শেষটা_সুন্দর(সিজন-২) #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৩৬।

0
373

#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩৬।

বেশ আড়ম্বতার সাথে সমাপ্ত হলো সারাজ আর পুতুলের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা। আত্মীয়স্বজন আর পাড়া-প্রতিবেশীর অভাব ছিল না। তার সাথে বাবা মন্ত্রী হওয়ার সুবাদে মিডিয়ার লোকেরা তো ছিলই। ছবি তোলা, খাওয়া দাওয়া, হৈ চৈ আর আনন্দ, সব মিলিয়ে চমৎকার এক দিনের মধ্যে দিয়েই প্রারম্ভ ঘটল তাদের আনকোরা জীবনের।

এবার বিদায়ের পালা। মেহমানদের উপস্থিতি ইতিমধ্যেই অবহুল হয়ে এসেছে। বসার ঘরে সবাই।
সারাজের সাথে কথা বলছে রাবীর। প্রচন্ড বিশ্বাস আর আশ্বাসের সহিত সে মেয়েকে তুলে দিচ্ছে সারাজের হাতে। সারাজও তাই তাকে আশ্বস্ত করে বলল,

‘আমি তোমার বিশ্বাস ভাঙতে দিব না, বাবা। পুতুলকে আমি আমার সবটুকু দিয়ে ভালো রাখব।’

মেহুল থেকে থেকে আঁচলে চোখ মুছছে। রিতা বোঝাচ্ছে তাকে, মেয়ে তো আর পরের ঘরে যাচ্ছে না। এক মা ছেড়ে কেবল অন্য মায়ের কাছে যাচ্ছে। তাও, মায়ের মন, সবকিছুর ঊর্ধ্বে তাদের কাছে সন্তানের অভাব। এই অভাব অন্যকিছুতে যে মিটে না।

সবার ভাবমূর্তি মনোযোগের সহিত পরখ করল পুতুল। সোফায় তার পাশেই বসে আছে লীনা। যদিও মন তার এখানে নেই। মাহাত ছেলেটা ক্রমাগত তাকে মেসেজ দিয়ে দিচ্ছে। তার মেসেজের রিপ্লাইটাও ঠিক মতো দিতে পারছে না সে। এত মানুষ, তাও আবার বিদায়ের বেলা। এইসময় মেসেজে প্রেমালাপ করা ঠিক মানায় না।

পুতুল হঠাৎ তাকে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘এই দোস্ত, আমি তো একটু পর চলে যাব।’

লীনা দুঃখি দুঃখি চোখে চাইল। বলল,

‘মন খারাপ করিস না, দোস্ত। তোর শ্বশুরবাড়ির মানুষরা তো তোকে অনেক ভালোবাসেন। তুই অনেক ভালো থাকবি।’

পুতুল বিষন্ন হয়ে চাইল। হতাশ সুরে বলল,

‘কিন্তু দোস্ত, সমস্যা তো অন্য জায়গায়।’

লীনা খানিক চিন্তিত সুরে জিজ্ঞেস করল,

‘কী সমস্যা?’

পুতুল ইতস্তত সুরে জবাবে বলল,

‘আমি না এখন চলে যাব? বিদায়ের বেলায় তো মেয়েরা অনেক কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে তো অনেকে আবার বেহুঁশও হয়ে যায়। অথচ দোস্ত, আমার না একটুও কান্না পাচ্ছে না। মানে, চেষ্টা করেও চোখে পানি আনতে পারছি না। এমন হলে কী করে হবে বলতো? না কাঁদলে সবাই কী বলবে, এই মেয়ের মা বাবার প্রতি একটুও মায়া নেই। দেখো, কেমন নাচতে নাচতে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে। আমার এখন কী হবে, দোস্ত?’

পুতুলের চোখে মুখে মারাত্মক চিন্তার ছাপ। অন্যদিকে সব শুনে লীনা বাকরুদ্ধ। সে কী প্রতিক্রিয়া দিবে বুঝতে পারছে না। এই মুহুর্তে এই মেয়ের কান্নাও উধাও হয়ে গিয়েছে? বাহ!
লীনা জোরে নিশ্বাস বর্জন করল। তাকাল পুতুলের দিকে। বীতঃস্পৃহ সুরে বলল,

‘না কান্না আসলে কাঁদবি না। এটা নিয়ে এত চিন্তা করার কী আছে?’

