শেষটা_সুন্দর(সিজন-২) #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৪৩।

0
378

#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪৩।

দীর্ঘ এক সপ্তাহের ভ্রমণ শেষে আজ সন্ধ্যায় বাড়ি এসে পৌঁছে সারাজ আর পুতুল। তিন দিন একটু আরামে থাকতে পারলেও বাকি চারদিন তাদের যাতায়াতেই কেটে যায়। পুতুলের শরীর এখন বড্ড ক্লান্ত। তাদের পেয়েই খুশিতে ঝলমল করে উঠে রিতা। এগিয়ে এসে পুতুল আর সারাজকে জড়িয়ে ধরে। পুতুল তখন সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠে,

‘মামনি জানো, আমি তোমার জন্য অনেকগুলো মশলা আনতে চেয়েছিলাম; কিন্তু, তোমার ছেলে দেয়নি। কত করে বলেছি, ইন্ডিয়ান মশলা খুব ভালো, একটু বেশি করে নিই; কিন্তু উনি নিতেই দিলেন না।’

সারাজ দুহাত পকেটে পুরে ক্ষুব্ধ হয়ে চাইল। বলল,

‘বাসায় আসতে না আসতেই আমার নালিশ দেওয়া শুরু? আগে একটু জিরিয়ে নে মা, নালিশ দেওয়ার সময় তো আর চলে যাচ্ছে না।’

রিতা ভ্রু কুঁচকে বললেন,

‘তুই মশলা আনতে দিলি না কেন?’

‘আম্মু, ঐসব মশলা তো আমাদের দেশেই আছে। অযথা সেখান থেকে এত বোজা বয়ে আনার কী দরকার?’

‘কী দরকার, সেটা তুমি বুঝলে তো হতোই। থাক মামনি কষ্ট পেও না, আমি পরেরবার একা গিয়ে তোমার জন্য অনেকগুলো মশলা নিয়ে আসব। তোমার ছেলের সাথে আর যাব না। আমি একটা সুন্দর ছোট্ট তাজমহল কিনতে চেয়েছিলাম সেটাও আমাকে কিনে দেয়নি। শুনো, পরের বার তুমি, আমি আর মা যাব। আর সব ছেলেরা বাড়িতে থাকবে। তখন আমরা যা খুশি তা কিনতে পারব, ভালো হবে না বলো?’

সারাজ ফিচেল হেসে বলল,

‘হ্যাঁ, খুব ভালো হবে। টাকাটা তখন কে দেয় দেখব।’

পুতুল তেতে উঠে বলল,

‘তুমি আমাকে টাকার খোঁটা দিচ্ছ?’

‘না, খোঁটা দিচ্ছি না। শুধু বাস্তবতাটা বললাম। স্বামীদের টাকা আছে বলেই তো স্ত্রীরা এত খরচ করতে পারে, নয়তো কি পারত?’

পুতুল নাক ফুলিয়ে কাঠকাঠ গলায় বলল,

‘আলবাত পারত। মেয়েরা কি রোজগার করছে না।’

‘সেই হিসাব তো আলাদা। তবে সত্যি তো এটাই, একটা ছেলের সমস্ত সম্পত্তির মালিক তো তার স্ত্রী’ই হয়। সেক্ষেত্রে আমার সব সম্পত্তির মালিকও তুই।’

নাক মুখ কুঁচকে পুতুল জবাব দিল,

‘আমার তোমার কোনো সম্পত্তি লাগবে না। আমি নিজেই নিজের সম্পত্তি গড়ব। নিজের উপার্জন করব, তারপর ইচ্ছে মতো খরচ করব। তোমার টাকা আমার লাগবে না, বুঝেছো?’

হাসল সারাজ। বলল,

‘ঠিক আছে।’

বলেই সে অগ্রসর হলো নিজের কক্ষের দিকে। রিতা এতক্ষণে হতাশ গলায় জিজ্ঞেস করল,

‘তোরা কি হানিমুনে গিয়েও সারাদিন এমন ঝগড়াই করেছিস?’

