মুঠোভরা_চোরাবালি #আলিশা_আঞ্জুম #অন্তিম_পর্ব

0
689

#মুঠোভরা_চোরাবালি
#আলিশা_আঞ্জুম
#অন্তিম_পর্ব

আকিকায় কাব্য এলো না। সে নাকি জরুরি কাজের জন্য আসবে না। ফাইজার মামি কহিনূর একথা বলতেই মনে মেঘ জমলো এক কণ্যার। কখন কিভাবে মন হারিয়ে সে ভুক্তভোগী হয়েছে তা বেচারি ঠাহর করতে পারেনি। সেই প্রথম দেখা, তারপর মনে পুষে মন পাঠিয়ে দেওয়া তার কাছে।

সকলে খাওয়া দাওয়া করলো, আনন্দ করলো তবে আয়রা মন খারাপ করে বসে রইলো শুধু বাবুর কাছে। খেতে যায়নি, কারো সঙ্গে কুশল বিনিময় করেনি। ফাইজা আয়রার এমন থম ভাব দেখে বারংবার শুধিয়েছে,

” কি হয়েছে আয়রা?”

আয়রার ছোট করে বলেছে

“কিছু না”

অবশেষে তাসরিফ-ফাইজা যখন খাবার খেতে বসলো ঘরে। তখন আয়রাকে আদর, যত্ন, স্নেহ দিয়ে তাসরিফ খাবারের প্লেটের সামনে বসিয়ে দিয়ে তিনজনে একসাথে খাবার শেষ করলো। স্নিগ্ধা জলদি বিদায় নিলো। ফাইজার মামা মামিও সাদকে নিয়ে দ্রুতই আবারও ফিরলো ঢাকার পথে। ফাইজা ভাইয়ের হাতে বেশকিছু টাকা গুঁজে দিলো। আবার কবে দেখা হবে কে জানে? সাদ এখন মামা বাড়ির স্থায়ী সদস্য। ফাইজার মায়ের ভাগের অর্থ সম্পদ ফাইজার মামা সাদের নামে সংরক্ষণ করে দিয়েছেন। সাদের মায়ের অভাব মামি পূরণ করে দিয়েছেন। আয়রা কোহিনূরকে দেখে লজ্জা পায় ভীষণ। কোহিনূর এই লজ্জার হেতু খুঁজে পায়না।

.
আকিকা করে বাবুর নাম রাখা হয়েছে জারিফ। জারিফ ফাইজার ঘরে এসেছে আজ একমাস হলো। তাসরিফ হঠাৎ যেন সুস্থ হ’য়ে গেছে। বেশ ভালো তার শরীরের অবস্থা। তবে মানুষ কি মৃত্যুর আগে হঠাৎই শেষ বােরের মতো ভালো হয়? সুস্থ হয়? হয়তোবা! সুখকর সময়গুলো বিষাদে রূপ নিলো। আচমকা আজ সকালে অফিস যাওয়ার পথে হাশফাশ ভাব তাসরিফের। এভাব তুচ্ছ করে অফিস পৌঁছে দু একটা ফাইল ঘাটাঘাটি করতে গিয়েই মাথায় ঘোয়ায় তাসরিফের। মনের সর্বোত্র অশান্তি ভাব। ফোঁস ফোঁস নিশ্বাস আসে বুকের ভেতর হতে। বুঝে উঠতে পারে না তাসরিফ এমন কেন লাগে তার? দ্রুত বাসায় ফেরে সে। ড্রয়িং রুমে পৌঁছেই একটু উঁচু স্বরে মা বলে ডেকে উঠে ধপ করে বসে পরে সোফায়। তাসলিমা দৌড়ে ছেলের নিকট এসেই কেঁপে উঠেন। বুকের ভেতরটা মুচড়ে ওঠে। বাবুকে ঘুমের সাগরে ডুবিয়ে ফাইজা মাত্রই বিছানায় বসেছিলো। তাসরিফের কন্ঠ কানে পৌঁছাতেই দ্রুত সে ড্রয়িং রুমে আসতেই নজরে আসে তাসরিফের বিধ্বস্ত চেহারা। কাছে যাওয়ার কথা আচমকা বোকা ফাইজা যেন ভুলে বসলো। ভাবশূন্য হয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলো ঘর্মাক্ত তাসরিফ কে। তাসরিফ শান্ত হয়ে গেলো যেন। আচমকা তার ছটফট ভাব দমে গেলো। কেবল নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো সে ফাইজার পানে। এমন সময় ফাইজা আচমকা ঢলে পরলো মাটিতে। চোখের সামনের দৃশ্য সে সহ্য করতে না পেরে পরে গেলো মেঝেতে। ঠিক তখনই তাসরিফ শান্ত ভঙ্গিতে মায়ের কাঁধে মাথা রাখলো চিরতরে, অতি শান্ত ভঙ্গিতে।

