শেষটা_সুন্দর(সিজন-২) #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ১৩।

0
419

#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৩।

পুতুলের মাথা ঘুরাচ্ছে। যেন ভনভন করে ঘুরছে চারপাশ। বুকের ভেতরেও ধপধপ করছে। হৃদপিন্ড এত কেন লাফাচ্ছে? চারপাশ এমন ঘোলাটে লাগছে কেন? সে কি চোখে ঝাপসা দেখছে? ঐ তো তার সামনে তার সারাজ ভাই, শান্ত স্বাভাবিক। তবে তার কেন এমন লাগছে? পুতুল মাথা চেপে ধরে উঠে দাঁড়ায়। গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। ভীষণ কষ্ট করে বলে,

‘মা, এখানে আমার বিয়ের কথা কোথ থেকে আসছে?’

মেহুল প্রসন্ন হেসে বলল,

‘ওমা, মেয়ে বড়ো হচ্ছে, এখন তো বিয়ে নিয়ে ভাবতেই হবে, তাই না?’

অসন্তোষ রাবীর। তার এসব মারাত্মক বিরক্ত লাগছে। চোখে মুখে সেই বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। মেহুল কেন এসব বলছে সে বুঝতে পারছে না। তবে এইটুকু বুঝতে পারছে, নির্ঘাত এর পেছনে কোনো জটিল কারণ আছে।

রাবীর শান্ত গলায় বলল,

‘মেহুল, এখন কি পুতুলের বিয়ে নিয়ে কথা বলার সময়? আর ওর তো এখনও বিয়ের বয়স হয়নি। বাচ্চা মেয়ে, আপনি হুট করে এখন কেন এসব বলছেন?’

মেহুলের ঠোঁটে হাসির রেশ। বলল,

‘আহা, এখনই তো আর বিয়ে হচ্ছে না। আপনি আপাতত ছেলের ব্যাপারে একটু খোঁজখবর নিন। সবকিছু পছন্দ হলে তারপরই না হয় আমরা আগাব।’

না, আর সহ্য করতে পারছে না পুতুল। এবার সে জ্ঞান হারাবে। বুকে ব্যথা করছে। যেকোনো সময় অ্যাটাক ফ্যাটাকও করে ফেলতে পারে। চোখ ঘোলা হয়ে উঠে স্বচ্ছ জলের আবেশে। টুপ করে সেটা গাল বেয়ে গড়িয়েও পড়ে। অথচ, তার সারাজ ভাই এখনও স্বাভাবিক। এই দৃশ্য বড্ড বেদনার। সে আর না পেরে এবার চেঁচিয়ে উঠল,

‘মা, আমি বিয়ে করব না। শুনেছ তুমি? আমি বিয়ে করব না। আজকের পর থেকে এই বাড়িতে আর কখনও আমার বিয়ে নিয়ে কোনো কথা উঠবে না। উঠবে না, মানে উঠবে না। বুঝেছ তোমরা?’

দৌড়ে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে যায় পুতুল। আর সম্ভব না। বড্ড কষ্ট হচ্ছে তার। শ্বাস ফেলতে পারছে না। সবথেকে বেশি কষ্ট হচ্ছে এটা ভেবে যে, এতকিছুর পরেও তার সারাজ ভাই একটা টু শব্দও করেননি। উনার কি কষ্ট লাগছে না? একটুও বুক পুড়ছে না? তাহলে কি, পুতুলের ভাবনা সব মিথ্যে? সারাজ ভাইয়ের মনে তার প্রতি কোনো অনভূতি নেই? তাই তিনি এতটা স্বাভাবিক? পুতুলের গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিতে ইচ্ছে করছে। এভাবে সবকিছু শেষ হয়ে যাবে? সে তার সারাজ ভাইকে পাবে না? তার জীবনে অন্য কেউ চলে আসবে? না না, সে আর নিতে পারছে না। দরজা আটকে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে। বালিশে মুখ চেপে অঝোরে কাঁদতে আরম্ভ করে। এই দুঃখ সে সইতে পারবে না। মরে গেলেও পারবে না।

রাবীর বিরক্ত হয়ে বসার ঘর ছেড়ে উঠে গেল। বসে রইল কেবল সারাজ। তার ভাবমূর্তি এখনও আগে মতো। মনে কী চলছে বাইরে থেকে ঠাহর করা মুশকিল। মেহুল তাকিয়ে আছে। দেখছে, ভাবছে; কিন্তু সারাজের অভিব্যক্তি বোঝা মুশকিল। তার মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই কেন? সে কি তবে সত্যিই এখন পুতুলকে পছন্দ করে না?

