শেষটা_সুন্দর(সিজন-২) #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ১৭।

0
410

#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৭।

রোদ কমেছে। বাইরে মৃদুমন্দ বাতাস। ভার্সিটি থেকে সবেই বেরিয়েছে পুতুল। বাইরে বেরিয়েই ক্লান্তশ্বাস ছাড়ল। সবকিছু বড্ভ বিরক্ত লাগছে। এই যে আজকের বিকেলটা এত তকতকে ঝকঝকে, তাও তার মন ভালো হচ্ছে না। মনের অসুখ হয়েছে বোধ হয়। কঠিন অসুখ। আর এই অসুখ কেবল তার সারাজ ভাই’ই সারাতে পারবেন।

পুতুলের মুখটা আরো মিইয়ে যায়। আজকাল সারাজ ভাই তো তাকে আগের তুলনায় একটু বেশিই অবজ্ঞা করছেন। কী সুন্দর অপরিচিত এক মেয়েকে নাম্বার দিয়ে দিলেন। নাম্বারের কথা মনে পড়তেই ভ্রু কুঁচকাল পুতুল। সারাজ ভাই ঐ মেয়েকে যে নাম্বার দিয়েছেন, সে তো জীবনেও এই নাম্বার সম্পর্কে জানত না। সারাজ ভাইয়ের একটা যে নাম্বার আছে সেটা তার টুটস্থ মুখস্থ। তবে ঐ নাম্বারটা কার? সারাজ ভাইয়ের কি আরেকটা সিম আছে? সেটা দিয়ে তিনি হয়তো খুব ব্যক্তিগত মানুষদের সাথে কথা বলেন।
বুকটা হুহু করে উঠল পুতুলের। মারাত্মক কান্না পাচ্ছে তার। ঐ পিচঢালা রাস্তার ঠিক মাঝে বসে হাত পা ছড়িয়ে এক ঘন্টা কাঁদতে পারলে হয়তো মনটা শান্ত হতো। তার সারাজ ভাই জীবনে যেই নাম্বার তাকে দেয়নি, আজ তিনি সেই নাম্বার একটা অপরিচিত মেয়েকে দিয়ে দিলেন? এত নিষ্ঠুর উনি?

পুতুল তৎক্ষণাৎ ঠিক করল, সে মায়ের পছন্দ করা ঐ ইঞ্জিনিয়ার ছেলেকেই বিয়ে করবে। হ্যাঁ, অবশ্যই করবে। সারাজকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সে ঐ ইঞ্জিনিয়ারকে বিয়ে করে নাচতে নাচতে হানিমুনে যাবে। আর ঐ অসভ্য অভদ্র সারাজ এসব দেখবে আর লুচির মতো ফুলবে…হু।

বাসায় এসেই সোফার উপর ব্যাগটা ছুড়ে মারল পুতুল। চিৎকার করে ডাকতে আরম্ভ করল,

‘মা, মা। কোথায় তুমি? এক্ষুনি এখানে এসো।’

সিঁড়ির কাছে এসে মেহুল বাজখাঁই গলায় বলে উঠল,

‘কী হয়েছে, এভাবে চেঁচাচ্ছিস কেন?’

‘নিচে নামো। তোমার সাথে জরুরি কথা আছে।’

মেহুল বিরক্ত হয়ে নিচে নেমে দাঁড়াল।

‘বল, কী বলবি।’

‘আমি ঐ ইঞ্জিনিয়ারকে বিয়ে করব।’

‘কোন ইঞ্জিনিয়ার?’

