#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৪।
পুতুল তার সিটে হেলান দিয়ে এক খেয়ালে সারাজকে অবলোকন করে যাচ্ছে। এই লোকটাকে মাঝে মাঝে অত্যন্ত অপরিজ্ঞাত লাগে তার। এই যে এখন যেমন লাগছে। সারাজ ভাইয়ের প্রেম প্রেম পাচ্ছে? আশ্চর্য, তার মতো এমন রগচটা গম্ভীর মানুষেরও বুঝি প্রেম প্রেম পায়?
সারাজ হঠাৎ কন্ঠ খাদে নামিয়ে ঔৎসুক্য সুরে বলে উঠে,
‘এভাবে যে দেখছিস, পরে যদি আমার নজর লেগে আমি কুৎসিত হয়ে যায়; সেই দায়ভার কি তুই নিবি?’
সারাজের প্রশ্ন শুনে ভড়কে যায় পুতুল। ভ্রুকুটি করে চেয়ে বলে,
‘আমি তোমাকে দেখছিলাম না। আমি ভাবছিলাম কেবল।’
সারাজ তার দিকে একপলক চেয়ে বলে,
‘কী ভাবছিলি?’
‘তোমার হঠাৎ প্রেম প্রেম পাচ্ছে কেন, বলতো? এটা তো মোটেও ভালো লক্ষণ নয়। ব্যাপার কী, হু?’
পুতুল ভ্রু নাচায়। সারাজ সদ্য প্রেমে পড়া প্রেমিকদের ন্যায় সলজ্জ হেসে বলে,
‘মনে হয় প্রেমে পড়েছি।’
বিস্ফোরিত নয়নে তাকায় পুতুল। কোটর ছেড়ে এই বুঝি অক্ষি যুগল বেরিয়ে আসবে তার। তার সারাজ ভাই প্রেমে পড়েছে? বক্ষঃস্থলে মোচড় দেয় তার। ত্রসন গলায় জিজ্ঞেস করে,
‘কার প্রেমে পড়েছ?’
সারাজ চোখ ঘুরিয়ে পুতুলের আতঙ্কিত মুখের দিকে চেয়ে ম্লান হাসে। তারপর আবার সামনে চেয়ে বলে,
‘একটা ছোট্ট প্রতিমার। কী মিষ্টি দেখতে সে। হরিণনয়নার ন্যায় অক্ষিযুগল মেলে সে যখন আমাকে দেখে, চিত্ত জুড়ে তখন আমার শীতল স্রোত বয়ে যায়। কী অনবদ্য সেই নেত্র জোড়া। মনে হয়, এই হরিণাক্ষীর গভীরে তলিয়েই আমার একদিন প্রাণনাশ হবে। তবে, তার থেকেও আমাকে অধিক প্রলুব্ধ করে কি জানিস? ওর ওষ্ঠযুগল।’
থামে সারাজ। না, আর বলতে পারছে না। মনটা এবার বেসামাল হয়ে যাচ্ছে। ঐদিকে আরেক মেয়ের যে জান ওষ্ঠাগত সেই খেয়াল তার নেই। পুতুলের গাল বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়ে। সারাজের দৃষ্টিগোচর হওয়ার আগেই সন্তর্পনে সেটা মুছে ফেলে সে। অন্যদিকে চেয়ে কাঠ কাঠ গলায় বলে,
‘কে সে মেয়ে? আমি কি চিনি তাকে?’
সারাজ রগড় সুরে বলে উঠে,
‘অবশ্যই চিনিস।’
পুতুল চট করে উঠে বসে। মাথার ভেতর সব এলোমেলো লাগছে। সে ঐ মেয়েকে চেনে? তারমানে তার পরিচিত কেউ। কে হতে পারে? পুতুল চিন্তন মনে ফের বাইরে তাকায়। দুশ্চিন্তা আর বিষাদ অন্তরিন্দ্রিয় চিবিয়ে খাচ্ছে তার। একটু পরপর নাক টানছে। মরে যেতে ইচ্ছে করছে। বেঁচে থেকে আর কী লাভ? সেই তো সারাজ ভাইকে তার হারাতে হলো। এবার ঐ কামাল মিয়া ছাড়া তার আর গতি নেই। পুতুলের গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। পাশে সারাজ বিধায় সেটাও এখন অসম্ভব। রাগে, ক্ষোভে ফেটে যাচ্ছে সে। এতদিনের এত প্রেম, এত আবেগ সব বৃথা তার।
_____
সারাজের গাড়ি এসে থামে তাদের গন্তব্যে। পুতুল হম্বি তম্বি দেখিয়ে গাড়ি থেকে নামার জন্য উদ্যত হতেই সারাজ মৃদু আওয়াজে বলে উঠে,
‘ঐ মেয়েটা কে, জানতে চাস না?’
