#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৮।
ক্লাস শেষ করে সবেই ভার্সিটির গেইটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে লীনা। বাইরের দিকে দৃষ্টি যেতেই চোখ মুখ কুঁচকে আসে তার। কী মারাত্মক রোদ আজ! চোখে এসে লাগছে যেন। পুতুলও আজ ভার্সিটিতে আসেনি। উল্টো তাকে তার বাড়িতে ডেকেছে। মেয়েটার যে আজকাল কী হয়েছে কে জানে?
লীনা হাত উঠিয়ে একটা রিক্সাকে ইশারা দেয়। তবে রিক্সা আসার আগেই সেখানে এসে উপস্থিত হয় মাহাত। মাহাতের এমন আকস্মিক আগমনে ভড়কে যায় লীনা। ভ্রূ কুঁচকে বলে,
‘আপনি এখানে?’
মাহাত ব্যস্ত চোখে একবার হাতের ঘড়িতে সময় পরখ করে পুনরায় লীনার দিকে চেয়ে বলে,
‘আরো দু ঘন্টা বাকি। তবে আমার আর ধৈর্যে কুলোচ্ছে না। উত্তরটা দিয়ে দাও তো, লীনা।’
লীনা বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। এমন ভাবে বলছে, যেন এই উত্তর দেওয়াটা একেবারেই ঠুনকো ব্যাপার। অথচ, এটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে কাল থেকে তার মাথা ব্যথা হয়ে গিয়েছে। লীনাকে চুপ থাকতে দেখে মাহাত নিঃস্পৃহ সুরে বলে উঠে,
‘এই, তুমি কি আজকেও চুপ থাকার ব্রত করছো? তবে, আমি কিন্তু আজ উত্তর না পাওয়া অবধি তোমাকে ছাড়ছি না। সো, বি ফাস্ট। আমার আবার ল্যাবে যেতে হবে।’
লীনা শান্ত চোখে চাইল। বলল,
‘আপনি আমায় ভালোবাসেন, মাহাত?’
মাহাত অকপটে বলে উঠে,
‘ভালোবাসা না থাকলে কি বিয়ে করতে চাইতাম?’
‘তাও, আপনি তো একবারও সেটা মুখে বলেননি। আর আমাদের তো কেবল এই কয়দিন’ই কথা হয়েছে। এর মাঝেই আপনি বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসলেন? পরে যদি আপনার আফসোস হয়?’
সশব্দে হাসে মাহাত। বলে,
‘আমার নিজের উপর আস্থা আছে। আমার পছন্দ কখনো খারাপ হতেই পারে না। এখন এত কথা না বাড়িয়ে উত্তর দাও তো। এমনিই মাথার উপর বিশাল চাপ। সামনে ফাইনাল, অ্যাসাইনমেন্টের প্যারায় যা তা অবস্থা একেবারে। এখন আপাতত তোমার উত্তর শুনে নিজের অশান্ত মনটাকে একটু শান্ত করতে চাই।’
লীনা ইতস্তত সুরে বলে,
‘কী উত্তর দিব?’
মাহাত ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল,
‘বিয়ে করবে কি-না?’
‘যদি উত্তর না হয়?’
‘তবে তুলে নিয়ে যাব।’
লীনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘তাহলে আর উত্তর শুনে কী করবেন? আমার হ্যাঁ বা না তে তো আপনার কিছুই যায় আসে না। সেই তো আমাকে তুলে নিয়ে গিয়েই বিয়ে করবেন।’
‘তাও, মনের শান্তি বলে একটা ব্যাপার আছে না?’
লীনা যে রিক্সাকে ডেকেছিল সেই রিক্সা অনেকক্ষণ যাবত তার সম্মুখেই দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা বোধ হয় এই যুগলের কথাই মনোযোগের সহিত শুনছিলেন এতক্ষণ। তাই ড্যাবড্যাব করে চেয়েছিলেন এইদিকেই। লীনা ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই উনি দাঁত বের করে হেসে বললেন,
‘আপনি না ডাকছিলেন, মামা। কই যাইবেন?’
‘বনানী এগারো নাম্বার রোডে যাবেন?’
‘হ মামা, উডেন।’
লীনা চট করে রিক্সায় চড়ে বসে। তাকে রিক্সায় বসতে দেখে আরও বেশি বিদ্বিষ্ট হয় মাহাত। কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
‘তুমি কি চাও, এখন আমি অন্যসব প্রেমিকদের মতো উত্তরের জন্য তোমার পেছন পেছন ঘুরি?’
লীনা ঠোঁট চেপে মিটমিটিয়ে হাসে। রিক্সার মামাকে তাড়া দিয়ে বলে,
‘মামা, যান তো।’
মাহাত এবার খানিকটা ক্রোধ নিয়ে বলে উঠে,
‘আরে, আশ্চর্য তো! তুমি চলে যাচ্ছো কেন? আমার সময়ের কি কোনো মূল্য নেই তোমার কাছে?’
