শেষটা_সুন্দর(সিজন-২) #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৪৭।(অন্তিম পর্ব)

0
963

#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪৭।(অন্তিম পর্ব)

অডিশনের স্থান ভার্সিটি’ই হওয়াতে পুতুলের বেশ সুবিধা’ই হয়েছে। মা, মামনি, সাদরাজ আর সারাজ, রাবীর বাদে সবাই’ই এসেছে তার সাথে। রাবীর জরুরি মিটিং এ ব্যস্ত বলে আসতে পারেনি। আবার ভার্সিটিতেও আগে থেকেই লীনা আর মাহাত উপস্থিত। তাই সব প্রিয় মানুষকে একসাথে এত কাছে পেয়ে অনেকটাই সাহস সঞ্চিত হয়েছে তার মনে।
অডিশন দিতে আসা ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা দেখে চক্ষু চড়কগাছ পুতুলের। এত মানুষ আজ অডিশন দিবে? আর তার মধ্যে নেওয়া হবে মাত্র বিশ জনকে। ফের ভয়ের ছায়ায় ছেয়ে যায় পুতুলের অস্থির চিত্তপট। ভীত চোখে সারাজকে দেখে। সারাজ তাকে আশ্বাস দেয়। অনেক ভাবে বুঝিয়ে তাকে আশ্বস্ত করে। সবাই শুভ কামনা জানায়। আর দুজনের পরেই তার ডাক। পুতুল তাই চুপচাপ একটা চেয়ারে বসে নিজেকে তৈরি করছে। তার থেকে কিছুটা দূরেই একটা চেয়ারে বসে আছে মেহুল। অবাক চোখে মেয়েকে অবলোকন করছে। যেন মেয়ের মাঝে নিজেকেই দেখতে পাচ্ছে সে। অন্তস্থলে ভীষণ প্রশান্তি অনুভূত হয় তার। এই একটা দিন দেখার জন্য একদিন সেও ভীষণ আফসোস করেছিল কিন্তু, পারেনি। অবশেষে, তার মেয়ে পেরেছে। আজ মনে হচ্ছে, তার মেয়ে যেন তারই স্বপ্ন পূরণ করতে যাচ্ছে। এই স্বপ্ন পুতুলের একার না, এর অংশীদার মেহুলও।

অবশেষে সেই দীর্ঘ প্রতীক্ষার ক্ষণ পুতুলের অতি সন্নিকটে এসে হাজির হয়েছে। ডাক পড়েছে পুতুলের। সে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। প্রথমেই যায় মেহুলের কাছে। মেহুল আলতো ঠোঁট ছোঁয়ায় তার ললাটে। একে একে রিতা, সাদরাজ, সারাজ সবার সাথে সাক্ষাৎ করে ভেতরের কক্ষে যায় সে। তার ভার্সিটির এই পরিচিত বিশাল অডিটরিয়ামে এসে আজ সে অদ্ভুত ভাবে ঘামছে। হাত যুগলও কেঁপে যাচ্ছে অনবরত। সামনে থাকা বিচারকমন্ডলী বেশ হেসে হেসে কথা বললেও ভীতু পুতুল স্বাভাবিক হতে পারছে না। তার মধ্যেই একজন বিচারক বললেন,

‘তুমি তো মন্ত্রী রাবীর খানের মেয়ে, আগে পরিচয় দাওনি কেন? তাহলে তোমার অডিশনটা আমরা আগে নিতাম।’

পুতুল প্রসন্ন হাসল। বলল,

‘না না, মন্ত্রীর মেয়ে বলে আগে কেন দিব? আমার বাবা সবসময়ই আমাকে মন্ত্রীর মেয়ে হিসেবে আলাদা সুবিধা নিতে বারণ করে এসেছেন। বরং তিনি আমাকে আর পাঁচটার সাধারণ মেয়ের মতোই বেঁচে থাকার সীক্ষা দিয়েছেন।’

উত্তর পেয়ে অভিভূত হলেন বিচারকমন্ডলী। জিজ্ঞেস করলেন,

‘বাহ, শুনে খুশি হলাম। তা তুমি আজ কী গান গাইছো?’