পুতুল দাঁত খিঁচে চেয়ে বলল,
‘না, জানতে চাই না।’
বলেই গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে যায় সে। সারাজ পেছন থেকে আওয়াজ তুলে বলে,
‘সমস্যা নেই। আগামী সপ্তাহেই তার সাথে তোর পরিচয় করিয়ে দিব।’
বলেই গাড়ি নিয়ে ফের বেরিয়ে যায় সে।
.
পুতুল বাড়ি এসে ধুমুর ধুমুর শব্দ করতে করতে নিজের রুমে চলে যায়। এত জোরে জোরে শব্দ শুনে মেহুল তার কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে দেখে, পুতুল এসেছে। মেহুল প্রসন্ন হেসে তার রুমের কাছে যায়। তখনই পুতুল গর্জে উঠে বলে,
‘মা, আগামী তিন ঘন্টা আমার রুমে কেউ এলাউ না। কেউ না মানে কেউ না। তিন ঘন্টা পর আমি নিজে নিচে গিয়ে খেয়ে আসব। এর আগে কেউ যেন আমার রুমের ধারে কাছেও না আসে। বুঝেছো?’
মেহুল চোখ পাকিয়ে তাকায়। পুতুল সেসবে পাত্তা না দিয়ে বলে,
‘তোমার ঐসব চোখ পাকানোতে বাবা ভয় পেলেও, আমি পাই না। সো, এসব করে লাভ নেই। যাও, তুমি তোমার রুমে গিয়ে চুপচাপ টিভি দেখো। তিন ঘন্টা পর আবার দেখা হচ্ছে। টাটা।’
বলেই রুমের দরজা আটকে দেয় সে। মেহুল মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এই মেয়ে আর তাকে শান্তি দিল না।
____
‘আপনি তো দেখছি মারাত্মক ফাজিল মেয়ে। একটা মানুষকে কেউ এতবার কল দেয়?’
মেসেজটা দেখেই মেজাজ তুঙ্গে উঠে লীনার। মানে ফাজলামো পেয়েছে না-কি? কাল থেকে তাকে লাগাতার জ্বালিয়ে এসে, এখন আবার তাকেই ফাজিল মেয়ে বলছে। কী অভদ্র, ভাবা যায়। লীনা সঙ্গে সঙ্গে মেসেজের জবাবে লেখে,
‘এই যে মি. , আপনি কে বলুন তো? কাল থেকে জ্বালিয়ে এখন আবার আমাকেই ফাজিল বলছেন? আমি ফাজিল হলে আপনিও হলেন বিরাট বড়ো মাপের একজন অভদ্র লোক।’
তার মেসেজ পাঠানোর পরপরই উত্তর আসে,
‘কী করব বলুন? আজকাল ভালো ছেলেদের মেয়েরা খুব একটা দাম দেয়না। তাই একটু অভদ্র হওয়ার ট্রাই করছি। তবে আমি কিন্তু খুব বেশি অভদ্র না। একটুখানি অভদ্র। আপনি চাইলেই আমার সাথে মানিয়ে নিতে পারবেন।’
মেসেজ পড়েই ভ্রু কুঁচকায় লীনা। এখানে মানিয়ে নেওয়ার কথা আসছে কোথ থেকে? সে আবার মেসেজে লেখে,
‘আশ্চর্য, এখানে মানিয়ে নেওয়ার কথা আসছে কোথ থেকে? মনে হচ্ছে যেন, আমি আপনাকে বিয়ে করতে যাচ্ছি।’
তার মেসেজেই বিপরীতে অপর পাশ থেকে উত্তর আসে,
‘বলা তো যায় না, কখন কী হয়।’
তার পরপরই একটা চোখ টিপের ইমুজি আসে। লীনা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে মেসেজটার দিকে। অভদ্রের শেষ সীমানায় পৌঁছে গিয়েছে লোকটা। লীনা তেতে উঠে সঙ্গে সঙ্গেই সেই নাম্বারটা ব্লক করে দেয়। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, আর একবার তাকে বিরক্ত করতে আসলে একেবারে পুলিশ কেইস ঠুকে দিবে। অভদ্র কবি কোথাকার।
________
ঠিক তিন ঘন্টা পরেই পুতুল নিচে নামে। ডাইনিং এ বসে মেহুলকে চেঁচিয়ে ডেকে বলে,
‘মা, খাবার দাও।’
মেহুল রুম ছেড়ে বেরিয়ে ডাইনিং রুমে এসে দাঁড়ায়। মেয়ের দিকে গভীর মনঃসংযোগ করে বলে,
‘কেঁদেছিস তুই?’
পুতুল নাকের পাটা ফুলিয়ে বলে,
‘হু।’
‘কেন?’
