#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৪।
পুতুল নাক টেনে জবাবে বলল,
‘আমি অন্য একজনকে পছন্দ করি।’
সারাজের কর্ণকুহরে কথাটা বিষের মতো গিয়ে ঠেকল। মস্তিষ্ক ঠিক নিতে পারল না। ভেতরটা মূর্ছে উঠল যেন। পুতুল অন্য কাউকে পছন্দ করে? সে কি আদৌ ঠিক শুনছে?
বুকের ব্যথা ততক্ষণাৎ বেড়ে গেল। রাগ চড়ে বসল মাথার ব্রহ্মতালুতে। গলার স্বর পাল্টে সে শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করল,
‘তুই অন্য কাউকে পছন্দ করিস?’
পুতুল আজ জড়তা দেখাল না। সহজ গলায় বলল,
‘হ্যাঁ।’
সারাজ চোয়াল শক্ত করে পুনরায় প্রশ্ন ছুড়ল,
‘কাকে?’
‘সেটা সময় এলে তোমাকে বলব। আগে তুমি মা’কে বোঝাও। আমি এই বিয়ে করতে পারব না। আর আমি জানি, তুমি বললে মা তোমার কথা শুনবেন।’
‘ফাজলামি পেয়েছিস? সামনে পেলে থাপড়াতে থাপড়াতে তোর গাল লাল করে ফেলতাম। অন্য কাউকে পছন্দ করিস? তাই বিয়ে করবি না? এখন আমাকে আবার বলছিস তোর হয়ে উকালতি করতে? এত সাহস হয় কী করে তোর? অনেকদিন ধরে থাপ্পড় খাচ্ছিস না। তাই দিন দিন সাহস বেড়ে আকাশ ছুঁয়েছে। আর তোর পছন্দ করা আমি বের করছি। এক্ষুনি আমি সব মা’কে বলব। পড়াশোনা বাদ দিয়ে তোমার মেয়ে প্রেম করে বেড়াচ্ছে। তোমাদের আর ওকে পড়াতে হবে না। বিয়ে দিয়ে দাও, সেটাই ভালো।’
‘সারাজ ভাই।’
করুণ সুরে ডাকল পুতুল। তাতে আরো বেশি তেতে উঠল সারাজ। পুতুল অন্য কাউকে পছন্দ করে এটা যেন সে মেনেই নিতে পারছে না। সে চেঁচিয়ে বলল,
‘চুপ। আর একটা কথাও আমি শুনছি না। তোর বিয়ে হবে। আমি যার সাথে চাইব, তার সাথেই তোর বিয়ে হবে। বুঝেছিস?’
পুতুলের মন অস্থির। এতকিছুর পরেও সারাজ ভাই কেন বলছেন না, বিয়েটা তিনি করবেন। তিনিই পুতুলকে ভালোবাসেন। এই এক কথা শুনতেই তো এতকিছু। পুতুল অস্থির গলায় বলল,
‘তাহলে আমার পছন্দের কী হবে, সারাজ ভাই?’
সারাজ দাঁতে দাঁত পিষছে। পাগল পাগল লাগছে সবকিছু। তার পুতুল অন্য কাউকে পছন্দ করে? তাকে পছন্দ করে না? কবে হলো এসব? তবে কি তার শাসন আর ঝগড়াই তার পুতুলকে তার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে? পুতুল কি তবে তার হবে না?
চোখ বুজতেই মনে হলো শ্বাস আটকে যাচ্ছে তার। এই নির্মম সত্য সে কোনোভাবেই মানতে পারবে না। তার পুতুল তাকে ব্যতিত অন্য কাউকে পছন্দ করতেই পারে না।
সারাজ কল কেটে দিল। মাথা কাজ করছে না। স্নায়ুতন্ত্র অকেজো হয়ে পড়েছে হয়তো। কোনো অনুভূতি আর কাজ করছে না। সুখ দুঃখ কিছুই টের পাচ্ছে না সারাজ।
এসব কখন হলো? পুতুল তার জায়গা অন্য কাউকে কী করে দিয়ে দিতে পারল? এতটা স্বার্থপর তার পুতুল কী করে হলো, কী করে?