রিক্সা চলতে শুরু করে ততক্ষণে। মাহাত চোখ মুখ খিঁচে দাঁড়িয়ে থাকে। রিক্সাটা তাকে পাড় হয়ে একটু সামনে যেতেই পেছন ফিরে তাকায় লীনা। মাহাতের বিক্ষিপ্ত চোখ মুখের দিকে চেয়ে বলে,
‘শুনেছি, কষ্ট করলে কেষ্ট মেলে। তাহলে আপনি কেন এত সহজে সবকিছু পেয়ে যাবেন, হু?’
ভ্রু নাচিয়ে হেসে আবার সামনে ফেরে সে। অধর জুড়ে তার শোভিত নিরুপম হাসি। উত্তর না পাক, মাহাতের মন লীনার ঐ নিঁখুত হাসিতেই শীতল হয়ে গিয়েছে। সে এবার নিশ্চিন্তে ল্যাবে যেতে পারবে।
_______
‘তোর কী হয়েছে বলতো? আজকাল খুব ক্লাস মিস দিচ্ছিস? আবার জরুরি তলপে ডাকাডাকিও করছিস? ব্যাপার কী, হু?’
পুতুল চিপসের প্লেটটা নিয়ে পা তুলে আরাম করে সোফায় বসল। তারপর একটা চিপস মুখে পুরে বলল,
‘ব্যাপার তো তুই বলবি। উত্তর দিয়েছিস?’
‘উঁহু।’
ভ্রু কুঁচকায় পুতুল। জিজ্ঞেস করে,
‘কেন? আরও সময় লাগবে তোর?’
‘সময়ের ব্যাপার না ঠিক। তবে এত সহজেই কি আর এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায়? একটু ঘুরাতে হবে না?’
‘আচ্ছা, তোমার মনে এই চলছে তাহলে?’
‘হুম। এবার তুই তোর সমস্যার কথা বল। ভার্সিটি না গিয়ে আমাকে তোর বাসায় ডাকলি কেন?’
‘একটা জরুরি কথা বলার আছে।’
‘কী?’
‘বলছি, চিপস খা তুই।’
লীনা চিপস একটা নিয়ে মুখে পুরল। পুতুল খালাকে ডেকে বলল,
‘খালা, দুই কাপ কফি দিয়ে যেও তো।’
‘আন্টি বাসায় নেই?’
‘না। মামনির সাথে একটু বাইরে গিয়েছেন।’
‘আচ্ছা। এবার তুই তোর জরুরি কথাটা বল।’
‘বলছি। তবে তুই আবার অ্যাটাক ফ্যাটাক করবি না তো?’
লীনা চিপস খাওয়া রেখে কপাল কুঁচকে তাকায়। তীক্ষ্ণ স্বরে জিজ্ঞেস করে,
‘কোনো আকাম কুকাম করেছিস না-কি? শোন, আমি কিন্তু কোনোকিছুর দায়ভার নিতে পারব না।’
বলেই দুহাত ঝেরে সোজা হয়ে বসল লীনা। পুতুল বীতঃস্পৃহ সুরে বলল,
‘আরে না, তেমন কিছু না।’
‘তাহলে কী?’
পুতুল এক পল থেমে সময় নিয়ে বলল,
‘আমার বিয়ে তো ফাইনাল।’
লীনা চমকে বলল,
‘ঐ কামাল মিয়ার সাথেই?’
‘না।’
আরেক দফা চমকাল লীনা। বলল,
‘তাহলে কার সাথে?’
পুতুল চোখ তুলে লীনার তীক্ষ্ণ চোখ মুখের দিকে চাইল। চোখের দৃষ্টি তখন আরো সরু হলো লীনার। পুতুল ক্ষীণ আওয়াজে বলল,
‘সারাজ ভাইয়ের সাথে।’
সঙ্গে সঙ্গেই “কী” বলে চেঁচিয়ে উঠল লীনা। তার গলার আওয়াজ গিয়ে বারি খেল এই বসার ঘরের প্রতিটি দেয়ালে। বিস্ময়ে হতভম্ব সে। মুখ দিয়ে কোনো রা বের হচ্ছে না। পুতুল জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,
‘মা বাবা বিয়ে ঠিক করেছেন। আমি তো কিছু জানতাম’ই না।’
ঠাস করে পুতুলের বাহুতে একটা চ ড় বসায় লীনা।।বিক্ষিপ্ত সুরে বলে উঠে,
‘আমাকে কি বোকা পেয়েছিস? তুই কি ভেবেছিস, তোর হাবভাব আমি বুঝি না? তারমানে এতদিন আমি ঠিকই সন্দেহ করেছিলাম। তোদের দুজনের পেটে পেটেই এসব চলছিল, কেবল মুখে স্বীকার করিসনি। কী মারাত্মক অভিনয় করেছিস আমার সামনে। সারাজ ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ডের নাটকটা কিন্তু দূর্দান্ত ছিল। সব করে এখন আবার আমাকে বোকা বানাতে এসেছিস? এক থা প্পড়ে সব দাঁত ফেলে দিব, ফাজিল মেয়ে।’
পুতুল মাথা নুইয়ে লজ্জিত কন্ঠে বলে,
‘তুই না সারাজ ভাইকে পছন্দ করতি, তাই তোকে কিছু বলার সাহস পাইনি।’
‘আশ্চর্য! আমি উনাকে পছন্দ করতাম, প্রেম ভালোবাসা তো আর ছিল না। তাই বলে এত বড়ো একটা কথা আমার কাছ থেকে চেপে গেলি?’