‘এমনি। অনেকদিন ধরে কাঁদছিলাম না বলে কীভাবে কাঁদতে হয় ভুলে গিয়েছিলাম; তাই কতক্ষণ প্র্যাকটিস করে আসলাম। বিয়েতে তো কাঁদতে হবে, তাই না?’
মেহুল ফিচেল হেসে ফলে,
‘আমার তো মনে হচ্ছে, তুই একদমই কাঁদবি না। বরং নাচতে নাচতে শ্বশুরবাড়িতে চলে যাবি।’
পুতুল ভ্রু কুঁচকে চেয়ে বলে,
‘হয়েছে। আমি এই ব্যাপারে আর কিছু শুনতে চাই না। খাবার দাও, খিদে পেয়েছে।’
মেহুল একজন গৃহকর্মীকে ডেকে বলল, রান্নাঘর থেকে সব খাবারগুলো বেড়ে নিয়ে আসতে। তারপর সেও একটা চেয়ার টেনে বসল ঠিক পুতুলের মুখোমুখি। পুতুল খালি প্লেটে আঙ্গুল দিয়ে খুটে যাচ্ছে। চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, মারাত্মক ক্ষোভ ভেতরে তার। মেহুল ঠোঁট গোল করে নিশ্বাস ফেলে। কোমল গলায় বলে,
‘কামাল মিয়াকে তুই বিয়ে করতে চাস না, তাই না?’
পুতুল চোখ তুলে মায়ের দিকে তাকায়। মায়ের চোখ মুখ দেখে চিত্তের খবর সে ঠাহর করতে পারছে না। তাই জিজ্ঞেস করে,
‘হঠাৎ এই প্রশ্ন?’
‘আমরা তোর উপর কোনদিনই কোনোকিছু চিপিয়ে দেইনি। সবকিছু হয়েছে তোর মর্জিতেই। আর তাই এই বিয়েটাও আমরা তোর উপর চাপিয়ে দিব না। তুই যা বলবি তাই হবে। বল, কী চাস তুই? বিয়েটা হোক?’
পুতুল হতাশ সুরে বলে,
‘না।’
মেহুল পরপরই বলে উঠে,
‘কেন? অন্য কাউকে পছন্দ করিস?’
মাথা নুইয়ে ফেলে পুতুল। মায়ের কাছে কোনদিনও কোনোকিছু লুকাইনি, কেবল সারাজের প্রতি তার অনুভূতি ছাড়া। কিন্তু, আজ ইচ্ছে হচ্ছে সেটাও বলে দিতে। পরক্ষণেই আবার ভাবছে, লাভ কী? সারাজ ভাই তো অন্যকাউকে ভালোবাসে। পুতুলের বুক চিরে বেরিয়ে আসে রুদ্ধশ্বাস। সে মায়ের দিকে চেয়ে বলে,
‘আমার পছন্দ অপছন্দে এখন আর কিছুই যায় আসে না, মা। আমি এমনিতেও তাকে হারিয়ে ফেলেছি।’
‘কাকে? কার কথা বলছিস তুই?’
মেহুল অধীর গলায় প্রশ্ন করে। পুতুলের নতজানু। মায়ের চোখের দিকে চেয়ে বলতে পারবে না। বিব্রত হচ্ছে ভীষণ। সে মৃদু আওয়াজে বলে,
‘সারাজ ভাই।’
কাঙ্খিত নাম শুনে স্বস্তির শ্বাস ফেলে মেহুল। তারপর প্রসন্ন হেসে পুতুলকে জিজ্ঞেস করে,
‘সারাজকে পছন্দ করিস?’
‘হু।’
‘বিয়ে করবি ওকে?’
পুতুল টলমল চোখে চেয়ে বলে,
‘কিন্তু, উনি অন্য কাউকে পছন্দ করেন।’
সেই কথা শুনে মেহুল সশব্দে হাসে কতক্ষণ। পরে হাসি থামিয়ে রয়ে সয়ে বলে,
‘ভেবে নে, বিয়ে ফাইনাল। আজ থেকে ঠিক দশ দিন পর।’
হতভম্ব হয়ে তাকায় পুতুল। মা কী বলছে এসব? তার তো বোধগম্য’ই হচ্ছে না কিছু। আজ থেকে দশ দিন পর কি তার আর সারাজ ভাইয়ের বিয়ে? এটা কি আদৌ সত্যি হবে? না-কি মা তার সাথে মজা করছে?
চলবে…
(আপনাদের দশ দিন সময় দেওয়া হলো। সবাই এর মধ্যেই সব শপিং সেরে ফেলুন। আর অবশ্যই বিয়ের পাত্র পাত্রীর জন্য সুন্দর সুন্দর গিফ্ট কিনবেন। গিফ্ট ব্যতিত বিয়ে খাওয়া নিষেধ🥱)