‘আরে, তুমি আর মামনি মিলে যাকে ঠিক করলে, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। আমি তাকে বিয়ে করতে রাজি।’

‘ওহ, আচ্ছা।’

বলার সঙ্গে সঙ্গেই বিদ্যুৎ গতিতে ভয়ানক এক ঝটকা খেল মেহুল। কোটর ছেড়ে চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম। সে আদৌ ঠিক শুনছে তো? পুতুল বিয়ের জন্য রাজি? মেহুলের মাথা ঘুরাচ্ছে। পুতুল এত সহজে রাজি হয়ে গেল কী করে? এবার তো মনে হচ্ছে নিজের পায়ে নিজেই কুঁড়াল মারা হয়ে গিয়েছে তাদের। মেহুল ঠোঁট চেপে দাঁড়িয়ে আছে। দুই ভ্রু এর মাঝে দৃঢ় তিন খানা দাগ পড়েছে। পুতুল চেয়ে আছে বিরক্তভরা দৃষ্টিতে। তার মা খুশি হয়নি? তাঁর তো এতক্ষণে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যাওয়ার কথা। অথচ, চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে, তিনি বরং কষ্ট পেয়েছেন।

‘মা, তুমি কি খুশি হওনি?’

মেহুল থতমত খায়। কী বলবে এবার? কী করে বলবে, সে একটুও খুশি হয়নি যে। পুতুলের সন্দিহান দৃষ্টি দেখে মেহুল হাসল। বলল,

‘খুশি হয়েছি। তবে, আমার মনে হচ্ছে আমি বোধ হয় তোর উপর এসব চাপিয়ে দিচ্ছি। তুই আমাকে খুশি করতে নিজেকে বিসর্জন দিচ্ছিস। আমি মা হয়ে সেটা এখন মেনে নিতে পারছি না। থাক, আপাতত বিয়ে নিয়ে আমি আর কোনো কথা বলব না। তুই আগে অনার্সটা শেষ কর তারপরই সব হবে।’

‘ওমা, বললেই হলো। দুদিন যাবত বিয়ে নিয়ে এত কাহিনী করে, এখন বলছ সব বাদ দিতে? শোনো, আমি মন থেকেই রাজি। তুমি পাত্র পক্ষকে আমাদের বাড়িতে আসতে বলো। আর আমার তো বিয়ের বয়স হয়েই গিয়েছে, তাই না? বিয়ের পর বাকি পড়াশোনাও কমপ্লিট করে নিব, নো টেনশন।’

পুতুল সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায়। মেহুলকে রেখে যায় কঠিন গোলক ধাঁধায়। মেহুলের ঘোর তো এখনও কাটছেই না। সকালে যে মেয়ে বিয়ে করবে না বলে তার সাথে এত ঝগড়া করে গেল, বিকেলে এসে সেই মেয়েই এভাবে পল্টি মারল? আশ্চর্য! এই কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে কী এমন হয়েছে? রিতাকে তো এক্ষুনি খবরটা দিতে হচ্ছে।

_______

‘কী বলিস, পুতুল বিয়েতে রাজি?’

‘হ্যাঁ, ও তো তাই বলল। আমার তো মাথা’ই কাজ করছে না। তবে কি আমাদের প্ল্যানে আমরা নিজেরাই ফেঁসে গেলাম?’

রিতা কিছুক্ষণ ভাবল। পুরো ব্যাপারটা বেশ চিন্তার। সে খানিক সময় পর বলল,

‘আমার মনে হচ্ছে, ঘটনা অন্যকিছু। দেখ, সারাজ আর পুতুল দুজনেই কিন্তু প্রথমে বিয়ে নিয়ে বেশ হম্বিতম্বি দেখিয়েছে। আমার মনে হয় কি, পুতুল আর সারাজের মধ্যে হয়তো রাগ অভিমান চলছে। হয়তো সারাজের সাথে রাগ দেখিয়েই পুতুল এখন বিয়েতে রাজি হয়েছে।’

‘সম্পর্কই যদি না থাকে, তবে সেই সম্পর্কে রাগ অভিমান আসবে কোথ থেকে?’

‘আহা, তুই বুঝছিস না। শোন, তুই তোর অভিনয় চালিয়ে যা। আর আমিও কালকে পাত্র পক্ষ নিয়ে আসব। ব্যাপারটাকে আরো ঘাটাতে হবে। ছেলে মেয়ে দুইটা মারাত্মক ফাজিল। এত সহজে ওদের ধরা যাবে না।’

মেহুল কপাল কুঁচকে বলল,

‘তুই পাত্রপক্ষ কই পাবি?’

