#সে_প্রেমিক_নয়
#Mehek_Enayya(লেখিকা)
#পর্ব ৪০
রাত দশটা। জুম করে বৃষ্টি পরছে বাহিরে। ঝড়োয়া হাওয়া তো রয়েছেই। কিছুক্ষন পর পরই আকাশ চমকে বজ্রপাত হচ্ছে। গাড়িতে বসে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে ইরান। তার পাশেই তাজীব ল্যাপটপের সাহায্যে কিছু করছে। রাকিয়াকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আনাবিয়ার খোঁজে বের হয়েছে তারা। ইরানের সন্দেহ আনাবিয়াকে ইসরাফই কিডন্যাপ করেছে। আনাবিয়া বেকুব নয় যে পালিয়ে যাবে! এখন ইসরাফের নাম্বার ট্র্যাক করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু সিম বন্ধ দেখায়। পরে ইরান ইসরাফের ফ্রেন্ড সুবহার থেকে ইসরাফের পার্সোনাল নাম্বার সংগ্রহ করে। এখন সেটা ট্র্যাক করে ইসরাফের লোকেশনে যাচ্ছে ইরান। ইসরাফকে চাইলে সে অনেক আগেই মেরে ফেলতে পারত। কিন্তু এক জায়গায় আটকে আছে সে। মাকে ওয়াদা দিয়েছিল ইরান ইসরাফের কোনোরকম ক্ষতি সে করবে না। ইসরাফ আপন ছেলে না হলেও রাকিয়ার কাছে ইসরাফ তারই রক্ত। ইসরাফ ইরানকে একসমান ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছে সে। মা কষ্ট পাবে, কাঁন্না করবে এই ভয়েই ইরান ইসরাফকে মারতে চায় না।
-স্যার,
-বলো তাজীব?
-স্যার লোকেশন তো শুধু সামনেই এগিয়ে চলছে!
-এখানে সবচেয়ে সামনের জায়গার নাম কী তাজীব?
-স্যার আর দুই ঘন্টা জার্নি করলে রাঙামাটি পৌঁছে যাবো। আমার মনে হয় ইসরাফ স্যার ম্যামকে সেখানেই নিয়ে যাচ্ছে।
-রাঙামাটিতে তো ইসরাফের ফ্রেন্ডের একটা হোটেল আছে। তবে কী সেখানেই যাচ্ছে?
-হতে পারে স্যার।
-তোমার ম্যামের নাম্বারে ট্র্যাক করা যাচ্ছে না?
-না স্যার নাম্বার বন্ধ।
-আমি চিন্তায় পাগল হয়ে যাবো তাজীব! তোমার ম্যাম সেই দুপুরে খেয়েছিল এখন পর্যন্ত না খাওয়া সে! আবার অসুস্থ না হয়ে পরে।। তার কিছু হলে আমার কী হবে!
-ধয্য রাখুন স্যার। ম্যামের কিছু হবে না।
_________________🌸
ইরানের ধারণা ঠিক আনাবিয়াকে ইসরাফই কিডন্যাপ করেছে। ইসরাফ জানে ইরান তাকে পেলে জিন্দা মাটিতে ঘেঁরে ফেলবে তবুও মনে একটুও ভয় নেই ইসরাফের। একরাত আনাবিয়ার সাথে কাটাতে পারলেই হলো। তারপর একজন রে*পিস্ট মেয়েকে কে নিজের স্ত্রী বলে পরিচয় দেবে? অবশ্য ইরানও আনাবিয়াকে তখন ঘৃণা করবে এবং ছেড়ে দেবে। একটা হোটেলের সামনে গাড়ি থামায় ইসরাফ। এই হোটেলের ওনার তার অতি পরিচিত। এখানে অনেকবার এসেছে ইসরাফ। গাড়ির পিছনের সিট্ খুলে অজ্ঞান আনাবিয়াকে নিজের কোলে তুলে নেয়। দ্রুত পায়ে হোটেলের ভিতরে চলে যায়।
এখানে আগের থেকেই তার দুইজন বন্ধু উপস্থিত ছিল। রুম বুক করে রেখেছে তারা। ইসরাফ আনাবিয়াকে একটি রুমে নিয়ে এসে বিছানায় শুয়ে দেয়। ইসরাফের বন্ধু নোমান আর সাফি আনাবিয়াকে দেখে শয়তানি হাসি দিয়ে বলে,
-বন্ধু মা*ল তো সেই আমাদেরও একটু ভাগ দিস। (নোমান)
