#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪৪।
পরদিন বেশ সকালেই বাড়ি ছাড়ল সারাজ। প্রথমেই সে গেল রাবীরের অফিসে। এত সকালে রাবীর তার অফিসে সারাজকে আশা করেনি। তবুও তাকে দেখে খুশি হয়েছে বেশ। সারাজ জামাই জামাই একটা ভাব নিয়ে গিয়ে রাবীরকে সালাম করে। রাবীরের খুশির মাত্রা এতে যেন আরো বৃদ্ধি পায়।
সারাজ চেয়ারে সোজা হয়ে বসে বলল,
‘বাবা, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
রাবীর বসল তার মুখোমুখি চেয়াটাতে। জিজ্ঞেস করল,
‘কী সিদ্ধান্ত?’
সারাজ একটু রয়ে সয়ে জবাবে বলে,
‘আমি দুইদিক একসাথে সামলাব। আব্বুর অফিস আর তোমার সভা দুটোই।’
চিন্তার ভাঁজ পড়ল রাবীরের প্রশ্বস্থ কপালে। টানটান কপালের চামড়া কুঁচকে এল। জিজ্ঞেস করল,
‘পারবি তুই? সাদরাজ নারাজ হবে না?’
‘না, হবেন না। আমি আব্বুকে সামলে নিব। তুমি শুধু আমাকে সাপোর্ট করো, তাহলেই হবে।’
রাবীর সহসা এক হাত নিয়ে ঠেকাল সারাজের কাঁধের উপর। আশ্বস্তের সুরে বলল,
‘আমি তোর পাশে আছি, বাবা।’
সারাজ নিশ্চিন্ত হলো। আরো কিছুক্ষণ রাবীরের অফিসে থেকে তারপর বেরিয়ে গেল সাদরাজের অফিসের উদ্দেশ্যে।
______
সকালের নাস্তা শেষ করেই পুতুল গেল রিতার রুমে। রিতা রুমে তখন আধশোয়া হয়ে বই পড়ছিল। পুতুল নিঃশব্দে তার শিউরে গিয়ে স্থান নিল। বলল,
‘মামনি, একটা কথা বলার ছিল?’
রিতা বইখানা বুকের উপর রেখে বলল,
‘বল, কী বলবি।’
‘আজকে একটু বাড়িতে যাই?’
‘বাড়িতে যাবি? যা।’
‘এখনই যাই?’
‘সারাজকে বলেছিস?’
‘না, উনি তো অফিসে। আসলে তুমি বলে দিও। আমি যাই এখন?’
‘আচ্ছা, আমি বলে দিব। তুই ড্রাইভারকে নিয়ে যাস।’
পুতুল হেসে বলল,
‘ঠিক আছে।’
নিজের রুমে এসে দ্রুত তৈরি হলো সে। অনেকগুলো দিন পর আবারও বাড়িতে যাচ্ছে, খুশি যেন আর ধরছে না তার। মায়ের জন্য আনা জিনিসপত্রগুলো একটা ব্যাগে পুরেই ছুট লাগাল।
বাড়ি পৌঁছাতে সময় নিল এক ঘন্টা। আধ ঘন্টার রাস্তা জ্যামের বদৌলতে এক ঘন্টা খুইয়েছে। গাড়ি মেইন গেইটের সামনে থামতেই দৌড়ে বাসার ভেতর প্রবেশ করল পুতুল। “মা মা” বলে চেঁচিয়ে দুনিয়া উদ্ধার করল যেন। রান্নাঘর থেকে একপ্রকার ছুটে বেরুত হলো মেহুলকে। বসার ঘরে এসে মেয়েকে দেখে খুশিতে দুহাত দুদিকে মেলে দিল। পুতুলও ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল তাকে। অনেকক্ষণ এভাবেই ছিল মা মেয়ে। এতদিন পর মেয়েকে বুকে জড়িয়ে চিত্তপটে প্রশান্তির স্রোত বইল মেহুলের। পুতুলেরও তাই। মা’কে টেনে নিয়ে বসাল সোফায়। তারপর সে তার ব্যাগ খুলে এক এক করে সব জিনিসপত্র বের করতে আরম্ভ করল। মেহুল অবাক হয়ে বলল,
‘এতকিছু এনেছিস কেন?’
