#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪৬।
রিতার সংকুচিত মুখপানে চেয়ে প্রথম দফায় ভয়ে কুন্ঠিত হলো পুতুলের চিত্ত। মনে মনে আওড়াল, “মামনি আদৌ রাজি হবেন তো?” তবে কয়েক পল অতিবাহিত হতেই, বক্ষঃস্থল নিমিষেই হালকা হলো তার। চিরচেনা এক নিরুপম সুন্দর হাসি প্রস্ফুটিত হলো রিতার অধর কোণে। উচ্ছ্বসিত সুরে সে বলে উঠল,
‘এ তো ভালো খবর। তুই অবশ্যই গান গাইবি। আমাদের কারোর কোনো আপত্তি নেই।’
ঈষৎ কম্পিত বক্ষঃস্থলে নেমে এল শান্তির স্রোত। খুশির রঙ মাখল চোখে মুখে। একবার অতি উৎসাহে চাইল সাদরাজের পানে। সাদরাজের প্রসন্ন হাসিমাখা মুখাবয়ব দেখে, জবাব পেয়ে গেল পুতুল। অফুরন্ত আনন্দে শরীরে অন্যরকম এক শিহরণ জাগল তার। সহস্তে রিতাকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরল। আপ্লুত সুরে বলল,
‘তুমি বেস্ট বেস্ট বেস্ট শাশুড়ি। আই লাভ ইউ।’
রিতাও দুহাতে অতি সন্তর্পনে আগলে নিল পুতুলকে। বলল,
‘আই লাভ ইউ টু।’
পুতুল আর বিলম্ব না ঘটিয়ে নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হলো। এই খুশির সংবাদখানা এক্ষুণি সারাজ অবধি পৌঁছাতে হবে। একপ্রকার ছুটে রুমে এসে দম নিল সে। সারাজ বিছানায় আধ শোয়া হয়ে বসে মোবাইল দেখছে। পুতুলকে হাঁপাতে দেখে তার দিকে নিগূঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জিজ্ঞেস করে,
‘কী ব্যাপার, এভাবে হাঁপাচ্ছিস কেন? মনে হচ্ছে পেছনে বাঘ ভাল্লুক কিছু তাড়া করেছে।’
পুতুল দুলতে দুলতে এসে সারাজের পায়ের কাছে বসল। অতি উৎসাহের সমেত বলল,
‘মামনিও রাজি, সারাজ।’
স্বস্তি পেল সারাজ। একটু হেলান দিয়ে বসে বলল,
‘বলেছিলাম না, আম্মু রাজি হবেন’ই। তাহলে তোর অডিশন কবে?’
‘আগামী মাসের পাঁচ তারিখ।’
‘ওহ, আজকে ত্রিশ তারিখ। হাতে গুণে আর চারদিন। ভালো মতো প্র্যাকটিস কর তবে।’
__________
অপেক্ষার প্রহর অবশেষে সমাপ্তির পর্যায়ে। আগামীকাল’ই পুতুলের গানের অডিশন। মেয়েটা তাই অতিরিক্ত উত্তেজিত। উত্তেজনার পাশাপাশি এক বিশ্রী রকমের ভয়ও অন্তঃকরণে তার চেপে বসেছে। গানের অনুশীলন বেশ জম্পেশ হলেও, ভয়ের চোটে গোলমাল লাগছে সবকিছু। এই কয়দিন তাকে সারাজ, রিতা, মেহুল আর লীনাসহ সবাই বুঝিয়ে গিয়েছে, ভরসা দিয়েছে। পুতুল তাও তার এই কদর্য ভয়কে কাটিয়ে উঠতে পারছে না। মাইক হাতে গান গাওয়ার অভ্যাস থাকলেও, কখনো তো বিচারকের মুখোমুখি হয়নি; সেই নিয়েই তো তার যত দুশ্চিন্তার বাহার।
আগামীকাল অডিশন বিধায় আজ একটু বেশিই প্র্যাকটিস করছে পুতুল। নিয়ম করে রিতা তাকে কুসুম গরম পানি আর আদা দিয়ে রং চা করে দিচ্ছে, গলা পরিষ্কারের জন্য। মেহুল বারবার ফোন দিয়ে খোঁজ নিচ্ছে তার। মেয়ের চোখে সে যেন নিজের স্বপ্ন পূরণ হতে দেখছে। আনন্দে তাই শব্দবহল খুইয়ে বসেছে যেন।