‘কিন্তু, মানুষ কী বলবে?’

‘মানুষ তোর মাথা আর আমার মুন্ডু বলবে। আপাতত আমার মাথা না খেয়ে চুপ করে বসে থাক।’

পুতুল গাল ফুলিয়ে বসল। মনে মনে বিড়বিড় করে কতকগুলো গালিও দিল লীনাকে।

__________

পুতুলকে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে মেহুল। বান্ধবীর কান্না দেখে রিতার চোখ জোড়াও সিক্ত হয়ে এসেছে। মেহুলের পিঠে হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। মেহুলের কান্না থামছে না তাও। সারাজ মোলায়েম সুরে বলল,

‘মা, তুমি তো পুতুলকে তোমার ছেলের হাতেই তুলে দিয়েছ; তাহলে এত কাঁদছ কেন? আমার উপর বিশ্বাস নেই তোমার? পুতুল ভালো থাকবে, মা। প্লিজ, কান্না থামাও।’

মেহুল নাক টেনে সোজা হয়ে দাঁড়াল। ফর্সা নাক গাল সব রক্তিম হয়ে ওঠেছে। পুতুল আর সারাজের কপালে পরপর চুমু খেয়ে বলল,

‘আমি জানি, আমার মেয়ে ভালো থাকবে। কিন্তু মেয়েকে ছাড়া আমি কী করে ভালো থাকব, বল? আমার সব ভালো থাকা যে মেয়েটা সাথে করে নিয়ে যাচ্ছে।’

‘তাহলে তুমিও চলো আমার সাথে।’

পুতুলের নির্লিপ্ত সুর শুনে হেসে ফেলল মেহুল। মেয়ের মাথায় চাটি দিয়ে বলল,

‘হ্যাঁ, এখন তোর জন্য মেয়ের শ্বশুরবাড়ি গিয়ে বসে থাকব? যা তুই। এমনিতেও এতদিন অনেক জ্বালিয়েছিস আমাকে। এবার আবার বান্ধবীর পালা।’

বলেই রিতার দিকে চেয়ে হাসল সে। রিতাও হেসে বোঝাল, সে পুতুলের সব জ্বালানো মাথা পেতে সহ্য করে নিবে।
রাবীরও এগিয়ে এসে মেয়ের কপালে চুমু খেল। অক্ষিযুগল তারও ছলছল। সারাজকে আরো একবার বুকে জড়িয়ে বলল,

‘মেয়েটাকে ভালো রাখিস, বাবা।’

.

লীনার চোখে পানি দেখে পুতুল অসহায় সুরে বলল,

‘দেখেছিস সবাই কাঁদছে, কেবল আমার চোখেই পানি আসছে না। কী এক মসিবতে পড়েছি বলতো?’

লীনা টলমল চোখেই হেসে ফেলে। পুতুলকে জড়িয়ে ধরে বলে,

‘তুই না জীবনেও শুধরাবি না।’

গাড়িতে নিজের আসনে আরাম করে বসল পুতুল। তার পাশের স্থান দখল করেছে সারাজ। পেছনের আরেক গাড়িতে রিতা আর সাদরাজ। তারপর আরো তিন গাড়ি মেহমান। গাড়ি স্টার্ট হয়। পুতুল জানলা দিয়ে তাকায় তার অসহায় মা বাবার দিকে। যারা এক বুক বিষন্নতা নিয়ে চেয়ে আছে তার পানেই। এবার খানিকটা মনস্তাপ হয় তার। তাকিয়ে থাকে এক ধ্যানে। চলন্ত গাড়িতে যতক্ষণ তাদের দৃষ্টিগোচর হলো ততক্ষণই চেয়ে রইল। দৃষ্টির বাইরে মানুষ দুটো হারিয়ে যেতেই সিটে হেলান দিয়ে বসল সে। চাইল সারাজ দিকে। সারাজও এতক্ষণ অনিমেষ চেয়ে ছিল বিধায় চোখে চোখ পড়ল। হঠাৎ কী খেয়াল করে চট করে সোজা হয়ে বসে পুতুল। তারপর ঠোঁট কামড়ে হেসে বলে উঠে,

‘এই সারাজ ভাই, তুমি দেখি ক্লিন শেভ করোনি। ভাগ্যিস, আল্লাহ আমার কথা শুনেছেন। নয়তো আজ তো তোমাকে বিয়েই করতাম না।’

সারাজ প্রচন্ড রকম তেতে ওঠল। জোরে ধমক দিয়ে বলল,

‘আমি কি এখনও তোর ভাই?’