প্রশ্নগুলো বড্ভ চিন্তায় ফেলে মেহুলকে। আরেকটু ঘাটাতে হবে ব্যাপারটাকে। এই ভেবে সোফায় বসল মেহুল। উদ্বিগ্ন গলায় বলল,

‘বুঝলি তো সারাজ, কেউ আমাকে বুঝতেই চাইছে না। আমি কি আমার মেয়ের খারাপ চাই, বল? মেয়ে একটু বড়ো হলে মায়েদের যে কত চিন্তা সে কি আর মেয়েরা বোঝে? বোঝে না। এই যেমন আমার মেয়েও এখন বুঝছে না। সারাজ বাবা, ওকে তুই একবার বুঝাবি? আমরা তো আর এখনই বিয়ে দিব না; দেখে শুনে আস্তে ধীরে হবে সব। তুই একটু ওকে সবটা বুঝিয়ে বল না, বাবা। আমি নিশ্চিত, তোর কথা ও কখনোই ফেলতে পারবে না।’

সারাজ চোখ মুদে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইল। মাথায় প্যাচ লেগে গেছে। এতকিছু একসাথে মস্তিষ্ক নিতে পারছে না। তার একটু সময় লাগবে। প্রতিটা কথা বুঝতে সময় লাগবে। এভাবে সবকিছু হতে পারে না। তাকে কিছু করতে হবে। চোখ মেলল। রিক্ত দৃষ্টি বর্তাল মেহুলের পানে। নিরেট গলার স্বর তার। তাও কষ্ট সমেত বলল,

‘এখনই ওর বিয়ে নিয়ে এত তাড়া দিচ্ছো কেন, মা? কেবল তো অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে; অন্তত অনার্সটা শেষ করতে দাও।’

মেহুল অধৈর্য গলায় বলল,

‘আহা, তুই বুঝতে পারছিস না। সবসময় কি ভালো ছেলে পাওয়া যায়? বিয়ে না হোক, অন্তত কাবিন করিয়ে তো রাখা যাবে। আমার বেলাতেও তো তাই হয়েছিল। তুই বোঝা ওকে। তুই বোঝালে ও বুঝবে।’

উঠে পড়ল সারাজ। মেহুল বুঝল না কিছু। জিজ্ঞেস করল,

‘কী হয়েছে?’

‘কিছু না। বাসায় যাচ্ছি। মাথা ধরেছে আমার।’

‘ওমা, চলে যাবি? রাতে খেয়ে যা।’

‘না, ভালো লাগছে না। বাসায় গিয়ে ঘুমাতে হবে। আসছি।’

গটগট করে বেরিয়ে যায় সারাজ। মেহুল আশ্বস্ত হয়। না, এখনও টান আছে। আর এই সুযোগকেই কাজে লাগাতে হবে।

____________

‘আম্মু, আম্মু।’

গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে সারাজ। চোখ মুখ ভয়ানক লাল তার। রাগে কপালের বাম দিকের শিরা ফুলে উঠেছে। মাথার ভেতরে ধপধপ করছে। ছেলের চিৎকারে রুম থেকে ছুটে আসে রিতা। কপালে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করে,

‘কিরে, কী হয়েছে? এভাবে চেঁচাচ্ছিস কেন?’

রাগে জ্বলে উঠল সারাজ। বিক্ষিপ্ত কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ল,

‘তুমি কি সবকিছু ছেড়ে এখন ঘটকালি শুরু করেছো? বাবা জানেন এসব?’

রিতা ভ্যামাচ্যাকা খায়। কী বলছে সারাজ? তিনি অবুঝ কন্ঠে বললেন,

‘কী বলছিস এসব? আমি ঘটকালি করতে যাব কেন?’

‘সেটা তো তুমিই ভালো জানো। কী দরকার ছিল, পুতুলের জন্য পাত্র দেখার? পাত্র আবার সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। খুব পছন্দ হয়েছে তাই না? এখন কি বিয়ে দিয়ে দিবে? ব্যস, শেষ সবকিছু? আশ্চর্য আমি। পুতুলের বিয়ের কথা কেন উঠছে, আম্মু? ওর কি বিয়ের বয়স হয়েছে? হয়নি। বাচ্চা মেয়ে ও। আমার ছোট্ট পুতুল। তোমরা ওর বিয়ের কথা ভাবছ কী করে? শুনো আম্মু, পুতুলের বিয়ে হচ্ছে না। আমি না চাওয়া অবধি পুতুলের কোনো বিয়ে হবে না। আর আমার কথার হেলফেল হলে তো জানোই আমি কী করতে পারি।’

শরীর কাঁপছে সারাজের। দ্রুত নিজের রুমের দিকে পা বাড়াল সে। এখানে থাকলে মাথা আরো গরম হবে তার। তাই নিজের রুমে গিয়েই ঘাপটি মারল।

