সে_প্রেমিক_নয় #Mehek_Enayya(লেখিকা) #পর্ব ৪১

0
319

#সে_প্রেমিক_নয়
#Mehek_Enayya(লেখিকা)

#পর্ব ৪১

নীরবতা বিরাজ করেছে দুইজনের মধ্যে। আনাবিয়া চোখ বন্ধ করে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। ইরানও চুপচাপ। আনাবিয়া ইরানের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়। নিজ পেটে হাত দিয়ে শান্ত স্বরে বলে,

-আমার বেবি ঠিক আছে?

-হ্যাঁ। আল্লাহর রহমতে সুস্থ আছে সে।

স্বস্তির নিঃশাস ছাড়ে আনাবিয়া। হটাৎ করেই তার মুখের ভঙ্গিমা পরিবর্তন হয়ে যায়। চোখের পানি মুছে রুক্ষ কণ্ঠে ইরানকে বলে,

-আমাকে তো আপনি ভালোবাসেন তাই না?

ইরান হ্যাঁ বোধক মাথা নারায়। আনাবিয়া ইরানের দিকে তাকিয়ে বলে,

-তো আমি চাই আমার সামনে আপনি আপনার ভাইকে ভয়ংকর মৃত্যুদন্ড দিবেন। দিবেন তো?

ইরান মাথা নিচু করে ফেলে। আনাবিয়া হতাশ হয়ে ইরানের দিকে তাকিয়ে থাকে। বিচলিত কণ্ঠে বলে,

-দিবেন তো ইরান?

ইরান পুনরায় আনাবিয়ার হাত চেপে ধরে। রাগের কারণে কাঁপতে থাকে তার হাত। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলে,

-ওকে এমন শাস্তি দেবো তোমার রূহও কেঁপে উঠবে ভয়ে। আমার স্ত্রীর গায়ে হাত দেওয়ার পরিনাম ও ভুগবে।

-আপনি কিভাবে জানলেন ও আমাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছিল?

-সব কথা এখানে বলা যাবে না। এখন বাসায় চলে তারপর ধীরেসুস্থে বলছি।

-হ্যাঁ।

একজন নার্স এসে আনাবিয়ার হাতের ড্রিপ খুলে দেয়। উঠে বসে আনাবিয়া। নিচে পা রাখতেই আচমকা পরে যেতে নেয় সে। ইরান আনাবিয়ার দু কাঁধ ধরে গম্ভীর হয়ে বলে,

-নিজেকে এতো শক্তিশালী ভাবা বন্ধ করুন। মাঝে মাঝে অন্যের সাহায্যও নিয়ে নেন।

-আনাবিয়া একাই একশো।

-সেটা আমিও জানি। আফটার অল তন্নী ফারুকের মেয়ে দুর্বল হবে না।

-তবুও তো কাল রাতে দুর্বল হয়ে পরেছিলাম!

কাঁপাকাঁপা কণ্ঠে কথাটা বলে আনাবিয়া। মুখে অন্ধকার নেমে আসে তার। ইরান আনাবিয়ার সামনের চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বলে,

-জাস্ট বেড ড্রিম ভেবে ভুলে যাও।

-সব কিছু ভোলা যায় না ইরান। আপনার আর আপনার পরিবারের দেওয়া আঘাতের কথা চাইলেও ভুলতে পারব না আমি।

___________________

বাসায় এসে মাত্রই বিছানায় বসেছে আনাবিয়া। রাকিয়া আগের থেকেই বাসায় উপস্থিত ছিল। আনাবিয়ার চিন্তায় ঐ বাসায় আর থাকতে পারেনি সে। ইরানকে বার বার জিজ্ঞেস করছে আনাবিয়াকে কে কিডন্যাপ করেছিল। ইরান কোনো উত্তর দেয়নি। ইসরাফের কথা বলতে চাচ্ছে না ইরান রাকিয়াকে। রাকিয়া আনাবিয়াকে স্যুপ খাইয়ে দিচ্ছে এই এটা সেটা জিজ্ঞেস করছে।

-ইরান ডাক্তার কী বললো? বাচ্চা ঠিক আছে?

-হ্যাঁ আম্মা ঠিক আছে।

-কয়মাস চলছে?