‘রবীন্দ্র সঙ্গীত, আমার পরান যাহা চায়।’

‘ঠিক আছে, শুরু করো তবে।’

পুতুল কয়েক দফা ক্ষুদ্র নিশ্বাস ছাড়ল। এখানে মাইক দিয়ে গাইতে হবে না। গাইতে হবে খালি গলায়। সমস্ত ভয়কে একসাথে জড়ো করে বক্ষঃস্থলের ক্ষুদ্র এক কোটরে জমিয়ে রাখল পুতুল। এখন গাইতে হবে। সমস্ত ভয়, অস্বস্তি দূর করে কেবল গাইতে হবে। শেষ বারের মতো আরো একবার তপ্ত শ্বাস নির্গমন করে সে অতঃপর, তুলে সুর,

“আমার পরান যাহা চায়
তুমি তাই, তুমি তাই গো
আমার পরান যাহা চায়
তোমা ছাড়া আর এ জগতে
মোর কেহ নাই, কিছু নাই গো
আমার পরান যাহা চায়
তুমি তাই, তুমি তাই গো
আমার পরান যাহা চায়
তুমি সুখ যদি নাহি পাও, যাও সুখের সন্ধানে যাও
তুমি সুখ যদি নাহি পাও, যাও সুখের সন্ধানে যাও
আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়মাঝে
আর কিছু নাহি চায় গো
আমার পরান যাহা চায়
তুমি তাই, তুমি তাই গো
আমার পরান যাহা চায়….”

পুরো গান গেয়ে ক্ষান্ত হয় পুতুল। ভীত সন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে অবলোকন করে বিচারকদের। বিচারকদের মুখের ভাবভঙ্গি সুবিধার ঠেকছে না যেন। ঢোক গিলে সে। বক্ষঃস্থল কোটর বন্ধী সমস্ত ভয় ফের একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে সমস্ত শরীরে। এবার হাতের সাথে পা যুগলও কাঁপছে। দুজন পুরুষ এবং একজন মহিলা বিচারক। তার মধ্যে মহিলা বিচারক গম্ভীর সুরে বলে উঠলেন,

‘গান শেখো তুমি?’

পুতুল ক্ষীণ সুরে বলে,

‘প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। যতটুকু শিখেছি, মায়ের কাছ থেকে।’

‘তোমার মাও গান করেন?’

‘গান করতে ভালোবাসতেন তবে, পারিবারিক কারণবশত সেটা ছাড়তে হয়েছিল।’

বিচারকমন্ডলী নিজেদের মধ্যে খানিক কথা চালালেন। ভয়ে জড়ো সড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পুতুল। হৃদপিন্ডের ধপাস ধপাস কম্পনের শব্দ যেন বাইরে থেকেও টের পাচ্ছে সে। অল্প সময়ের আলোচনার পর আবারও সেই মহিলা বিচারক বলে উঠলেন,

‘কি মনে হয়, “ইয়েস কার্ড” পাওয়ার যোগ্য তুমি?’

পুতুল ফের স্মিত আওয়াজে বলে,

‘নিজের উপর আত্মবিশ্বাস আছে। তবে সবসময় ভাগ্য সহায় নাও হতে পারে।’

হাসলেন তিনি। বললেন,

‘এবার মনে হচ্ছে ভাগ্য তোমার সহায় আছে। এদিকে এসো।’

পুতুল স্তব্ধ হয়। প্রথমে ঠিক বোধগম্য হয় না ব্যাপারটা। তাও ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে যায় তাঁদের দিকে। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে কেবল। সেই মহিলা বিচারক উঠে একটা কার্ড নিয়ে গলায় ঝুলিয়ে দেয় তার। পুতুল এখনও হতভম্ব। কার্ডটা হাতে নিয়ে অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে আছে। মহিলা বিচারক বললেন,

‘ইউ আর সিলেক্টেড, পুতুল।’

পুতুল বিমূর্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রয়। এইটুকু একটা ব্যাপারেও মাত্রাধিক বিস্ময়াবিষ্ট সে। বিচারকদের কোনোরকমে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে আসে। বাইরে বের হতেই তার গলার কার্ডটা প্রখর গতিতে গিয়ে বারি খায় সকলের দৃষ্টিকোণে। মেহুল অতিরিক্ত অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘তুই কি “ইয়েস কার্ড” পেয়েছিস, পুতুল?’

