শেষটা_সুন্দর #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৬৩।

0
546

#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৬৩।

ঈদের দিন খুব সকালে মেহুলের খুব ভাঙে। চোখ মেলে তাকাতেই দেখে, বাইরে ফকফকা সকাল। চারদিক কেমন যেন ঝলমল করছে। যেন প্রকৃতিও বুঝেছে, আজ ঈদ। সে পাশে ফিরতেই দেখে, রাবীর নেই। ওয়াশরুম থেকে পানির শব্দ পেতেই সে বুঝতে পারল, রাবীর সেখানেই। আলগোছে উঠে দাঁড়াল সে। বড়ো করে হাই তুলে হাত নিচের দিকে আনতেই চোখ পড়ল, হাতের উল্টো পৃষ্ঠে। মেহেদি দিত না। তবে, রাবীর খুব জোর করেছে বিধেয় ছোট্ট একটা ডিজাইন করে, মাঝখানে রাবীরের নাম লিখেছে। সেই মেহেদি রাখা হাতটা দেখে মেহুল তপ্ত শ্বাস ছাড়ে। পরে বিছানা ঝেরে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়।

খান বাড়ির এইদিকটাই খুব একটা শোরগোল নেই। দিনের অর্ধেকটা সময়ই কাটে নিরবতায়। তবে বিকেলের দিকে এইদিকে মানুষ হাঁটতে আসে। ঐ পাশের রাস্তাটা আবার ভীষণ পরিষ্কার। দু ধারে নারকেল গাছ সটান দাঁড়ান। বেশ ছায়াযুক্ত একটা জায়গা। বিকেলের দিকটায় হাঁটার জন্য সুন্দর একটা পরিবেশ বটে।

এসবের মাঝেই, ওয়াশরুমের দরজায় খট করে শব্দ হয়। মেহুল সতর্ক হয়ে পেছন ফিরে। রাবীর বেরিয়েছে। তোয়ালে দিয়ে চুল মুছছে। এক পলক মেহুলের দিকে চেয়ে মুচকি হেসে বলে,

‘ঈদ মোবারক, মিসেস খান।’

মেহুল খরখরে শুকনো ঠোঁট ছড়িয়ে হাসে। বলে,

‘ঈদ মোবারক।’

রাবীর তোয়ালেটা বারান্দায় এসে রাখে। জিজ্ঞেস করে,

‘গোসল করবেন এখন?’

‘না, আপনি নামাজে যাওয়ার পর করব। এখন ফ্রেশ হয়ে নিচে গিয়ে আগে আপনাদের জন্য নবাবী সেমাই বানাব। খেয়ে যাবেন।’

রাবীর হেসে জবাবে বলে,

‘অবশ্যই।’

মেহুল কথা না বাড়িয়ে চলে যায় ফ্রেশ হতে।

_______________

মিষ্টি জাতীয় জিনিস রিতার খুব একটা পছন না হলেও, এই সেমাই জিনিসটা তার বড্ড পছন্দের। অথচ, আজ এই জিনিসটাকেই সে মুখের কাছে নিতে পারছে না। কাল খালাকে বেশ শখ করে বলেছিল,

‘খালা, কাল আমাকে একটু বেশি করে দুধ দিয়ে সেমাই করে দিবে?’

খালাও বিনাবাক্যে রাজি হোন। অথচ মেয়েটা আজ সেই সেমাই মুখেই তুলতে পারছে না। গন্ধ পেয়েই নাক চেপে ধরে বসে আছে। ওর এমন কান্ডে সাদরাজ অধৈর্য হয়ে বলে,

‘তাহলে তুমি কী খাবে? নুডুলস করব? নাকি বাইরে থেকে কিছু আনব?’

রিতা হাঁসফাঁস করে। কী খাবে? কোনো খাবারই তো এখন গলা দিয়ে নামে না তার। কাছে নিলেই, বমি আসে। সে চোখ পিটপিট করে এদিক ওদিক তাকায়। হুট করে প্রশ্ন করে,

‘আপনি নামাজে যাবেন না?’

‘হ্যাঁ, এখন বের হব। কিন্তু, তার আগে তো তোমার খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। কী খাবে, বলো?’