ইরান আনাবিয়ার দিকে তাকায়। চোরা চোখে নজর সরিয়ে ফেলে আনাবিয়া। ইরান কপালে হাত দিয়ে বলে,

-রিপোর্ট অনুযায়ী দুইমাসে পরবে সামনে।

-এই সময়টা নিজের অনেক যত্ন নিতে হয় মা। নয়মাস বেশি বেশি করে খেলে বাচ্চা সুস্বাস্থ্য হয়।

-জি মম।

-তোমরা বসো আমি আনাবিয়ার জন্য কিছু বানিয়ে নিয়ে আসি।

-এখনই তো স্যুপ খেলাম আর কত কিছু খাওয়াবে মম!

-কী বললাম বেশি বেশি খেতে হবে। আসছি আমি।

রাকিয়া বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। আনাবিয়ার কপালে চুমু দিয়ে চলে যায়। ইরান দরজা লাগিয়ে আনাবিয়ার পাশে বসে পরে। আনাবিয়া ইরানকে দেখে দূরে সরে বসে।

-এখন শুরু থেকে সবটা বলুন?

-ইসরাফের নাম্বার ট্র্যাক করে খুঁজেছি তোমাদের। ঐ হোটেল আমার আগের থেকেই চেনা।

-ওহ আচ্ছা! তারপর!

🌸ফ্লাসব্যাক🌸

হোটেলের সামনে আসতেই গাড়ি থামায় তাজীব। তখনও প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল। ইরান ছাতা রেখে বড় বড় পা ফেলে ভিতরে ঢুকে। হোটেলের মেনেজার তাকে দেখতেই ভয়ে ঢোক গিলে।

-স্যার আপনি!

-ইসরাফ এসেছে এখানে? ইয়েস ওর নো?

-জি স্যার এসেছে।

-রুম নং?

-১৩৬।

ইরান আর কিছু না বলেই ভিতরে ঢুকে যায়। পিছনে আরো পাঁচ ছয়জন বডিগার্ড ছিল। মেনেজার তাঁদের দেখে বলে,

-রাতের বেলা এতো মানুষ নিয়ে ভিতরে যাওয়া এলাও নয় স্যার।

ইরান পিছনে ফিরে তাকায় না। তাজীব শসানোর স্বরে মেনেজারকে বলে,

-নিজের জানের ভয় থাকলে আমাদের পথে আসার চেষ্টা করবি না। বুঝা গেলো?

-জজজি স্যার।

-রুমের সিক্রেট চাবি আছে তোর কাছে? কুইকলি দে।

মেনেজার তাজীবের হাতে বন্দুক দেখে ভয়াত হয়ে পরে। কাঁপাকাঁপা হাতে চাবি এগিয়ে দেয়। ১৩৬ নং রুমে আসতেই দাঁড়িয়ে যায় ইরান। একজন বডিগার্ড বলে,

-স্যার দরজা ভাঙবো?

-দরজা ভাঙার প্রয়োজন নেই আমি চাবি নিয়ে এসেছি।

পিছন থেকে তাজীবের কথা শুনতেই বডিগার্ড দূরে সরে যায়। অস্বাভাবিক ভাবে হাত পা কাঁপছে ইরানের। তাজীব চাবির সাহায্যে দরজা খুলতেই ইরান সম্পূর্ণ দরজা উম্মুক্ত করে। যেই ভিতরে পা বাড়াবে ওমনেই আনাবিয়া ছিটকে তার ওপরে এসে পরে। কায়দা করে আনাবিয়াকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে ফেলে ইরান। অর্ধবস্ত আনাবিয়াকে দেখে রক্ত হিম হয়ে যায় ইরানের। টগবগ করতে থাকে শরীরের রগগুলো। অস্থির হয়ে কয়েকবার ডাক দেয় আনাবিয়াকে। কিন্তু ততক্ষনে জ্ঞান হারায় সে।