পুতুল খুশিতে কেঁদে ফেলে। বলে,

‘হ-হ্যাঁ মা, আমি “ইয়েস কার্ড” পেয়েছি। এই যে দেখো।’

বলেই সে কার্ডটা খুলে মেহুলকে দেখায়। মেহুল নিমিষ চেয়ে থাকে। সাদরাজ রিতা এসে জড়িয়ে ধরে তাকে অভিনন্দন জানায়। সারাজের খুশির মাত্রাও আকাশচুম্বী। পুতুলকে আগলে ধরে আপ্লুত সুরে বলে উঠে,

‘আমি জানতাম, তুই পারবি।’

রিতা আর মাহাতের খুশিরও অন্ত নেই। পুতুল তড়িৎ গতিতে রাবীরকে কল দিয়ে জানায় সবটা। প্রচন্ড খুশি নিয়ে রাবীর বলে,

‘আমি এক্ষুনি আসছি, মা।’

মেহুল কার্ডটা হাতে নিয়ে নির্নিমেষ কেবল চেয়ে আছে। পুতুল তার কাছে এগিয়ে যায়। জিজ্ঞেস করে,

‘কী দেখছ, মা?’

মেহুল চোখ তুলে তাকায়। বলে,

‘জানিস, আজ তুই তোর স্বপ্ন না, আমার স্বপ্ন পূরনের পথে একধাপ এগিয়েছিস। আমি দোয়া করি মা, একদিন তুই এই স্বপ্নের চূড়ান্ত পর্যায়ে যেন পৌঁছাতে পারিস। আর আল্লাহ যেন, সেই দৃশ্য দেখা না অবধি আমার মৃত্যু না দেয়।’

পুতুল চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে। ভগ্ন সুরে বলে উঠে,

‘এসব কী বলছো, মা? তুমি আমার সব স্বপ্ন পূরণের একমাত্র পাথেয় হবে। আমাকে ছেড়ে কোথাও যাওয়ার কথা কখনো কল্পনাও করবে না।’

পুতুলকে জড়িয়ে ধরে মেহুল। সিক্ত সুরে বলে,

‘না চাইলেও যেতে হয়। তবে যতদিন থাকব, তোকে আগলে ধরেই বাঁচব। তুই আমার বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল। আমার ভালোবাসা, আমার মেয়ে, আমার পুতুল।’

পুতুল কেঁদে ফেলে। বলে,

‘আর তুমি আমার মা, মা, মা। আমার একমাত্র পরিচয়।’

রিতা তখন কপাল কুঁচকে বলে উঠে,

‘এই এই, তোদের মা মেয়ের ভালোবাসা বন্ধ কর। একটা চমৎকার খবর এসেছে, কই একটু ট্রিট ফিট দিবি; তা না, এখানে কান্নাকাটি শুরু হয়েছে।’

মেহুল হেসে ফেলে। বলে,

‘এই ট্রিটের কথা তুই কখনোই ভুলবি না।’

‘অবশ্যই না। আর আজকে ট্রিট তুই দিবি।’

মেহুল বলে,

‘ঠিক আছে। আমিই দিব।’

সবাই ছুটল ট্রিটের উৎসবে মাততে। রাবীরকেও কল দিয়ে সেখানে আসতে বলা হলো। একটা পুরো দিন কাটাল তারা হৈ হুল্লোড় করে।

দুপুর গড়িয়ে বিকেলের আবির্ভাব। সবাই একসাথে বাড়ি ফিরছে। তবে তাদের বাহন আলাদা। সারাজ ড্রাইভ করছে, তার পাশেই পুতুল। চোখে মুখে একরাশ স্বপ্নের হাতছানি তার। সারাজ বারংবার দেখছে তাকে। পুতুল সেই দৃষ্টি খেয়াল করে বলে উঠে,

‘আমাকে এত দেখলে, এক্সিডেন্ট হবে তো।’

‘হোক।’

সারাজের এমন দায়সাড়া ভাব দেখে চকিত হয়ে তাকে দেখে পুতুল। বলে,

‘হোক মানে? এক্সিডেন্ট হলে কী হবে বুঝতে পারছো?’

‘কী হবে?’

‘আমরা দুজন মা রা পড়ব?’

পুতুলের দিকে তাকায় সারাজ। জিজ্ঞেস করে,

‘আমার সাথে ম রতে অসুবিধা আছে?’