.
কিছু মানুষ হারিয়ে যায় স্বইচ্ছায়। কিন্তু মানুষ হারিয়ে যায় ওপর ওয়ালার ইচ্ছায়। তারা শুধু হারিয়ে যাওয়ার মাঝেই সমাপ্ত করে দেয় তাদের অধ্যায়। কিন্তু হারিয়ে যাওয়া মানুষটার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা আরেকটা মানুষের যে শুরু হয় করুন এক নব অধ্যায়। তার যে পালিয়ে যাওয়ার কোনো পথ নেই। তার যে কষ্ট গুলো তালাবদ্ধ করে রাখার মতো কোনো পাত্রবা কক্ষ নেই।

আগরবাতি, ধুপ কাঠির কড়া গন্ধ মৌ মৌ করে আজ তাসলিমার ঘর জুড়ে। চেনা অচেনা কত লোকের ভীড়। চোখের অশ্রু বাঁধাহীন ঝড়ছে। মুহূর্তেই তার ছেলে হয়ে গেছে মৃত। ভাবতেও বুক কাপে। চিৎকার করে কেঁদে উঠতে ইচ্ছে করে। স্নিগ্ধা, আয়রা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে তাসলিমার পানে। ইতিমধ্যে কে যেন বলে ওঠে, ‘বউটা কোথায়?’ কথাটা যেন মাটিতে পরতে না করতেই ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে আসে ফাইজা। এতোক্ষন জ্ঞান শূন্য থাকার পর মাত্র তার জ্ঞান ফিরেছে। বাঁকহীন ঘর থেকে ড্রয়িং রুমে এসেই ফাইজা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো সোফার পানে। সেখানে বসে আছে স্নিগ্ধা, আয়রা আর তাসরিফের মা। তাসরিফ নেই কেন? ফাইজার এক চোখ হতে গড়িয়ে পরে অশ্রু। যেন তার কাল পরিস্থিতি আমলে নিতে কষ্ট হচ্ছে। যখনই মস্তিষ্ক বুঝে উঠলো সব তখনই একটা চিৎকার দিয়ে মেঝেতে বসে পরে ফাইজা। এলোমেলো চিৎকার। অবিন্যস্ত ভাব। ছোট বাচ্চার মতো হাউমাউ করে কান্না। ধুপের কড়া গন্ধ যেন মস্তিষ্ক কে বিগড়ে দিলো। সাফা দৌড়ে গিয়ে ফাইজাকে বুকের সাথে চেপে ধরতেই কান্নার বেগ তীব্র হলো। দৌড়ে ফাইজা যেতে চায় তাসরিফের কাছে। সকলে আটকে ফেলে। শুরু হয় ভয়ঙ্কর দৃশ্য। ফাইজার মুখে বারংবার ধ্বনিত হলো

” আমাকে সঙ্গে নিলে না কেন?”

ফাইজার এই বাঁক যেন ধ্বনিত হলো সকলের কানে। কি দুঃখ, কি কষ্ট! ইশ! মেয়েটা কিভাবে এই কষ্টের ভার বহন করবে আজীবন? আফসোসে ছেয়ে গেলো চারপাশ।

বাদ আছর জানাজা করানো হবে তাসরিফের। ফাইজা শেষ দেখা দেখবে না বলে গো ধরে রইলো। সে বারংবার সকলকে বলল, “আমি সহ্য করতে পারবো না। আমি দেখবো না। আমি বিশ্বাস করি না।” কিন্তু ফাইজার বিশ্বাস অবিশ্বাসে কি সত্য পাল্টে যায়? জোর করে শেষ দেখা দেখানো হলো ফাইজাকে।

———

গভীর নিশির কান্না, বুকে তরতাজা কষ্ট, নির্ঘুম রাতের মধ্য দিয়ে ফাইজা প্রিয়র বিয়োগান্ত অধ্যায় বরণ করে নিয়েছে। বছর কাটিয়েছে পাঁচটা। এই পাঁচ বছরে ফাইজা শিখে গেছে নিজেকে সামলানো। ব্যাবসা সামলিয়ে ছেলেকে সামলানো শিখে গেছে সে। কাব্য ফাইজার পাশে দাবড়ানোর ইচ্ছে পোষণ করেছিল। তাসরিফ চলে যাওয়ার এক বছর হতেই কাব্যর পক্ষ হতে পরোক্ষ প্রস্তাব আসে ফাইজা চাইলে সে পাশে আজীবন পাশে থাকবে ফাইজার। জারিফকে আগলে রাখবে। তবে ফাইজা বলে দিয়েছে

” সব গল্পের নায়িকা দ্বিতীয় নায়ককে জীবনে ঠাঁই দেয় না। ”