______
দরজায় ঠকঠক শব্দ হচ্ছে। এই শব্দ গত বিশ মিনিট যাবত ক্রমাগত হয়েই যাচ্ছে। তবে ভেতর থেকে কোনো রা নেই। রিতা এবার চিন্তিত স্বরে ডাকল,
‘সারাজ, বাবা দরজাটা খুল না।’
বরাবরের মতোই ভেতরে নিশ্চুপ। রিতার এবার চিন্তা হচ্ছে। ছেলেটা আবার বেশি সিরিয়াস হয়ে উল্টা পাল্টা কিছু করে বসেনি তো? দরজার ধাক্কানোটা বাড়াল সে। থামল না। পরপর আঘাত করতেই থাকল।
বেশ অনেকক্ষণ পর দরজাটা খট করে খুলে গেল। খুলেই দৃশ্যমান হলো এক লম্বা সুঠামদেহী পুরুষ। ছেলেটা যা লম্বা হয়েছে, রিতাকে উপর দিকে চেয়ে কথা বলতে হয়। সে বলতেই নিল,
‘কিরে, এতক্ষণ দরজা খুলছিলি না…’
মাঝপথেই থামতে হলো তাকে। সারাজের চোখ মুখ দেখে আঁতকে উঠল সে। তারপর গালে হাত দিয়ে ভীত সুরে বলল,
‘কী হয়েছে, বাবা? তোর চোখ মুখ এমন হয়ে আছে কেন?’
সারাজ চুলে আঙ্গুল চালিয়ে যথাসম্ভব নিজেকে গুছিয়ে বলল,
‘কই, কিছু হয়নি তো। তুমি দরজা ধাক্কাছিলে কেন, কিছু বলবে?’
‘হু? হ্যাঁ হ্যাঁ। রাতের খাবারের জন্য ডাকতে এসেছিলাম তোকে। খাবি আয়।’
সারাজ জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভেজাল। গলার স্বর কেন যেন কাঁপছে তার। কষ্ট করে বলল,
‘আমাকে একটু খাইয়ে দিবে, মা?’
ভীষণ কাতর শোনাল এই স্বর। রিতার বুকের ভেতরে ধক করে উঠল যেন। তারা কি সত্যি জানতে গিয়ে ছেলে মেয়েগুলোকে খুব বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে?
রিতা ঢোক গিলে বলল,
‘তুই রুমে যা, আমি খাবার নিয়ে আসছি।’
‘সাত আটটা কাচা মরিচ সাথে এনো।’
রিতা বিচলিত হয়ে পড়ল। না না, এবার হয়তো বেশিই কষ্ট দিয়ে ফেলছে তারা। মেহুলের সাথে কথা বলতে হবে। এত ভেবে আর কাজ নেই, ছেলে মেয়ে দুটোকে ধরে বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। তারপর বাকিটা ওরাই সামলে নিবে।
রিতা খাবার নিয়ে আসার আগে সারাজ দ্রুত তার রুমটা গুছিয়ে নিল। সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মা এসে এসব দেখলে হয়তো আরো বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়বে। তাকে প্রশ্ন করতে করতে মাথা খাবে। কিন্তু সারাজ জানে, জবাব দেওয়ার জন্য আজ সারাজের ঝুলিতে কোনো উত্তর নেই।
এক লোকমা শেষ হতে না হতেই সারাজ চারটা কাচা মরিচ শেষ করে ফেলল। প্রচন্ড ঝাল এই মরিচ। ইতিমধ্যেই তার নাক মুখ লাল হয়ে উঠেছে। রিতা ছেলের কর্মকান্ড দেখে হতভম্ব। আরেকবার লোকমা মুখে তুলে দিল। সেটা গিলেই আরো দুইটা মরিচ খেল সারাজ। রিতা এবার তার হাত থেকে মরিচটা কেড়ে নিল। চিন্তিত সুরে বলল,
‘পাগল হয়েছিস তুই? এভাবে মরিচ খাচ্ছিস কেন?’
ততক্ষণে সারাজের নাকে মুখে পানি চলে এসেছে। সে নাক টেনে হেসে বলল,
‘আসলে মাথা ধরেছে, মা। একটু ঝাল খেলে মাথা ধরাটা ছেড়ে দিবে।’
রিতা আরেক লোকমা মুখে দিতে দিতে বলল,
‘মাথা ধরেছে তো মাথা ধরার ঔষধ খা। তাই বলে এভাবে মরিচ খাবি? একটু পর পেট খারাপ করলে?’