‘এতকিছু কোথায় আনলাম? অল্প অল্প এনেছি সব। এখানে যা যা আছে সব তোমার আর মামনির জন্য ডাবল ডাবল আনা হয়েছে। কালারও সব এক কিন্তু, যাতে দুই বান্ধবীর মধ্যে কোনো ঝগড়া না হয়।’
মেহুল হেসে পুতুলের মাথায় চাটি মেরে বলল,
‘পাজি মেয়ে। তা, সারাজকে নিয়ে আসিসনি কেন?’
‘আর সারাজ! উনার কি এত সময় আছে? সকালে আমি ঘুম থেকে উঠার আগেই তো ফুড়ুৎ।’
‘দেখেছিস, আমার ছেলেটা কত প্ররিশ্রমী।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, অনেক।’
তারপর মা মেয়ের খোশগল্প জারি রইল আরো কিছুক্ষণ। এতদিন পর মা’কে পেয়ে পুতুল তার পেটের কথা সব উগলে বের করছে। মেহুলেরও যেন মনে হচ্ছে, আজ এই বাড়িতে ফের প্রাণ ফিরেছে। এতদিনের সেই নির্জীব গৃহ পুনরায় সতেজ হয়ে উঠেছে, পুতুলের আগমনে।
মধ্যাহ্নভোজ’টা আজ পুতুল মায়ের সাথেই সেরেছে। এর মাঝে তার রিতার সাথে একবার কথা হলেও, সারাজের সাথে আর কোনোরূপ যোগাযোগ হয়নি। এতদিন পর অফিসে গিয়ে সারাজ নিশ্চয়ই একটু বেশিই ব্যস্ত।
দুপুরের রোদ একটু প্রশমিত হতেই পুতুল লীনাকে কল দিয়ে তাদের বাড়ি আসতে বলে। লীনাও এক কথায় রাজি হয়ে যায়। এক ঘন্টার ব্যবধানেই বাড়িতে এসে হাজির হয় সে। পুতুলকে পেয়ে খুশিতে আপ্লুত যেন। পুতুল তাকে নিয়ে যায় বাড়ির ছাদে। একসাথে অনেক গল্প করে, লীনা আর মাহাতের প্রেমের কথাও শুনে। লীনা জানায়, তাদের প্রেম বেশ জমে উঠেছে। আরো জানায়, এই মাহাত ছেলেটা উপরে যতই ভোলাভালা হোক না কেন, ভেতরে ভেতরে সে মারাত্মক ফাজিল। এই কয়দিনে বেশ ভালোমতোই চেনা হয়ে গিয়েছে তাকে।
তাদের কথাবার্তার একপর্যায়ে লীনা বলে উঠে,
‘তোকে তো একটা কথা বলা হয়নি, পুতুল। আমি না তোকে না জানিয়েই একটা কাজ করে ফেলেছি।’
পুতুল সন্দিহান চোখে চেয়ে বলল,
‘কী কাজ?’
‘আসলে গত পরশু আমাদের ভার্সিটিতে একটা গানের রিয়েলিটি শো থেকে লোক এসেছিল, ভার্সিটিতে যারা গান গাইতে ইচ্ছুক তাদের একটা লিস্ট নিয়ে গিয়েছেন; অডিশনের জন্য। সেখানে আমি তোর নামটাও দিয়ে দিয়েছি। আগামী মাসের পাঁচ তারিখ অডিশন। আমাদের ভার্সিটিতেই হবে। তুই প্লিজ অংশগ্রহণ করিস।’
চোখ জোড়া গোল গোল করে চাইল পুতুল। কথাটা বিশ্বাসযোগ্য ঠেকল না। অতি মাত্রায় বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘কী বলছিস এসব?’