-হো আমি নিউজ চ্যালেনে দেখেছিলাম এই মেয়েটাকে তোর ভাইয়ের সাথে। মেয়ের সৌন্দর্য দেখে সেদিনই পাগল হয়ে গিয়েছিলাম আমি। (সাফি)
-কিন্তু আমি তো ওকে ভালোবাসি! তোদের ভাগ দেওয়া যাবে না। (ইসরাফ)
-এই তোর ফ্রেন্ডশিপ? বেস্টফ্রেইন্ড বেস্টফ্রেইন্ড বলিস আর এভাবে ফ্রেন্ডশিপ পালন করবি?(নোমান)
-আচ্ছা যা তোরাও ভাগ পাবি বাট শুধু একবার। (ইসরাফ)
-আচ্ছা আচ্ছা চলবো। (সাফি)
মুখে বাতি চকচকে আলো পরতেই নিজের হুশে ফিরে আসে আনাবিয়া। কয়েকজন ছেলের কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে সম্পূর্ণ চোখ খোলে না সে। পিটপিট তাকিয়ে সবটা পরোক্ষ করে নেয়। তার মানে তাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে তাও তার চরিত্রে দাগ লাগানোর জন্য। আনাবিয়া মনে মনে ভাবতে থাকে নিজেকে কিভাবে রক্ষা করবে এই শয়তানগুলো হাত থেকে। ওরা তিনজন অন্যদিকে ফিরে নিজেদের মতো কথা বলছে এই সুযোগে আনাবিয়া চেষ্টা করে মাথার একটা ক্লিপ খোলার। দুইবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। অতঃপর তৃতীয়বারে সফল হয় সে। হাতের মুঠোয় পুরে নেয় ক্লিপটা।
কথা শেষ হলে ইসরাফ এগিয়ে আসে আনাবিয়ার কাছে। এক গ্লাস পানি ঢেলে দেয় আনাবিয়ার মুখে। ধরফড়িয়ে উঠে বসে আনাবিয়া। হাত দিয়ে মুখের পানি সরিয়ে সামনে তাকায়। ইসরাফকে দেখে বলে,
-আমি কোথায়? আপনিই আমাকে কিডন্যাপ করেছেন?
ইসরাফ বাঁকা হাসে। আনাবিয়াকে ঘুঁটিয়ে ঘুঁটিয়ে দেখতে দেখতে বলে,
-আমি ছাড়া আর কারো সাহস আছে তোমাকে কিডন্যাপ করার!
-কেনো কিডন্যাপ করেছে আমাকে? কী চাই আপনার?
-এক্সজেকলি আমার তোমাকে চাই। বেশি কিছু না একরাত আমার সাথে কাটাও।
আনাবিয়া ঘৃনীত চোখে ইসরাফের দিকে তাকায়। এক দলা থু থু ছুঁড়ে মারে ইসরাফের মুখে। রাগী কণ্ঠে উঁচু স্বরে বলে,
-তোর মতো কুত্তার সঙ্গে আমি তো কী আমার জুতাও রাত কাটাতে চাইবে না!
ইসরাফ মুখ পরিষ্কার করে ঠাটিয়ে চড় বসিয়ে দেয় আনাবিয়ার গালে। গাল লাল হয়ে যায় কিন্তু আনাবিয়ার মধ্যে ব্যাথার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। রাগে জ্বলজ্বল করছে তার আঁখিজোড়া। নোমান ভয় পেয়ে যায় আনাবিয়ার রূপ দেখে। ইসরাফ চিৎকার করে বলে,
-মুখ কম চালাবি। বিদেশে না জানে আরো কত নষ্টামী করেছে এখন আমাদের সামনে ভালো সাজে! তোর এই রূপ, যৌ*বন সব শেষ করে দিবো আজ।
আনাবিয়ার মনে হলো ইসরাফ কোনো জোকস বলছে। একা একাই হাসতে হাসতে বলে,
-তোর কী মরার ভয় নেই? আমার হাসব্যান্ড তোকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলবে শয়তান।
-আগে তোকে নষ্ট করব তারপর তোর হাসব্যান্ড যা মন চায় তাই করুক কোনো সমস্যা নেই।
ইসরাফ আনাবিয়ার পাশে বসে লোলুপ দৃষ্টিতে আনাবিয়ার সমস্ত শরীর দেখতে থাকে। কিড়মিরে উঠে আনাবিয়া। পর পুরুষের এইরকম চাহনি বিষের থেকেও বেশি বিষাক্ত লাগছে তার।
-আমার সামনে আসবি না ইসরাফ। দূরে সরে যা আমার থেকে শয়তান।
-দূরে সরলে কিভাবে হবে!
