শেষটা_সুন্দর(সিজন-২) #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ১৮।

0
385

#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৮।

সারাজকে খুব বুঝিয়ে সুঝিয়ে রিতা তার সাথে এনেছে। এমনিতেই সারাজের মেজাজ খারাপ। তার উপর রিতাও এমন শুরু করেছে যে, সে না পারছে সইতে আর না পারছে কিছু বলতে।
কোথ থেকে কোন পাত্র পক্ষ আসবে কে জানে?
অথচ মেহুল মেয়েকে সাজিয়ে অস্থির। পুতুল জমে খিচ মেরে বসে আছে। আজকে পুরোদিন এইভাবেই কাটাবে সে। নিচে রিতা, সারাজ আর সাদরাজ আছে। রাবীরও তাদের সাথে। উপরে পুতুল রাগে একটু পরপর দাঁত পিষছে। এত রাগ জীবনেও হয়নি তার। মেহুল এইদিকে আহ্লাদে আটখানা। মেয়েকে সাজাতে ব্যস্ত। এমন একটা ভাব যেন, পাত্র দেখতে না বিয়ে পড়াতে আসছে।

‘মা, হয়েছ?’

‘দাঁড়া না, আরেকটু।’

‘উফফ! মা, আর ভাল লাগছে না। আল্লাহর দোহাই লাগে, এবার ছাড়ো।’

মেহুল শব্দ করে চিরুনিটা রাখল। বলল,

‘ভাল না লাগলে বিয়েতে রাজি হলি কেন? পাত্রপক্ষের সামনে তো আর যেমন তেমন করে গেলে চলবে না। রাজকুমারী সেজে যেতে হবে, যেন পাত্র একবার দেখেই টাস্কি খায়।’

পুতুল ঠোঁট ফাঁক করে ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে। মা’কে বলে লাভ নেই। ঐদিকে নিচে কী হচ্ছে কে জানে? সারাজ ভাইও নিশ্চয়ই সবার সাথে বসে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন। আচ্ছা, উনি কি ঐ মেয়েটার সাথে কথা বলে নিয়েছেন? এক কথাতেই আবার প্রেম ট্রেম হয়ে যায়নি তো? উফ, এই ছোট্ট মাথাত আর কত দুশ্চিন্তার ভার বইবে সে?

নিচ থেকে রিতার উঁচু গলার স্বর পাওয়া গেল। সে বলছে,

‘এই মেহুল, পাত্রপক্ষ চলে এসেছেন। নিচে আয় জলদি।’

মেহুল অস্থির গলায় বলল,

‘তুই এখানে চুপটি করে বসে থাক। আমি পরে এসে তোকে নিচে নিয়ে যাব।’

মেহুল বেরিয়ে যায়। মুখ গোমড়া করে বসে থাকে পুতুল। সত্যি সত্যিই সব হচ্ছে? সারাজ ভাই কি আটকাবেন না এসব? পুতুলকে অন্য কারোর হতে দেখলে, উনার বুকের ব্যথা করবে না? কষ্ট হবে না? দম আটকে আসবে না?

পুতুল আস্তে আস্তে করে গা থেকে সব জুয়েলারিগুলো খুলে রাখে। কপালের ছোট্ট টিপটা তুলে আয়নাতে লাগিয়ে দেয়। গর্জিয়াস জামা পাল্টে ঘরের একটা সুতি জামা গায়ে দেয়। মুখের সব মেকআপ ও তুলে ফেলে। আয়নার দিকে চেয়ে মৃদু হেসে বলে,

‘এবার ঠিক লাগছে। এইভাবেই নিচে যাব।’

___

মন্ত্রীর বাড়ি বলে কথা, তার উপর তাঁর মেয়ের বিয়ে নিয়েই এত জালিয়াতি। ধরা পড়লে আর রক্ষে নেই। তিন জন ব্যক্তি জবুথবু হয়ে বসে আছেন সোফাতে। মধ্য বয়স্ক মহিলা আর পুরুষের ঠিক মাঝখানে একজন তরতাজা যুবক। তবে তার অবস্থাও বেগতিক। ভীত সন্ত্রস্ত লাগছে তাকে। বারবার তাকাচ্ছে রিতার দিকে। রিতা যেন ইশারা করে কী বলছে। সারাজ পারছে না ছেলেটাকে চোখ দিয়েই গিলে ফেলতে। এমন একটা কেরামত আলী টাইপ ছেলের সাথে পুতুলের বিয়ে? তারই তো ছেলে পছন্দ হয়নি, পুতুলের কী পছন্দ হবে। মেহুল বুঝতে পারছে না, লোকগুলোকে সত্যি সত্যিই আপ্যায়ন করবে, নাকি আপ্যায়নের অভিনয় করবে? রিতা যে এদের কোথ থেকে ধরে এনেছে কে জানে?