ইসরাফ ও তার বন্ধুরা ভয়ে সিটিয়ে যায়। ইসরাফ বন্ধুদের ফেলে জালানা দিয়ে পালিয়ে যেতে নেয় তার আগেই বডিগার্ডরা তাঁদের তিনজনকে ধরে ফেলে। তাজীব মাথা নিচু করে মেঝেতে পরে থাকা আনাবিয়ার শাড়ী এগিয়ে দেয় ইরানকে। ইরান শাড়ী দিয়ে আনাবিয়াকে পেঁচিয়ে কোলে তুলে নেয়। একবারও শ*য়তান গুলোর দিকে তাকায় না ইরান। তার সমস্ত ধেন এখন আনাবিয়ার মধ্যে। তাজীব বলে,

-স্যার আপনি ম্যামকে নিয়ে হসপিটালে চলুন আমি ওদের নিয়ে আমাদের স্টাইলে খাতিরযত্ন করি।

-হুম।

ইরান আর এক মুহূর্ত সেখানে দাঁড়ায় না। আনাবিয়াকে নিয়ে বেরিয়ে পরে হসপিটালের উদ্দেশ্যে।

🌸বর্তমান🌸

শান্ত ভঙ্গিতে সবটা শুনে আনাবিয়া। ইরানও চুপচাপ বসে আছে। আনাবিয়া পাংসুটে মুখে বলে,

-সত্যি এরফান শেখের রক্ত দিয়ে এর থেকে ভালো আশা করা যায় না! সব অমানুষ সৃষ্টিকর্তা শুধু তার ঘরেই দিয়েছে! বাহ্!

আনাবিয়ার কথায় ইরানের নিজের প্রতি নিজেরই ঘৃণা হয়। পাগলদের মতো হাসতে থাকে আনাবিয়া। নিজের পেটে হাত দিয়ে বলে,

-যার বংশ খারাপ সে কী ভালো হবে? আমি কী তাহলে একটা অমানুষকেই জন্ম দেবো? তাই আমি বলি এই বাচ্চা চাই না আমার।

-কথা বুঝে শুনে বলো আনাবিয়া। আমাকে যা মন চায় বলো বাট আমাদের বেবিকে কিছু বলবে না।

আনাবিয়া বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়। রাগে দুঃখে তিরতির করে শরীর কাঁপছে তার। উত্তেজনা চেঁচিয়ে বলে,

-তো কী করব আমি? একটা খারাপ অবস্থায় বেবি কখন ভালো হবে না। ওর মধ্যেও আপনার রক্তই থাকবে। সেও এইরকম ভাবেই মানুষ খুন করবে!নির্দোষ মানুষদের মেরে তাঁদের আপনজন ছিনিয়ে নেবে। না আমি এইরকমটা হতে দিবো না। আরেকটা ইরানকে জন্ম দেবো না আমি।

রাগে হাতের সামনে যা পাচ্ছে তাই ছুঁড়ে ফেলছে আনাবিয়া। ইরান রাগ সংযোগ করে আনাবিয়াকে সামলাতে নেয়। কিন্তু আনাবিয়া ইরানকে ছুঁতে দেয় না নিজেকে। একসময় আনাবিয়া বেডের সাথে পেটে বারি খায়। ব্যাথায় মৃদু কুঁকড়ে উঠে আনাবিয়া তবুও ইরানকে সামনে আসতে দেয় না। আনাবিয়ার এহেন আচরণে ক্ষেপে যায় ইরান। বড় বড় নিঃশাস নিয়ে রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে অসক্ষম হচ্ছে সে।
টেবিলের ওপরে ফল কাটার চাকু ছিল। আনাবিয়া ধপ করে সেটা হাতে নিয়ে নেয়। ইরান আনাবিয়ার হাতে চাকু দেখে জ্ঞানশূন্য হয়ে পরে। শান্ত স্বরে বলে,

-আনাবিয়া, দেখো আনাবিয়া উল্টাপাল্টা কিছু করো না। তোমার সব কথা শুনবো আমি প্লিজ কিছু করো না।

-আমি বাঁচতে চাই না।

-তোমাকে বাঁচতে হবে। ডিভোর্স চাও তো? ঠিক আছে আমার বাচ্চা আমাকে দিয়ে তুমি ডিভোর্স দিয়ে চলে যেও।

ইরান কথার জালে ফেলে এগিয়ে যায় আনাবিয়ার কাছে। আনাবিয়া প্রতিউত্তরে কিছু বলবে তার আগেই ইরান আনাবিয়াকে ধরে তার হাত থেকে চাকু নিয়ে নেয়। তারপর ছেড়ে দেয় আনাবিয়াকে। আনাবিয়া রাগে শিরশির করে বলে,

