#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪।
‘এই সারাজ, তোর কি আর কোনো কাজ নেই? তুই অযথা মেয়েটাকে এত জ্বালাস কেন বলতো?’
মাত্রই বাসায় ফিরেছে সারাজ। সিঁড়ির কাছে যেতেই রিতা তার পথ আটকাল। মায়ের প্রশ্নে কপালে ভাঁজ পড়ল তার। জিজ্ঞেস করল,
‘কোন মেয়ে?’
রিতা জোরে শ্বাস ফেলে বলল,
‘পুতুলকে ছাড়া আর কোন মেয়েকে চিনিস তুই?’
সারাজ ভাবুক দৃষ্টিতে চেয়ে শুধাল,
‘কিন্তু, আমি কী করেছি?’
‘পুতুল আমার কাছে বিচার দিয়েছে, তুই নাকি ওকে খুব বিরক্ত করিস।’
সারাজ বিরক্ততে মাথা নাড়াল। কাঠ কাঠ গলায় বলল,
‘আম্মু, তোমার ছেলে এতটাও অবসর না, যে সারাদিন ঐ মেয়ের পেছনে পড়ে থাকবে। আর ওকে তোমরা যত নিষ্পাপ ভাবছ, ও মোটেও তেমন না। আস্ত একটা ফাজিল হয়েছে। কেউই তো শাসন করো না ঠিকঠাক। আমিও যদি ছেড়ে দেই, তবে আরো বিগড়ে যাবে।’
বলেই সে সিঁড়ি বেয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। রিতা তার যাওয়ার পানে চেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। যাক,
ছেলেটা তার পুতুলকে নিয়ে খুব সিরিয়াস। এমনই তো চায় সে। পুতুল তার ঘরের পুতুল হয়ে আসুক। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে খুব শীঘ্রই এই স্বপ্নটা পূরণ করে ফেলবে।
__________
রুমে বসে পড়ছিল পুতুল। ঠিক পড়ছিল না, বইয়ে মাঝে রেখে ফোন দেখছিল। পরীক্ষার আগের রাত ছাড়া তার আবার পড়া হয়না। কিন্তু, মা মানলে তো সেসব। জোর করে পড়ায় বসিয়ে রাখে। ভেবেছিল, অনার্সে উঠলে বোধ হয় এই পড়ার চাপ থেকে একটু রেহাই পাবে। তেমন তো হলোই না, উল্টো মনে হচ্ছে চাপ যেন আরো বেড়েছে। আর সে জানে, এর পেছনেও পরোক্ষভাবে ঐ সারাজ ভাই’ই জড়িত। সারাক্ষণ মায়ের কান ভাঙায়। একটা ছেলে যে এত বড়ো কূটনা হতে পারে, সেটা সারাজকে না দেখলে সে বুঝতেই পারত না। সাংঘাতিক এক মানুষ!
হঠাৎ সারাজের কথা মনে পড়তেই বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠে। আচ্ছা, সারাজ ভাইয়েরও কি এমন করে? করে হয়তো, নয়তো তখন উনার হৃদস্পন্দনটা এত বেড়ে গিয়েছিল কেন? এটা মোটেও স্বাভাবিক হৃদস্পন্দন ছিল না। সারাজ যতই চোখ রাঙাক না কেন, সে হাজারবার বলবে, এই হৃদস্পন্দন মোটেও স্বাভাবিক না। এই স্পন্দন অন্যকিছু বলছে। তবে কি সারাজ ভাইও তাকে…?
লজ্জায় লাল হয়ে উঠে পুতুলের ফর্সা গোল গোল গালগুলো। চট করে ফোনের গ্যালারিতে গিয়ে সারাজের একটা ছবি বের করে। দু ভ্রু উঁচু করে আপ্লুত হয়ে তাকায় সেই ছবির দিকে। যত দেখে ততই যেন প্রেমে পড়ে। ইশ, এই মানুষটা এত সুদর্শন কেন? সে তো প্রেমে পড়তে পড়তে এবার ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। একটা মানুষের উপর আর কতবার প্রেমে পড়া যায়?
তার প্রেমময় ভাবনায় ছেদ পড়ে। মেহুল তখন এক দুধের গ্লাস নিয়ে রুমে ঢুকে। জিজ্ঞেস করে,
‘কী করছিস?’
মায়ের গলা পেয়ে পুতুলের সম্বিত ফেরে। চট জলদি ফোনটা বইয়ের ভাঁজে লুকিয়ে ফেলে। মেহুল দুধের গ্লাসটা টেবিলের উপর রাখতে রাখতে শান্ত গলায় বলে,
‘তোর এই সময়টা আমিও পার করে এসেছি, পুতুল। দে, ফোনটা আমার কাছে দে।’
বলেই সে পুতুলের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। পুতুল ইতস্তত বোধ করছে। বইয়ের ভাঁজ থেকে ফোনটা বের করে, সেটা লক করে মায়ের হাতে দেয়। মেহুল ফোনটা চেপে ধরে বলে,
‘এবার দুধটুকু খেয়ে মনোযোগ দিয়ে পড়।’
দুধ দেখে নাক ছিটকাল পুতুল। অসহায় গলায় বলল,
‘মা, দুধ না দিয়ে কি চা দেওয়া যায় না?’
