#মুঠোভরা_চোরাবালি
#আলিশা_আঞ্জুম
#পর্ব_১৯
টেস্ট শেষে তাসরিফ কে নিয়ে ডাক্তারের মন্তব্য হলো তারা কিছুই করতে পারবে না। তাদের করার মতো কিছু নেই। কেবল ওষুধ দেওয়া যায় এই রোগের। রক্ত দেওয়া যায়। গুরুতর কিছু হলে লিভার ট্রান্সফার করা যায়। তবে তাসরিফের লিভার জনিত কোনো সমস্যার দেখা পাওয়া যায়নি। দু তিন মাস হবে তাসরিফ তার নিয়মিত রোগী। কখনো অনিয়ম করেনি ওষুধে, ডাক্তার দেখাতে। তবুও কেন যে তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হলো না সে কথা ডাক্তারের অজানা। তাসলিমা গভীর মনোযোগী হয়ে শুনলেন। তিনি হতভম্ব, আশ্চর্যান্বিত। তাসরিফের বাবা ভাষা হারিয়ে ফেললেন। কেবল অসহায় চোখ নিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন ডাক্তারের মুখপানে। ফাইজার বুকে দাবানল শুরু হলো। কি হবে? কি হয়ে গেছে আচমকা? তাসলিমার অগোচরে তার চোখ থেকে টুপ টুপ করে ঝড়তে লাগলো অশ্রু। ছেলে এসবের ঘুণাক্ষরও ফাঁস করেনি! কেন? বড় হয়ে গেছে বলে কি মা বাবার প্রয়োজন নেই?
.
রাত নিঝুম হলো। কারো চোখে ঘুম নেই। উপরন্তু ঘুম ছুটে গেছে কিছু মানুষের। সাফা তার মেয়, স্বামী নিয়ে উপস্থিত হয়েছে হসপিটালে। মুখখানি দেখে মনে হয় এখনই গগন কাপিয়ে কেঁদে উঠবে। ফাইজা ধীর পায়ে এগিয়ে গেছে কখন কেমন করে তাসরিফের কাছে তার খোঁজ সকলে রাখতে যেন ভুলে গেছে। মুখ ফিরিয়ে শুয়ে থাকা শয্যাশায়ী তাসরিফের নিকট গিয়ে ফাইজা দাঁড়াতেই ফিরে চায় তাসরিফ। চোখে ফুটে ওঠে তার অবাক ভাব। ফাইজা গলা চেপে ধরা কান্না আঁটকে রাখে। তার রাগ আর অভিমান এতোটাই হয়েছে যে তা ডিঙিয়ে তাসরিফের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে হচ্ছে না। তাসরিফের মুখটা মলিন হলো। বুক ধুকপুক করতে শুরু করলো। ফাইজার মুখের দিকে অনিমেষ তাকিয়ে থাকতে থাকতেই হঠাৎ কখন কিভাবে যেন চোখের কোণ বেয়ে এক ফোটা অশ্রু গাড়িয়ে গেলো কান বারবার। তৎক্ষনাৎ ফাইজা হুহু করে কেঁদে উঠলো। তাসরিফের চোখের পলক পরে না যেন। কান্নার শব্দ বাতাস পৌঁছে দিলো বাইরের প্রতিটি মানুষের কানে। হুড়মুড় করে এগিয়ে এলো আয়রা, কাব্য, সাফা সহ সকলে। তাসরিফ মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তাকিয়ে আছে পাশের দেয়ালে। তাসলিমা সরে এলেন দ্রুত। তাসরিফের বাবাও দাড়িয়ে রইলেন না। চলে গেলো সাফাও। কেবল দাড়িয়ে রইলো কাব্য ও আয়রা। রুম হতে ভেসে এলো বিরক্ততে ভরপুর একটা কথা
— ইশ! ফাইজা, কান্না থামাও।
আসলেই কি বিরক্তি ছিলো সে কথায়? নাকি ছিলো অসীম ভালোবাসা, কষ্ট।
.
নির্বাকে কেবল দেখাই হলো দু’জনের। কথা হলো না সেদিন। তাসরিফ বাড়ি ফিরলো পরদিনই। কেউই অভিমান করে কথা বলল না তার সঙ্গে। ফাইজা ওবাড়িতে ফিরে যাবে কিনা এনিয়ে মনের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে গেলো। অবশেষে তার দ্বন্দ্বের সমাপ্তি হয় তাসলিমার অনুরোধে। শাশুড়ি যদি সিক্ত চোখে বলেন
” আমার ভুল ভুলে গিয়ে বাসায় চলো ফাইজা। আমার উচিত হয়নি তোমাদের সংসার জীবনে আঙ্গুল তোলা। তাসরিফের তোমাকে ছাড়া চলবে না। ”
ফাইজা চলে এলো তাসরিফের বাড়িতে।
……..
দুপুর যেন বিষন্ন প্রহর। মন খারাপের মুখ্য সময়। ফাইজা ঘর ছেড়ে পাকশালার পাশের খোলা জানালায় দাড়িয়ে আছে। বেশ বড় জানালা। যতোদূর দৃষ্টি যায় কেবল দেখা যায় আকাশ আর গাছপালা। কোনো যানজট নেই। তাসরিফ হসপিটাল থেকে ফেরার তিনদিন হলো। কত স্বাভাবিক মানুষটা। আগেরই মতো হাঁটছে, খাচ্ছে, ঘুমোচ্ছে। কে বুঝবে তার ভেতরে এমন সর্বনাশা অসুখ বেঁধেছে? ফাইজা এখন অব্দি মন খুলে তাসরিফের সঙ্গে কথা বলেনি। কেন যেন থমকে যায় সব কথা। তাসলিমার সঙ্গে ছেলের কথা হয়েছে গত রাতে। ঘরে এসে মা ছেলের হাত ধরে কেঁদে আকুল হয়ে যখন শুধালেন
“কেন বলিস নি তুই? আমি কি তোর কিচ্ছু হই না? ”
তাসরিফের জবাব ছিলো
“মা, কিছু হয়নি আমার। কি বলবো। ”
কত সহজ করে বলে বেড়ায় সে কথাগুলো। তাসলিমা ছেলের হাত চেপে ধরে ধরা গলায় কাল বলেছেন
“শোন বাবা, তোর কিচ্ছু হবে না। আমি আর তুই ইন্ডিয়া যাবো। আমাদের ভিসা আছে না? তারপর এরমধ্যে ফাইজার ভিসা রেডি করবো। তারপর ফাইজাও যাবে। দরকার হলে তোকে ওখানেই বাসা কিনে দেবো। তুই ওখানে থাকবি আর ট্রিটমেন্ট করবি। ”
একথা শুনে তাসরিফ আনমনা হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ গভীর চোখে তাকিয়ে ছিলো মায়ের পানে। অতঃপর বলেছিল
“তোমাকে অনেক ভালোবাসি মা। ”
— ফাইজা? লাঞ্চ করেছো?
ভাবনার মাঝে হঠাৎ তাসরিফের ডাক। ফাইজা চোখ মুছে পিছু ফিরে তাকায়। মুখটা মলিন হলেও তাসরিফের হাসি উজ্জ্বল।
— নাহ।
তাসরিফ মাথার টুপি খুলে নিয়ে ব্যাস্ত পায়ে ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল
— চলো লাঞ্চ করবে। তারপর আমারা একসাথে বেরোবো।
চলবে……