____________
সন্ধ্যার একটু আগেই বাড়ি ফিরে সারাজ। পুতুলের জন্য হাতে করে নিয়ে আসে একগুচ্ছ লাল গোলাপ। গোলাপের ঘ্রাণ পুতুলের মাত্রাধিক পছন্দ। তাই সারাজের হাতে লাল গোলাপ দেখেই সমস্ত ভয়, চিন্তা নিমিষেই উবে গেল তার। সারাজ ফুলের গুচ্ছ এগিয়ে দেয় পুতুলের দিকে। নিবিষ্ট জড়ানো আওয়াজে বলে,
‘আমার পুতুল জীবনের সব প্রতিযোগিতায় জয়ী হোক।’
সুগভীর, নির্মল এক হাস্যরেখা ফুটল পুতুলের অধর কোণে। হাসি জারি রেখেই বলল,
‘আমিন।’
তারপর সারাজের হাত থেকে ফুলের গুচ্ছটা গ্রহণ করে বলল,
‘ধন্যবাদ।’
সারাজ একটু এগিয়ে এল। ভ্রু নাচিয়ে বলল,
‘শুধু ধন্যবাদ?’
সরু চোখে পুতুল চেয়ে বলল,
‘আর কী চাই?’
সারাজের দুর্জ্ঞেয় দৃষ্টিজোড়া ততক্ষণাৎ আপতিত হলো পুতুলের পাতলা ফিনফিনে ঠোঁটের উপর। আরেকটু এগিয়ে এসে ফিচের স্বরে বলল,
‘যা চাইব তাই দিবি?’
পুতুলের অসেচতন দৃষ্টিও নিক্ষিপ্ত হলো সারাজের পুরু ঠোঁটের অভিলাষে। বুঝতে বাকি নেই, সারাজের ধূর্জটি অভিব্যক্তি। সহসা আরক্ত হলো পুতুলের গাল যুগল। পিছিয়ে গেল সে। বলল,
‘অসভ্য।’
‘আর কত বলবি?’
‘তুমি সভ্য না হওয়া অবধি বলেই যাব।’
‘জীবনেও হব না।’
‘তবে, আমিও তোমাকে আজীবন অসভ্যই বলে যাব।’
সারাজ ড্রেসিং টেবিলের কাছে গেল। হাত থেকে ঘড়ি খুলে রাখল সেখানে। অতঃপর পুতুলের দিকে অটল, নিবিড়, নিগূঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
‘কালকে এই ঠোঁট দিয়ে গান গাইবি বলে আজকে বেঁচে গিয়েছিস। নয়তো আমাকে অসভ্য বলার শাস্তি অবশ্যই আজ এই ঠোঁট পেত।’
ঠোঁট চেপে রগড় হাসল পুতুল। সারাজ আজ আর ক্ষেপল না। তাকে পাশ কাটিয়ে ঢুকে পড়ল ওয়াশরুমে।
________
রাতে খেতে বসে আরেক ঝামেলার উদয় হলো। পুতুলের আজ গলা দিয়ে কোনোভাবেই খাবার নামছে না। এত চেষ্টা করেও মেয়েটা খেতে পারছে না কিছু। পেটের ভেতর কেমন যেন গুরগুরি করছে সব। একটু পরপর বুকে মোচড় দিয়ে উঠছে। তার সাথে সাথে হাত পাও কেমন যেন ঝিমঝিম করছে। পুতুল তো ভয়ে আছে এই ভেবে যে, আজই এমন অবস্থা; না জানি কাল মাইক হাতে নেওয়ার পর তার কী অবস্থা হয়।
পুতুল কোনোরকমে কিছু খেয়ে উঠে পড়ল। কেউ আর জোর করল না তাকে। সবাই পুতুলের মনের ভীত সন্ত্রস্ত ভাবটা টের পাচ্ছে। তাই এই সময় আর খাবার নিয়ে কেউ তাকে অযথা বিরক্ত করল না। পুতুল রুমে আসতেই, পেছন পেছন হাতে গরম দুধের গ্লাস নিয়ে হাজির হয় রিতা। রিতার দুধ সমেত হাত দেখে বিষন্নতায় ছেয়ে যায় পুতুলের মুখশ্রী। হতাশ সুরে বলে উঠে,
‘এখন আবার দুধও খেতে হবে?’