ইসরাফ আনাবিয়ার কাঁধে শাড়ীর আঁচলে হাত দিতে যাবে তার আগেই আনাবিয়া সেই ক্লিপ দিয়ে ইসরাফের চোখে খোঁচা মারে। চোখ ধরে উঠে দাঁড়ায় ইসরাফ। জ্বালাতন করতে থাকে তার এক চোখ। ব্যাথায় চেঁচাতে থাকে ইসরাফ। নোমান ইসরাফের চোখে পানি দিতে থাকে। এই সুযোগে আনাবিয়া শাড়ী ঠিক করে উঠে দাঁড়ায়। দৌড়ে দরজা খুলতে নেবে তখনই সাফি তার একহাত চেপে ধরে। আনাবিয়া সাফি থেকে ছোটার আপ্রাণ চেষ্টা করে। সাফি আনাবিয়ার পেট নিজে হাত ধারা খামচে ধরে। শরীরে অন্য পুরুষের ছোঁয়ায় নিজের প্রতি নিজেরই ঘৃণা হয় আনাবিয়ার। পিছনে থেকে সাফির পায়ে লাত্থি দিয়ে সরিয়ে দেয় তাকে। এতক্ষনে ইসরাফের চোখ ঠিক হয়েছে। রেগে আনাবিয়ার হাত ধরতে নেয়। কিন্তু আনাবিয়া কায়দা করে দূরে সরে যায়।
ইসরাফ এবার রেগে অগ্নিমূর্তি হয়ে আনাবিয়ার শাড়ীর আঁচল নিজের হাতে পেঁচিয়ে নেয়। আনাবিয়া এখন আর নড়াচড়া করতে পারে না। ইসরাফের ও তার বন্ধুদের মুখে নিকৃষ্ট হাসি। আনাবিয়া মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে থাকে। ইসরাফ বড় একটি হাসি দিয়ে বলে,
-এবার তোকে কে বাঁচাবে? কই আসলো না তোর ইরান?
পুনরায় একসাথে হাসতে থাকে তিনজন। আনাবিয়া তবুও নরম হয় না। বাঘিনীর মতো চিৎকার করে বলে,
-আমার শাড়ী ছাড় জা*নো*য়ারের বাচ্চা। যদি একটুও মরার ভয় থাকে ছেড়ে দে আমাকে।
-কে মারবে আমাদের? তোর ইরান? সে তো জানেই না আমরা কোথায়! (নোমান)
নোমানের কথায় অট্টহাসিতে ফেটে পরে সবাই। ইসরাফ বাঁকা হেসে আনাবিয়ার শাড়ীর আঁচল ধরে টান দেয় নিজের সর্বশক্তি দিয়ে। সাথে সাথেই বক্ষ থেকে সরে যায় আঁচল। শাড়ীর অর্ধেকের বেশি অংশ ইসরাফের হাতে চলে যায়। সাফি হাসতে হাসতে বলে,
-বা রে ইসরাফ! তোর ভাই তো ভালোই খা*সা মা*ল পেয়েছিল রে! আমাদের কপালেই এইরকম জোটে না!
