মুঠোভরা_চোরাবালি #আলিশা_আঞ্জুম #পর্ব_১৭

0
370

#মুঠোভরা_চোরাবালি
#আলিশা_আঞ্জুম
#পর্ব_১৭

ফাইজার পিছু ছুটে এসে কাব্য ক্লান্ত হয়ে চোখের পলক ফেলতে ফেলতেই হারিয়ে ফেলল আচমকা ফাইজাকে। কোথায়, কোনদিকে গেলো তা আর ঠাহর করতে পারলো না কাব্য। হাঁক দেওয়ারও যে উপায়ন্তর নেই। শূন্য মস্তিষ্কে কাব্য চোখ বুলিয়ে যেতে লাগলো ভীরের মাঝে।

.
স্নিগ্ধার কবুল বলার পালা এলো। সে নীরবে খুজতে শুরু করলো বোনকে। আয়রা যে পাহাড় সমান ক্ষোভ পুষে রেখেছে তার নামে। আশপাশের ফিসফিস ধ্বনি স্নিগ্ধা কে তাড়া দিলো রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করে বউ হয়ে যেতে। স্নিগ্ধার চোখ জোরা এবার ভিজে উঠলো। কি হবে এরপর? কি হবে যখন সকলে জেনে যাবে চোখে ধুলো দিয়ে স্নিগ্ধা তাসরিফ কে নয় শানকে বিয়ে করে নিয়েছে?

.
সাদা শার্ট আর কালো প্যান্টে ফিটফাট ফর্মাল ড্রেসে তাসরিফ বেরিয়ে পরলো বিয়ে বাড়ি হতে। মুখে তার মাস্ক এঁটে রাখা। চোখে কালো সানগ্লাস। জীবনে সে প্রথম বারের মতো কারো ভালোবাসা পাইয়ে দেওয়ার মাধ্যম হলো। অন্যের ভালোবাসা দেখতেও ভালোলাগে। সত্যি!

প্রথম দিন স্নিগ্ধার সাথে একাকী কথা হয়েছিল তাসরিফের। মুহূর্তের মাঝে বন্ধুত্বের বাধনে বেঁধে ফেলে স্নিগ্ধা বুদ্ধি এঁটে নিলো। তাসরিফ কে বলল, ‘ বন্ধু হিসেবে নির্লজ্জের মতো আপনাকে এই বিপদে ফেললে কি একটু ঝাপ দেবেন এই বিপদে? ‘ সেদিনের পর তাসরিফ সময় নেয়। ভেবে কিছুদিন পর তারা দেখা করেছিল একটা রেস্টুরেন্টে। তাসরিস বলে দেয় ‘ ঝাপ দেওয়াই যায়। অন্তত মায়ের মেয়ে দেখাটা থেমে যাবে।’ ভাবনার মাঝে তাসরিফ ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছাড়লো। জীবন বিচিত্র। স্নিগ্ধার সাথে হুটহাট একটা বিবাহিত ছেলের বিয়ে ঠিক করার বিষয়ে তাসরিফ স্নিগ্ধাকে জিজ্ঞেস করলে স্নিগ্ধা জানিয়েছিল তার আর শানের গোপনে বিয়ে হওয়ার এক গুঞ্জন আছে। প্রতিবেশী, আত্মীয় সকলেই একপ্রকার ছি ছি করে তারপর থেকে। পাত্র এসে পালিয়ে যায়। আবার না পালালে পালিয়ে দেয় স্নিগ্ধা-আয়রা। স্নিগ্ধার অপেক্ষা কেবলই শানের জন্য ছিলো।

