#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৯।
চোখ মুখ কালো করে পুতুল দু কদম এগুতেই পেছন থেকে সারাজ আবার ডাকল। নাক মুখ কুঁচকে চাইল পুতুল। কর্কশ গলায় বলল,
‘আরো শাস্তি বাড়াতে চাও?’
সারাজ শান্ত চোখে চাইল। অমন শান্ত শীতল দৃষ্টিতে বরাবরই পুতুলের বুকের ধুকধুকানি বাড়ে। এখনও বেড়েছে। এভাবে তাকায় কেন লোকটা? বুঝে না, তার অস্বস্থি লাগে? সারাজ চোখ ঘুরিয়ে বাইক দেখিয়ে বলে,
‘বাইকে উঠ।’
চকচক করে উঠে পুতুলের মুখ। খুশি হয়ে বলে,
‘আর, শাস্তি?’
‘বাসায় গিয়ে দিব। না-কি এখানেই চাস?’
‘না না, বাসায় গিয়েই দিও। যত খুশি শাস্তি দিও, কোনো সমস্যা নেই।’
বলেই নাচতে নাচতে বাইকের কাছে গেল সে। সারাজও গিয়ে বাইকে উঠে বসল। পেছনে বসল পুতুল। বাইক ঘুরিয়ে টান দিয়ে গিয়ে থামল লীনার কাছে। লীনা এখনও চুপসে মুখে দাঁড়িয়ে আছে। সারাজ তার সামনে বাইক থামিয়ে বলল,
‘তুমি কীভাবে যাবে? রিক্সা নিয়ে এখান থেকে একা যেতে পারবে?’
লীনা চট করে মাথা দুলিয়ে বলল,
‘জি জি, পারব। এখান থেকে আমার বাসা বেশি দূর না। দশ মিনিটের রাস্তা। চলে যেতে পারব।’
‘ঠিক আছে। তুমি চলো, আমি রিক্সা ঠিক করে দিচ্ছি।’
সারাজ গেইটের বাইরে একটা রিক্সা ডেকে রাখে। লীনা তাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে চলে যায় তার বাসার দিকে। পুতুল ভীষণ খুশি হয় তাতে। কত দায়িত্ব নিয়ে সে লীনাকে রিক্সায় তুলে দিল, যেন নিজের বোন। হ্যাঁ, বোন। লীনা সারাজের বোন। দুই ভাই বোনকে খুব মানায়। পুতুল মুখ টিপে হাসে। সে আর তার মায়েরা বাদে, দুনিয়ার সব মেয়ে সারাজের বোন; অনলি বোন।
আজ পুতুল সারাজের পিঠ আগলে বসল না। ইচ্ছে করেই বসেনি। এত সহজে সারাজ তাকে নিয়ে বাসায় চলে যাচ্ছে, সেটাই তো পুতুলের হজম হচ্ছে না। শাস্তি দিয়েও দিল না, এতটা ভালো মানুষ তো উনি নন। নির্ঘাত মাথায় অন্য কিছু চলছে। পুতুল চোখ তুলে সারাজের মাথার দিকে চাইল। এক মাথা ভরতি চুলগুলো বাতাসের তালে দুলছে। এলোমেলো হচ্ছে। পুতুলের ইচ্ছে করছে চুলগুলোকে একটু গুছিয়ে দিতে। কিন্তু, এই অধিকার, এই সাহস আদৌ তার হয়নি। কখন হবে, সেটাও জানে না।
মনের অগোচরেই বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরুল তার। এই দীর্ঘশ্বাসের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ছে এক বিশাল আক্ষেপ, সারাজকে না পাওয়ার আক্ষেপ। কবে ঘুচবে এই আক্ষেপ, কবে পাবে সারাজকে? নিজের করে, খুব নিজের করে।