হাসে রিতা। বলে,
‘জি, অবশ্যই। তাড়াতাড়ি দুধটুকু খেয়ে একটা আরামের ঘুম দে। তাহলে দেখবি, সকাল সকাল মন আর শরীর দুটোই ফ্রেশ লাগবে। তখন গানটাও ঠিক মতো গাইতে পারবি।’
পুতুল নিমিষ চেয়ে রইল রিতার মুখ পানে। বিস্ময়াবিষ্ট সুরে বলে উঠল,
‘তুমি এত ভালো কেন, মামনি?’
রিতা প্রসন্ন হেসে পুতুলের চিবুক নাড়িয়ে বলল,
‘কারণ তুই আমাকে ভালোবাসিস। আর কারোর ভালোবাসার মানুষ কখনো খারাপ হতে পারে না।’
পুতুল স্মিত হেসে জবাব দিল,
‘আমি দোয়া করি, প্রত্যেক মেয়ে যেন তোমার মতো একটা শাশুড়ি পায়।’
পরপর প্রত্যুত্তর করল রিতা,
‘আমিও দোয়া করি, প্রত্যেক শাশুড়ি যেন তোর মতো একটা পুতুল বউ পায়।’
_________
পরদিন অতি প্রত্যুষেই ঘুম ভেঙে যায় পুতুলের। পিটপিট করে চোখ মেলতেই, নিজেকে আবিষ্কার করে সারাজের প্রশ্বস্থ বক্ষে। মাথাটা একটু তুলে সে মোহনীয় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সারাজের মুখপানে। তার এলোমেলো চুলে হাত বুলায়। তারপর একটু এগিয়ে এসে ঠোঁট ছোঁয়ায় তার চওড়া ললাটে। চট করে ঘুম ছুটে যায় সারাজেরও। এক চোখ মেলে ঠোঁট কামড়ে ধরে। পুতুল অতি সন্তর্পনে সরে আসতে চায়, কিন্তু সারাজের দৃঢ় হাতের বাঁধনে সহসা আটকে পড়ে সে। সারাজ এবার দু চোখ মেলে তাকায়। ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘ঘুমের মধ্যে সুযোগ নিচ্ছিলি?’
পুতুল ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে,
‘জি না, আমি কারোর কোনো সুযোগ নেই না। আমি অতি ভদ্র মেয়ে।’
‘তা তো দেখতেই পাচ্ছি। সেদিনও ঘুমের মাঝে চুমু খেয়েছিলি, আজও খেলি। তারপরও নিজেকে এত ভদ্র বলে দাবি করছিস কী করে?’
পুতুল কপাল গুঁটিয়ে তাকায়। বলে,
‘আমি দুটো চুমু খাওয়াতেই অভদ্র হয়ে গিয়েছি আর, তুমি যে রাত দিন চব্বিশ ঘন্টা আমাকে চুমু থেরাপি দাও, তখন?’
সারাজ আরেকটু শক্ত করে স্বীয় হাতের বাঁধন। মাথাটা একটু তুলে ফিসফিসিয়ে বলে,
‘চুমু থেরাপি দিলে শরীর সুস্থ থাকে, বুঝলি?’
পুতুল দুহাতে সজোরে সারাজের বুকে ঘুষি মেরে বলে উঠে,
‘না, বুঝিনি। আর বুঝতে চাইও না। ছাড়ো, উঠতে হবে আমাকে।’
সারাজ তাকে ছাড়ল না, বরং তাকে আরো ঘনিষ্ঠ করে বলল,
‘এখন পনেরো মিনিটের জন্য চুমু থেরাপি দিলে, আজকে গানটা আরো ভালো গাইতে পারবি।’
পুতুল বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে বলে,
‘না না, আমার এখন কোনো থেরাপি লাগবে না।’
পুতুলের “নাকচ” কি সারাজ আগে কখনো শুনেছে যে, আজ শুনবে? বরাবরের ন্যায় তাই আজও তাকে সারাজের নিকট পরাস্ত হতে হলো।
চলবে…..
ছবি: রত্নাবু❤️