“হানিমুনের” কথা শুনতেই লজ্জায় লাল হলো পুতুলের ফর্সা গাল যুগল। সে এখন কী করে বলবে যে, হানিমুনে তারা তো সব দুষ্টু দুষ্টু কাজ করেছে। ঐসব কি আর শাশুড়িকে বলা যায়? পুতুলের লাজমাখা মুখশ্রী রিতার নজর এড়াতে পারল না। রিতাও বুঝল সব; ঠোঁট চেপে হাসল। বলল,

‘হয়েছে, আর কিছু বলতে হবে না। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে রেস্ট কর। খাবার তৈরি হলে আমি ডাকব।’

অতি ভদ্র মেয়ের ন্যায় মাথা নাড়িয়ে পুতুল সেই জায়গা ছাড়ল। ইশ, সব শেষ করে এখন এত লজ্জা লাগছে কেন?

_________

রাতের খাবারের সময় হয়েছে। পুতুল সেই সন্ধ্যায় ঘুমিয়েছিল এখনও উঠার নাম গন্ধ নেই। সারাজ নিচে বসার ঘরে সাদরাজের সাথে কথা বলছে। টেবিলে খাবার দিয়ে রিতা আসে পুতুলের রুমে। পুতুলের শিউরে আলতো করে বসে তার মাথার উপর নিজের হাত ঠেকায়। মৃদু আওয়াজে ডাকে,

‘পুতুল, এই পুতুল, উঠ না। খাবার বেড়েছি তো, ঠান্ডা হয়ে যাবে।’

ঘুম জড়ানো কন্ঠে পুতুল জবাব দিল,

‘আরেকটু পরে উঠি, মামনি?’

‘না না, মা। এখনই উঠতে হবে, নয়তো পরে খাবার ঠান্ডা হয়ে যাবে।’

‘মামনি, আমার ঘুম পাচ্ছে ভীষণ। এই কয়দিন আমি একটুও ঘুমাতে পারিনি। তোমার ঐ অসভ্য ছেলে…’

বাকিটা শেষ করার পূর্বেই মস্তিষ্ক জেগে উঠে তার। হায় হায়, কী বলতে যাচ্ছিল সে। দুহাতে মুখ চেপে চট করে উঠে বসে। ঘুমের ঘোরে বুদ্ধিসুদ্ধি সব লোপ পেয়েছিল নাকি? লজ্জায় লাল হয়ে রিতার দিকে এক পলক চাইল। দেখল, রিতা ঠোঁট গুঁজে হাসছে। পুতুল মাথা চুলকে উঠে দাঁড়াল। আমতা আমতা করে বলল,

‘ইয়ে, মামনি… আমি আসলে ঘুমের ঘোরে কী কী যেন বলে ফেলেছি।’

রিতা এবার শব্দ করেই হেসে ফেলল। হাসি জারি রেখেই বলল,

‘ইশ, আমার অসভ্য ছেলেটা বুঝি তোকে খুব বিরক্ত করেছে? একটুও ঘুমাতে দেয়নি, তাই না?’

লজ্জায় রা খুইয়েছে পুতুল। অস্বস্তিতে শরীরে কাটা দিচ্ছে। দৌড়ে সে ওয়াশরুমের কাছে চলে যায়। জোরে দম নিয়ে বলে,

‘উফফ, মামনি… তুমিও দেখছি তোমার ছেলের মতো ঠোঁটকাটা হয়ে যাচ্ছ।’

বলেই ওয়াশরুমে গিয়ে ঘাপটি মেরে বসে। অপরদিকে রিতা তার কথা শুনে হাসতে হাসতে কুপোকাত।

______

খাবার টেবিলে চুপচাপ খাবার শেষ করে পুতুল গিয়ে বসল বসার ঘরে। সারাজ আর সাদরাজ এখনো খাচ্ছে। পুতুল টিভি ছেড়ে সোফায় দু পা তুলে আরাম করে বসে। খাওয়ার মাঝেই সারাজ বলে উঠে,

‘আব্বু, ভাবছি এবার অফিসের সাথে সাথে বাবার কাজটাও একটু আধটু দেখব। রাজনীতি না করি, কিন্তু টুকটাক বাবাকে সাহায্য করতে তো আর অসুবিধা নেই।’

সাদরাজ এক পলক ছেলেকে অবলোকন করে বলল,

‘দুদিক একসাথে সামলাতে পারবে না। কষ্ট হবে।’

‘আমি ম্যানেজ করতে পারব।’

‘সারাজ, তোমার জন্য চাপ হয়ে যাবে। কী দরকার? আর রাবীর তো বলেছেই…’