বাইক থেকে নেমেই এক ছুটে পুতুল বাসার ভেতরে চলে যায়। শুধু বাসায় না, দৌড়ে গিয়ে নিজের রুমে ঢুকে। আপাতত, তিন চার ঘন্টা এই রুম থেকে বের হবে না সে। সারাজ নির্ঘাত এসে তার মা’কে বিচার দিবে। তারপর মা বলবে বাবাকে। তারপর মা বাবা মিলে বিচার বসাবে। বিচারে হয়তো কেউ খুব বেশি কিছু বলবে না, তাও তার মা তাকে ঠিকই কঠিন কঠিন কথা শোনাবে। পড়াশোনা বন্ধ করে বিয়ে দিয়ে দেওয়ারও হুমকি দিবে। এ আর নতুন কিছু না। সে যতবার কোনো ভুল করেছে, ততবারই এমন হয়েছে।
পরিবেশ শান্ত দেখে কিছুটা বিস্মিত হয় পুতুল। কী ব্যাপার, নিচে কারোর গলা শোনা যাচ্ছে না কেন? কোনো চিল্লাফাল্লা নেই কেন? সব শুনে তার মা এখনও এত নিরব কী করে? ব্যাপারখানা তো কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না পুতুলের।
সিঁড়ির কাছে গিয়ে উঁকি দেয় পুতুল। না, নিচেও তো কেউ নেই। সারাজ ভাই কি তবে বাসার ভেতরে আসেননি। গুটি গুটি পায়ে নিচে নামে পুতুল। পরিবেশ একদম শান্ত। সে এবার রান্নাঘরে গিয়ে উঁকি দেয়। মেহুল রান্না করছে। গলা বাড়িয়ে পুতুল বলে,
‘মা, কী করছো?’
মেহুল চমকে চাইল। জিজ্ঞেস করল,
‘ওমা, তুই এখন এলি?’
পুতুল অবাক হয়। মা কিছু জানেই না? ওয়াও। পুতুল পেছন থেকে মা’কে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘মাত্র এসেছি। কী রান্না করছো?’
‘বিরিয়ানি।’
‘ওয়াও, তাই! আজকে তো তাহলে দুপুরে বেশ জম্পেশ খাওয়া দাওয়া হবে। বাবা এখনও আসছে না কেন?’
‘দুপুরে নাকি এসে খেতে পারবেন না। মিটিং আছে।’
পুতুল মুখ কালো করে বলল,
‘পারবে না বললেই হলো। দাঁড়াও, আমি বাবাকে কল করছি।’
পুতুল ছুটে গেল নিজের রুমে। ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করতেই উপরে ভেসে উঠল কিছু লেখা। সারাজের মেসেজ। ইনবক্সে গিয়ে দেখল সেখানে লেখা,
‘শাস্তি না দিয়েই চলে এসেছি বলে ভাবিস না মাফ পেয়ে গিয়েছিস। কিছু শাস্তি জমা থাকুক। একেবারে দিব; বিশেষ দিনে। ততদিন পর্যন্ত অপেক্ষায় থাক।’
“বিশেষ দিন?” এই বিশেষ দিনটা আবার কবে? তার জন্মদিন? না সেটা তো চলে গিয়েছি। তবে কি সামনে যখন আবার আসবে, তখন? সে তো অনেক দেরি। তবে এই বিশেষ দিনটা কোনদিন?
