শেষটা_সুন্দর(সিজন-২) #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ২১।

0
399

#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২১।

‘মা, তোমার সাথে আমার কথা আছে।’

রিতা ফোন কেটে ছেলের দিকে চাইল। বলল,

‘হ্যাঁ, বল কী বলবি।’

নিশ্বাসের গতি প্রখর হলো সারাজের। অন্তরিন্দ্রিয়তে প্রশ্ন জাগল, আদৌ কথাটা বলা উচিত হবে তো? তার চিত্ত জুড়ে উত্তোলিত প্রেম বলল, অবশ্যই বলা উচিত। নয়তো সব হারিয়ে নিঃস্ব হতে হবে তোকে। চিত্তের এহেন প্রবচন সারাজ অগ্রাহ্য করতে পারল না। সত্যিই যদি এই বিলম্বতায় সব হারিয়ে নিঃস্ব হতে হয় তাকে, তখন?
সারাজ নিজেকে ধাতস্ত করে মৃদু সুরে বলল,

‘মা, আমি বিয়ে করব।’

রিতা আঁতকে উঠল। চোখ জোড়া এমন আকৃতি করল, যেন এই মুহুর্তেই সেগুলো তাদের স্থান ত্যাগ করে বেরিয়ে আসবে। ড্যাবড্যাব করে চেয়ে অপ্রত্যয় সুরে শুধাল,

‘আমি কি আদৌ সব ঠিকঠাক শুনছি, বাবা? আমার কানে আবার কোনো সমস্যা হয়নি তো?’

সারাজ ভ্রু বাঁকায়।

‘আহ মা, মজা করো না তো। আ’ম সিরিয়াস। আমি সত্যিই বিয়ে করতে চাই।’

রিতা ঠোঁট গোল করে ছেলের মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। মুখ দেখে চিত্তহরণের চেষ্টা চালাচ্ছে। সারাজ অপ্রসন্ন সুরে বলল,

‘মা, কিছু বলবে?’

‘হু? হ্যাঁ হ্যাঁ, বলছি। ইয়ে মানে বলছিলাম যে, হঠাৎ বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলি যে?’

‘না নিয়ে আর উপায় কই? আমার আশেপাশের সবাই তো বড্ড নির্বোধ। তাদের আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে না দিলে কিছুই দেখে না। তাই আমি একপ্রকার বাধ্য হয়েই এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছি।’

‘বেশ বেশ। তা বাবা, কাকে বিয়ে করবি? না মানে, পাত্রী ঠিক করা আছে? না-কি আমরা দেখব?’

সারাজ অকপটে বলল,

‘পাত্রী ঠিক করা আছে।’

রিতা একটু নড়ে চড়ে বসল। খুব সিরিয়াস তার ভাব ভঙ্গি। চোখ নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘মেয়েটা কে?’

সারাজ দৃষ্টি রাখল মায়ের উপর। বাক্য বিবরণ করতে গিয়েও থেমে যাচ্ছে। একটু ইতস্তত। তবে সে ভীত নয়। হালকা গলা ঝেরে বলল,

‘পুতুল।’

রিতা বড়ো করে নিশ্বাস ফেলল। মনে হচ্ছে বুকের উপর থেকে বিশাল পাথর সরে গিয়েছে। আহ, কী শান্তি! শ্বাস প্রশ্বাসও নিচ গতিতে বহমান। এতদিনে গিয়ে একটু স্বস্তি পেল সে।

‘মা, কিছু বলছো না কেন?’

‘হ্যাঁ? আমাকে কি কিছু বলতে হবে?’

‘মা, আমি বলেছি, আমি পুতুলকে বিয়ে করতে চাই।’

রিতা মাথা নুইয়ে কিছু একটা ভাবল। পরে বিষন্ন চোখে ছেলের দিকে চেয়ে বলল,

‘কিন্তু, পুতুলের তো বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে।’

সারাজ টুঁটিস্বর কাঠিন্য করে বলল,

‘ঐ বিয়ে ভেঙে দিতে বলো। পুতুলের বিয়ে আমার সাথেই হবে। আর এটাই ফাইনাল।’

বলেই মায়ের কক্ষ হতে প্রস্থান ঘটাল সে। রিতা খুশিতে পারছে না একটু নেচে উঠতে। কিন্তু, বয়সের সাথে এসব ঠিক মানায় না বলে, বসেই রইল সে। সঙ্গে সঙ্গেই মেহুলকে কল লাগাল। এই সুসংবাদটা যে এক্ষুনি মেহুলকে দিতে হবে।

_____

‘আরে, আপনি আমার কথা কেন শুনছেন না?’