কাব্য কথায় বাড়ায়নি। আর কখনো দ্বিতীয় বার ফাইজার নিকট একথা কোউ তোলার সাহস করেনি। আয়রা ইতিমধ্যে তার যত্নে পোষা ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ করে। ঢাকার এক নামি-দামি প্রাইভেট ভার্সিটিতে সে পড়ালেখা করছে ইদানীং। হঠাৎ সৌভাগ্যক্রমে তার দেখা হয়ে যায় কাব্যর সঙ্গে। একদিন চা খাওয়ার নাম করে আয়রা লুকিয়ে সতর্কতার সাথে কাব্যর শার্টের পকেটে টুপ করে ছেড়ে দেয় একটা নীল কাগজের চিঠি। যে চিঠি সে সার্বক্ষণিক সঙ্গে নিয়ে ঘুরতো। আয়রার ভাবনা ছিলো হয়তো নীল কাগজের চিঠি তার জন্য নীল অপরাজিতা হবে নয়তো হবে নীল রাঙা বেদনা।

.
অনেক দিন আগের কথা। ফাইজার বই বের হওয়ার কথা ছিলো। সে বই এতোদিনে বাজারে প্রকাশ করা হলো। বইয়ের গল্পটা ফাইজা সাজিয়েছিল একরকম। ভেবেছিল ওটাই বুঝি তার জীবন। তবে ভাবনা যে ভুল হয়েছে। প্রমাণ হয়েছে, জীবণ কখনো সুষম বেগে চলে না। ত্বরণ, মন্দন হীন জীবন হয় না। আর চোখের দেখার বাইরেও থাকে অনেক কিছু।

জারিফকের মুখপানে চাইলে ফাইজার বাঁচার ইচ্ছে জাগে। তাসরিফ তাকে একটা রত্ন দিয়ে গেছে। এই মাণিক যদি ফাইজার নিকট অনুপস্থিত থাকতো তবে হয়তো ফাইজা শ্বাস প্রশ্বাস ফেলা লাশ হয়ে পৃথিবীর বুকে পরে থাকতো। জারিফ মা বলে ডাকলে ফাইজার দায়িত্ববোধ জেগে ওঠে। ভাবনার মাঝে ফাইজার দুচোখে আঁধার মিলল। কে যেন তার চোখে হাত রেখে পেছনে চুপটি করে দাড়িয়ে আছে। ফাইজার কি বোঝার বাকি রইলো এই কান্ডটা কার? সে তবুও আগন্তুক কে খুশি করার লক্ষ্যে খানিক ভাবসাব করে বললো

— এই ছোট হাত দু’টো তো খুব চেনা। কে কে…. ওহ… এটা তো আমার সোনা বাবা।

জারিফ খিলখিল করে হাসতে হাসতে ফাইজার সামনে চলে এলো। কাঁধে তার স্কুল ব্যাগ। জারিফ ব্যাগ থেকে একটা তাজা গোলাপ বের করে ফাইজার সামনে ধরে বলল

— ভালোবাসি দিবসে ভালোবাসা মা।

ফাইজা শব্দ করে হেসে উঠলো জারিফের এলোমেলো শব্দে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ দেখে। জারিফ ঠোঁট উল্টে মায়ের হাসি দেখলো। মনটা কি খারাপ হলো তার? একটু হলো বটে। তবে ফাইজা বুঝিয়ে বললো। সঠিকটা শিখিয়ে দিয়ে বেলকাণি হতে উঠে ছেলের পোষাক পাল্টে স্কুলের গল্প শুনলো। কত-শত গল্পের মাঝে ছেলেকে ফ্রেশ হতে সাহায্য করলো। জারিফ ফ্রেশ হয়ে ছুটে গেলো দাদির ঘরে। তাসলিমা এখন জারিফের মায়ায় আবদ্ধ। জারিফ মানে তার প্রাণ, জারিফ মানেই এবাড়ির আনন্দ, খুশি, হাসি।

ফাইজা এমন সময় আজ লুকিয়ে চলে গেলো তাসরিফের মাটির বাড়িতে। খুব বেশি মনে পরলে সে একাকী চলে আসে এখানে। দু ফোঁটা চোখের জল ফেলে। দু একটা কথা বলে। তবে অভিযোগ তার একটাই,

” আমায় কেন সঙ্গে নিলে না। ”

ফাইজা আজ জারিফের দেওয়া গোলাপ তাসরিফের মাথার নিকট রেখে বলতে আরাম্ভ করলো,

” আজ ছেলে আমাকে এই ফুল দিয়ে কি বলেছো জানো? ‘ভালোবাসি দিবসে ভালোবাসা মা’ হা হা হা… ছেলেটা একটু দুষ্টুই। আজ আমার অনেক খুশি লাগছে ওর ভালোবাসা দেখে। আচ্ছা ও যদি বড় হয়ে জানতে পারে আমি ওর পালক মা। তখন কি ও আমাকে একা করে দিয়ে চলে যাবে? যাবে না নিশ্চয়ই তাই না? যদি চলে যায়? আমি কি নিয়ে হাসবো? বাঁচার কথা বলি না। মৃত্যু কে তো আমি ভয় পাই না। তবে বেঁচে থাকতে যে আমার খুব কষ্ট হবে? তুমি কেন আমায় সঙ্গে নিলে না গো? তুমি আমায় সঙ্গে নিলে আমার যে এতো কষ্ট হতো না।”

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here