এত মাথা ঘামাল না পুতুল। আপাতত মাফ পেয়েছে সেটাই অনেক। বাবার নাম্বারে কল লাগাল। রিসিভ হলো না সেটা। পরপর কয়েকবার লাগিয়েই গেল। এবার নাম্বার ব্যস্ত দেখাচ্ছে। তার মানে, বাবা কল কেটে দিচ্ছে। তাতে কী? পুতুল কল দিয়েই যাচ্ছে। অন্য সবার কাছে তার বাবা একজন গম্ভীর, রাগী মানুষ হলেও, তার কাছে তার বাবা একজন বন্ধু বৈ আর কিছু না। তাই বাবাকে জ্বালানোর কোনো উপায়ই ছাড়ে না সে। এই যে এখন, নির্ঘাত তার বাবা ব্যস্ত। অথচ তাকে লাগাতার কল করে বিরক্ত করতেই হবে।
অনেকক্ষণ পর কলটা রিসিভ হলো। ওপাশের ব্যক্তিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই পুতুল বলতে আরম্ভ করল,
‘বাবা, তুমি নাকি দুপুরে খেতে আসবে না? কেন শুনি? এত কীসের ব্যস্ততা তোমার? জানো, মা বিরিয়ানি রেঁধেছে। তোমাকে ছাড়া আমি এক লোকমাও মুখে তুলব না। তাই, ভালোই ভালোই বাসায় চলে এসো বলছি। নয়তো আমি আর মা বিরিয়ানি নিয়ে তোমার অফিসে হাজির হব। তারপর সেখানে সবার সাথে পিকনিক করে বিরিয়ানি খাব।’
‘আর তারপর আমি এক থাপ্পড়ে তোর সবগুলো দাঁত ফেলে দিব।’
পুতুল হকচকিয়ে উঠল। এটা তো তার বাবার গলা না। ফোনটা চোখের সামনে ধরে দেখল, নাম্বার ঠিক আছে কিনা। হ্যাঁ, তার বাবার নাম্বার’ই তো। তাহলে কথা বলছে কে? পুতুল চটে গিয়ে বলল,
‘হ্যালো, কে আপনি? আমার বাবার মোবাইল আপনার কাছে কী করে এল? চুরি টুরি করেছেন নাকি? দেখুন, ভালো ভালোই মোবাইলটা বাবাকে দিয়ে আসুন। আমার বাবার মোবাইলে আমার অনেক সুন্দর সুন্দর ছবি আছে। খবরদার যদি একটা ছবিও ডিলিট করেছেন। চুপচাপ মোবাইল ফেরত দিয়ে আসুন। নয়তো, আমার বাবা আপনার একটাও হাড়গোড় আস্ত রাখবে না। আমর বাবাকে আপনি চেনেন না। সাবধান করছি কিন্তু।’
‘বুঝেছি, এক থাপ্পড়ে হবে না। তোকে লাগাতার চার থেকে পাঁচটা থাপ্পড় দিতে হবে। সকাল, দুপুর, রাত নিয়ম মাফিক। তাহলে হয়তো কিছটা মানুষ হতে পারবি।’
এই কন্ঠস্বর বড্ড পরিচিত। বেশি বেগ পোহাতে হলো না। সারাজকে সে চিনে ফেলল। গলার স্বর কমিয়ে পুতুল বলল,
‘বাবার মোবাইল তোমার কাছে কী করে এল?’
‘কারণ, আমি তোর বাবার অফিসে। আর তোর বাবা এখন মিটিং এ আছেন। কিন্তু, তুই আহাম্মক তো উনাকে মিটিং-এ ও শান্তিতে থাকতে দিচ্ছিস না। দেখছিস, নাম্বার ব্যস্ত দেখাচ্ছে। তাও কল করতে হবে তোকে? সামান্য কমনসেন্সও নেই, না?’
‘সব ঠিক আছে। তবে, তুমি বাবার অফিসে কী করছো বলতো? তোমার ওখানে কী কাজ?’
‘সেই কৈফিয়ত আমি তোকে দিব নাকি? ফোন রাখ।’
কল কেটে দিল সারাজ। পুতুল কান থেকে ফোন নামিয়ে ভাবতে থাকে, এই লোকটা ঐখানে কেন? বাবার অফিসে উনার কী কাজ থাকতে পারে?
______
খাওয়া দাওয়া করে বিকেলে চোখ লেগেছিল পুতুলের। সেই চোখ খুলে সন্ধ্যার পর। তাও আবার নিচ থেকে আসা হৈ চৈ এর শব্দে। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে সে। নিচে থেকে বেশ উঁচু গলার স্বর ভেসে আসছে। গলার স্বর পরিচিত তার। একটা তার বাবার, অন্যটা সাদরাজ চাচ্চুর। কী নিয়ে এমন উচ্চস্বরে কথা বলছেন উনারা? খুব সিরিয়াস কিছু নাকি?