লীনা চেয়ার ছাড়ল। বলল,

‘দেখুন, আমার প্র্যাকটিস করা হয়ে গিয়েছে। এখন আমাকে যেতে হবে।’

‘এই তো এখন এলেন। একবার কেবল কবিতাটা পড়লেন। আর তাতেই প্র্যাকটিস করা শেষ? এর আগে আপনি কখনও স্টেজ পারফরম্যান্স করেননি। এটাই প্রথমবার। তাই বারবার প্র্যাকটিস করতে হবে। আমি চাই, আমাদের ডিপার্টমেন্টের প্রত্যেকটা পারফরম্যান্স যেন নিখুঁত হয়, বুঝেছেন?’

লীনা ফোঁস ফোঁস করছে। এই লোকটাকে একদম তার সহ্য হচ্ছে না। এইদিকে তার খুব জোরে ওয়াশরুম চেপেছে। এখন একবার না গেলেই নয়। অথচ এই তার ছেঁড়া লোক তার কথা মানতেই নারাজ। সে বিদ্বিষ্ট ভঙিতে আবার তার জায়গায় বসল। তার থেকে কিছুটা দূরেই পুতুল তার গানের প্র্যাকটিস করছে। চোখ বুজেই পরপর সুর তুলে যাচ্ছে সে। লীনা খুব করে চাইছে, পুতুল একটিবার তার দিকে দৃষ্টিপাত করুক। কিন্তু, এই মেয়ে তো তার গান নিয়েই মজে আছে।

আধ ঘন্টা খুব কষ্টে নিজেকে সংযত রাখল। না, আর সম্ভব না। এবার ওয়াশরুমে না গেলে এখানেই উল্টা পাল্টা কিছু একটা হয়ে যাবে। লীনা চেয়ার ছেড়ে উঠতেই মাহাত তার সম্মুখে এসে দন্ডায়মান হয়। তাকে দেখা মাত্রই লীনার মুখ ভঙিমা পাল্টে যায়। মাহাত জিজ্ঞেস করে,

‘প্র্যাকটিস শেষ?’

‘হু।’

‘ঠিক আছে, একবার আমাকে শোনান।’

লীনা ব্যস্ত কন্ঠে বলে,

‘এখন শোনানো সম্ভব না।’

‘কেন?’

ভ্রুকুটি হলো মাহাতের। লীনা ঠোঁট কামড়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে কী করে বোঝাবে, ভেতরে কী যুদ্ধ চলছে তার। মাহাত সরু চোখে চেয়ে বলে,

‘কী হলো, চুপ কেন?’

‘ইশ, আপনি বুঝতে পারছেন না। আমাকে এক্ষুনি এখান থেকে বেরুতে হবে।’

‘আশ্চর্য! আপনি এমন করছেন কেন? কেন বের হতে হবে? কোনো প্রবলেমে পড়েছেন?’

‘জি, হ্যাঁ। বিশাল প্রবলেমে পড়েছি। এখনই যদি এখান থেকে যেতে না পারি, তবে প্রবলেম সব এখানেই হয়ে যাবে।’

মাহাত হা করে চেয়ে থাকে। মেয়েটা কী বলছে কিছুই তার বোধগম্য না। কিন্তু, তার ঘর্মাক্ত মুখ দেখে এইটুকু বুঝতে পারছে, জটিল কোনো সমস্যা। সে মুখ খুলে কিছু বলতে নিবে, তার আগেই লীনা বলে উঠে,

‘দয়া করে আর কিছু বলবেন না। আমি একটু পর এসে আপনার সব কথা শুনব। এখন আসছি।’

বলেই এক প্রকার ছুটে সে অডিটরিয়াম থেকে বেরিয়ে গেল। আর মাহাত বোকার মতো চেয়ে রইল কেবল।

_______

অডিটরিয়ামের কোথাও লীনাকে না দেখে পুতুল মাহাতের কাছে আসে। জিজ্ঞেস করে,

‘ভাইয়া, লীনা কোথায়? ওকে দেখছি না যে?’

‘আপনার বান্ধবী কিছুক্ষণ আগেই ছুটি বেরিয়ে গেছে। কী একটা প্রবলেম যেন বলছিল। আমি কিছু বলার আগেই উনি লাপাত্তা।’

পুতুল চিন্তায় পড়ে।

‘বলেন কী? আমাকে না বলেই উধাও? কী এমন প্রবলেম ওর? খুব গুরুতর কিছু?’