‘না, যায় না। দুধ খেলে পুষ্টি পাবি। আর চায়ের মধ্যে কোনো পুষ্টি নেই। তাই চায়ের চেয়ে দুধ বেটার অপশন।’
বলেই সে বেরিয়ে যায়। পুতুল বিরক্ত চোখে চেয়ে থাকে দুধের গ্লাসের দিকে। এইসময় বাবা থাকলে, বাবার সামনে গিয়ে অভিমান করতে পারত। মা চা বানিয়ে দেয় না বলে অভিযোগ করতে পারত। কিন্তু, এই মানুষটার এত অভিমান, অভিযোগ শোনার সময় কই? উনি তো কেবল উনার মন্ত্রিসভা নিয়েই ব্যস্ত।
_______
এক টেবিলে সকলে খেতে বসেছে। যদিও সবাই নেই এখন। একজন ব্যক্তির অভাব। আর সেই ব্যক্তির চেয়ারটাও বরাবরের মতোই শূন্য। প্রতিবার চেয়ারে বসে একবার তার বরাবর চেয়ারটার দিকে তাকায় রাবীর। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এই চেয়ারে তার মা বসতেন। এখন আর বসে না। চেয়ারটা শূন্যই পড়ে থাকে। কেউ আর বসে না। কিন্তু, তাও প্রতিদিন সে নিয়ম করে একবার এই চেয়ারটাতে চোখ বুলায়। মাঝে মাঝে মনে হয়, ঐ তো মায়ের প্রতিচ্ছবি দেখছে সে। কিন্তু, সে জানে, এটা মনের ভ্রম ছাড়া আর কিছুই না। মা মারা গিয়েছে আজ পাঁচ বছর। অথচ মানুষটাকে সে এখনও আগের মতোই স্মরণ করে, প্রতি ক্ষণ, প্রতি মুহূর্তে।
রাবীরের পাশের চেয়ারটাতে পুতুল এসে বসে। পুতুলকে দেখে রাবীর হেসে বলে,
‘কী রাজকন্যা, ফুচকা খেয়ে এসে মন ভালো হয়েছ?’
পুতুল প্লেট নিতে নিতে হেসে বলে,
‘হ্যাঁ, খুব। তবে তুমি নিয়ে গেলে মন আরো ভালো হয়ে যেত। তুমি তো আজকাল আমাদের সময়ই দাও না, বাবা। মাও কত কষ্ট পাচ্ছে জানো? সেদিন লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদেছিল।’
মেয়ের কথা শুনে মেহুল ভড়কে যায়। সে আবার কখন কাঁদল? এই মেয়ে যেভাবে নাক মুখ শুকিয়ে মিথ্যা বলছে, যে কেউ এর কথা বিশ্বাস করবে। হলোও তাই। রাবীরও বিশ্বাস করে নিল তার কথা। মেহুলের দিকে বড়ো বড়ো চোখে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘আমি সময় দিতে পারছি না বলে আপনি কাঁদছিলেন, মেহুল?’
মেহুল কপাল চাপড়ে বসে। হতাশ গলায় বলে,
‘যেমন মেয়ে তার তেমন বাপ। ওর এই কথাটা আপনার কোনদিক দিয়ে সত্যি মনে হলো? সেই যৌবন কালেই আপনার ব্যস্ততায় আমি কোনোদিন বিরক্ত হয়নি, আর এখন বুড়ো বয়সে এসে বুঝি কাঁদব? আপনিও না, মেয়ে যা বলবে তাই বিশ্বাস করবেন?’
‘মা, তুমি না কাঁদলেও কষ্ট পাচ্ছো তো। আর আমি তো ..’
