা আরিয়ান খান রাবীর আর মা মেহুল খানের একমাত্র সন্তান পুতুল খান। ও এই বাড়ির মেয়ে, আর এটাই তার একমাত্র পরিচয়। এই নিয়ে যেন আর কোনোদিন কোনো কথা না ওঠে।’

অতঃপর পুতুলের দিকে চাইল সে। মৃদু হেসে বলল,

‘তবে কাল থেকে ওর আরো একটা পরিচয় হবে। আর সেটা হলো, সারাজ আহমেদের স্ত্রী পুতুল আহমেদ।’

পুতুল মাথা নুইয়ে রাঙা গালে লজ্জিত হাসে। মেহুল পুনরায় মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বলে,

‘অনেক কান্নাকাটি হয়েছে, এবার যা উপরে গিয়ে হলুদ শুরু কর। সারাজ, যা তো বাবা পুতুলকে নিয়ে ছাদে যা।’

সারাজ এগিয়ে এসে পুতুলের দিকে এক হাত মেলে ধরল। মুচকি হেসে সেই হাতের উপর স্বীয় হস্ত অর্পণ করল পুতুল। অন্য হাতে লেহেঙ্গাটা একটু উঁচু করে সামনের দিকে অগ্রসর হলো। পেছন থেকে তারা বন্ধু বান্ধবরাও পুনরায় মেতে উঠল হৈ চৈ এ। প্রতিবেশীদের সবার রা বন্ধ হয়ে গেল। মনে মনে ভাবল, এমন স্বার্থপর ভূমিতলে আজকাল এমন স্বার্থহীন ভালোবাসা পাওয়া দুষ্কর।

_______

সারাজ বসেছে পুতুলের পাশেই। সবাই একে একে এসে হলুদ দিয়ে যাচ্ছে। মিউজিক সিস্টেমে গান চলছে ফুল জোশে। পুতুলের বন্ধু বান্ধবরা সব উরাধুরা নাচে ব্যস্ত। সারাজ এর মাঝেই হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। পুতুলের দিকে চেয়ে বলল,

‘একটু দুতলার বেলকনিতে আসিস তো।’

পুতুল অবাকন্ঠিত সুরে বলল,

‘কেন?’

‘কাজ আছে।’

বলেই সারাজ ছাদ থেকে বেরিয়ে গেল। পুতুল আস্তে ধীরে উঠে দাঁড়াল। সবাইকে ফেলে হুট করে চলে যাওয়াটা কেমন দেখায়? তাও, সে নেমে গেল। সারাজ ভাই যখন বলেছেন, কাজ আছে; তার মানে জরুরি কাজ। যেতেই হবে।

পুতুল বেলকনির কাছে এসে সারাজের পেছন বরাবর দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল,

‘কী কাজ?’

সারাজ ঘুরে চাইল। মোলায়েম সুরে বলল,

‘কাছে আয়, বলছি।’

পুতুল ইতস্তত পায়ে এগুল। সারাজের মুখ বরাবর দাঁড়ালেও উচ্চতা তার সারাজের গলা অবধি। তাই মাথা ঝুঁকাল সারাজ। এক হাতের সমস্ত হলুদটা বেশ যত্ন করে মাখাল পুতুলের দুই গালে। অকস্মাৎ এমন কাজে খানিকটা লজ্জা পেল পুতুল। তবে তার থেকেও অধিক ব্রীড়ায় ফেলল যখন সারাজের হস্ত তার গ্রীবা এবং গ্রীবার পশ্চাদ্ভাগ স্পর্শ করল। সেখানে লেপ্টে গেল হলুদের বাকি অংশ। সারাজের পুরু হাতের স্পর্শ তার গলা ঘাড় ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে। আর তাতেই শরীরের প্রতিটি ঊর্ণা ততক্ষণাৎ দন্ডায়মান হয়ে জানান দিল, এই স্পর্শ ভয়ংকর পুতুল, এই স্পর্শ ভয়ংকর।

পুতুলের নিমীলিত চোখ জোড়ার দিকে চেয়ে মৃদু হাসল সারাজ। রগড় সুরে বলে উঠল,

‘চোখ বোজে আছিস যে, আরো কিছু যাচ্ছিস নাকি?’

চট করে চোখ মেলে তাকায় পুতুল। সারাজের কথার মানে বুঝতেই লজ্জায় সংকুচিত হয়ে পড়ে। পরক্ষণেই আবার ক্ষুব্ধ হয়ে বলে,

‘বাজে কথা বলবে না একদম। আর কোন সাহসে তুমি আমাকে এত হলুদ লাগালে? এমনিতে কি আমার গায়ে হলুদ কম ছিল, যে তোমাকেও লাগাতে হবে? ভূত বানিয়ে ফেলেছ একদম।’

বলেই হাত দিয়ে মুখ গলার হলুদ পরিষ্কার করতে শুরু করল। সারাজ ঠোঁট কামড়ে হাসল। বলল,

‘আমি হলুদ না ছোঁয়ালে এই হলুদ অসম্পূর্ণ’ই থেকে যেত। তুই তো বোকা তাই বুঝিস না।’

পুতুল মুখ কালো করে বলল,

‘কিন্তু, আমি তো তোমায় হলুদ লাগাতে পারলাম না।’

পুতুলের বিষন্ন সুর ক্ষান্ত হওয়ার পূর্বেই সারাজ ততক্ষণাৎ তার দুই গাল পুতুলের গালে ঘষে বলল,

‘নে, তোর এই ইচ্ছেটাও পূরণ দিলাম।’

পুতুল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দুই গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সারাজ ঠোঁট চেপে হেসে সরে আসতে নিলেই পুতুল অস্ফুট স্বরে বলে উঠে,

‘তোমার দাঁড়ি এত ধার কেন, সারাজ ভাই? আমার গালগুলো নির্ঘাত কেটে গিয়েছে।’

সারাজ ঘুরে তাকায়। ভ্রুকুটি করে এক পল পুতুলের দিকে চেয়ে বলে,

‘কাল তবে ক্লিন শেভ করে আসব।’

পুতুল ততক্ষণাৎ চেঁচিয়ে বলে উঠে,

‘না না। ক্লিন শেভ করে আসলে আমি তোমাকে বিয়ে করব না, সারাজ ভাই। তোমাকে ক্লিন শেভে জঘন্য লাগে।’

অথচ সারাজ শুনলই না। সে ততক্ষণে সে জায়গা ছেড়ে উধাও। পুতুল মাথা চাপড়ে বলে উঠল,

‘হায় হায়, সত্যি সত্যিই কি সারাজ ভাই কাল ক্লিন শেভ করে চলে আসবেন? হে মাবুদ, প্লিজ উনার সেই ক্লিন শেভ করা চেহারা আমাকে দেখিও না, প্লিজ প্লিজ।’

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here