‘আব্বু, প্লিজ। প্লিজ আমাকে সবটা সামলাতে দাও। আমারও একটা শখ আহ্লাদ আছে। আর আমি তো তোমার কাজের ক্ষতি করে কিছু করছি না। দুইদিক আমি ঠিক সামলে নিতে পারব।’

সাদরাজের ঠিক পছন্দ হলো না কথাটা। সে নিঃস্পৃহ সুরে বলল,

‘এত বোঝানোর পরও যখন তুমি আমার কথা শুনবে না, তখন আমার আর কিছুই বলার নেই। যা খুশি করো।’

বাকিটা সময় নিরবতা বজায় রেখে খাবার শেষ করে উঠে পড়ে সাদরাজ। সে চলে যেতেই রিতা প্রশ্ন ছুড়ে,

‘কী দরকার এসবের, সারাজ? রাজনীতি তোর বাবার পছন্দ না, এসবের মাঝে নিজেকে জড়াস না। অযথা তোদের সম্পর্ক খারাপ করিস না, বাবা। একটু বোঝ।’

‘আম্মু, তোমাদেরও তো একটু বোঝা উচিত। প্রত্যেক মানুষের’ই তো একটা স্বপ্ন থাকে, একটা প্যাশন থাকে। আর আমার কাছে রাজনীতি ভীষণ পছন্দের একটা জিনিস। সবার চিন্তা ভাবনা তো আর সমান না। আব্বু কেন বুঝতে পারছেন না? আমি কখনোই রাজনীতির অপব্যবহার করব না। বাবাকে দেখেই আমি অনুপ্রাণিত। প্লিজ, তোমরা কেউ আমাকে বাঁধা দিও না। আমি তোমাদের কথা রাখতে পারব না।’

বলে সেও সে জায়গা ছেড়ে প্রস্থান ঘটাল। বসে রইল কেবল রিতা আর পুতুল। পুতুল নিমিষ চেয়ে আছে রিতার মুখের দিকে। রিতার চোখে মুখে অস্থিরতা স্পষ্ট। পুতুল উঠে দাঁড়িয়ে তার সামনে গিয়ে হাজির হয়। আশ্বাসের স্বরে বলে উঠে,

‘মামনি, আমি উনাকে বুঝিয়ে বলব।’

রিতা রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল। মলিন হেসে বলল,

‘আমি জানি তুই পারবি। ওকে বোঝা। আমি বাবা ছেলের মাঝে কোনো অশান্তি চাই না, পুতুল।’

________

পুতুল রুমে এসে দেখল, সারাজ রুমে নেই। তাই বারান্দার দিকে পা বাড়াল সে। সেখানেই সারাজ উপস্থিত। পুতুল মৃদু শব্দে তার পার্শ্বে নিজের অবস্থানের জানান দেয়। পুতুলের উপস্থিতি টের পেয়েও নির্লিপ্ত সারাজ। কেবল নিমিষ চেয়ে আছে উন্মুক্ত অন্তরিক্ষের দিকে। পুতুল নিরব রইল। সারাজ আরো কিছুক্ষণ সময় ব্যয় করে অতঃপর বলল,

‘কেউ আমাকে না বুঝলেও তুই নিশ্চয়ই আমাকে বুঝবি, পুতুল। বুঝবি না?’

বিষন্ন শোনাল সারাজের গলার স্বর। পুতুল জবাবে কী বলবে ভাবছে। রিতাকে যে সে অন্য কথা দিয়ে এসেছে। এখন সারাজকে সে কী করে বোঝবে? কথা না পেয়ে নিরবতাই শ্রেয় মনে হলো পুতুলের। সারাজ পুনরায় গম্ভীর আওয়াজে বলল,

‘আম্মু নিশ্চয়ই আমাকে বোঝাতে বলেছেন?’

প্রশ্ন করে সে চাইল পুতুলের দিকে। পুতুল উপর নিচ মাথা নাড়াল। যার উত্তর বোঝে সারাজ বলল,

‘যার নিজ থেকেই বোঝার ইচ্ছে নেই, তাকে কেউ হাজার চেষ্টা করেও বোঝাতে পারে না। তাই এসব নিয়ে তোর কথা না বলাই শ্রেয়।’

বলেই বারান্দা ছেড়ে রুমে চলে যায় সারাজ। পুতুলের ততক্ষণাৎ মনঃস্তাপ হয়। মনে মনে আওড়ায়,

‘একবার আমার কথাটাও শুনলে না, সারাজ। এত জেদ!’

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here