রিতা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হেসে বলল,

‘বাবা, তুমি কিছু নিচ্ছ না কেন? চা’টা নাও। ঠান্ডা হচ্ছে তো।’

ছেলেটা হেসে হেসে চায়ের কাপটা হাতে নিল। সারাজের বোধগম্য হলো না, চায়ের কাপ নেওয়ার সময় এমন দাঁত কেলাতে হবে কেন? তার তখন ভীষণ ইচ্ছে জাগল, ছেলেটার ঠিক দাঁত বরাবর একটা ঘুষি মেরে সামনের দুখানা দাঁত ফেলে দিতে। তখন তাকে দেখতে আরো বেশি সুন্দর লাগবে।

পাত্রের মা বলে পরিচিত ভদ্রমহিলা এবার বললেন,

‘তা, আপনাদের মেয়েকেও এবার নিয়ে আসুন। আমরাও একটু দেখি তাকে।’

মেহুল হেসে উঠে দাঁড়াল। বলল,

‘জি, অবশ্যই। এক্ষুনি নিয়ে আসছি।’

মেহুল রুমে এসে চমকে যায়। মেয়েকে রেখে গিয়েছিল রাজকুমারী বানিয়ে, অথচ মেয়ে এখন হয়ে আছে রাজ্যের দাসী। মেহুল কপাল কুঁচকে বলল,

‘এসব কী, পুতুল? তুই সবকিছু খুলে ফেললি? এইভাবে নিচে যাবি তুই?’

পুতুল দায়সাড়া ভাবে বলল,

‘হু।’

‘তোকে এভাবে দেখলে উনারা জীবনেও পছন্দ করবেন না।’

‘না করুক। উনারা পছন্দ না করলে কি আমার আর বিয়ে হবে না? এবার সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার এনেছ, পরেরবার না হয় কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার আনবে। তার পরেরবার না হয় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার আনবে। আর ইঞ্জিনিয়ার পছন্দ না হলে, ডাক্তার, ব্যাংকার এইগুলো তো অপশনে আছেই। সো, নো টেনশন।’

মেহুল ধমক দিয়ে বলল,

‘ঠাস করে মারব এক চড়। বড্ড ফাজিল হয়েছিস। চল, তোকে এইভাবেই পাত্রপক্ষ দেখুক।’

‘ঠিক আছে, চলো। আমার তাতে কোনো আপত্তি নেই।’

মায়ের আগে সে’ই বেরিয়ে পড়ল। মেহুল পেছন থেকে ডেকে বলল,

‘আহা, মাথায় ঘোমটা’টা তো একটু দে।’

পুতুল গটগট করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল। তাকে এভাবে দেখে সবাই বিস্মিত। এসেই সে বলল,

‘হাই, আমি পুতুল। পুতুল খান।’

কন্ঠের মাঝে কোনো জড়তা বা অস্বস্তি নেই। মেহুল পেছন থেকে এসে দুহাতে মেয়েকে ধরে বলল,

‘আমাদের একমাত্র মেয়ে। ভীষণ লক্ষী।’

পাত্রের মা বাবা কী বুঝলেন কে জানে, বোকা বোকা হেসে মাথা নাড়ালেন তাঁরা। পাত্রের মা ভদ্রতার খাতিরে বললেন,

‘বসো না, মা।’

পুতুল এদিক ওদিক চেয়ে বলল,

‘জায়গা নেই তো, কোথায় বসব?’

মেহুল মেয়ের হাতে হালকা চাপ দেয়। বোঝানোর চেষ্টা করে, চুপ থাকতে। সারাজ তখন তার জায়গা ছেড়ে উঠে বলল,

‘এখানে বস।’

পুতুল সারাজের দিকে চাইল। কী শান্ত, সাবলীল তার চোখের দৃষ্টি; যেন এখানে কিছুই হচ্ছে না। পুতুলের রাগ আরো বাড়ল তাতে। সে হেসে গিয়ে সারাজের জায়গায় বসে পড়ল। তারপর কৌতুহল নিয়ে প্রশ্ন করল,

‘উনি বুঝি পাত্র?’

পাত্র বলতেই সেই ছেলেটি তার দিকে লজ্জামাখা হাসি দিয়ে চাইল। হাসি দেখেই বিরক্ত হলো পুতুল। হাসছে দেখো, যেন লজ্জায় মরে যাচ্ছে। পুতুল ও জোরপূর্বক হাসল। জিজ্ঞেস করল,

‘নাম কী আপনার?’

‘জি, কামাল মিয়া।’

পুতুলের হাসি গায়ের হয়ে গেল। রিতা মেহুলের দিকে চেয়ে ঠোঁট চেপে হাসছে। হঠাৎ পুতুল উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠল,

‘বাহ, দারুণ নাম তো। তা, কামাল মিয়া আপনি বুঝি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার? কোন ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশোনা করেছেন?’

ছেলেটা হালকা হাসার চেষ্টা করে বলল,

‘ঐ তো, ঐ যে..’

‘ঐ তো ঐ যে বলে বাংলাদেশে তো কোনো ইউনিভার্সিটি নেই, কামাল মিয়া। বিদেশে থাকলে থাকতে পারে। আপনি কি বিদেশ থেকে পড়াশোনা করেছেন?’