‘হ্যাঁ, দোস্ত। তুই তো ছিলি না, আর আমি তখন অনেকবার কলও দিয়েছিলাম তোকে। কলটাও তুই ধরিসনি। আর এত বড়ো একটা সুযোগ আমি কী করে হাতছাড়া হতে দিতাম, বল? তুই না সবসময় বলতি, গানটা তোর ভীষণ পছন্দের? তাই এখন যখন সুযোগ এসেছে, তখন সুযোগটাকে কাজে লাগা। আমাদের ভার্সিটির অনেকে নাম দিয়েছে। একবার অডিশনে টিকে গেলে জেলা পর্যায়ে যেতে তোকে আর কেউ আটকাতে পারবে না।’
পুতুল একপল ভেবে বলল,
‘কিন্তু, সারাজ যদি রাজি না হয়?’
‘হবে না মানে? অবশ্যই হবে। তুই আজই কথা বল ভাইয়ার সাথে।’
পুতুল চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘আচ্ছা।’
সন্ধ্যা পড়তেই লীনা আবার বাড়ি ফিরে গেল। পুতুল ছাদ ছেড়ে এল মায়ের রুমে। বাবা ফিরেছেন কিছুক্ষণ আগেই। বাবার জন্যও বেশকিছু জিনিস এনেছে সে। সেগুলো বাবাকে দিয়ে, সে গিয়ে বসল বিছানার এক কোণে। রাবীর আর মেহুল বিছানার অপর পাশে বসে কী নিয়ে যেন কথা বলছে। এর মাঝেই পুতুল বলে উঠল,
‘আমার একটা কথা বলার ছিল?’
রাবীর, মেহুল একসঙ্গেই তার মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করে। মেহুল জিজ্ঞেস করে,
‘কী কথা?’
পুতুল একটু সময় নিয়ে ভেবে বলল,
‘আসলে মা, লীনা একটা গানের কম্পিটিশনে আমার নাম দিয়ে দিয়েছে। আমি জানতাম না। আজকেই ও বলল। আগামী মাসের পাঁচ তারিখ নাকি অডিশন। এখন তোমরা কী বলো?’
মেহুল রাবীরের দিকে চাইল। রাবীর সবসময় তাকে বলত, পুতুল নাকি তার মতোই চমৎকার এক গানের গলা পেয়েছে। পুতুল যখন সুর টানত মেহুলের মস্তিষ্কে তখন তার গানের সময়গুলোর স্মৃতি বিচরণ চলতো। শাশুড়ির কথা রাখতে তার তো আর গান গাওয়া হলো না। এখন মেয়ের বেলাতেও এমন কিছু হোক, সে চায় না। তাই নির্লিপ্ত সুরে বলল,
‘অবশ্যই গান গাইবি তুই। মন প্রাণ দিয়ে গান গাইবি। আমার স্বপ্ন তুই পূরণ করবি। পারবি না, মা?’
পুতুল এতটাও সম্মতি আশা করেনি। খুশিতে অন্তর নেচে ওঠল। বলল,
‘অবশ্যই পারব, মা। কিন্তু, মামনি আর সারাজ কি রাজি হবেন?’
‘ওদের সাথে তুই কথা বল। আমার বিশ্বাস, ওরা রাজি হবে।’
_____
বাড়ি এক ভৃত্য তখন সেই রুমে এসে বললেন,
‘খালা, নিচে ছোট সাহেব আসছেন।’
“ছোট সাহেব” মানে সারাজ, সেটা সবাই জানে। তাই খালার সাথে সাথে মেহুল আর পুতুলও পা বাড়াল সিঁড়ির দিকে। মেহুল সারাজের কাছে গেলেও পুতুল ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল সিঁড়ির কোণে। মেহুলকে সারাজ সালাম করল। তারপর ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করল, অথচ পুতুল এক চুলও জায়গা ছেড়ে নড়ল না। কথা শেষ করে মেহুল পা বাড়াল রান্নাঘরে উদ্দেশ্যে, নাস্তা বানাতে। সারাজের তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টি ততক্ষণাৎ আপতিত হলো পুতুলের উপর। দুহাত পকেটে পুরে সে বুক টানটান করে দাঁড়াল। পুতুল ড্যাবড্যাব করে চেয়ে বোঝার চেষ্টা করছে, ‘সে কি রেগে আছে?’ কিন্তু সারাজের মুখ দেখে ক্লান্ত বৈ আর কিছুই মনে হচ্ছে না। সারাজ চিবিয়ে চিবিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘কাকে বলে এখানে এসেছিস?’
চলবে…..