.
ফাইজা এসে মুখোমুখি হতে চাইলো তাসরিফের। তবে খুঁজে পাওয়া গেলো না। হঠাৎ রব উঠলো পারিবারিক দন্দ্বের। নব আত্নীয় হওয়া দু পরিবারের মাঝে নাকি গাঢ় আকারের মনোমালিন্য শুরু হয়েছে। বিগড়ে গেছে পরিবেশ। আচমকা বর কে আটকে দেওয়া হয়েছে। বউকে আর বরকে হাওয়ায় মিলিয়ে দেওয়ার মতো করে লোকসমাগম থেকে বিচ্যুত জরা হয়েছে। আয়রা তার চাচাতো, মামাতো, খালাতো ভাইদের চিৎকারে নিজের ঘর হতে ছুটে কাঙ্খিত স্থানে পৌছে সে বরের স্থানে দেখতে পায় তার প্রিয় শান ভাইকে। চমকে তাকায় স্নিগ্ধার পানে৷ তাসরিফ কে বিয়ে করবে বলে মত দেওয়ার পর আয়রার সাথে স্নিগ্ধার মনোমালিন্য। তাসরিফের মায়ের মুখটা রাগে, ক্ষোভে শুকিয়ে গেছে। স্নিগ্ধার বাবা মায়ের মুখের দিকে তাকালে স্পষ্ট হয়ে ভেসে ওঠে রাগের উপস্থিতি। আয়রা থ হয়ে দাড়িয়ে রইলো। স্নিগ্ধার দাড়িয়ে আছে বাবার পাশে। শান বসে আছে একা এক সোফায়। স্নিগ্ধার বাবা প্রশ্ন ছুড়ে দিলো শানের উদ্দেশ্যে

— এতো বড় সাহস তোমার কিভাবে হয়?

শান প্রত্যুত্তর করার মতো বিপদ ডাকলো না। নতমুখে বসে রইলো ঘর্মাক্ত গা নিয়ে।

.
সকলের নজর এড়িয়ে অবিরাম সন্ধান করে যাওয়া ফাইজা হঠাৎ নজরে পরে যায় স্নিগ্ধার। যখন স্নিগ্ধা বিদায় নিচ্ছিলো। আত্নীয়দের কাছে দোষী সাব্যস্ত করলো তাসরিফ কে। সকলে জানলো ছেলে আচমকা উধাও হয়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে মেয়েকে তার প্রেমিকের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। একথায় তাসরিফের নামটা দোষীর ঘরে না উঠে উঠলো একজন ‘ভালোবাসতে জানে’র তালিকায়। ছেলে নিশ্চয়ই তার প্রথম বউকে বেশি ভালোবাসে। ভালোবাসার মতো করে ভালোবাসতে জানে বলে সে এই বিয়ে করেনি। উত্তম কাজ হয়েছে।

স্নিগ্ধা যখন ফাইজাকে চিনতে পারলো তখনই সে আচমকা জড়িয়ে ধরে সকলের মাঝে ফাইজাকে। স্বাভাবিক ভাবে সকলে ভাবলো মেয়ে বিদায় মুহূর্তে শোকে কাতর হয়ে কান্না করছে আপনজনকে ধরে। স্নিগ্ধা ফাইজার কানে পৌঁছে দিলো অনাকাঙ্ক্ষিত খবর

— তুমি ভাগ্যবতী ফাইজা। তুমি দূরভাগ্যবতীও। তাসরিফ কেবল ফাইজাতেই আটকাতে জানে৷ অন্য নারীতে সে আটকায় না।

ফাইজা স্তব্দ হয়ে যায়। স্নিগ্ধা চলে যায় তাকে রেখে। ছলছল চোখ নিয়ে। সময়ের সল্পতার তার বলা হয়ে ওঠে না তাসরিফের মারাত্মক অসুখের কথা। বুকটা হুহু করে ওঠে তার। সামনে এগিয়ে যাওয়ার কালে সে পিছু ফিরে চায় আয়রার বেলকনির দিকে। ডুকরে কাঁদছে আয়রা। তবে স্নিগ্ধার জন্য নয়। সে কাঁদে তাসরিফের জন্য। ইশ! এমন জলজ্যান্ত মানুষ কি সত্যিই একদিন স্তব হয়ে যাবে? হারিয়ে যাবে? কথা বলবে না আর? আয়রার কান্নার গতি বেগবান হয়। এমন করেই স্নিগ্ধার এগিয়ে যাওয়ার সাথে বেগবান হয় ফাইজার বুকের ধুকপুক। সে দুর্ভাগ্যবতী কেন? কেন স্নিগ্ধা তাকে দুর্ভাগ্যবতী বলল? বুকজুড়ে ছটফট ভাব মুহূর্তেই বাসা বেঁধে নিলো ফাইজার। এমন সময় পেছন হতে ডেকে ওঠে তাকে সাফা

— ফাইজা?