রিতা হতবিহ্বল। ঘটনা আগা মাথা সে কিছুই জানে না। সারাজ কেন এত রাগ দেখাল? পুতুলের বিয়ের প্রসঙ্গ আসল কোথ থেকে? কী থেকে কী হয়ে গেল, মাথায় ঢুকছে না তার। ভড়কে যাওয়ার দৃষ্টিতে একবার এদিক ওদিক তাকাল সে। না, বুঝতে পারছে না কিছুই। মেহুলকে জানানো ছাড়া উপায় নেই। রুমে ফিরে এসে মেহুলকে কল করল। রিসিভ হলো সঙ্গে সঙ্গেই। রিতা আতঙ্কিত কন্ঠে বলে উঠল,

‘দোস্ত, জানিস কী হয়েছে?’

ওপাশ থেকে শান্ত গলায় মেহুল জবাব দিল,

‘জানি, তোর ছেলে পাঁচ মিনিটে ঘৃর্ণিঝড় বইয়ে দিয়েছে। সমস্যা নেই, সময় আসলে ঘূর্ণিঝড়ের তেজ আপনাতেই কমে যাবে।’

‘কীসব বলছিস? আর পুতুলের বিয়ের কথা আসছে কোথ থেকে? তাও আবার আমি নাকি ঘটকালি করছি? কিছুই তো মাথায় ঢুকছে না।’

‘আরে বাবা, আমাদের প্ল্যান অনুযায়ী কাজ করছি। ভুলে গেলি নাকি?’

‘ওহহো, না ভুলিনি তো। কিন্তু, তুই হুট করেই সব শুরু করে দিবি, বলবি না আমায়। আমি তো সারাজের প্রতিক্রিয়া দেখে বেকুবের মতো চেয়ে ছিলাম। আচ্ছা, তাহলে এই হলো কারণ?’

‘জি হ্যাঁ, ম্যাডাম। এবার অন্তত এটা ভেবে নিশ্চিন্ত যে সারাজ এখনও পুতুলকে আগের মতোই পছন্দ করে।’

‘হ্যাঁ, ও বাসায় এসে যে হম্বিতম্বি দেখিয়েছে তাতে আর কোনো সন্দেহ নেই। শোন, এবার আর দেরি করব না। সারাজ সব স্বীকার করলেই বিয়েটা দিয়ে দিব।’

‘হু, আমিও তাই ভাবছি। সারাজের মাথায় পুতুলের চিন্তা ঢুকালে রাজনীতির চিন্তা থেকে ও কিছুটা হলেও দূরে থাকতে পারবে।’

‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস। এবার পরবর্তিতে আমাকে আর কী করতে হবে বল।’

‘শোন, বলছি….’

_____

দুহাতে মাথা চেপে বসে আছে সারাজ। অসম্ভব মাথা যন্ত্রণা করছে। বুকেও ব্যথা করছে খুব। পুতুলের পাশে অন্য কোনো পুরুষকে সে সহ্য করতে পারবে না। তার পুতুল কেবল তার। তার নিজস্ব সম্পত্তি। এই সম্পত্তিতে সে অন্য কারোর ভাগ বরদাস্ত করবে না। কখনোই না।

রাগের চোটে বিছানার বালিশটা ছুড়ে নিচে ফেলল। তার পরিবারের মানুষ পুতুলের সাথে অন্যকারোর বিয়ের কথা ভাবছে কী করে। সেই ছোট্ট বেলা থেকে সে সবাই জানিয়ে এসেছে, এই ছোট্ট পুতুল তার। আজও তার। আজীব তারই থাকবে। তাহলে, কেন উনারা তার থেকে তার পুতুলকে ছিনিয়ে নিতে চাইছে? কীসের অপরাধে?

সারাজ মাথার চুল টেনে চোখ বুজে। ক্রমাগত জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করে। ফোনটা বেজে উঠে তখন। হাতে নিয়ে দেখে স্ক্রিনে পুতুলের নাম, সাথে ওয়ালপেপারে তার হাস্যজ্জ্বল এক ছবি। এই ছবি দেখেই প্রতিবার সারাজের পরাণ জুড়ায়। তবে আজ এই মুখের সেই হাসি যেন সারাজের বক্ষস্থলে গিয়ে তীরের মতো বিঁধল। রক্তক্ষরণ হলো সেই স্থান থেকে। অথচ কেউ দেখল না, কেউ না।

কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে শোনা গেল কারো কান্নাভেজা বিধ্বস্ত স্বর,

‘সারাজ ভাই, আমি বিয়ে করব না। তুমি মা’কে বোঝাও না, প্লিজ।’

সারাজ নির্লিপ্ত সুরে শুধাল,

‘কেন বিয়ে করবি না?’

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here