‘স্যরি।’
‘সর, ঐসব স্যরি ট্যরি দিয়ে আমি কী করব? আমার লেহেঙ্গা লাগবে।’
মাথা তুলে তাকায় পুতুল। অবাক গলায় প্রশ্ন করে,
‘লেহেঙ্গা দিয়ে তুই কী করবি?’
‘তোর বিয়েতে পরব। আর সেই লেহেঙ্গা আমাকে তুই কিনে দিবি। নাহলে তোর সাথে আমার কোনো কথা নেই।’
পুতুল হেসে জড়িয়ে ধরে লীনাকে। উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে উঠে,
‘অবশ্যই অবশ্যই, কিনে দিব।’
‘হয়েছে, এবার প্রথম থেকে সব খুলে বল আমায়। সব না শোনা পর্যন্ত আমি শান্তি পাব না।’
__________
‘তোর কোন কার্ডটা পছন্দ হয়েছে, পুতুল?’
পুতুল সবগুলো কার্ড খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। হঠাৎ একটা হালকা বেগুনী রঙের কার্ডের দিকে নজর স্থির হয় তার। কার্ডের চারদিকে চিকন গোল্ডেন রঙের ফুলের কাজ। ফুলের এই কাজটা নিঁখুত। এই হালকা বেগুনী রঙের উপর এই কাজটা দারুন মানিয়েছে। সে কার্ডটা হাতে নিয়ে বলল,
‘মা, মামনি, আমার এটা পছন্দ হয়েছে।’
রিতা আর মেহুল কার্ডটা হাতে নিয়ে বলল,
‘বাহ, সুন্দর তো।’
‘আমার এটা ভীষণ পছন্দ হয়েছে, মা। এটাই ফিক্সড করো।’
মেহুল তখন বলল,
‘একবার সারাজকেও এই কার্ডের ছবিটা পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করেনে, ওর পছন্দ কি-না।’
‘আচ্ছা, দাঁড়াও পাঠাচ্ছি।’
পুতুল কার্ডের ছবি তুলে সারাজের হুয়াট’স অ্যাপে পাঠিয়ে দিল। লিখে দিল, ‘দেখোতো, এই কার্ডটা পছন্দ হয়েছে কি-না?’
সারাজ এই সময় অফিসে। তাই মেসেজ সিন করছে না। পুতুল বিরক্ত হয়ে কল করে। দুবার রিং বাজতেই রিসিভ হয়। পুতুল ব্যস্ত গলায় বলে উঠে,
‘শোনো, তোমার ফোনে না একটা কার্ডের ছবি পাঠিয়েছি। দেখোতো কার্ডটা কেমন লাগে।’
সারাজ বলে,
‘হোল্ড অন, দেখছি।’
ছবি দেখে সারাজ বলে,
‘একদম ভালো লাগেনি, এটা একটা কার্ড হলো?’
পুতুল বলল,
‘ছবিতে হয়তো ভালো লাগছে না। তবে বাস্তবে ভীষণ সুন্দর। আমার পছন্দ হয়েছে।’
‘তোর পছন্দের উপর আমার ভরসা নেই। তোরা থাক, আমি আসছি। আমি এসে পছন্দ করব।’
বলেই কল কাটে সারাজ। পুতুল ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে উঠে,
‘মা, তোমাদের ছেলের নাকি আমার পছন্দের উপর ভরসা নেই। সে নাকি নিজে এসে পছন্দ করবে। আমিও বলে দিচ্ছি, আমি এটা ছাড়া অন্য কার্ড নিব না। মেয়ে ছেলে উভয় পক্ষের কার্ড এটাই হবে। আর তোমরাও আমার সাপোর্ট করবে, বুঝেছো?’
জবাবে মেহুল আর রিতা হতাশ ভঙিতে মাথা নাড়ায় কেবল।
চলবে….
(নো টেনশন, সবার বাড়িতে বাড়িতে কার্ড পাঠিয়ে দেওয়া হবে😉)