কিছুটা অবক হয়ে পেছন ফিরে তাকায় ফাইজা। সাফা আহত দৃষ্টিতে তাকায়। বুকে শুরু হয় ভাই হারিয়ে ফলার ভয়, কষ্ট। ছলছল চোখ নিয়ে সাফা বলে

— আম্মুর সাথে আমার সম্পর্ক ঠিক করে দিয়েছে তাসরিফ। এরপর সে চলে যাওয়ার ফন্দি আঁটেছে ফাইজা। তোমাকে বলেনি ভয়ে বা কষ্টে। ও অনেক বেশি অসুস্থ। ওর থ্যালাসেমিয়া মেজর। ডাক্তার ভালো কিচ্ছু বলে না। ও হয়তো বাঁচবে……

গলা শুকিয়ে যায় ফাইজার। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে সে সাফার দিকে। শুকনো কাঠ হওয়া গলা দিয়ে ফিচেল কন্ঠে বলে

— কি বলছেন আপু?

বলতে গিয়ে এক চোখের অশ্রু গাড়িয়ে যায় তার কালো নিকাবের আড়ালে। সাফা চোখ মুছে নেয়। ফাইজা আড় না দাড়িয়ে উল্টো পথে হাটা দিয়ে মনস্থির করে সে তাসরিফের বাড়িতে যাবে। এজন্যই এতো নাটক? এ জন্য অবহেলার খাদ খুঁড়ে রাখা? ভাবনার মাঝে ফাইজার চোখ বেয়ে অঝোরে ঝড়তে লাগলো অশ্রু। এটা কি ভালোবাসা নাকি তাসরিফের পাগলামি, বোকামি?

.
একা পথ চলতে চলতে তাসরিফ এলোমেলো হেঁটে চলে এসেছে অজানা কোথাও। তবুও তার ভাবনা নেই। ধীর পায়ে বসে পরে সে সোডিয়ামের আলোর নিচে। মাস্ক খুলে নেয়। সানগ্লাস খুলে ফেলে বার কয়েক জোরে শ্বাস নিয়ে আবার উঠে দাড়িয়ে হাঁটতে লাগে। পথিমধ্যে কখনো আঁধার। কখনো ল্যামপোস্টের আলোয় ঝলমলে পথ। পকেটে দু-হাত গুঁজে হেঁটে চলা তাসরিফের মনে ভাবনা একটাই। আর ক’দিন, আর ক’দিন সে আছে এই পৃথিবীতে? এই যে মাথা ঝিমঝিম করছে। পা টলমল করছে। সম্মুখের সবকিছুতে আঁধার নেমে আসছে৷ পায়ের শক্তি ফুরিয়ে আসছে। দাড়িয়ে থাকা আর হয়ে উঠলো না। তাসরিফ আচমকা বসে পরলো রাস্তার মাঝ বারাবর। তাসরিফের বুকের হৃদস্পন্দন বাড়ির দিতে চলে এলো নাকে রক্তের ধারা। এরই মাঝে তাসরিফ হাত দিয়ে শরীরের ভারের সাম্যতা বজায় রাখতে হাত রাস্তার ওপর। তখনই পরে থাকা লোহা তার হাতে প্রবেশ করলো। শুরু হলো রক্তপাত। এ যেন আর থামবে না। তাসরিফ নির্মম এই রক্তের ধারার দিকে দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। আজই বুঝি তার শেষ দিন। এভাবে রক্ত বেরিয়ে এলে সে রক্তশূণ্য হয়ে আধার রাতেই আজ মাঝ রাস্তাতেই বুঝি প্রাণ ত্যাগ করবে। ফাইজার সাথে আর দেখা হবে না কি?

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here