‘এই তোর আর কিছু বলতে হবে না। চুপচাপ খা। এক্কেবারে একটা ফাজিল হয়েছে। এইজন্যই সারাজ বলে, শাসনে শাসনে রাখতে।’
সারাজের কথা শুনে কপাল কুঁচকাল পুতুল। ক্ষিপ্ত সুরে বলল,
‘হ্যাঁ, তোমরা তো সারাদিন ঐ সারাজকে নিয়েই পড়ে থাকো। এক কাজ করো, উনাকে যদি তোমাদের এতই পছন্দ হয় তবে, উনাকে তোমরা নিজেদের কাছে নিয়ে এসো আর আমাকে মামনির কাছে দিয়ে এসো। এমনিতেও মামনি তোমাদের মতো না। সারাজ ভাইয়ের চেয়েও মামনি আমাকে বেশি ভালোবাসে।’
পুতুল অভিমান করে মুখ ফুলায়। মেহুল তখন মনে মনে ভাবে, ‘তা তো বাসবেই। একমাত্র ছেলের বউ যে তুই।’
বাবার আদরে গলায় কিছুক্ষণের মাঝেই মন হালকা হয় পুতুলের। এই যে এত বড়ো হয়ে গিয়েছে, বয়স বাড়ছে, তাও মা বাবার সামনে যেন সে সেই ছোট্ট পুতুল। সবার আদরের পুতুল। তাই তো এত অভিমান, অভিযোগ আর আহ্লাদ করার সুযোগ পায়। নয়তো পেত নাকি?
___________
বারান্দায় ছিল পুতুল। রুমের ভেতরে ফোনটা তার ক্রমাগত বেজে চলছে। সেই শব্দ কান অবধি পৌঁছাচ্ছেনা তার। সে মন দিয়ে আকাশ দেখছে। কী দেখছে কে জানে? সেই তো প্রতিদিন একই রকম রূপে দেখে এই আকাশকে। তাও, এত তাকিয়ে থাকার কী আছে কে জানে?
পুতুল অনেকক্ষণ আকাশ দেখে রুমে যায়। গিয়েই দেখে ফোন বাজছে তার। এত রাতে কে কল করছে? মনে প্রশ্ন জাগে। ফোন হাতে পরিচিত নাম্বারটা দেখেই ঠোঁটের কোণে চমৎকার হাসি ফুটে তার। মন বলে উঠে, ‘তোর মতো তোর সারাজ ভাইও তোকে মিস করছিল, পুতুল। এই জন্যই তো কল দিচ্ছে।’
পুতুলের খুশি যেন ধরে না। কল রিসিভ করে কানে ধরে। বুকটা এমন করছে যেন, সদ্য প্রেম হওয়া কোনো প্রেমিকের কল ধরছে।
তবে ওপাশ থেকে শোনা যায়, শক্ত রুক্ষ গলার স্বর,
‘তুই তো ভীষণ স্বার্থপর মেয়ে, পুতুল। এতটা স্বার্থপরতা তো মীরজাফরও নবাবের প্রতি দেখায়নি। তুই এত স্বার্থপর হলি কী করে?’
পুতুল আগা মাথা কিছুই বুঝল না। অবুঝ গলায় প্রশ্ন করল,
‘আমি আবার কী করেছি?’
‘কী করেছিস? কিছু বুঝতে পারছিস না, তাই না? সামনে থাকলে দু তিনটা দিয়ে বোঝাতে পারতাম। সাধে কি আর তোকে ফাজিল, বেয়াদব ডাকি? তুই আসলেই একটা ফাজিল, বিরাট মাপের ফাজিল। আমি আমার এত মূল্যবান সময় ব্যয় করে তোকে ফুচকা খাওয়াতে নিয়ে গেলাম। এক প্লেটের জায়গায় দুই প্লেট খাওয়ালাম। তাও কিনা, তুই বাসায় ফিরে গিয়ে আমার আম্মুর কাছে আমার নামে নালিশ করেছিস? এত বড়ো বেয়াদবি করার সাহস হলো কী করে তোর? এর জন্য তো একটা কঠিন শাস্তি পেতে হবে তোকে। আর সেটা হলো, আজকে থেকে তোর ফুচকা খাওয়া বন্ধ। আমি কেন, অন্য কারোর সাথে গিয়েও তুই ফুচকা খেতে পারবি না। বুঝেছিস?’
পুতুল ঠোঁট উল্টে বসে পড়ে। মামনিকে বলে লাভটা কী হলো? উল্টো তো এই ছেলে তার উপর এখন আরো চড়াও হয়েছে।
সে নরম গলায় সাহস করে বলল,
‘সত্যিই তো বলেছি। আপনি তো অযথাই আমাকে বিরক্ত করেন।’
চলবে…
(যারা সিজন-১ পড়েননি, তাদের কাছে একটা কনফিউশান, পুতুল আর সারাজের সম্পর্ক কী? ওরা কি কাজিন? উত্তর হলো, না, ওরা কাজিন না। সারাজ হলো মেহুল অর্থাৎ পুতুলের মায়ের বান্ধবীর ছেলে। এখন আবার প্রশ্ন, তাহলে সারাজ পুতুলের মা বাবাকে মা বাবা কেন ডাকছে। সেটা জানতে আগের সিজনের লাস্ট কয়েকটা পর্ব পড়লেই চলবে। আশা করছি, এখন আর কোনো কনফিউশান নেই। গঠনমূলক মন্তব্যের অপেক্ষাই রইলাম❣️)