#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৬৫।
এক তিক্ত গম্ভীরতা ছেয়ে আছে পুরো কক্ষ জুড়ে। ক্ষণে ক্ষণে শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ কেবল কর্ণগোচর হচ্ছে। মেহুল ভয়ে যবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাত পা মৃদু কাঁপছে তার। শাশুড়ি মায়ের প্রতিক্রিয়া ধরতে পারছে না। চোখ পিটপিট করে সে রাবীরের দিকে মনোযোগ দেয়। রাবীর আগের মতোই শান্ত, নিরব। মেহুলকে চোখ দিয়ে ইশারা করে আশ্বস্ত করে। কিন্তু, বললেই কি আর নিশ্চিন্ত হওয়া যায়?তাও আবার এত বড়ো একটা ঘটনার পর।
বয়স বাড়লেও, চোখে মুখে বার্ধক্যের ছাপ নেই। চোখ মুখ এখনো টানটান তার। এই বয়সে এসেও মুখের এমন সুশ্রী ভাব’ই প্রমাণ দেয়, যৌবনে তিনি হৃদয়হরনী ছিলেন। শাড়ির আঁচল’টা টেনে কপালের ঘাম মুছলেন রাবীরের মা। অনেকক্ষণ ধরে কিছু ভাবলেন, গভীর চিন্তা করলেন। তার এই এত বছরের জীবনে এমন বিদঘুটে ধাক্কা কখনও খাননি তিনি। তাই আজ একটু নিজেকে ধাতস্ত করতে বেগ পেতে হচ্ছে। তাও নিজেকে সামলালেন। গুমোট মুখে একবার ছেলেকে আরেকবার ছেলের বউকে পরখ করলেন। মেহুল ভয়ে ঠকঠক করছে। পাতলা ঠোঁট যুগল তিরতির করে কাঁপছে তার। কপালের ছোট চুল ঘামে লেপ্টে আছে। কী হবে এখন?
শাশুড়ি মা চাইলেন মেহুলের দিকে। কর্কশ গলায় শুধালেন,
‘বিয়ের আগে এই কথা তুমি জানতে না?’
মেহুল পরপর চোখের পল্লব ফেলে। একবার রাবীরের পানে চায়। পরে ভয়ে ভয়ে তাকায় শাশুড়ির দিকে। কী উত্তর দিবে? কথা সব গুলিয়ে ফেলেছে। কন্ঠস্বর বসে গিয়েছে। তাও চেষ্টা চালাল। খুব কষ্টে কম্পিত স্বরে বলল,
‘না, মা। আমি কিছুদিন আগে টেস্ট করিয়ে জেনেছি।’
শাশুড়ি মা নাকের পাটা ফুলিয়ে ফোস ফোস নিশ্বাস ফেলছেন। রাগ তার তরতরিয়ে ব্রহ্মতালুতে উঠে নাচছে। তাও, ছেলে সামনে উঁচু গলায় কিছু বলতে পারছেন না। তাই দাঁত চেপে রাগ নিবারণের পৃথা চেষ্টা চালিয়ে বলেন,
‘ডাক্তার কী বলেছেন? কী সমস্যা তোমার?’
মেহুল আই-ঢাই করছে। ফরফরিয়ে সব বলে দিতে পারলে মন হালকা হত তার। কিন্তু, আপাতত সেই উপায়ও নেই। তাই সে ধীরে সুস্থে সময় নিয়ে বলল,
‘আমার জরায়ুতে সমস্যা। ডাক্তার বলেছেন, এটা জন্মগত। চিকিৎসা করলেও ভালো হবে না।’
খুব সাহস করে কথাটা বলে জোরে শ্বাস ফেলল মেহুল। জানে, শাশুড়ি মা এখন রেগে বাড়ি থেকে বেরও করে দিতে পারেন। কিন্তু, তাও সত্যটা তো অন্তত বলতে পেরেছে, সেই ঢের।
রাগে কটকট করছেন তিনি। এত বড়ো একটা খবর, আর তিনি বিয়ের আগে কিছুই জানলেন না? ঐ বাড়ির লোক কথাটা চেপে গেলেন কী করে? এটা তো অন্যায়, রীতিমতো ঠকানো। তিনি ঠকেছেন, তার ছেলেও ভীষণ ভাবে ঠকেছে। তার ছেলেটাকে আজীবন বাবা না হওয়ার আফসোস নিয়েই থাকতে হবে। উনার অন্তরটা তখন ছেলের দুঃখে হু হু করে উঠল। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন, না না; এমনটা তিনি হতে দিবেন না। তিনি তাই মাথা তুলে শক্ত গলায় বলেন,
‘তুমি না জানলেও, তোমার মা নিশ্চয়ই সব জানতেন। আর উনি ইচ্ছে করে আমাদের কিছু বলেননি, যাতে এই বিয়েটা না ভাঙে। তোমার মা তো একপ্রকার ঠকিয়েছেন আমাদের। আমাদেরকে ভালো পেয়ে নিজের অসুস্থ মেয়েকে ধরিয়ে দিয়েছেন। এখন তোমার জন্য আমার ছেলেটাকে সারাজীবন আফসোস নিয়ে বাঁচতে হবে। বলো, এখন কী করব?’