সিটে হেলান দেয় পুতুল। ঘাড় কাত করে তাকায় তার প্রাণেশ্বরের দিকে। মৃদু আওয়াজে বলে,

‘আমি তোমার সাথেও মরতে চাই না, আবার তোমার অনুপস্থিতিও চাই না। আমি চাই, তোমার উপস্থিতিতে, তোমার সম্মুখে, তোমার অতি নিকটে শুয়ে মৃত্যুকে বরণ করতে। আমি চাই, তুমি আমার মৃত্যু দেখো। আমি চাই, আমার মৃত্যুর সময় আমার কানে শেষ কালেমা’টা তুমি পড়ো। আমি চাই, আমার মৃত্যুর পর তুমি আজীবন আমার স্মৃতি নিয়েই বাঁচো। বিয়ের করার অনুমতি আমি তোমায় দেব না। ম রে গেলেও তোমার ভাগ আমি সহ্য করতে পারব না। তুমি কেবল একান্তই আমার, বুঝেছো?’

সারাজ ততক্ষণাৎ ব্রেক কষে। ক্ষুব্ধ হয়ে তাকায় পুতুলের হাস্যজ্জ্বল মুখপানে। ক্রোধ নিয়ে বলে,

‘থাপ্পড় খেতে চাস, পুতুল? আর কখনো যদি তোর মুখে এসব শুনেছি তবে, খুব খারাপ হয়ে যাবে। সাবধান করছি।’

পুতুল খিলখিল করে হাসে যেন, সারাজ তাকে দারুণ এক মজার কথা বলেছে। ভ্রু কুঁচকায় সারাজ। জিজ্ঞেস করে,

‘হাসছিস কেন?’

হাসি থামিয়ে সে জিজ্ঞেস করে,

‘আমায় কতটা ভালোবাসো, সারাজ?’

সারাজ থমকায়। প্রশ্ন ছুড়ে,

‘ভালোবাসা মাপার নিক্তি আছে?’

পুতুল ঠোঁট উল্টে মাথা নাড়িয়ে “না” বোঝায়। সারাজ তখন ফের জিজ্ঞেস করে,

‘তাহলে মাপব কী দিয়ে?’

‘না মেপে কি বলা যায় না?’

এক পল কী যেন ভাবে সারাজ। অতঃপর বলে,

‘শোন তবে, তুই আমাকে যতটুকু ভালোবাসিস তার থেকে এক চিমটি বেশি আমি তোকে ভালোবাসি। এবার তুই হিসাব-নিকাশ করে আমার ভালোবাসার পরিমাণ বের করেনে।’

সারাজের কথা শুনে হাসে পুতুল। জিজ্ঞেস করে,

‘আমাদের গল্পের শেষটা সুন্দর হবে তো, সারাজ?’

সারাজ ঠোঁট প্রসারিত করে চমৎকার এক হাসি দিয়ে বলে উঠে,

‘অবশ্যই হবে।’

সমাপ্ত।

(আজকে শেষ পর্ব দিব বলেই কালকে গল্প দেইনি। শেষটা পছন্দ হয়েছে তো? আর আমি কিন্তু তাড়াতাড়ি শেষ করিনি, ওদের নিয়ে যতটুকু ভেবেছি, ঠিক ততটুকুই লিখেছি। আর এই গল্পটা নিত্যান্তই একটা প্রেমের গল্প ছিল। তাই এতে আহামরি কোনো টুইস্ট বা রহস্য রাখিনি। অনেকে আবার জিজ্ঞেস করেছেন, পুতুলের আসল মা বাবা আসবেন কিনা। না, পুতুলের আসল মা বাবাকে এখানে আনলে অযথা গল্পটা বড়ো হতো, কাহিনী বাড়তো। আর আমি কাহিনী বাড়াতে চাইনি। একটা ছোট্ট সুন্দর প্রেমকাব্য উপহার দিতে চেয়েছি, কতটুকু পেরেছি জানা নেই। তবে আশা করছি, একটু হলেও ভালো লেগেছে। এতদিন অবধি পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ। পরবর্তীতে আবারও নতুন কোনো গল্পের সাথে দেখা হবে। ততদিন অবধি ভালো থাকবেন সবাই। আসসালামু আলাইকুম।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here