‘হবে হয়তো। কিছু তো বলেওনি ভালো করে।’

‘আচ্ছা ভাইয়া, আমি ওকে দেখে আসছি।’

পুতুল ফোনে লীনার নাম্বার ডায়েল করতে করতে বাইরে ছুটল। কল রিসিভ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই উৎকন্ঠিত সুরে সে বলে উঠল,

‘দোস্ত, কই তুই? কী প্রবলেমে পড়েছিস? আমাকে না বলেই চলে এলি কেন? খুব সিরিয়াস কিছু হয়েছে?’

‘হ্যাঁ, খুব সিরিয়াস। আগামী তিন ধরে আটকে যাওয়া কাজ আজ সম্পন্ন হলো। এখন খুব শান্তি লাগছে।’

পুতুলের মস্তিষ্ক এই কথার মানে বুঝল না। তাই জিজ্ঞেস করল,

‘কী বলছিস? কিছুই তো বুঝতে পারছি না।’

‘দুতালার ওয়াশরুমে চলে আয়। তোকে বুঝিয়ে বলছি।’

বলেই লীনা কল কাটল। পুতুল ভড়কে গিয়ে ভাবল, ওয়াশরুমে গিয়ে বোঝার মতো কী এমন কাজ করল ও?

____

‘এই মেয়ে, তুই আমাকে পরিষ্কার করে বলতো কী হয়েছে?’

‘উফ! বললাম না, তিন দিনের আটকে যাওয়া কাজ আজ সম্পন্ন হয়েছে।’

‘মানে?’

‘মানে, আজ আমার স্টেশন ক্লিয়ার। তিন ধরে অনেক চেষ্টা করেও ক্লিয়ার করতে পারছিলাম না। আজ সেটা পরিপূর্ণ ভাবে ক্লিয়ার হয়েছে। তাই এখন হালকা লাগছে খুব।’

লীনার চোখ মুখ দেখে পুতুলের আর বুঝতে বাকি রইল না, সে কীসের কথা বলছে। চেতে গিয়ে লীনার হাতে ঠাস করে এক চড় বসিয়ে বলল,

‘ফাজিল মেয়ে, আমি আরও ভাবলাম কী না কী হয়েছে? চিন্তায় ঘাম ছুটে গিয়েছে আমার।’

লীনা উত্তরে দাঁত কেলিয়ে হাসে। পুতুল বলে,

‘চল, মাহাত ভাইয়াও তোর জন্য চিন্তা করছেন।’

‘উনার কেন আমাকে নিয়ে এত মাথাব্যথা বলতো? একটা তো কবিতা আবৃত্তি করতে চেয়েছিলাম, তাও আবার ভার্সিটির প্রোগ্রামে। অথচ এই ভদ্রলোক এমন একটা ভাব করছেন, যেন আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউজে গিয়ে কবিতাটা আবৃত্তি করব। আশ্চর্য!’

লীনা লোকটার উপর ভীষণ ক্ষুব্ধ। তা দেখে পুতুলের অবশ্য ভারী আনন্দ জাগছে।

তাদের কথার মাঝেই ওয়াশরুমে আরো দুজন মেয়ের আগমন ঘটল। তার মধ্যে একটা মেয়েকে পুতুল চেনে। খুব ভালো ভাবেই চেনে। এটাই সে মেয়ে, যে তার সারাজ ভাইয়ের থেকে নাম্বার নিয়েছিল। তাদের কথোপকথন শুনতে কান খাড়া করল পুতুল। শুনতেও পেল সে। মেয়েটা তার পাশের মেয়েটাকে খুব আফসোসের সুরে বলছে,

‘আমার শালা ভাগ্যটাই খারাপ। ভেবেছিলাম, অবশেষে একটা ক্রাশ পাত্তা দিল। এখন বোধ হয় চুটিয়ে একটা প্রেম করতে পারব। অথচ, সেই ক্রাশের নাম্বার এখনও বন্ধই বলে যাচ্ছে। বেটা বোধ হয় আমাকে ভুল নাম্বার দিয়েছে রে।’

ব্যাস, এইটুকু শুনেই পুরো ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে গেল পুতুলের। তার মানে, সে অযথাই সারাজ ভাইকে এত সন্দেহ করছিল। পুনরায় পুরোনো সেই অনুরাগ মস্তিষ্কে চেপে বসল তার। এবার, সে নিশ্চিত; সারাজ ভাই তাকে ঈর্ষান্বিত করার জন্যই এসব করেছেন। খুশিতে চোখ মুখ পুলকিত হয়ে উঠে তার। সারাজ ভাইকে এখনই একটা কল দিতে হবে। বলতে হবে, সে তার সমস্ত চালাকি ধরে ফেলেছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here