পুতুল ঠোঁট চেপে হেসে বলল,

‘ওপস সরি, ভুলে গিয়েছিলাম। তুমি তো এখন ভাইয়া থেকে সাইয়্যা হয়ে গিয়েছ।’

বলে শব্দ করেই হেসে ফেলল সে। সারাজ চোয়াল শক্ত করে বলে উঠল,

‘আজকে বাসায় গিয়েই আমি ক্লিন শেভ করব।’

ভ্রু কুঁচকে তাকাল পুতুল। তারপর ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘আজ ক্লিন শেভ করলে বাসর ক্যান্সেল।’

হাসল সারাজ। পুতুলের দিকে খানিকটা এগিয়ে এসে একই সুরে বলল,

‘তোর কি মনে হয়, সবকিছু তোর কথায় হবে? আমার এতদিনের প্রতীক্ষার রজনী, অবশ্যই আজ তোর কোনো মর্জি চলছে না।’

ভ্রু যুগলের ভাঁজ দৃঢ় হলো পুতুলের। এক পল সারাজকে দেখে ফের গা এলিয়ে দিল তার আসনে। দায়সাড়া ভাবে বলল,

‘তোমাকে আমি ভয় পাই না।’

ফের ক্রূর হাসল সারাজ। বলল,

‘আচ্ছা, রাতেই দেখা যাবে।’

পুতুল সন্দিহান চোখে তাকাতেই চোখ টিপল সারাজ। অতঃপর মুখ ঘুরিয়ে জানলার বাইরে চাইল। ভ্যাবাচ্যাকা খেল পুতুল। মনে মনে ভাবল, “এই অসভ্য লোকটার মাথায় কী চলছে কে জানে?”

_________

পুতুলকে বেশ তোড়জোড় করে বরণ করা হলো। বসার ঘরে গিয়ে বসল তারা। আশপাশ থেকে আরো মানুষ এসেছে নতুন বউ দেখতে। পুতুলকে ড্যাবড্যাব করে দেখছে সবাই। এতক্ষণ ভালো লাগলেও এবার ভীষণ ক্লিষ্ট আর অস্বস্তি হচ্ছে। কতক্ষণে এসব শাড়ি গহনা খুলবে আপাতত সেই চিন্তাতেই বিভোর সে। রিতা এসে নতুন বউকে পুনরায় পরিচয় করিয়ে দিল সকলের সাথে। অতঃপর একটা মেয়েকে ডেকে বলল, পুতুলকে আপাতত গেস্ট রুমে নিয়ে যেতে। বাসর ঘর সাজানো এখনও শেষ হয়নি। শেষ হলেই খেয়ে দেয়ে তারা রুমে যাবে।

ভারি শাড়ি গহনা থেকে নিজেকে উন্মুক্ত করতেই মাত্রাধিক শান্তি অনুভূত হলো পুতুলের। গায়ে পুনরায় জড়াল একটা সুতি লাল রঙা শাড়ি। সে শাড়ি পরতে জানে না বিধায়, সেই অজ্ঞাত মেয়েটাই তাকে সাহায্য করেছে।
ভেজা কুন্তল বেয়ে ঝরঝরিয়ে পড়ছে বিন্দু বিন্দু অম্বু রাশি। আরশিতে নিজের প্রতিবিম্ব পরখ করতেই লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠল স্বীয় গন্ডস্থল। অক্ষিপটে সারাজের মুখাবয়ব প্রস্ফুটিত হতেই আরো বেশি লাজে কুন্ঠিত হয়ে পড়ল যেন। মনে পড়ল, আজ তো তাদের বাসর রাত। সারাজ তখন গাড়িতে যেভাবে বলল, তার কাছে এই রজনী দীর্ঘ প্রতীক্ষিত রজনী। এই রজনীতে পুতুলের কোনো মর্জিই গ্রাহ্য করা হবে না। একেবারেই না। আবারও লজ্জায় নুয়ে পড়ল সে। ঠোঁট কামড়ে হাসল। বিড়বিড় করে বলল,

‘অসভ্য সারাজ।’

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here