#মুঠোভরা_চোরাবালি
#আলিশা_আঞ্জুম
#পর্ব_১৬
মৃদু মৃদু করে আশায় বুক বাঁধলো কাব্য। ফাইজাদের বাড়িতে দশদিন থাকার পর আজ সে ছুটলো ঢাকার পথে। শীঘ্রই ফিরবে। পরশু বা তার পরদিন। মাকে সাথে নিয়ে। পাত্র হয়ে দেখতে আসবে সে ফাইজাকে।
.
তাসরিফের বিয়ের দিন তারিখ পাকা। দু’দিন পর বিয়ে। তাসলিমা বড্ড খুশি। তাসরিফ গায়ে হাওয়া লাগিয়ে দিন কাটাচ্ছে। বিয়ে নিয়ে তার বিশেষ কোনো মাথা ব্যাথার লেশমাত্র নেই। এনিয়ে একটু ভেবে পরক্ষনেই তাসলিমা প্রফুল্লচিত্তে ফেরেন। বিয়ে তো করছে তাসরিফ!
ফাইজা জানতো না ওবাড়ির ধুমধামের জোয়ার সম্পর্কে। কাব্যর অপ্রকাশ্য ভালোবাসা সম্পর্কেও তার ধারণা শূন্য। সাদ সেদিন বলল আরুর বিয়ে। পাত্র দ্বিতীয় বিয়ে করছে। প্রথম বউয়ের সাথে কোনো এক কারণে ছেলের বিচ্ছেদ হয়েছে। আরুর মা বাবা রাজি। কারণ তাদের মেয়ের নামে রটানো আছে এক কুৎসা। ফাইজার হাত পা অবশ হয়ে গিয়েছিল এহেন খবর শুনে। তাসরিফ অবশেষে বিয়ে করছে! সত্যিই বিয়ে করবে?
.
সত্যি কিনা মিথ্যা সে কথা একমাত্র সুপ্ত রইলো তাসরিফের অন্তরে। ঘটা করে আয়োজন করা হলো না। মাত্র দশজন মানুষ নিয়ে একপক্ষ হতে তাসরিফ রওনা হলো আজ স্নেহাদের বাড়ির পথে। ফুলে সজ্জিত গাড়ি, বউয়ের আপাদমস্তক সাজিয়ে ফেলার মতো অহরহ অলঙ্কার, বিষয়সামগ্রী। ওবাড়িতে আলোর ঝলক। আত্নীয়দের কমতি নেই। স্নেহা প্রফুল্লচিত্তে হাতে মেহেদী পরেছে। বউ সেজেছে তাসরিফের আনা অলঙ্কার ও লেহেঙ্গায়। তার বড় শখ ছিলো বিয়েতে লেহেঙ্গা পড়া। ফাইজার বুকটা ভেঙে গুড়িয়ে গেলো। শেষ বরের মতো তাসরিফের জন্য হৃদয় পুড়লো, আর পুড়বে না কখনো, ফাইজা পুড়তে দেবে না কথাগুলো সকাল সন্ধ্যা জপ করেও আজ ছুটে এসেছে নিজ চোখে তাসরিফের পদার্পণ দেখতে। সত্যি তবে তসরিফ আসলো! ঘিরে রঙের শেরওয়ানি পরে। স্নেহা সাজলো লাল খয়েরী লেহেঙ্গা পরে। আড়াল হয়ে ছলছল চোখ নিয়ে সব পর্যবেক্ষণ করে ফাইজা হঠাৎ বেরিয়ে পরলো বিয়ে বাড়ি হতে। কালো বোরকা তার গায়ে। মুখ আঁটসাঁট করে আটকে রাখা। মাথার ওপর থেকে আরো একটা ফিনফিনে কালো পর্দা ফেলে রাখা ছিলো। কাকপক্ষিও চিনবে না তাকে। সবকলে ডিঙিয়ে উদভ্রান্তের মতো ছুটে ফাইজা চলে এলো অজানা দিকে। হনহন করে হাঁটতে হাঁটতে সে হঠাৎ আপন গলা চেপে ধরলো। মুখ চেপে আটকাইতে চাইলো চিৎকার করে আসা কান্না। বিশাল এক ব্রিজের ওপর এসে ফাইজা হাঁটার গতি রোধ করলো। দৃষ্টি অলক্ষ্যে স্থান নিলো ব্রিজের নিচে৷ ইচ্ছেরা ডাকছে তাকে নিচ হতে। ঝাপ দিয়ে ঝট করে সকল দুঃখ স্তব্ধ করার বাসনা হচ্ছে। ফাইজা বিশৃঙ্খল চিন্তা নিয়ে একবার ঝাপ দেওয়ার জন্য উদ্যত