#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৮।
দুপুরের কাঠফাটা রোদে চারদিক খা খা করছে। প্রকৃতিতে বিন্দুমাত্র বাতাসের রেশ নেই। তাও এই তপ্ত দুপুরে এই খোলা মাঠে বসে থেকে পুতুল যেন অন্যরকম প্রশান্তি পাচ্ছিল। তবে তার এই প্রশান্তি বর্তমানে অশান্তি রূপে তার সামনে এসে হাজির হয়েছে। কপাল, নাক, আর চিবুকের বিন্দু বিন্দু ঘামের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে, মেয়েটা গরমে নয়, ভয়ে ঘামছে। হাতের ফোনট কাঁপছে। স্ক্রিনে প্রিয় সুন্দর মুখটা স্পষ্ট। তাও আজ এই মুখটাকে তার পছন্দ হচ্ছে না। কতক্ষণ যাবত ফোনটা মুখ বরাবর ধরে বসে আছে পুতুল। সারাজের মাঝে কোনো হেলদোল নেই। কী দেখছে লোকটা? পুতুলকে তো আর সে প্রথম দেখছে না, তাহলে এভাবে দেখার কী আছে? পুতুল জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে মৃদু হাসে। জিজ্ঞেস করে,
‘এখন রাখি, সারাজ ভাই? ক্লাসেও তো যেতে হবে।’
সারাজের দুই ভ্রু এর মাঝে কিঞ্চিৎ ভাঁজ পড়ে। তা দেখে ঢোক গিলে পুতুল। সারাজ ভাই কিছু ধরে ফেললেন না তো? পুতুলকে সেই মুহুর্তে আরো ভড়কে দিয়ে সারাজ বলল,
‘তোর ভার্সিটির মাঠে তো কখনো নারকেল গাছ দেখেনি, তোর পেছনের ঐ গাছগুলো কোথ থেকে এসেছে?’
পুতুল আঁতকে উঠে। এই লোকের চোখ তো নয়, যেন দূরবীন। ভিডিও কলেও এতকিছু কেউ খেয়াল করে? পুতুল মুখ কাচুমাচু করে বলে,
‘আসলে এটা তো ভার্সিটির সামনের মাঠ না, পেছনের মাঠ। এইদিকটাই তুমি আসোনি তো, তাই চোখে পড়েনি কখনও।’
‘আচ্ছা, তাই। আমি তো আরো ভাবলাম, এটা বোধ হয় রমনা পার্ক। অনেকটা সেরকম দেখতে, তাই না?’
পুতুল নির্বাক। পরপর দুবার ঢোক গিলে সে লীনার দিকে চাইল। লীনার চোখে মুখেও ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। সারাজ নির্ঘাত সব জানে। জেনে বুঝে এখন ইচ্ছে করে এমন করছে। পুতুল নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে সারাজের দিকে তাকায়। সারাজের চোখ মুখ গম্ভীর। তবে ঐ গম্ভীর চোখ দিয়েই যেন পুতুলকে সে ভস্ম করে দিতে চাইছে। পুতুল এখন কী করে বোঝাবে? ভয়ে হাতের কম্পন আরো বাড়ে তার। ঠোঁট দুখানা তিরতির করে কাঁপে। ফোনের মাঝেই কম্পিত সেই ঠোঁট জোড়ার দিকে নজর আটকায় সারাজের। কিছুক্ষণ একভাবে চেয়ে থেকে চোখ বুজে নিশ্বাস ছাড়ল। কেমন যেন দম বন্ধ দম বন্ধ লাগছে তার। নিজেকে ধাতস্ত করে শান্ত গলায় বলল,
‘চুপচাপ মাঠ ছেড়ে পেছনে লেকের কাছে আয়।’
বলেই কল কেটে দিল সারাজ। পুতুল ঠোঁট উল্টে ন্যাকা কান্না জুড়ে বলল,
‘শেষ রে লীনা, আমার সব শেষ। উনি এখানেই। এতক্ষণ ধরে আমার সাথে ইচ্ছে করে মজা করছিলেন। এখন নির্ঘাত আমাকে লেকে নিয়ে চুবিয়ে মারবেন। এখন আমার কী হবে গো? ও আল্লাহ!’
লীনা নাক মুখ কুঁচকে বলল,
‘তখন যখন বলেছিলাম, আমার কথা তো শুনলি না। এখন ভালো হয়েছে না? এবার যা, সিংহের গুহায় গিয়ে নিজের প্রাণ দিয়ে আয়।’
‘তুইও এভাবে বলছিস, লীনা?’