‘কিচ্ছু হবে না, মা। আমার ঝাল খেয়ে অভ্যাস আছে।’
বলেই আরেকটা মরিচ হাতে তুলল। সঙ্গে সঙ্গে সেটা হাত থেকে নিয়ে ফেলে দিল রিতা। সারাজ ক্ষান্ত হলো। মুখ কালো করে শান্ত হয়ে বসল। চোখ মুখ মরিচের ঝাঁঝে আরো রক্তিম হয়ে উঠেছে। রিতা অসহায় চোখে চেয়ে আছে ছেলের দিকে। তার ঝাকড়া চুলগুলোতে হাত রেখে বলল,
‘কী হয়েছে, বাবা? কোনো কিছু নিয়ে কি কষ্ট পাচ্ছিস? মা’কে বল, মা সব ঠিক করে দিব?’
সারাজের এলোমেলো দৃষ্টি মায়ের উপর বর্তাল। ভীষণ বিধ্বস্ত ঐ চোখের দৃষ্টি। দেখলে মায়া হয়। সেই নিরেট গলায় জিজ্ঞেস করল,
‘আমি কি খুব খারাপ, মা?’
রিতা অবাক হলো এই প্রশ্নে। সে সিক্ত চোখে চেয়ে জবাব দেয়,
‘এসব কী বলছিস? আমার ছেলে তো লাখে এক। তোকে কেউ খারাপ বলতেই পারবে না।’
তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে সারাজ বলে,
‘তাহলে মানুষ আমায় কেন পছন্দ করে না?’
‘মানুষ পছন্দ করে না? কোন মানুষ পছন্দ করে না? কার কথা বলছিস?’
এদিক ওদিক চেয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে সারাজ উত্তরে বলল,
‘না, কারোর কথা না। খাইয়ে দিবে না? ভাত ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তো।’
রিতা বুঝতে পারছে, ছেলেটা কষ্ট পাচ্ছে। এই কষ্ট যে পুতুলের জন্য সেটাও সে নিশ্চিত। কিন্তু, হঠাৎ এই প্রশ্নে খানিকটা নড়ে উঠে সে। মানুষ তাকে পছন্দ করে না? সে কোনো মানুষের কথা বলছে, পুতুলের?
_______
থমথমে অন্ধকার চারদিক। আকাশ শূন্য। চাঁদ নেই। তারাও খুব বেশি একটা চোখে পড়ছে না। বাতাসেরও নাম গন্ধ নেই। আছে কেবল এক বিশাল নিরবতা আর নিস্তব্ধা।
‘আমি তখনই বুঝেছিলাম, মাথায় আপনার অন্যকিছু চলছে।’
মেহুল হেসে বলল,
‘জি। সারাজকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে এর থেকে আর ভালো কোনো উপায় নেই।’
ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলল রাবীর। বলল,
‘ছেলেটাকে ওর মতো করে ভালো থাকতে দিবেন না, তাই না? ঠিক আছে, যা খুশি করুন। আমি এসবের মাঝে নেই।’
মেহুল হতাশ হয়ে বলল,
‘আহা, আপনি এভাবে কেন বলছেন? সারাজ রাজনীতিতে গেলে অযথাই ঝামেলা বাড়বে। তার চেয়ে বরং সে সাদরাজ ভাইয়ের ব্যবসায় যোগ দিয়ে বিয়ে শাদি করে সংসার করবে, সেটাই ভালো।’
‘হ্যাঁ, খুব ভালো। তবে আর দেরি কেন; বিয়ে দিয়ে দিন ওদের।’
মেহুল জানে তার কথা মোটেও রাবীরের পছন্দ হচ্ছে না। তাতে আজ তার কিছু যায় আসে না। ভালো মন্দ সেও কম বোঝে না। আপাতত সারাজ পুতুলের বিয়েতেই সবার মঙ্গল।
_______
‘এই যে শুনো।’
প্রচন্ড গরম পড়েছে আজ। রোদে ঠিক মতো চোখ মেলেও তাকানো যাচ্ছে না। গরমে ঘেমে গেয়ে একাকার। তার মাঝে কারোর এমন কর্কশ গলার স্বর শুনে মেজাজটা এবার পুরোপুরিই হারাল লীনা। নাক মুখ কুঁচকে পেছন ফিরে চাইতেই মুখের অভিব্যক্তি পাল্টে গেল। জোরপূর্বক হেসে বলল,
‘আসসলামু আলাইকুম, ভাইয়া। ভালো আছেন?’
‘ওয়ালাইকুমুস সালাম। হ্যাঁ, ভালো। আসলে, তোমার সাথে একটু কথা ছিল। সময় হবে?’
‘জি, ভাইয়া। বলুন।’
সারাজ এক পল সময় নিয়ে প্রশ্ন করল,
‘পুতুল কি কোনো ছেলেকে পছন্দ করে?’
চলবে….
ছবি: রত্নাবু❣️