হতেই হঠাৎ স্মরণে এলো সে আত্মকে হত্যা করছে। এ যে মহাপাপ! মুহূর্তেই ফাইজা স্তব্ধ হলো। তবে ঝাপিয়ে পরলো তার মনে কান্না। বিরতিহীন ছুটে চলা বাস ট্রাকের মাঝে ছুটে চলেছিল তখন একটা প্রাইভেট কার। ছলকে পরা হাসি নিয়ে মাকে পাশে রেখে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলো যুবক চিত্তহারীর নিকট। বাবার সনে এক প্রহরের মনোমালিন্য শেষ করে মা’কে নিয়ে তার ছুটে আসা। পথিমধ্যে হঠাৎ থমকে যায় তার গাড়ির গতি। স্তব্ধ হয়ে সে তড়বড় করে নেমে আসে কান্নায় ভেঙে পরা ফাইজার নিকট। ফাইজা চমকে চোখের পানি হাতের পিঠে স্থান দেয়। কাব্য অন্তরে অস্থিরতা রেখে জানতে চায়
— ফাইজা? তুমি এভাবে এখানে? কি হয়েছে?
আটকে রাখতে চাওয়া কান্না যেন সর্বনাশা যমুনা হয়। বাঁধ ভেঙে নদী যেমন বিস্তার ঘটায় নিজের তেমন করে বেগ বাড়ায় ফাইজার কান্না। কাব্যর মা আগলে নেয় ফাইজাকে হাতের বাহুতে। ফাইজা মুখ ফুটে বলে না কিছু। কাব্য শুধালো বারংবার। ফাইজা অদম্য কান্নার সাথে পেরে উঠতে পারলো না। কাব্যর মা কোহিনুর যখন শুধালেন
— কি হয়েছে মা? মামি কে কি মা মনে করে বলা যাবে না?
ফাইজা পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে চাইলো সুন্দরী মহিলার পানে। আগে কখনো দেখেনি। উনি না বললে জানাও হতো না সে সম্পর্কে মামি। ফাইজা বলে উঠলো এবার
— আমার একটা গোপন দুঃখ আছে মামি। আমার সংসার আজ ভেঙে যাচ্ছে। আমার সংসারে অন্য কেউ জায়গা করছে। আমার ম*রে যাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে।
মেঘ, বৃষ্টি ছাড়া যেন আকাশ থেকে বাজ পরলো। কোহিনুর সরু চোখে চাইলেন কাব্যর পানে। মাথা ঝিম ঝিম করে উঠলো তখন কাব্যর। মনে হলো এই বুঝি সে অচেতন হয়ে পরবে। হৃদপিণ্ড কামড়ে ধরলো কেউ। কোহিনূরের হাতের বাঁধন ঢিমা হলো। কাব্য নিজেকে সামলে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে বলল
— আজ তোমার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করছে? তুমি আটকালে না? এভাবে ভালোবাসার মানুষ অন্যের করে দিচ্ছো? চেষ্টা করবে না আটকানোর?
ফাইজার হঠাৎ কিনা কি মনে হলো তা ঠাহর করা দুঃসাধ্য। হঠাৎই ফাইজা ছুটতে লাগলো উল্টো পথে। আবারও স্নিগ্ধাদের বাড়ির দিকে। কাব্য যেন ফাইজার সাথে এক রশিতে বাঁধা ছিলো। সেও ছুটলো ফাইজার পিছু পিছু। কোহিনূর ঠাঁই দাড়িয়ে রইলেন। এই ছিলো তবে তার উড়নচণ্ডে ছেলের কপালে? ফাইজা কি পোষ মানবে? কাব্য কি তবে প্রথম দিনের মতো সিট ফাঁকা থাকা ট্রেনের ঝুলন্ত যাত্রীই রয়ে যাবে? ফাইজার রাজার আসন ফাঁকা থাকলেও কাব্য ছুঁতে পারবে না সেই আসন?
চলবে……