পুতুল নাক টেনে বলল। লীনা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘এখন ঢং না করে, জলদি যা সেখানে। লেইট হলে তোর ভাই আরো বেশি রেগে যাবেন।’
“তোর ভাই” সম্বোধনটা ভীষণ বিদুঘুটে। এই মেয়ে কথায় কথায় তোর ভাই, তোর ভাই করে কেন? কোন জনমের ভাই লাগে সে? জামাই লাগে, জামাই; আহাম্মক কোথাকার।
মনে মনেই লীনাকে বকে ক্ষান্ত হলো পুতুল। তারপর পা বাড়াল পেছনের লেকের দিকে। বেশি কষ্ট করতে হয়নি। ঐ তো সারাজ ভাইকে দেখা যাচ্ছে। বাইকের সাথে হেলান দিয়ে গভীর মনোযোগে ফোন দেখছেন। ভীষণ সুন্দর তার সারাজ ভাই। দেখতে বসলে, দেখার তৃষ্ণা মেটে না। কিন্তু, এই সুন্দর মানুষটাকে সবসময় সুন্দর লাগে না। রেগে গেলে উনার রূপ পাল্টে যায়। চোখ মুখ কেমন যেন লাল হয়ে উঠে। সেই লাল মুখখানা আর যায় হোক পুতুলের চোখে সুন্দর কখনোই না।
পুতুল গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যায়। ঠিক সারাজের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। লীনা দূরেই চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকে। সারাজ আগের মতোই স্থির। ফোন দেখছে মনোযোগের সহিত। ফোনে সারাদিন কী এত দেখে, কে জানে? পুতুল হালকা উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু, সফল হয় না। অতদূর থেকে বোঝা যাচ্ছে না কিছু। তবে লোকটার আঙ্গুল চালানো দেখে সে বেশ আন্দাজ করতে পারছে, যে সে কারো সাথে চ্যাট করছে। কার সাথে? এত দ্রুত বৃদ্বাঙ্গুল চলছে তার। পুতুল বিরক্ত চোখে চেয়ে রইল। কার সাথে এত চ্যাটিং কে জানে।
প্রায় অনেক সময় পর সারাজ ফোনটা পকেটে পুরে সোজা হয়ে দাঁড়াল। পুতুলের ঠিক মুখ বরাবর। পুতুল বেচারি ভয়ে আড়ষ্ট। মনে মনে কথা সাজাচ্ছে। তবে সে জানে, এই লোকের সামনে সে জীবনেও গুছিয়ে মিথ্যা বলতে পারে না, আর আজও পারবে না।
সারাজ দুহাত পকেটে পুরে শক্ত চোখে পুতুলের দিকে চেয়ে আছে। পুতুল ভয়ে ভয়ে চাইল। হাসার চেষ্টা করল। তবে সারাজের শক্ত চোয়াল দেখে হাসিটা আর ফুটে উঠল না তার। শুকনো গলা ভেজাতে কেবল ঢোক গিলে গেল।
‘এসব করতেই মা তোকে ভার্সিটিতে পাঠাচ্ছেন?’
সারাজের ঠান্ডা অথচ শক্ত গলার স্বরে পুতুল জমে গেল সঙ্গে সঙ্গে। পিটপিট করে একবার সে সারাজের দিকে চাইল। সারাজের দৃষ্টি এখনও আগের মতোই কঠোর। পুতুলকে চুপ থাকতে দেখে সে পুনরায় প্রশ্ন করল,
‘বল, এবার কোনটার জন্য শাস্তি দিব তোকে? ভার্সিটির ক্লাস ফাঁকি দিয়ে এখানে ঘুরতে আসার জন্য, নাকি ফোনে আমাকে মিথ্যে বলার জন্য? তুই যা বলবি তাই হবে।’
পুতুল চোখ মুখ কুঁচকে নিল। মনে হচ্ছে শাস্তি না, খাবার অফার করছে। কী খাবি বল, ফুচকা না চটপটি? যেটা খেতে চাইবি সেটাই খাওয়াব। জীবনে কোনোদিন তো এত সুন্দর করে খাবারের অফার করেনি। শাস্তির বেলাতেই যত দরদ উতলে পড়ে তার।
মুখ কালো করে পুতুল বলল,
‘শাস্তি না দিলে হয় না, সারাজ ভাই? ক্ষমা মহৎ গুণ। আমাকে এবারের মতো ক্ষমা করে দিন, প্লিজ।’