ছেলেটা বোকার মতো সজোরে মাথা নাড়ায়। পুতুল তখন তার বাবার দিকে চেয়ে উৎসুক কন্ঠে বলে উঠে,

‘দেখেছো বাবা, কী শিক্ষিত! এই জন্যই মা’র এত পছন্দ হয়েছে, আমি তো এতক্ষণে বুঝলাম। এই, আপনারা আমাকে কোনো প্রশ্ন করছেন না কেন? আমি তো পাত্রী। পাত্রীকে প্রশ্ন না করলে চলে? নিন নিন, প্রশ্ন করুন।’

অজ্ঞাত ব্যক্তি তিনজন একে অপরের মুখ দেখছে। কোথায় যে এসে ফেঁসেছেন তারা, উফ!

রাবীর ঠান্ডা গলায় বলল,

‘পুতুল মা, তুমি একটু শান্ত হয়ে বসো। আমরা বড়োরা কথা বলছি তো।’

তারপর সে পাত্রের মা বাবার দিকে চেয়ে প্রসন্ন গলায় বলল,

‘কিছু মনে করবেন না। আমাদের মেয়ে একটু চঞ্চল। তবে অনেক সহজ সরল। সবাইকে নিজের মতো করে ভালোবেসতে জানে। আশা করছি, আপনারা ব্যাপারটা সহজ চোখে দেখবেন।’

‘না না। এই বয়সী মেয়েরা একটু চঞ্চল হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। আর আমাদের চঞ্চল মেয়েই পছন্দ। আমাদের বাড়িটা মাথায় তুলে রাখতে পারবে। আমাদের মেয়ে পছন্দ হয়েছে। এবার আপনারা যা বলবেন তাই হবে।’

পুতুল মিইয়ে গেল এবার। মাথা কাত করে একবার চাইল তার সারাজ ভাইয়ের দিকে। লোকটা এখনও এতটা নির্লিপ্ত কী করে? কিছুই কি বলবেন না তিনি? পুতুলের বিয়েটা তিনি হাসি মুখে মেনে নিবেন?

রাবীর প্রশ্নবিদ্ধ চোখে মেহুলের দিকে চেয়ে আছে। মেহুল নিচেও নির্বাক। তার তো মনে হচ্ছে, এগুলো অভিনয় না, সত্যিকার অর্থেই হচ্ছে। সে চাইল রিতার দিকে। রিতা চোখের ইশারায় কিছু বোঝাল। বুঝল মেহুল। হেসে বলল,

‘না না, আমাদেরও কোনো আপত্তি নেই। কী বলেন, পুতুলের বাবা?’

রাবীর খানিক ভেবে বলল,

‘ঠিক আপত্তি না। তবে, বিয়ের ব্যাপার তো; একটু ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়া ভালো। আমরা আপনাদের দু’দিন পর জানাচ্ছি।’

‘দু’দিন পর জানানোর কী আছে, বাবা? আমার তো করিম মিয়াকে বেশ পছন্দ। আজই তোমরা পাকাপাকি কথা সেরে ফেল।’

পুতুলের ব্যবহারের সবাই বেশ তাজ্জব হয়ে চেয়ে আছে। মেহুল আর রিতা ভাবছে, তারা না হয় অভিনয় করছে বলে এসব মেনে নিচ্ছে। কিন্তু, এই মেয়ে কীসের দায়ে এমন করছে? রাবীর তখন ঠান্ডা গলায় বলল,

‘মা, বিয়ে নিয়ে এত তাড়াহুড়ো করা ঠিক না। আমরা ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত জানাব।’

_______

পাত্রপক্ষ চলে গেলেন। রাবীর সাদরাজকে নিয়ে তার রুমে গেল, এই বিয়ে নিয়ে জরুরি আলোচনা করতে হবে। কেন যেন ছেলেটাকে তার ঠিক পছন্দ হচ্ছে না। মেহুল আর রিতা গেল অন্য আরেক রুমে। সব প্ল্যান তো তাদের মাঠে মারা যাচ্ছে। দুই পক্ষই শান্ত। তাদেরকে আরো ভয়ানক কিছু ভাবতে হবে এবার। বসার ঘরে কেবল পুতুল আর সারাজ। পুতুল বেশ আয়েশ করে বসে মেহমানদের দেওয়া নাস্তাগুলো খাচ্ছে। সারাজ কিছুক্ষণ দাঁতে দাঁত চেপে তার এসব কান্ড দেখে গিয়েছে। এমন একটা হাঁদারামকে বিয়ে করতে পুতুল রাজি হয়ে গেল? রাগে গা জ্বলছে তার। সে ছুটে এসে পুতুলের হাত চেপে ধরল। তাকে এক টানে দাঁড় করিয়ে বলল,

‘চল।’

পুতুল চমকাল না একটুও। মনে মনে বরং খুশি হলো। তাও মুখে অবাক হওয়ার ভান করে বলল,

‘কোথায়?’

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here