‘আরে সেটা আমি ম্যানেজ করে নিব। তুই গিয়ে পুতুলকে জানিয়ে দে, আগামীকাল পাত্রপক্ষ তাকে দেখতে আসবে। তারপর দেখ ও কী বলে।’

মেহুল বিরক্ত হয়ে বসল। সামনের কিছু চুলে পাকা ধরেছে তার। এবার তো মনে হচ্ছে এই ছেলে মেয়ে দুইটার চিন্তায় চিন্তায় এক মাসের মধ্যেই তার সব চুল পেকে যাবে।

_______

সন্ধ্যার পর বাপ বেটা অফিস থেকে ফেরে। সাদরাজ ছেলেকে অনেক কিছু বুঝিয়েছে। পারছে না কেবল একদিনেই সব দায়িত্ব তার ঘাড়ে তুলে দিতে। অফিসের সবাইও বস বস বলে মাথা খারাপ করে দিচ্ছিল তার। মাথা ধরেছে এখন।মৈ। ফ্রেশ হয়ে কড়া লিকারে এক কাপ চা খেতে হবে।

রিতা সারাজের দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বলল,

‘প্রথম দিন অফিস কেমন গেল, বাবা?’

‘আর কেমন যাবে, বলো? তোমার হাজবেন্ডের জ্বালায় বাঁচা যায়? একদিনেই সব বুঝিয়ে আমার মাথা হ্যাং করে দিয়েছেন।’

রিতা হেসে বলে,

‘তাই? এক্ষুনি একটা দারুণ খবর দিব। দেখবি, এক সেকেন্ডেই মাথার হ্যাং ছেড়ে দিয়েছে।’

সারাজ চায়ের কাপে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,

‘কী খবর?’

রিতা তার পাশে বসল। মুখে চওড়া হাসি। আমোদ গলায় বলল,

‘পুতুল বিয়েতে রাজি। কালই পাত্রপক্ষ ওকে দেখতে যাবে।’

নাকেমুখে চা উঠে গেল সারাজের। কাশতে আরম্ভ করল। রিতা অস্থির ভঙিতে পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,

‘আস্তে খা। এমন নাকে মুখে উঠল কেন?’

সারাজ ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করল। মাথার হ্যাং ছাড়ার বদলে উল্টো আরো জমে গিয়েছে। সে চায়ের কাপ রেখে সটান উঠে দাঁড়াল। বিরক্ত গলায় বলল,

‘ভালো তো, খুব তাড়াতাড়ি একটা বিয়ে খেতে পারব।’

‘তুই যাবি না কালকে?’

‘আমি কেন যাব? ওর মতো আহাম্মককে আরেক আহাম্মক দেখতে আসছে, সেখানে আমি গিয়ে কী করব? দুই আহাম্মকের আহাম্মকগিরি দেখব?’

রিতা মুখ থেকে ‘চ’ জাতীয় শব্দ করে বলল,

‘এভাবে বলছিস কেন? তুই থাকলে পাত্রের সাথে একটু ভালোভাবে কথা বলে খোঁজ খবর নিতে পারবি। আফটার অল, তোর দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র বোন; ভাই হিসেবে তো এইটুকু দায়িত্ব পালন করতেই পারিস, তাই না?’

সারাজ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘মা, যাবে এখান থেকে?’

‘আরে বাবা, রেগে যাচ্ছিস কেন? এখানে রাগার মতো আমি কী বললাম?’

সারাজ চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। কপালের রগ ফুলে উঠেছে। রিতা তার চোখ মুখ দেখে ঠোঁট চেপে হাসছে। আহা, ছেলেটার এই রাগ তার মনে ভীষণ শান্তি দিচ্ছে। এই রাগই বলে দিচ্ছে, সে অবশ্যই পুতুলকে চায়। আর চিন্তা নেই, এবার যা করবার তার ছেলেই করবে। রিতা নিশ্চিন্ত মনে ঘরে ছাড়ল।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here