বেশ অনুরোধের সুরে সে বলল। কিন্তু তার এই অনুরোধ সারাজের কঠিন হৃদয়ে আঁচড় কাটতে পারল না। সারাজ দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
‘সবাইকে ক্ষমা করা গেলেও, তোকে ক্ষমা করা যাবে না। আজকাল ভীষণ সাহস বেড়েছে তোর। আর সেই সাহসকে যদি ক্ষমার ছলে উপেক্ষা করি, তবে একসময় তা দুঃসাহসে পরিণত হবে। আর সেটা তো আমি হতে দিতে পারি না। তবে আমার মন তো আবার বিশাল বড়ো, মানুষের উপর দয়া ভীষণ। তাই চেয়েও খুব কঠিন শাস্তি দিতে পারছি না তোকে। খুব সহজ শাস্তি দিব। এই যে, এই লেক থেকে পুরো মাঠটা তুই কান ধরে পাঁচবার রাউন্ড দিবি। তারপর বাসায় গিয়ে মা’কে সব বলে, ক্ষমা চাইবি। আর জীবনেও ক্লাস ফাঁকি দিয়ে এদিক ওদিক যেতে পারবি না। ব্যস, এইটুকুই তোর শাস্তি।’
এইটুকু? এতবড়ো একটা শাস্তি এইটুকু হয় কী করে? সে এখন, এই ভর দুপুরে এত মানুষের মাঝে কান ধরে ঘুরপাক খাবে? অসম্ভব। তার একটা মান সম্মান আছে না? এই লোকটা এভাবে তার মান সম্মানে আঘাত করতে পারে না। সে অনুনয়ের সুরে বলল,
‘সারাজ ভাই, প্লিজ অন্য কোনো শাস্তি দিন। এত মানুষের মাঝে আমি কান ধরে ঘুরতে পারব না। আমারও তো একটা মান সম্মান আছে তাই না? আর তাছাড়া অনেকেই বাবাকে চিনেন, আমাকেও চিনেন। কেউ যদি বাবাকে গিয়ে বলে দেয়, আপনার মেয়েকে তো রমনা পার্কে দেখলাম, কান ধরে ঘুরছে। কী বিশ্রী ব্যাপার হবে, একবার ভেবে দেখেছেন?’
তার এত আক্ষেপ শোনার সময় কি আদৌ সারাজের আছে। সে পুনরায় বাইকে হেলান দিয়ে বসল। ফোনটা বের করে চোখে সামনে ধরে বলল,
‘সময় নষ্ট করলে, সংখ্যা বেড়ে পাঁচের বদলে দশ হবে। সেটা নিশ্চয়ই তোর জন্য ভালো হবে না?’
পুতুল ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়ে। লোকটাকে এক ধাক্কায় লেকে ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে। অ ভদ্র, অ সভ্য একটা লোক। এইটুকু একটা ব্যাপারে কেউ এত বড়ো একটা শাস্তি দেয়?
সারাজ ফের বলল,
‘সংখ্যা বাড়াতে চাইছিস, পুতুল?’
পুতুল দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘না, যাচ্ছি।’
‘এখান থেকেই কান ধরে যা। পুরো পাঁচটা রাউন্ড দিয়ে এসে আবার এখানে দাঁড়াবি। নাও গো।’
পুতুল হাত পা ছুড়ে রাগ দেখিয়ে কানে হাত দিল। মুখ কালো করে লীনার দিকে চাইল। লীনা অসহায় মুখে এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। সারাজ এবার চোখ ঘুরিয়ে লীনার দিকে চাইল। লীনা কিছুটা দূরে বিধায় সে উঁচু গলায় বলল,
‘আর এই যে তুমি, নেক্সট টাইম আর কোনো বাঁদরামিতে ওকে সাহায্য করলে তোমার বাড়িতেও বিচার যাবে। সো, বি কেয়ারফুল।’
পুতুল এমন ভাবে চোখ গরম করে সারাজের দিকে চাইল, যেন চোখ দিয়ে আস্ত মানুষটাকে গিলে ফেলবে সে। সারাজ তার দিকে শান্ত চোখে চেয়ে বলল,
‘কিরে, তুই নড়ছিস না কেন? শাস্তি কি ডাবল করব?’
কথা শেষ করার সাথে সাথেই পুতুল বড়ো বড়ো পায়ে ছুটতে লাগল। পেছন থেকে একপলক তাকে দেখে আবার তার মোবাইলে মনোযোগ দিল সারাজ।
চলবে….
ছবি: রত্নাবু❤️