ফ্রেস হয়ে এসে পুতুল সিঁড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। এখান থেকে বসার ঘর স্পষ্ট। একপাশের সোফায় সাদরাজ বসা। অন্যটাতে রাবীর আর সারাজ। মেহুল এক কোণে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে। সবার চোখ মুখ কেমন থমথমে। কেবল সাদরাজকেই খুব রগচটা লাগছে। পুতুল বুঝতে পারছে না, কী নিয়ে এমন হৈ চৈ হচ্ছে। তাই আরেকটু নেমে দাঁড়ায়। এবার ঠিক সবার মুখ স্পষ্ট।
সাদরাজ এর মাঝে কাঠকাঠ গলায় বলল,
‘তোকে আমি বারণ করার পরও তুই সারাজকে কেন তোর মন্ত্রীসভার সভাপতি বানালি? কেন ওকে এসবের মাঝে জড়াচ্ছিস? আমার মত অমতের কি কোনো মূল্য নেই তোদের কাছে?’
সাদরাজ প্রচন্ড ক্ষেপেছে। পুতুল পিটপিট করে বাবা আর সারাজকে দেখে। সারাজ ভাই মন্তীসভার সভাপতি? উনার মাথায় আবার রাজনীতির ভূত ঢুকল কবে?
সারাজ ঠোঁট চেপে কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বৃদ্বাঙ্গুল দিয়ে কপালের একপাশ বার দুইবার ঘষে বলল,
‘আব্বু, তুমি কেন এমন করছো? রাজনীতির মাঝে খারাপ কী আছে? আমার ইচ্ছা ছিল বলেই বাবা আমাকে সভাপতি বানিয়েছেন। আর বাবা মন্ত্রী হিসেবে কেমন, সেটা তো আমরা জানি। এতবছরে কেউ উনার জায়গা নিতে পারেনি। উনি তো উনার ক্ষমতা কখনও খারাপ কাজে ব্যবহার করেননি। রাজনীতিকে ভালো পথে ব্যবহার করেছেন সবসময়। আমিও তো এমনটাই চাই। তাহলে, এখানে সমস্যা কোথায় আব্বু?’
‘সমস্যা তুমি বুঝবে না। এই রাজনীতি আমার কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। আমার স্বপ্ন, আমার মা, আমার বন্ধু, আমার বাবা, সবকিছু সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। তাই আমি চাই না এই রাজনীতি আবার আমার জীবনে ফিরুক। এটাই আমার লাস্ট ডিসিশান, তুমি রাজনীতি করবে না মানে করবে না। আর রাবীর, অন্যকাউকে সভাপতি বানা। আমার ছেলেকে এসবের মাঝে জড়াবি না।’
বলেই জোরে নিশ্বাস ছাড়ল সাদরাজ। রাবীর বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইল। কথাগুলো যে ভীষণ কষ্ট দিয়েছে তাকে। সে কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল,
‘সারাজ কি আমার ছেলে না? আমি কি ওর খারাপ চাইব, সাদ? তোর সময় রাজনীতিকে খারাপভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল বলেই তুই এতকিছু হারিয়েছিলি। কিন্তু, তোর ছেলে তো রাজনীতির খারাপ ব্যবহার করছে না। তাহলে…’
‘করছে না, করতে কতক্ষণ? সবাই তো আর তোর মতো সৎ না। আমি চাই না, রাবীর। প্লিজ, অনুরোধ করছি। সারাজকে বুঝিয়ে বল। তোর কথা ও ফেলবে না। তুমি প্লিজ ওকে বোঝা। এটাই আমার শেষ অনুরোধ তোর কাছে। আশা করছি, আমার অনুরোধটা রাখবি।’
চলবে….