-আমি বাঁচ,,,,,,,,,,

কথা শেষ করতে পারে না আনাবিয়া। ইরান শক্তি দিয়ে থাপ্পড় মারে আনাবিয়ার গালে। তাল সামলাতে না পেরে গাল ধরে নিচে বসে পরে আনাবিয়া। আনাবিয়াকে যে হাত দিয়ে মেরেছিল সে হাত মুঠো করে ফেলে ইরান। উঁচু স্বরে চিৎকার করে বলে,

-ব্যাস অনেক বলেছো! কী মনে করো মরা অনেক সহজ? তুমি চাইলেই মরতে পারবে এটা ভাবো তুমি? বাট ইউ ফুল! মরব মরব বলা অনেক সহজ কিন্তু করা কঠিন। পেটে ঢুকিয়ে দেবে চাকু। অনেকগুলো রক্ত বের হবে, বাচ্চা মারা যাবে, নিজের ক্ষতি হবে কিন্তু তুমি মরবে না। তখন আরো বেশি কষ্ট ভোগ করবে তুমি।

দম নেয় ইরান। দেয়ালে মুঠি করা হাত বারি মারে। পর পর তিনটা বারি দিতেই হাতে বিন্দু বিন্দু রক্ত জমাট বাধে। রাকিয়া এতক্ষনে চলে আসে। দরজায় টোকা দিয়ে দরজা খুলতে বলে। ইরান আনাবিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,

-এই মরার থেকে তো ভালো তুমি পালিয়ে যাও। বাট সেটাও করলে না! কাল শুধু তোমার কথা ভেবেই আমি তোমাকে পার্টিতে নিয়ে গিয়েছিলাম। কী মনে করো তুমি আমাকে? যদি তোমাকে সারাজীবনের জন্য বন্দি রাখার ইচ্ছে আমার হতো তাহলে তোমাকে আর এই রুমের বাহিরে পা রাখতে দিতাম না? অনুতপ্ততে পুড়ে যাচ্ছি আমি। তাই কাল ভেবেছিলাম তোমাকে সেখানে নিয়ে যাবো যদি তোমার মন চায় তাহলে পালিয়ে যেও। বাট না পালালে না তুমি! আর পালাবেই বা কেনো? একজন খুনির সন্তান নিয়ে কারো পালাতে মন চায়?

বিস্মিত নজরে আনাবিয়া ইরানকে দেখছে। পাগলের মতো ব্যবহার করছে ইরান। শেষে না পেরে হাঁটু ঘেরে মেঝেতে বসে পরে ইরান। চুলগুলো মুঠি করে ধরে বলে,

-আমি মানি আমি তোমার পরিবারের খুনি। তোমার কাছে আমি অপরাধী। প্লিজ আনাবিয়া তুমি আমাকে মেরে ফেলো তবুও আমার সন্তানকে মারার কথা বলো না।

-এখনও আপনি সত্যিটা লুকাবেন ইরান?

ছলছল দৃষ্টিতে আনাবিয়া ইরানের দিকে তাকায়। চমকিত হয়ে ইরান মাথা তুলে আনাবিয়ার দিকে তাকিয়ে মূর্তি হয়ে যায়। আনাবিয়া চোখের পানি মুছে দৃঢ় কণ্ঠে বলে,

-আমি জানি আমার মা জীবিত আছে। কেনো আমার থেকে সত্যিটা লুকাচ্ছেন ইরান? এতো করেও আমি পারছি না আপনার মুখ থেকে সত্যিটা জানতে! আসলে আপনি আমাকে কখন ভালোই বাসেননি! যদি বাসতেন তাহলে এভাবে মিথ্যে বলে আমাকে কষ্ট দিতেন না ইরান!

-,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,।

-সত্যিটা বলুন ইরান। কিছু তো বলুন?

-,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

-ইরান?

-হ্যাঁ তন্নী ফারুক বেঁচে আছে। কিছু হতে দেইনি আমি তাকে। বেঁচে আছে তোমার মা।

>>>>চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here