মেহুলের কোটর ভরে উঠে উষ্ণ জলে। গাল বেয়ে গড়িয়েও পড়ে সেটা। ত্রস্ত হাতে সেই জল মুছে, কোনোরকমে সোজা হয়। রাবীর তাকিয়ে দেখে তাকে। মায়ের দিকে চেয়ে দেখে, মা এখনো রাগে হাঁসফাঁস করছেন। রাবীর এবার তটস্থ হয়। নড়চড়ে বসে। গম্ভীর গলায় বলে,
‘মা, তুমি না জানলেও আমি সবকিছুই জানতাম।’
তার মা চোখ মুখ কুঁচকে তার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
‘জানতে মানে? কী জানতে তুমি?’
রাবীর স্বাভাবিক স্বরে বলে,
‘এই যে মেহুল কোনোদিন মা হতে পারবে না, সেটা। বিয়ের আগেই মেহুলের মা আমাকে এই কথাটা জানিয়ে ছিলেন। বলেছিলেন,আমি যেন সবকিছু ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিই। তবে, মেহুলকে আমার প্রথম দেখাতেই পছন্দ হয়েছিল। আর আমার কাছে এই বাচ্চা না হওয়ার ব্যাপারটা কোনো বিগ ইস্যু বলে মনে হয়নি। কেউ ইচ্ছে করে এই সমস্যা নিয়ে জন্মায় না। সবকিছুই আল্লাহর দান। তাই ব্যাপারগুলো সহজ ভাবে মেনে নিতে পারলেই, জীবন সুন্দর। এখানে কারোরই কোনো দোষ নেই। আর মেহুলের তো একদমই না।’
ছেলের কথায় যেন মা আকাশ থেকে পড়লেন। ছেলে তো তার পুরো বউয়ের আঁচলের নিচে একেবারে ঢুকে পড়েছে। কী সুন্দর, এত বড়ো একটা খবর সে মেনে নিল। তার ছেলেটাকে এত ভালো হতে কে বলেছে? ভালো মানুষের যে এই দুনিয়াতে কোনো দাম নেই, তা কি সে জানে না? তার মুখমন্ডলে নেমে এল ইষৎ কালো ছায়া। এত সহজে, এসব কিছু তিনি কী করে মেনে নিবেন? তার মনটা যে হতাশাগ্রস্ত। কত আশা করেছিলেন, একটা নাতি নাতনির মুখ দেখবেন। সব কি তবে শূন্য, শূন্যই রয়ে গেল?