সাদরাজ বরাবরের মতোই অস্থির। বাবা হওয়ার কথা শুনে, ছেলেটা আর একটুও স্থির হতে পারছে না। কী করবে, কী না করবে, সেটাই বুঝে উঠতে পারে না সে। রিতাকে পারলে সারাক্ষণ বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখত বোধ হয়। মেয়েটার একটু অসচেতনতা তাকে ভীত করে তুলে।

রিতা পাতলা অধর ছড়িয়ে আলতো হাসে। বলে,

‘আমাকে নিয়ে ভাববেন না। খালা তো কত কিছু বানিয়েছেন। কিছু একটা ঠিক খেয়ে নিব। আপনি বরং ঐ খয়েরী পাঞ্জাবীটা পরে নামাজে যান। ঐ রংটায় আপনাকে খুব মানায়।’

রিতার এমন দায়সাড়া ভাব দেখে, সাদরাজের চিন্তা বিস্তর হয়। মেয়েটাকে কী করে বোঝাবে, সারাক্ষণ যে সে কী পরিমাণ দুশ্চিন্তায় থাকে তাকে নিয়ে। অথচ, এই মেয়ে সর্বদা স্বাভাবিক। কোনো কিছুতেই যেন কোনো কিছু আসে যায় না তার।

সাদরাজ উঠে দাঁড়ায়। খালাকে ডেকে বলে,

‘খালা, এক বাটি চিকেন স্যুপ করে নিয়ে এসো। আমি এটা ওকে খাইয়ে তবে নামাজে যাব।’

সাদরাজের কথা শুনে রিতা কপাল চাপড়ে বলে, ‘এই মানুষটা তার চিন্তায় চিন্তায় কবে যে পাগল হয়ে যায়, কে জানে!’

____________

আজ অনেকদিন পর, সাদরাজ আবার রাবীরের মায়ের মুখোমুখি হয়েছে। এতে ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে তার। উপর দিয়ে হেসে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলেও, ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড হাঁসফাঁস করছে। সেই সময়টাই এই মানুষটাকেও কত কিছু বলেছিল সে। আজ কি উনি তাকে ক্ষমা করবেন?

সংশয় নিয়ে নিজেকে শুধায়, উত্তর পায় না। তবে, রাবীরের মা ভীষণ ধাতস্ত ভাব ভঙ্গি নিয়ে তাদের সাথে কথা বলছেন। এমন একটা ভাব, যেন কিছুই হয়নি। রিতার প্রেগন্যান্ট এর খবরে মারাত্মক খুশি তিনি। ইনিয়ে বিনিয়ে বলার চেষ্টা করছেন, তিনিও এই বাড়িতে এমন খুশির খবর চান। মেহুল রাবীর দুজনেই বুঝতে পারে ব্যপারটা। মা’কে কিছু জানানো হয়নি। রাবীর’ই বারণ করেছে; বলেছে সে নিজে সময় হলে কথা বলবে। মেহুল তো ভাবছে, সব শুনে এই ভদ্র মহিলা কেমন প্রতিক্রিয়া করবেন। বিয়ের পর থেকেই তো উনি নাতি নাতনি বলে চেঁচিয়ে মরছেন। এখন এই বিদঘুটে সত্যটা তিনি মেনে নিতে পারবেন তো?

__________

নাস্তার ছোট্ট পর্ব চুকিয়ে রিতা মেহুলের সাথে সাথে তার রুমে যায়। রাবীর আর সাদরাজ নিচে বসেই আড্ডাতে মগ্ন। তার শাশুড়ি মা উঠে গেছেন অনেক আগে।
মেহুল রুমে এসে রিতাকে বিছানায় বসতে বলল। তারপর সে গিয়ে আলমারি খুলে একটা ফাইল বের করে এনে বলল,

‘এটা দেখ।’

রিতা ফাইলটার আপাদমস্তক দেখে শুধাল,

‘কী এটা?’

মেহুল বস্তটা নাড়িয়ে চাড়িয়ে চাপা স্বরে বলল,

‘সেদিন ডাক্তারের দেওয়া টেস্ট গুলো আমি করিয়ে ছিলাম।’

একটু থেমে শ্বাস ফেলে বলে,

‘তবে, রিপোর্ট ভালো আসেনি। আমার জরায়ুতে সমস্যা। ডাক্তার বলেছেন, আমি কখনো মা হতে পারব না।’

মেহুল যতটা স্বাভাবিক থেকে কথাটা তাকে বলল, রিতা ঠিক ততটাই অস্বাভাবিক ভাবে আঁতকে উঠল। কন্ঠনালী আটকে গেছে। কথা বের হচ্ছে না। এটা কীভাবে সম্ভব? এত বড়ো একটা ধাক্কা, মেয়েটা কী করে সামলাচ্ছে? রিতার চোখ ভিজে উঠে। কম্পিত গলায় বলে,

‘তুই আমাকে আগে কেন বলিসনি এসব?’