-আসলেই। এইরকম নারী আমার হলে আর কোনোদিন অন্য নারীর দিকে চোখ তুলে তাকাতাম না ভাই!(নোমান)
-এতটুকেই এতো কমপ্লিমেন্ট! আরেকটু ওয়েট করে দোস্ত সামনে আরো মজা!(ইসরাফ)
আনাবিয়া শাড়ীর শেষের অংশটুকু শক্ত করে ধরে রেখেছিল। ইসরাফ টান দিতেই আনাবিয়াও শাড়ীর সাথে ইসরাফের স্মুখীন চলে যায়। ভেজা ভেজা চোখে আনাবিয়া ইসরাফের দিকে তাকায়। ফর্সা মেয়েদের লাল চোখে আসলেই ভয়ংকর দেখায়! ইসরাফ আনাবিয়ার গালে ছুঁতে যাবে তার আগেই আনাবিয়া ইসরাফের গালে থাপ্পড় দেয়। নরম হাতের থাপ্পড়ে কিছুই হয় না ইসরাফের। আনাবিয়ার অতি নিকটে যেতে নেবে তখন পুনরায় আনাবিয়া ইসরাফকে থাপ্পড় দিয়ে থু থু ছুঁড়ে মারে।
ইসরাফের ধয্যর সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে আনাবিয়া। রাগ মাথায় উঠে যায় ইসরাফের। আনাবিয়াকে ধাক্কা দিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেলে ইসরাফ। কমজোর হয়ে পরেছিল আনাবিয়া। এতো জোরে ধাক্কা খেয়ে তাল সামলাতে পারে না। তার পিছনে কাঠের দরজা ছিল তাহলে স্বাভাবিক সেটার সাথেই বারি খাবে আনাবিয়া। ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে সে। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে দরজার সাথে বারি খায় না আনাবিয়া। নিজেকে কারো বাহুডোরে অনুভব করে সে। চোখ খুলে হাতের অধিকারী ব্যক্তিতে দেখতে চায় আনাবিয়া। কিন্তু সেটা আর হয় না। ভয়ে ও দুর্বল হওয়ার কারণে জ্ঞান হারায় আনাবিয়া।
__________________🌸
সারারাত অঝোরে বৃষ্টি হয়ে সকালে উজ্জ্বল রোদের দেখা মিলেছে। গাছের পাতায় বিন্দু বিন্দু পানির কণা জমে আছে। মানুষজন ব্যস্ত হয়ে নিজ নিজ গন্তব্যে যাচ্ছে। হসপিটালে তিনতালার বাড়িন্দায় দাঁড়িয়ে জালানা দিয়ে সবটা দেখছে ইরান। মানুষ কতই না বিচিত্র! এইযে রিকশা চালক একটু পেয়েই হাসি মুখে বাড়ি ফেরে। অথচ বড় বড় ব্যবসায়ী এতো শত কামিয়েও তাঁদের মন ভরে না। যত পায় ততই চায়! ইরানের মতে গরিব মানুষরাই ভালো। তাঁদের শত শত টাকা পয়সা না থাকলেও মানুষত্ববোধ আছে। অন্যকে সম্মান করতে জানে তারা। আর ধনীদের তো অহংকারে মাটিতে পা-ই পরে না।
-মিস্টার ইরান আপনার পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে।
নার্সের কণ্ঠস্বর শুনতেই বাহির থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ফেলে ইরান। হালকা হেসে নার্সকে বলে,
-জি। ধন্যবাদ।
ক্যাবিন রুমে প্রবেশ করতেই ইরানের নজর পরে ধবধবে সাদা হসপিটাল বেডে শুয়িত আনাবিয়ার ওপর। ইরান মৃদু পায়ে এগিয়ে যেয়ে একটি চেয়ার নিয়ে পাশেই বসে। পেটের ওপরে রাখা আনাবিয়ার হাত ধরতেই চোখ খুলে আনাবিয়া। ইরানকে দেখে নজর সরিয়ে ফেলে। ইরান কী বলে কথা শুরু করবে বুঝতে পারছে না। ধীরে ধীরে আনাবিয়ার কাঠিন্য মুখশ্রী নরম হয়ে যায়। চোখ দিয়ে এক ফোটা দু ফোটা করে পানি গড়িয়ে পরতে থাকে। অথচ ঠোঁটে তার হাসি। স্মিত হেসে মৃদু কণ্ঠে বলে,
-জীবনে অনেক বড় গুনাহ করেছিলাম আমি। তাই সৃষ্টিকর্তা আমাকে শুধু কষ্টই দেয়!
শক্ত মনের মানুষ ইরানও আজ দুর্বল হয়ে পরেছে। আনাবিয়ার দিকে তাকানোর সাহস হচ্ছে না তার। আনাবিয়ার এতো অসহায়ত্ত্বা তাকেও অসহায় করে দিচ্ছে। আনাবিয়া করুণ স্বরে বলে,
-আমি বুঝি না আমার সকল প্রিয় মানুষই আমার থেকে দূরে কেনো চলে যায়! কেনো আমি সারাজীবনের জন্য কাউকে পাই না! কেনো?
>>>>চলবে।