তিনি চট করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর কোনোপ্রকার সাড়া শব্দ না করেই, হনহন করে পা বাড়ালেন নিজের রুমের দিকে। শাশুড়ি মায়ের ব্যস্ত পদতলের দিকে অমোঘ চেয়ে রইল মেহুল। ধ্যান ভাঙল রাবীরের স্পর্শে। সে মেহুলের উজ্জ্বল ফর্সা গালে হাত রেখে নরম সুরে বলল,
‘চিন্তা করবেন না, মা’কে আমি বোঝাব।’
___________
বাইরের গরম কমেনি। তপ্ত বিকেল। সূর্য মামা এখন পশ্চিমে হেলে পড়াতে ব্যস্ত। এভাবে পড়তে পড়তেই ধীরে ধীরে তার তেজ কমবে। একসময় তার বিশাল আকাশ বন্ধুর বিশালতায় হারিয়ে যাবে। তারপর বুক ধর্পিয়ে মাথা চারা দিয়ে উঠবে নিকষ কালো অন্ধকার। হানা দিবে, এই ভৌগলিক অঞ্চলে।
লুকিয়ে লুকিয়ে একটা বেনসনের প্যাকেট নিয়ে বারান্দায় দাঁড়ায় রিতা। আজকাল যে তার কী হয়েছে কে জানে। একসময় যে জিনিস সে দু চোখেও সহ্য করতে পারত না, এখন তার সেটাই খেতে ইচ্ছে করছে। এই যেমন, এই সিগারেট। যেটার ঘ্রাণেই গা গুলিয়ে উঠত তার, বমি বমি পেত; আজ সেটা খাওয়ার জন্যই মরিয়া হয়ে উঠেছে সে। নিজের মনের সাথে অনেক যুদ্ধ করেছে। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত পরাজয় স্বীকার করে সাদরাজের বেনসনের প্যাকেটটা লুকিয়ে লুকিয়ে খুঁজে বের করে।
সাদরাজ এখন বাসায় থেকেই অফিস করছে। সাথে ফ্রিল্যান্সিং এর কাজ করছে বিধায়, তাকে আর কষ্ট করে অফিসেও যেতে হচ্ছে না। মাস শেষে হাতে এমনিই টাকা চলে আসে। সাদরাজ বাড়িতে আছে বলেই রিতার যত অসুবিধা। খাবার নিয়ে একটুও অনিয়ম সাদরাজ মেনে নিতে চায়না। জোর করে খাওয়াবে সে, বমি করলে করুক, তাও খাওয়াবে। এসবের জ্বালায় যে বেচারার শরীর কতবার বমিতে ভরেছে, তার আর হিসাব নেই। তবুও, এই ছেলে ক্লান্ত হয়না, এইটুকুও বিরক্ত হয় না। উল্টো বরং আরো সুখ পায় যেন।
সাদরাজ দেখলে কেলেঙ্কারি হবে। তাই চুপি চুপি বসার ঘরের বড়ো বারান্দায় এসেছে। এখানে খেলে, গন্ধ আর সারা ঘরে ছড়াতে পারবে না। বাইরের খোলা প্রান্তরে মিশে যাবে। রিতা সেই ভেবে, ভয়ে ভয়ে একটা সিগারেটে দু আঙ্গুল দিয়ে চিপকে আরেক হাতে আগুন জ্বালায়। পরে সেই জ্বলন্ত সিগারেট’টা দু ঠোঁটের মাঝে চেপে ধরে। একটা টান দিয়েই, নাক মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে কাশতে আরম্ভ করে সে। সেই কাশি ভয়ানক হাসি, থামার নামই নেই। বেচারির চোখ মুখ লাল হয়ে উঠেছে মুহুর্তেই। তার কাশির শব্দ দ্রুত গিয়ে ঠেকল সাদরাজের কর্ণগুহরে। ঘুম থেকেই চট করে উঠৈ বসল সে। আশেপাশে সতর্ক দৃষ্টিতে চেয়ে রিতাকে খুঁজল। না পেয়ে খোলা দরজার দিকে চাইল। বাইরে থেকেই খুকখুক শব্দ আসছে। সাদরাজ দ্রুত উঠে পা বাড়ায় সেদিকে। সাদরাজের ভয়ে রিতা ততক্ষণে মুখে ওড়না চেপেছে। শব্দ না হলেও, শরীর কাঁপছে তার। জলদি সিগারেট’টা বাইরে ছুড়ে মারে। হাত নাড়িয়ে ধোঁয়া আর গন্ধ সরানোর বৃথা চেষ্টা চালায়। সাদরাজ সেই মুহুর্তেই পেছনে এসে প্রশ্ন ছুড়ে,
‘কী করছো, রিতা?’
রিতা আঁতকে উঠে। ভয়ে ভয়ে সাদরাজের দিকে তাকায়। সাদরাজের ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে। হঠাৎই তার কুঁচকানো ভ্রু আরো দৃঢ় হয়। দু’বার নাক টেনে জিজ্ঞেস করে,
‘সিগারেটের ঘ্রাণ আসছে কোথ থেকে?’
রিতা ঢোক গিলে। সে যে সিগারেট খেয়েছে, সেটা জানলে সাদরাজ কী করবে কে জানে?
চলবে….