মেহুল অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় বলে,

‘আজও বলতাম না। নেহাতই তখন আমার শাশুড়ি মায়ের সামনে খুব বড়ো মুখ করে বলছিলি, তিনিও খুব তাড়াতাড়ি খুশির সংবাদ শুনবেন; তাই তোকে বলে রেখেছি। নয়তো এই সময় তোকে আর কোনো আলাদা দুশ্চিন্তা দিতে চাইছিলাম না।’

মেহুলের কথা রিতা গ্রাহ্য করল না। খড়খড়ে গলায় বলল,

‘তাই বলে, এত বড়ো একটা কথা তুই লুকিয়ে গেলি?’

মেহুল মাথা নুইয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। পরে ওর দিকে চেয়ে চমৎকার হেসে বলে,

‘আমার এই ড্রেসটা কেমন হয়েছে, বলতো? রাবীর নিজে পছন্দ করে নিয়ে এসেছেন। এবার আর আমি শপিং এ যাইনি। কেন যেন ইচ্ছেই করছিল না।’

রিতা বেশ বুঝতে পারছে, মেহুল যে কথা ঘুরাচ্ছে। তাই সে চোখ পাকিয়ে বলল,

‘একদম কথা ঘুরাবি না। আমি বুঝি তোর এতই পর হয়ে গেছি যে, এখন তুই আমাকে কিছুই বলিস না। ঐদিকে আমি অসুস্থ বলে, ঠিক মতো তোর খবরই নিতে পারিনি। তাই বলে, তুই আমাকে কিছু বলবিও না।’

মেহুল নিরব। একটু রাগ করুক না, তাতে কী হবে। মেয়েটা তো তাকে ভালোবাসে। তার অধিকার আছে, তার উপর রাগ দেখানোর। রিতা বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলে শান্ত হয়। মেহুলের কুন্ঠিত মুখপানে চেয়ে দরদমাখা কন্ঠে শুধায়,

‘কষ্ট পাচ্ছিস?’

মেহুল ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে হাসে। বলে,

‘একটুও না।’

‘রাবীর ভাইয়া জানে সব?’

‘হ্যাঁ।’

‘কী বলেছেন?’

‘বলেছেন, উনার বাচ্চা চাই না। আমি হলেই চলবে।’

শেষের কথা বলতে গিয়ে আত্মতৃপ্তিতে বুক ভরে উঠে তার। কথাটা শুনে রিতাও ভীষণ খুশি হয়। আশ্বস্ত হয়ে বলে,

‘ভাগ্য করে এমন একটা মানুষ পেয়েছিস। কখনো ছেড়ে যাস না।’

মেহুল মাথা নাড়িয়ে বলে,

‘উঁহু, জীবনের শেষ নিঃশ্বাস অবধি উনাকে আকড়ে ধরেই বেঁচে থাকব।’

পরে সে আলতো করে রিতার পেটের উপর হাত রাখে। অক্ষি কোটরে জল জমে ততক্ষণাৎ। ফিনফিনে স্বরে বলে,

‘তোর ছেলের সাথে আমার মেয়ের আর বিয়ে দেওয়া হলো নারে। ওর জন্য তুই অন্য কোথাও বউ দেখিস।’

কথাটা শেষ করতে জল যেন ঝাপিয়ে পড়ল গালের উপর। মেহুল ব্যস্ত ভঙিতে হাত নাড়িয়ে জল মুছল। মেহুলের এমন হাহাকার দেখে, বুকে ফেটে কান্না আসছে রিতার। কেন সব পরীক্ষা কেবল মেহুলের মতো ভালো মানুষগুলোকেই দিতে হয়?

রিতা মেহুলের গালে হাত রেখে শক্ত গলায় বলে,

‘তোর মেয়েকেই আমি আমার ছেলের বউ বানাব। নয়তো, ছেলের বিয়েই দিব না। একেবারে কনফার্ম।’

রিতার এমন জেদ দেখানো কথা শুনে মেহুল হেসে ফেলে। মনে মনে ভাবে,

‘তাদের স্বপ্নটা বুঝি স্বপ্ন’ই রয়ে গেল।’

চলবে …

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here